সামাজিক ইতিহাস চর্চার একটি অন্যতম দিক হলো "বিজ্ঞান প্রযুক্তি ও চিকিৎসা বিদ্যার ইতিহাস"।
বিজ্ঞান প্রযুক্তি ও চিকিৎসা বিদ্যার ইতিহাস |
বিজ্ঞান প্রযুক্তি ও চিকিৎসা বিদ্যার ইতিহাসের সংজ্ঞা
(১.) বিজ্ঞান (২.) প্রযুক্তি (৩.) চিকিৎসা বিদ্যা সংক্রান্ত জ্ঞানের বিকাশ এবং মানব সমাজের ওপর তার ব্যবহারিক প্রয়োগের অতীত ইতিহাসের চর্চাই সাধারণ ভাবে “বিজ্ঞান, প্রযুক্তি ও চিকিৎসা বিদ্যার ইতিহাস” নামে পরিচিত।
বিজ্ঞান, প্রযুক্তি ও চিকিৎসা বিদ্যার ধারনা
এখন বিজ্ঞান, প্রযুক্তি ও চিকিৎসা বিদ্যা বলতে কি বোঝায়, সেটি জেনে নেওয়া যাক।
(১.) বিজ্ঞান :-
প্রকৃতি ও পরিবেশ সম্পর্কে মানুষের বিশুদ্ধ জ্ঞানকেই "বিজ্ঞান" বলা হয়।
(২.) প্রযুক্তি :-
যেসব উপকরন ও প্রক্রিয়ার সাহায্যে আমরা প্রকৃতি ও পরিবেশকে নিজের সুবিধার্থে ব্যবহার করতে পারি, তাকেই বলা হয় "প্রযুক্তি" ।
প্রযুক্তির দৃষ্টান্ত হিসাবে কৃষিকাজে"লাঙ্গল" এবং "ট্রাক্টরের" ব্যবহারের কথা বলা যেতে পারে। কৃষিকাজে লাঙ্গলের ব্যবহার ছিলো একধরনের "প্রযুক্তি"। আবার ট্রাক্টরের ব্যবহারও ছিলো কৃৃষি কাজের একটি আধুনিক "প্রযুক্তি" ।
এখানে লাঙ্গল প্রযুক্তির থেকে ট্রাক্টর প্রযুক্তি অনেক বেশি উন্নত। কারন এই প্রযুক্তির সাহায্যে আমরা লাঙ্গলের থেকে অনেক কম সময়ে অনেক বেশি জমিকে আবাদযোগ্য করে তুলতে পারি।
ট্রাক্টরের মতোই ধান লাগানো ও ধান কাটা মেশিনের ব্যবহার, জল তোলার মেশিন, থ্রি জি, ফোর জি, ফাইভ জি র ব্যবহার, এসবই এক একটি প্রযুক্তির উদাহরণ।
যে দেশের হাতে যত উন্নত বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি আছে, সেইদেশ ততো প্রকৃতিকে নিজের সুবিধার্থে ব্যবহার করে নিজেকে উন্নত করে তুলতে পারে।
(৩.) চিকিৎসা বিদ্যা :-
শরীরের রোগ নির্নয় এবং তা নিবারণের বিদ্যাকেই সাধারণ ভাবে "চিকিৎসা বিদ্যা" বলা হয়ে থাকে।
বিজ্ঞান ও প্রযুক্তির উন্নত জ্ঞানের ওপর চিকিৎসা বিদ্যার অগ্রগতি ঘনিষ্ঠভাবে সম্পৃক্ত।
উদাহরন হিসাবে বলা যায়, প্রযুক্তি বিদ্যার অভাবনীয় অগ্রগতির ফলেই আজকাল অধিকাংশ অপারেশন কোন রকম কাটাছেঁড়া ছাড়াই উন্নত যন্ত্রের সাহায্যে চিকিৎসকরা করতে সক্ষম হচ্ছেন। উন্নত প্রযুক্তি বিদ্যাকে কাজে লাগিয়ে আজকাল চিকিৎসকরা রোগ নির্নয় অনেক সহজ, দ্রুত এবং নির্ভুল ভাবে করতে পারছেন।
