চিনের ওপর "নানকিংয়ের সন্ধি" ও তার গুরুত্ব

 প্রথম আফিম যুদ্ধে ইংল্যান্ডের কাছে পরাজিত হবার পর চিন নানকিংয়ের সন্ধি স্বাক্ষর করতে বাধ্য হয়েছিলো। ১৮৪২ খ্রিঃ ২৯ আগস্ট চিন নানকিংয়ের সন্ধিতে স্বাক্ষর করে। 

এই সন্ধিপত্র রচনায় চিনের কোন মতামত বা আপত্তিকে ইংল্যান্ড কর্নপাত করে নি। নানকিংয়ের সন্ধিতে আফিম যুদ্ধের জন্য চিনকে দায়ী করে তার কাছ থেকে বিপুল পরিমাণ ক্ষতিপূরণ আদায় করে নেওয়া হয়। এছাড়া, চিনে ইংল্যান্ডের অবাধ বানিজ্যের অনুকূূল কিছু সুবিধাজনক শর্তও চিনের ওপর চাপিয়ে দেওয়া হয়। নানকিংয়ের সন্ধির ঐতিহাসিক তাৎপর্য শুধু এটুকুর মধ্যেই সীমাবদ্ধ ছিলো না। এই সন্ধিপত্রের প্রকৃত ঐতিহাসিক ভূমিকা ও তাৎপর্য ছিলো আরোও সুদূর প্রসারী। 

 নানকিংয়ের সন্ধির সূত্র ধরেই পরবর্তীকালে - 

  •  ইংল্যান্ড "বোগের সন্ধি" এবং বাদবাকি পশ্চিমি শক্তিগুলি অন্যান্য একাধিক অসম চুক্তি চিনের ওপর বলপূর্বক ভাবে চাপিয়ে দিয়েছিলো, 
  • এই অসম চুক্তি গুলির ফলে চিনের সার্বভৌমত্ব বিপন্ন হয়ে পড়েছিলো এবং চিন উপনিবেশবাদের  কবলে পড়ে গিয়েছিলো। 

চিনের ওপর নানকিংয়ের সন্ধি ও তার গুরুত্ব
চিনের ওপর নানকিংয়ের সন্ধি ও তার গুরুত্ব


শর্তাবলী

নানকিংয়ের সন্ধিতে বলা হয়েছিলো - 

  1. চিন ক্যান্টন সহ অ্যাময়, ফুচাও, নিংপো ও সাংহাই এই ৫ টি বন্দর ইংরেজদের কাছে উন্মুক্ত করে দেবে। এই বন্দর গুলিতে ব্রিটিশ রাজপ্রতিনিধি থাকবেন। ইংরেজ বনিকরা এইসব বন্দরে তাদের পরিবারবর্গ নিয়ে থাকতে পারবে।
  2. ক্যান্টনে আর কো হং বনিকদের নিয়ন্ত্রন থাকবে না, 
  3. হংকং দ্বীপকে ইংরেজদের ছেড়ে দিতে হবে,
  4. লিন যে আফিম ধ্বংস করে দিয়েছিলেন তার ক্ষতিপূরণ এবং ইংরেজদের যুদ্ধের ক্ষতিপূরণ মিলিয়ে মোট দুই লক্ষ ডলার অর্থ চিন ইংল্যান্ডকে ক্ষতিপূরণ হিসাবে দেবে, 
  5. ব্রিটিশ পন্যের ওপর একটি নির্দিষ্ট পরিমান আমদানি রপ্তানি শুল্ক ধার্য করা হবে, এবং তার পরিমান কত হবে তা পরের চুক্তিতে ঠিক করে দেওয়া হবে।
অসমাপ্ত নানকিংয়ের সন্ধি কে পূর্নতা দানের জন্য এবং ঐ চুক্তিতে শুল্ক ও বানিজ্যিক সুবিধার দিক গুলো সুস্পষ্ট ভাবে তুলে ধরার জন্য ইংল্যান্ড ১৮৪৩ খ্রিঃ চিনকে "বোগের সন্ধিতে" স্বাক্ষর করতে বাধ্য করে। বোগের সন্ধি কে "হুমেনের সন্ধি"ও বলা হয়ে থাকে। 
 
