খাদ্যাভ্যাসের ইতিহাস

 সামাজিক ইতিহাস চর্চার একটি অন্যতম দিক হল - খাদ্যাভ্যাসের ইতিহাস চর্চা।

খাদ্যাভ্যাসের ইতিহাস
খাদ্যাভ্যাসের ইতিহাস চর্চা


খাদ্যাভ্যাসের ইতিহাসের সংজ্ঞা

মানুষের দৈনন্দিন খাদ্য, খাদ্য গ্রহণের নানা রীতিখাদ্যসংস্কৃতিকে নিয়ে আলোচনার ইতিহাসকেই এককথায় "খাদ্যাভ্যাসের ইতিহাস" বলা হয়।

খাদ্যাভ্যাসের ইতিহাস চর্চার সূত্রপাত

  1. খাদ্যাভ্যাসের ইতিহাস চর্চা প্রথম শুরু করেন ফ্রান্সের অ্যানাল গোষ্ঠীর ঐতিহাসিকরা। এদের মধ্যে ছিলেন - ব্রোদেল, মার্ক ব্লখ।
  2. অ্যানাল গোষ্ঠীর ঐতিহাসিকরাই প্রথম দেখান মানুষের দৈনন্দিন খাদ্যাভ্যাসের মধ্যেও অতীতের সমাজকে খুঁজে পাওয়া সম্ভব। 
  3. বর্তমানে সিডনি মিনজ, মাসিমো মন্টানারি, ক্রিস্টান জে গ্রামিলিয়ন, অর্জুন আপ্পাদুরাই, তপন রায়চৌধুরী, চিত্রিত ব্যানার্জি খাদ্যাভ্যাসের ইতিহাস চর্চা করে যাচ্ছেন।

খাদ্যাভ্যাসের বৈশিষ্ট্য

খাদ্যাভ্যাসের ইতিহাস চর্চা থেকে মানুষের খাদ্যাভ্যাসের ৩ টি মূল বৈশিষ্ট্যের দিকের কথা জানা যায় -

(১.)  খাদ্য বৈচিত্র্য

পৃথিবীর সব জনগোষ্ঠী ও জনসমাজের খাদ্যাভ্যাস এক নয়।প্রতিটি জনগোষ্ঠী ও জনসমাজের খাদ্যের মধ্যেই একটি খাদ্যবৈচিত্র্য লক্ষ্য করা যায়। যেমন পশ্চিমবঙ্গের মানুষদের প্রধান খাদ্য হলো ভাত, আবার পাঞ্জাবের মানুষরা রুটি খেতে পছন্দ করেন। চিনের মানুষদের যা খাদ্যাভ্যাস তার সাথে ভারতের মানুষদের খাদ্যাভ্যাস মেলে না।

(২.) খাদ্যগ্রহনের ৪ টি প্রধান রূপ 

এখনও পর্যন্ত পৃথিবীর বিভিন্ন জনগোষ্ঠীর খাদ্যবৈচিত্র্যের ইতিহাস থেকে মানুষের খাদ্যাভ্যাসের ৪ টি বিশেষ রূপের কথা জানা যায়। যেমন - 
  • কাঁচা, 
  • পড়ানো, 
  • সেদ্ধ, এবং 
  • মশলা যুক্ত খাবার। 

(৩.) আমিষ ও নিরামিষের ধারনা

খাদ্যসংস্কৃতিকে কেন্দ্র করে মানুষের মধ্যে যে সংস্কার বোধ গড়ে ওঠে, তা থেকে জন্ম নেয় আমিষ ও নিরামিষ খাদ্যাভ্যাসের ধারনা। 

এগুলি মানুষের সমাজ ও সংস্কৃতিকে গভীর ভাবে প্রভাবিত করে। 

খাদ্যাভ্যাসের ইতিহাসের গুরুত্ব 

খাদ্যাভ্যাসের ইতিহাস চর্চার একাধিক গুরুত্বের দিক রয়েছে। যেমন - 

(১.) বিভিন্ন খাদ্যের উদ্ভব

খাদ্যাভ্যাসের ইতিহাস চর্চা থেকে বিভিন্ন ধরনের খাবারের উদ্ভব কিভাবে হলো, তা জানা যায়। 

এই ইতিহাস চর্চা থেকেই জানা গেছে - 
  • ভারতীয়রা আলু খাওয়া শেখে পর্তুগীজদের কাছ থেকে। 
  • কিচেন গার্ডেনের ব্যবহার শেখে ওলন্দাজদের কাছ থেকে। 
  • দুধ কাটিয়ে ছানা তৈরির কৌশল শেখে পর্তুগীজদের কাছ থেকে। 
  • বাংলায় রসগোল্লার আবিষ্কার করেছিলেন হারাধন ময়রা। 
  • স্পঞ্জ রসগোল্লার আবিষ্কার ছিলেন নবীনচন্দ্র সেন। 
  • ভারতে বিরিয়ানির উদ্ভব ঘটেছিলো সুলতানী যুগে। 