বিজ্ঞান,প্রযুক্তি ও চিকিৎসা বিদ্যার ইতিহাসের সূত্রপাত
- ১৯২৭ খ্রিঃ হার্ভার্ড বিশ্ববিদ্যালয় প্রথম বিজ্ঞান, প্রযুক্তি ও চিকিৎসা বিদ্যার ইতিহাস চর্চায় উদ্যোগী হয়।
- পরবর্তীকালে বিশ্বের নানা দেশে এই ইতিহাস চর্চা জনপ্রিয়তা লাভ করে।
- ভারতের বেশ কয়েকটি বিশ্ববিদ্যালয়েও বিজ্ঞান,প্রযুক্তি ও চিকিৎসা বিদ্যার ইতিহাস পড়ানো হয়ে থাকে।
- ঔপনিবেশিক আমল থেকেই অবশ্য ভারতীয় বিজ্ঞানী ও ঐতিহাসিকরা প্রাচীন ভারতের বিজ্ঞান ও চিকিৎসা বিদ্যার ওপর ইতিহাস চর্চা শুরু করেন।
বিজ্ঞান,প্রযুক্তি ও চিকিৎসা বিদ্যার ইতিহাসের গুরুত্ব
বিজ্ঞান, প্রযুক্তি ও চিকিৎসা বিদ্যার ইতিহাস চর্চার একাধিক ঐতিহাসিক গুরুত্বের দিক আছে -
(১.) সমাজ বিজ্ঞানের শাখা হিসাবে মানব সভ্যতার বিবর্তনের কথা আমরা ইতিহাসে পড়ে থাকি।সভ্যতার অগ্রগতি বিজ্ঞান, প্রযুক্তি ও চিকিৎসা বিদ্যার অগ্রগতির ওপরেই নির্ভর করে। সুতরাং অতীত পর্যালোচনাতে সভ্যতার অগ্রগতির ধারা সঠিক ভাবে বুঝতে গেলে বিজ্ঞান, প্রযুক্তি ও চিকিৎসা বিদ্যার ইতিহাস চর্চা অপরিহার্য।
(২.) ঔপনিবেশিক আমলে ইংরেজরা ভারতীয়দের অসভ্য বর্বর ইত্যাদি বলে বিদ্রুপ করতো। এর বিপ্রতীপে প্রাচীন ভারতের সভ্যতার অগ্রগতি অনুসন্ধানের জন্য অনেক ভারতীয় ভারতের বিজ্ঞান, প্রযুক্তি ও চিকিৎসা বিদ্যার ওপর ইতিহাস অনুসন্ধান শুরু করেন। আচার্য প্রফুল্ল চন্দ্র রায় লেখেন, হিস্ট্রি অব হিন্দু কেমিস্ট্রির" মতো বিখ্যাত গ্রন্থ । বিজ্ঞান, প্রযুক্তি ও চিকিৎসা বিদ্যার ইতিহাস চর্চার ফলে জানা যায়, অতীতে" সভ্যতার উৎকর্ষতার দিক থেকে ইওরোপের চেয়েও ভারত অনেক এগিয়ে ছিলো"।
(৩.) বিজ্ঞান, প্রযুক্তি ও চিকিৎসা বিদ্যার ইতিহাস চর্চা থেকেই জানা যায় প্রাচীন ভারতে বিজ্ঞান, প্রযুক্তি ও চিকিৎসা বিদ্যার অভূতপূর্ব অগ্রগতি ঘটেছিল -
- প্লাস্টিক সার্জারির জন্ম ভারতেই প্রথম হয়েছিলো।
- ভারতেই প্রথম চিকিৎসা বিদ্যায় অস্ত্রোপচার ও তার উপকরনের উদ্ভব হয়।
- অঙ্কশাস্ত্রে শূন্য, দশমিক এবং জ্যামিতির উদ্ভব ভারতেই প্রথম ঘটে।