 এই চুক্তিতে ঠিক করে দেওয়া হয় -
  1. এখন থেকে চিনকে শুল্ক নির্ধারনের ক্ষেত্রে ইংল্যান্ডের কনসালের পরামর্শ নিতে হবে, 
  2. আমদানিকৃত পন্যের ওপর ৪ - ১৩ % শুল্ক ধার্য করা হবে। এবং রপ্তানিকৃত পন্যের মূল্যের ওপর নির্ধারিত শুল্কের পরিমান হবে ১.৫ - ১০.৭৫ %
  3. ব্রিটিশরা চিনে "অতিরাষ্ট্রিক অধিকার" পাবে। অর্থাৎ চিনে অবস্থিত ব্রিটিশ নাগরিকরা ব্রিটিশ আইন অনুযায়ী বিচার লাভের অধিকার লাভ করবে, 
  4. এখন থেকে ইংল্যান্ড চিনে " Most favoured nations treatment" বা সর্বাপেক্ষা অনুগৃহীত দেশের সম্মান পাবে। এই শর্ত বলে ইংল্যান্ড অন্য সব দেশের থেকে চিনে অনেক বেশি সুবিধা ভোগের অধিকারী হয়, 
  5. ক্যান্টন, অ্যাময়, ফুচাও, নিংপো এবং সাংহাই বন্দরে ইংরেজরা যুদ্ধ জাহাজ রাখতে পারবে। 

ঐতিহাসিক গুরুত্ব 

চিনের ইতিহাসে নানকিংয়ের সন্ধির গুরুত্ব ছিলো অপরিসীম এবং সুদূরপ্রসারী - 
  1. নানকিংয়ের সন্ধি ছিলো চিনের সামন্ত শাসক কর্তৃক স্বাক্ষরিত প্রথম অসম চুক্তি
  2. এই চুক্তির মধ্য দিয়ে চিনে ইংল্যান্ডের শ্রেষ্ঠত্ব প্রতিষ্ঠিত হয়, 
  3. চিনে মাঞ্চু শাসকের দুর্বলতা এই চুক্তির মধ্য দিয়ে প্রকট হয়ে ওঠে, 
  4. এই চুক্তির মধ্য দিয়েই চিনের সুদীর্ঘ একবন্দর কেন্দ্রিক এবং একতরফা ক্যান্টন বানিজ্যের অবসান ঘটে,
  5. চিনের দীর্ঘ "রুদ্ধদ্বার নীতি" এই চুক্তির ফলে ভেঙ্গে পড়ে
  6. ইংল্যান্ড ঈর্ষনীয় বানিজ্যিক সুযোগ সুবিধা চিনে লাভ করে, 
  7. নানকিংয়ের সন্ধিতে ইংল্যান্ডের প্রভূত বানিজ্যিক সুবিধা লাভের দিকটিতে অন্যান্য ইওরোপীয় শক্তি গুলি উৎসাহিত হয়ে ওঠে, 
  8. এই সন্ধির পরেই চিনের দুর্বলতার সুযোগ নিয়ে আমেরিকা চিনের ওপর ওয়াংশিয়া চুক্তি (১৮৪৪),এবং ফ্রান্স হোয়ামপোয়ার চুক্তি (১৮৪৪) ও তিয়েনসিনের চুক্তি (১৮৫৮) চাপিয়ে দেয়, 
  9. এই সব চুক্তি ব্যবস্থার সূত্র ধরে চিন উপনিবেশবাদের শিকার হয়ে পড়ে, 
  10. চিনের অর্থনীতি এই সন্ধি ব্যবস্থার দ্বারা মারাত্মক ভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয়, 
  11. পাশ্চাত্য শক্তিগুলির চুক্তিব্যবস্থার চাপে চিন একটি "আধা সামন্ততান্ত্রিক ও আধা ঔপনিবেশিক" রাষ্ট্রে রূপলাভ করে। 

Post a Comment (0)
Previous Post Next Post