(২.) ভৌগলিক পরিবেশ 

খাদ্যাভ্যাসের ইতিহাস চর্চা থেকে একটি অঞ্চলের ভৌগলিক ও প্রাকৃতিক পরিবেশের কথা জানা যায়। কারন ভৌগলিক ও প্রাকৃতিক পরিবেশের ওপর নির্ভর করেই এক একটি অঞ্চলের খাদ্যাভ্যাস গড়ে ওঠে। 

(৩.) বানিজ্য ও অর্থনীতি 

খাদ্যাভ্যাসের বিবর্তন একজন ঐতিহাসিককে দেশের বানিজ্য ও অর্থনীতিকে চিনতে সাহায্য করে। 

(৪.) সাংস্কৃতিক প্রভাব 

খাদ্যাভ্যাসের ইতিহাস চর্চা থেকে এক জনগোষ্ঠীর ওপর অপর জনগোষ্ঠীর সাংস্কৃতিক প্রভাবের দিকটি সহজেই বোঝা যায়। যেমন - 
  • বাঙালি সংস্কৃতি পর্তুগীজ সংস্কৃতির দ্বারা কতদূর প্রভাবিত হয়েছিলো, তা একমাত্র খাদ্যাভ্যাসের ইতিহাস চর্চা থেকেই বোঝা যায়।
  •  দুধ কাটিয়ে ছানা তৈরির কৌশল থেকে শুরু করে আলু খাওয়া, পাঁওরুটি তৈরি সবই বাঙালিরা পর্তুগীজদের কাছ থেকে শিখেছিলো। 

(৫.) সমাজ সংস্কার আন্দোলন 

খাদ্যাভ্যাসকে ব্যবহার করে কখনও কখনও সমাজ সংস্কার আন্দোলনও সংগঠিত হয়। যেমন - 
  • উনিশ শতকে ইয়ং বেঙ্গলরা প্রকাশ্যে মদ্যপান ও হিন্দু ধর্মের নিষিদ্ধ খাদ্য গ্রহণের মাধ্যমে রক্ষনশীল হিন্দু সমাজের দীর্ঘদিনের অচলায়তনকে ভেঙ্গে ফেলতে চেয়েছিলেন। 
  • একই ভাবে মধ্যযুগে "পঙ্কতি ভোজনের" মধ্য দিয়ে অর্থাৎ উঁচু ও নীচু জাতের মানুষদের একত্রে সমবেত হয়ে খাদ্য গ্রহণের মধ্য দিয়ে শ্রীচৈতন্যদেব সমাজের জাতপাত কে ভেঙ্গে ফেলতে চেয়েছিলেন। 

(৬.) সামাজিক বৈষম্যের পরিচয় 

খাদ্যাভ্যাসের ইতিহাস চর্চা থেকে সমাজে নারী পুরুষের বৈষম্যের দিকটিও বোঝা যায়। যেমন - 
  • ভারতীয় সমাজে স্বামীর আগে স্ত্রীর খাদ্য গ্রহণের কোন শাস্ত্রীয় বিধান ছিলো না। স্বামীর খাদ্য গ্রহণের পর তার উচ্ছিষ্ট খাবার গ্রহণের কথা শাস্ত্রে বলা হয়েছিলো। 
  • আবার হিন্দু বিধবাদের অবদমিত করে রাখার জন্য সমাজে তাদের আমিষ খাদ্য গ্রহণের ওপর কঠোর বিধিনিষেধ আরোপ করা হয়েছিলো। 

(৭.) আন্দোলন ও বিদ্রোহে প্রভাব

খাদ্য অনেক সময় গুরুত্বপূর্ণ আন্দোলনেরও শরিক হয়ে ওঠে। যেমন - 
  • পালযুগে কৈবর্ত বিদ্রোহের একটি বড়ো কারন ছিলো জেলে কৈবর্তদের মাছ ধরার ওপর বৌদ্ধ ধর্মাবলম্বী পাল রাজাদের নিষেধাজ্ঞা, 
  • স্বদেশী আন্দোলনের সময় বাঙালিরা বিদেশী পন্য বয়কট করতে গিয়ে বিদেশী সাদা চিনিকে বর্জন করার ডাক দিয়েছিলো, 
  • আইন অমান্য আন্দোলনের সময় ব্রিটিশ শোষনের প্রকৃত স্বরূপ উন্মোচনের জন্য গান্ধীজি লবন সত্যাগ্রহের ডাক দেন এবং সমুদ্র থেকে লবন প্রস্তুত করে খান। এই কর্মসূচির মধ্য দিয়েই আইন অমান্য আন্দোলনের সূত্রপাত ঘটে, 
  • ফরাসি বিপ্লবের সময় খাদ্যের দাবিতে ভার্সাই নগরীতে ফরাসি মেয়েদের আন্দোলন ফ্রান্সের রাজতন্ত্রের পতনকে সুনিশ্চিত করে তুলেছিল, 
  • ইওরোপীয় দেশগুলির ভারতে সাম্রাজ্যবাদের একটি বড়ো কারন ছিলো ভারতীয় মশলা ও গোলমরিচের ওপর আধিপত্য স্থাপন করা, 
সুতরাং খাদ্যাভ্যাসের এত গুরুত্বপূর্ণ ঐতিহাসিক ভূমিকার জন্য খাদ্যাভ্যাসকে এখন আর ঐতিহাসিকরা নিছক দৈনন্দিন খাদ্য গ্রহণের একটি সামাজিক অভ্যাস ও প্রয়োজন হিসাবে দেখতে রাজি নন। 

