১৬৪৪ খ্রিঃ মিং রাজবংশ কে ক্ষমতাচ্যুত করে চিনের সিংহাসন দখল করেছিলো মাঞ্চু রাজবংশ। মাঞ্চু রাজবংশকে চিং বংশ নামেও ডাকা হতো। ১৬৪৪ থেকে ১৯১১ পর্যন্ত দীর্ঘ ২৬৭ বছর মাঞ্চু রাজবংশ চিন শাসন করেছিলো।
এই রাজবংশের আমলেই ইংল্যান্ড, ফ্রান্স, জার্মানি, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র, জাপান প্রভৃতি বৈদেশিক শক্তি গুলি চিনে প্রবেশ করেছিলো এবং একাধিক "অসম চুক্তি" চিনের ওপর চাপিয়ে দিতে শুরু করেছিলো।
চিনের ওপর আরোপিত চুক্তি সমূহ |
অসম চুক্তি কাকে বলে?
চিং বংশের শাসনকালের শেষদিকে, আফিম যুদ্ধের পর ইংল্যান্ড, ফ্রান্স, জার্মানি, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র, রাশিয়া, জাপান প্রভৃতি বৈদেশিক শক্তি গুলি চিনের ওপর যে একতরফা, বৈষম্যমূলক চুক্তি গুলি চাপিয়ে দেয়, সেগুলিকেই একত্রে "অসম চুক্তি" বলা হয়ে থাকে।
অসম চুক্তির সময়কাল
সাধারনত প্রথম আফিম যুদ্ধের পর থেকে অর্থাৎ ১৮৪২ খ্রিঃ থেকে ১৯৪৯ খ্রিঃ পর্যন্ত সময়কালে বিদেশী শক্তিগুলি বিভিন্ন অসম চুক্তি চিনের ওপর চাপিয়ে দিয়েছিলো।
অসম চুক্তির বৈশিষ্ট্য
চিনের ওপর ইংল্যান্ড, ফ্রান্স, জাপান, আমেরিকা, রাশিয়া প্রভৃতি একাধিক বৈদেশিক শক্তি গুলি যে চুক্তি গুলি চাপিয়ে দিয়েছিলো, তার কিছু বৈশিষ্ট্য লক্ষ্য করা যায় -
- চুক্তি গুলি সবই একতরফা ভাবে চিনের ওপর চাপিয়ে দেওয়া হয়েছিলো,
- এগুলি ছিলো আরোপিত চুক্তি, অর্থাৎ বলপূর্বক চাপিয়ে দেওয়া চুক্তি,
- চুক্তিপত্র রচনায় চিনের কোন মতামত বা আপত্তিকর গুরুত্ব দেওয়া হয় নি,
- এই চুক্তি গুলির দ্বারা ইওরোপীয় শক্তি গুলি চিনে বিপুল বানিজ্যিক সুযোগ সুবিধা লাভ করে,
- চুক্তি গুলির শর্তাবলীতে চিনের সার্বভৌমত্ব অনেকাংশে ক্ষুন্ন হয়,
- চুক্তি গুলির দ্বারা ইওরোপীয় শক্তি গুলি চিনের কাছ থেকে বিপুল পরিমান ক্ষতিপূরণ আদায় করে,
- এই চুক্তি গুলির সূত্র ধরেই পশ্চিমি শক্তিগুলি চিনা ভূখন্ডে আধিপত্য স্থাপন করে।
অসম চুক্তির পরিচয়
চিনের ওপর আরোপিত বিভিন্ন অসম চুক্তি গুলির সংক্ষিপ্ত পরিচয় ও প্রেক্ষাপট নীচে আলোচনা করা হলো -
(ক.) চিনের ওপর ইংল্যান্ডের অসম চুক্তি
প্রেক্ষাপট