- নিউটনের বহু আগে ব্রহ্মগুপ্ত মাধ্যাকর্ষন থিওরি আবিষ্কার করে ফেলেন।
- প্রাচীন ভারতের আয়ুর্বেদ শাস্ত্র ছিলো সারা বিশ্বের কাছে বিষ্ময়।
- জ্যোর্তিবিদ্যা চর্চার ক্ষেত্রেও ভারত উল্লেখযোগ্য কৃতিত্বের স্বাক্ষর রেখেছিলো।
অর্থাৎ বিজ্ঞান, প্রযুক্তি ও চিকিৎসা বিদ্যার ইতিহাস থেকে একটি দেশের বিজ্ঞান, প্রযুক্তি ও চিকিৎসা বিদ্যার কালানুক্রমিক বিবর্তনের ইতিহাসকে জানা যায়।
(৪.) আমাদের বর্তমান সভ্যতা বিজ্ঞান ও প্রযুক্তির উৎকর্ষতার ওপরেই দাড়িয়ে আছে। কিভাবে ধারাবাহিক বিবর্তনের মধ্য দিয়ে বিজ্ঞান, প্রযুক্তি ও চিকিৎসা বিদ্যা আধুনিক পর্যায়ে উন্নীত হলো, তা এই ইতিহাস চর্চা থেকে জানা যায়।
(৫.) ভারতে ঔপনিবেশিক শাসন প্রতিষ্ঠিত হওয়ার সাথে সাথে নানা ক্ষেত্রে বদল এসেছিল। ইংরেজদের হাত ধরে এদেশে প্রবর্তিত হয়েছিল উন্নত বিজ্ঞান, প্রযুক্তি ও আধুনিক চিকিৎসা বিদ্যা। কিন্তু এগুলির সুফল ভারতীয়রা কতটা পেয়েছিল, তা একমাত্র বিজ্ঞান – প্রযুক্তি ও চিকিৎসা বিদ্যার ইতিহাসের পর্যালোচনা থেকেই বোঝা যায়।
(৬.) এছাড়াও বলা যায় -
- ঔপনিবেশিক আমলে ভারতীয়রা বিজ্ঞান, প্রযুক্তি ও চিকিৎসা বিদ্যার গবেষণায় কিভাবে বৈষম্যের শিকার হয়েছিলেন,
- ঔপনিবেশিক নীতি ও কাজকর্মের জন্য কিভাবে এদেশে মহামারির প্রাদুর্ভাব বৃদ্ধি পেয়েছিল,
- মহামারী রোধে ব্রিটিশ সরকারের গৃহীত ব্যবস্থা (১৮৯৭, বোম্বে ও ভারতে প্লেগ নিবারনে মহামারী আইন ও তার কুপ্রয়োগ) কিভাবে জনমনে ক্ষোভের সঞ্চার করেছিল, এই সমস্ত বিষয় এই ইতিহাস চর্চা থেকেই জানা যায়।
(৭.) সাম্রাজ্যবাদী শক্তি সব সময়ে বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিদ্যাকে নিজেদের কুক্ষিগত করে রাখতে চায়। এই কারনে ঔপনিবেশিক আমলে ভারতীয় বিজ্ঞানীরা গবেষনায় নানা রকম বৈষম্যের শিকার হয়েছিলেন।
বর্তমানেও উন্নত বিশ্বের দেশ গুলি উন্নত প্রযুক্তি ও বিজ্ঞানকে হাতিয়ার করে অনুন্নত দেশ গুলির ওপর সাম্রাজ্যবাদী শোষন চালাচ্ছে। তারা উন্নত প্রযুক্তি গুলি নিজেদের কুক্ষিগত রেখে বাতিল হয়ে যাওয়া টেকনোলজি গুলি অনুন্নত দেশ গুলির কাছে পাঠাচ্ছে।