উপসংহার 

বর্তমানে ঐতিহাসিকরা খাদ্যাভ্যাসের সঙ্গে মানুষের স্বাস্থ্য, শ্রম ও রোগের সংযোগ স্থাপন করছেন। সাম্প্রতিক কালে (২০২০) চিনের খাদ্যাভ্যাস থেকে ছড়ানো নভেল করোনাভাইরাস যেভাবে বৃহত্তর বিশ্বের স্বাস্থ্য, শ্রম ও রোগের ক্ষেত্রটিকে প্রভাবিত করেছে, তা খাদ্যাভ্যাসের ইতিহাস চর্চার গুরুত্বকে এক অন্য মাত্রা প্রদান করেছে। 

খাদ্যাভ্যাসের ইতিহাস সম্পর্কে গুরুত্বপূর্ণ তথ্য 

  1. ভারতীয়রা কিচেন গার্ডেনের ব্যবহার শেখে - ওলন্দাজদের কাছ থেকে। 
  2. দুধ কাটিয়ে ছানা তৈরির কৌশল শেখে - পোর্তুগিজদের কাছ থেকে। 
  3. আলু খাওয়া শেখে - পোর্তুগিজদের কাছ থেকে। 
  4. রসগোল্লার আবিষ্কারক ছিলেন - হারাধন ময়রা। 
  5. স্পঞ্জ রসগোল্লার উদ্ভাবক ছিলেন - নবীনচন্দ্র সেন। 
  6. কেকের দেশ বলা হয় - স্কটল্যান্ড কে। 
  7. বাংলার প্রথম খাদ্য প্রনালী সম্পর্কিত বই - প্রাক রাজেশ্বর। 
  8. প্রাক রাজেশ্বর গ্রন্থের লেখক ছিলেন - বিপ্রদাস মুখোপাধ্যায়। 
  9. পাস্তা হলো - আরব দেশের একটি খাবার। 
  10. পারসিক রন্ধনশৈলীর সঙ্গে ঢাকার নিজস্ব রন্ধনশৈলীর সংমিশ্রনে যে খাদ্যপ্রনালী গড়ে উঠেছিলো, তাকেই বলা হয় - ঢাকাই খাবার। 
  11. খাদ্যাভ্যাসের ইতিহাস চর্চা করেছেন এমন কিছু ঐতিহাসিক হলেন - মা ইমো মন্টানারি, তপন রায় চৌধুরী, অর্জুন আপ্পাদুরাই, ক্রিস্টান জে গ্র্যামিলিয়ন, চিত্রিতা ব্যানার্জি। 
  12. ভারতে মূলত ৪ ধরনের রন্ধনশৈলী আছে - 
    • উত্তর ভারতীয় রন্ধনশৈলী ( দিল্লি, রাজস্থান, পাঞ্জাব, কাশ্মীর, বেনারস) 
    • দক্ষিণ ভারতীয় রন্ধনশৈলী ( অন্ধ্রপ্রদেশ, কর্নাটক, কেরল, তামিলনাড়ু) 
    • পূর্ব ভারতীয় রন্ধনশৈলী (বাংলা ও আসাম) 
    • পশ্চিম ভারতীয় রন্ধনশৈলী (মহারাষ্ট্র, মালব, গুজরাট)। 

খাদ্যাভ্যাসের ইতিহাস সম্পর্কিত উল্লেখযোগ্য গ্রন্থ 

  • মুঘল আমলে খানাপিনা - তপন রায়চৌধুরী, 
  • ফুড ইন হিস্ট্রি - রিয়াই টান্নাহিল, 
  • ইন্ডিয়ান ফুড :আ হিস্টোরিক্যাল কম্প্যানিয়ন - কে টি আচয়, 
  • আ হিস্টোরিক্যাল ডিকশনারি অব ইন্ডিয়ান ফুড - কে টি আচয়, 
  • অক্সফোর্ড হ্যান্ডবুক অব ফুড হিস্ট্রি - জিওফ্রে পিলচার, 
  • অ্যাপেটাইটস : ফুডস ইন প্রি হিস্ট্রি - জে গ্র্যামিলিয়ন, 
  • আ সোশ্যাল হিস্ট্রি অব ইন্টিং ইন মর্ডান আমেরিকা - লেভেনস্টেইল, 
  • প্রাক্ প্রনালী - বিপ্রদাস মুখোপাধ্যায়, 
  • রসগোল্লা : বাংলার জগৎ মাতানো আবিষ্কার - হরিপদ ভৌমিক, 
  • Sweetness and power : The place of sugar in modern History - সিডনি মিনজ। 

Post a Comment (0)
Previous Post Next Post