ইংল্যান্ড দীর্ঘদিন ধরেই চিনে মুক্ত ও উভয়মুখী বানিজ্য চালানোর চেষ্টা করেছিলো। শেষপর্যন্ত ব্যর্থ হয়ে ইংল্যান্ড চিনে আফিম ব্যবসা শুরু করলে চিনের সঙ্গে ইংল্যান্ডের বিরোধ ঘটে, যা শেষপর্যন্ত যুদ্ধে রূপলাভ করে।
১৮৩৯ খ্রিঃ প্রথম আফিম যুদ্ধের শেষে ইংল্যান্ড চিনের ওপর দুটি অসম চুক্তি চাপিয়ে দেয় এবং একাধিক বানিজ্যিক সুবিধা আদায় করে নেয়। এই দুটি চুক্তি ছিলো -
নানকিংয়ের সন্ধি (১৮৪২)
১৮৪২ খ্রিঃ আফিম যুদ্ধের শেষে ইংল্যান্ড চিনের ওপর নানকিংয়ের সন্ধি চাপিয়ে দিয়েছিলো। এই সন্ধিতে ইংল্যান্ড চিনের -
- ক্যান্টন, সাংহাই, অ্যাময়, ফুচাও, নিংপো বন্দরে বানিজ্য করার অধিকার লাভ করে,
- হংকং বন্দর চিরদিনের জন্য লাভ করে,
- ইংরেজরা চিনে অবাধ ব্যবসা, বসবাস ও প্রবেশের অধিকার লাভ করে,
- ক্যান্টনে কো হং প্রথা বাতিল হয়,
বোগের সন্ধি (১৮৪৩)
- চিনে আমদানিকৃত পন্যের ওপর ৪ থেকে ১৩ % পর্যন্ত শুল্ক বসবে। রপ্তানির ক্ষেত্রে শুল্কের পরিমান হবে ১.৫ থেকে ১০.৫ %,
- ইংল্যান্ড চিনে "অতিরাষ্ট্রিক অধিকার" লাভ করবে। অর্থাৎ চিনে বসবাসকারী ব্রিটিশ নাগরিকদের বিচার চিন করতে পারবে না,
- বানিজ্যিক নিরাপত্তার জন্য ইংল্যান্ড চিনের বন্দর গুলিতে যুদ্ধ জাহাজ রাখতে পারবে,
- ভবিষ্যতে অন্য রাষ্ট্র কে চিন যে সুযোগ সুবিধা দেবে তা ইংল্যান্ডকেও দিতে বাধ্য থাকবে।
(খ.) চিনের ওপর ফ্রান্সের অসম চুক্তি
প্রেক্ষাপট
হোয়ামপোয়ার সন্ধি (১৮৪৪)
- ৫ টি বন্দরে ব্যবসা করবার অধিকার লাভ করে,
- চিনে বসবাস করবার ও চার্চ নির্মান করবার অধিকার লাভ করে,
- অতিরাষ্ট্রিক অধিকার লাভ করে,
- চিন - ফ্রান্সের মধ্যে বানিজ্য শুল্ক নির্দিষ্ট করে দেওয়া হয়।
(গ.) চিনের ওপর ইংল্যান্ড ও ফ্রান্সের যৌথ অসম চুক্তি
প্রেক্ষাপট
তিয়েনসিনের সন্ধি (১৮৫৮)
- ইংল্যান্ড ও ফ্রান্স চিনের কাছ থেকে আরোও ১০ টি বন্দর লাভ করবে,
- চিনের যেকোন জায়গায় অবাধে যাতায়াত ও বসবাস করতে পারবে,
- রাজধানী পিকিং এ ইংল্যান্ড ও ফ্রান্সের একজন করে প্রতিনিধি থাকবে,
- খ্রিষ্টান মিশনারিরা অবাধে বিচরন ও ধর্মপ্রচার করতে পারবে।
পিকিং এর সন্ধি (১৮৬০)
- চিন তিয়েনসিনের সন্ধি কার্যকর করবে,
- ইংল্যান্ড ও ফ্রান্স তিয়েনসিনের বন্দরে ব্যবসা করতে পারবে,
- ইংল্যান্ড ফ্রান্স প্রচুর ক্ষতিপূরণ পাবে,