সুতরাং একটি সময়কালের অগ্রগতিকে বুঝতেই শুধু নয়, যেকোন সময়কালের সাম্রাজ্যবাদী শোষনের স্বরূপকে সঠিক ভাবে উপলব্ধি করতেও বিজ্ঞান প্রযুক্তি ও চিকিৎসা বিদ্যার ইতিহাস চর্চা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ বলে মনে করা হচ্ছে।
মনে রাখার জন্য গুরুত্বপূর্ণ তথ্য একঝলকে
- বিংশ শতাব্দীর দুজন প্রখ্যাত বাঙালি বিজ্ঞানী – আচার্য প্রফুল্ল চন্দ্র রায়, জগদীশ চন্দ্র বোস।
- ইন্ডিয়ান অ্যাসোসিয়েশন ফর দা কালটিভিশন অব সায়েন্স প্রতিষ্ঠা করেন – মহেন্দ্রলাল সরকার।
- ক্যালকাটা মেডিক্যাল জার্নাল প্রকাশ করেন – মহেন্দ্রলাল সরকার।
- কলকাতা মেডিক্যাল কলেজ প্রতিষ্ঠিত হয় – ১৮৩৫ খ্রিঃ।
- Geological survey of india প্রতিষ্ঠিত হয় – ১৮৫১ খ্রিঃ ।
- বসু বিজ্ঞান মন্দির প্রতিষ্ঠা করেন – জগদীশ চন্দ্র বোস।
- বেঙ্গল ক্যামিকেল প্রতিষ্ঠা করেন – আচার্য প্রফুল্ল চন্দ্র রায়।
- ভারতের প্রথম মহিলা চিকিৎসক – কাদম্বিনী গঙ্গোপাধ্যায়।
- কলকাতা মেডিক্যাল কলেজে প্রথম শব ব্যবচ্ছেদ করেন - মধূসূদন গুপ্ত।
- হিপোক্রেটিস ছিলেন – প্রাচীন গ্রিসের একজন চিকিৎসক।
- ইন্ডিয়ান স্ট্যাটিস্টিক্যাল ইন্সটিটিউট প্রতিষ্ঠা করেন – প্রশান্তচন্দ্র মহলানবীশ।
- প্রশান্তচন্দ্র মহলানবীশ ছিলেন – প্রখ্যাত প্রযুক্তিবিদ ও ভারতে পঞ্চবার্ষিকী পরিকল্পনার প্রবক্তা।
- ভারতে পরমানু শক্তি কমিশনের প্রতিষ্ঠা – ১৯৪৮ খ্রিঃ ।
- ভারতে পরমানু কর্মসূচির জনক ছিলেন – হোমি জাহাঙ্গীর ভাবা।
- ম্যালেরিয়া রোগের আবিষ্কারক – রোনাল্ড রস।
বিজ্ঞান, প্রযুক্তি ও চিকিৎসা বিদ্যা সম্পর্কিত গুরুত্বপূর্ণ গ্রন্থ
- A History of Hindu chemistry / হিন্দু রসায়ন শাস্ত্রের ইতিহাস - আচার্য প্রফুল্ল চন্দ্র রায়।
- হিস্ট্রি অব সায়েন্স /ইতিহাসে বিজ্ঞান - জে ডি বার্নাল
- দ্য স্টাকচার অব সায়েন্টিফিক রিভোলিউশন - টমাস কুন।
- সায়েন্স, টেকনোলজি অ্যান্ড মেডিসিন ইন কলোনিয়াল ইন্ডিয়া - ডেভিড আর্নল্ড।
- সায়েন্স অ্যান্ড দ্য রাজ - দীপক কুমার।
- উনিশ শতকে বাংলা ভাষায় বিজ্ঞান চর্চা - বিনয়ভূষন রায়।
- প্রাচীন ভারতে চিকিৎসা বিজ্ঞান - দেবীপ্রসাদ চট্টোপাধ্যায়।
- শতবর্ষ বাঙালির বিজ্ঞান সাধনা - তপন চক্রবর্তী।