- মিশনারিরা জমি কেনার এবং রাষ্ট্রদূতরা স্থায়ী আবাস নির্মানের অধিকার লাভ করবে।
(ঘ.) চিনের ওপর রাশিয়া ও জাপানের অসম চুক্তি
আইগুনের সন্ধি (১৮৫৮)
- উত্তর চিনের বেশ কিছু অঞ্চল লাভ করে,
- চিনের বেশ কিছু নদী ব্যবহার করার সুযোগ লাভ করে।
শিমোনোশেকির সন্ধি (১৮৯৫)
- চিন কোরিয়াকে স্বাধীনতা দেয়,
- জাপান চিনের কাছ থেকে প্রচুর ক্ষতিপূরণ ও বেশ কিছু বন্দর লাভ করে।
(ঙ.) চিনের ওপর আমেরিকার অসম চুক্তি
ওয়াংসিয়ার সন্ধি (১৮৪৪)
- অতিরাষ্ট্রিক অধিকার সহ, ৫ টি বন্দরে বানিজ্য করার অধিকার আমেরিকা লাভ করে,
- চিন ও আমেরিকার মধ্যে বানিজ্য শুল্কের পরিমান আগে থেকেই ঠিক করে দেওয়া হয়,
মুক্তদ্বার নীতি (১৮৯৯)
(চ.) চিনের ওপর সম্মিলিত চুক্তি - বক্সার প্রটোকল
- বিদ্রোহে যুক্ত ব্যক্তিদের কঠোর শাস্তি দানের ব্যবস্থা করা হয়,
- চিনের ওপর বিপুল পরিমান ক্ষতিপূরণ চাপানো হয়,
- চিনের দূর্গ গুলিকে ভেঙ্গে ফেলা হয়,
- অস্ত্র নির্মান ও আমদানি নিষিদ্ধ হয়,
- ঠিক হয় চিন বিদেশী বনিকদের কাছে ৫% বেশি শুল্ক নিতে পারবে না।
অসম চুক্তির প্রভাব ও গুরুত্ব
- চুক্তি ব্যবস্থার ফলে চিনের সার্বভৌমত্ব বিপন্ন হয়ে পড়ে এবং বিদেশী শক্তি গুলি চিনে অবাধ বিচরন ও আধিপত্য স্থাপন, ও নিয়ন্ত্রণের সুযোগ লাভ করে,
- চিনের অর্থনীতি এই সন্ধি ব্যবস্থা দ্বারা বিপুল ভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয়,
- বিদেশী পন্যের ওপর আমদানি শুল্ক কম ধার্য করায় বিদেশী পন্যে চিনের বাজার ছেয়ে যায়। বিদেশী পন্যের চাপে গ্রামীন স্বয়ং সম্পূর্ন অর্থনীতি ভেঙ্গে পড়ে এবং চিনের অর্থনীতি আধা ঔপনিবেশিক অর্থনীতিতে পরিনত হয়,
- অসম চুক্তি ব্যবস্থায় চিনে মাঞ্চু শাসকদের দূর্বলতা প্রকট হয়ে ওঠে। এর বিরুদ্ধে চিনা জনসাধারণের মধ্যে ক্ষোভ সৃষ্টি হয়, যা শেষ পর্যন্ত রাজতন্ত্র বিরোধী আন্দোলনে রূপলাভ করে,
- অসম চুক্তি ব্যবস্থায় চিনের দূর্বলতা প্রকট হওয়ায় তা দূর করবার জন্য পরবর্তীকালে চিনে একাধিক সংস্কার আন্দোলনের উদ্ভব ঘটে,
- সর্বোপরি, অসম চুক্তি ব্যবস্থার ফলে চিনের স্বাধীনতা, সার্বভৌমত্ব, ভৌগলিক অখন্ডতা সবই প্রায় বিপন্ন হয়ে পড়ে এবং চিন "আধা সামন্ততান্ত্রিক ও আধা ঔপনিবেশিক" একটি রাষ্ট্রে পরিনত হয়।