পোস্ত গাছের আঠা থেকে যে আফিম তৈরি হয়, সেই আফিমকে ব্যবহার করেই ইওরোপীয় দেশ গুলো চিনের "রুদ্ধদ্বারকে" শেষ পর্যন্ত ভেঙ্গে ফেলতে সক্ষম হয়েছিলো।
|
প্রথম আফিম যুদ্ধ |
চিনে আফিমের আমদানি
সপ্তম এবং অষ্টম শতকে চিনে প্রথম আফিমের আমদানি করেছিলো তুর্কি এবং আরবের বনিকরা। আফিমকে তখন শুধুমাত্র ঔষুধ তৈরির কাজেই লাগানো হতো। নেশার জিনিস হিসাবে এর ব্যবহার তখনও চিনারা জানতো না। কিন্তু ঊনবিংশ শতাব্দীর প্রথম দিক থেকে নেশার দ্রব্য হিসাবে আফিম ধীরে ধীরে পরিচিতি লাভ করতে শুরু করে।
নেশার দ্রব্য হিসাবে আফিমের সঙ্গে চিনাদের পরিচয়টা অবশ্য ইংরেজ বনিকরাই করে দিয়েছিলেন। এর পিছনে ছিলো ইংল্যান্ডের ঔপনিবেশিক স্বার্থ রক্ষার তাগিদ ও পরিকল্পনা।
ইংল্যান্ডের "ত্রিকোন" বানিজ্য
আমরা আগেই বলেছি, চিনের সঙ্গে ইওরোপের বানিজ্যের পুরো রাশ এবং নিয়ন্ত্রনটাই ছিলো চিনের হাতে। ক্যান্টন বানিজ্যের ফলে লক্ষ লক্ষ রূপার মুদ্রা চিনে জমা হচ্ছিলো। ইওরোপের দেশ গুলো থেকে যেভাবে জলের মতো রূপো বেরিয়ে গিয়ে চিনে জমা হচ্ছিলো, সেটা অর্থনীতির পরিভাষায় মোটেই স্বাস্থ্যকর ছিলো না।
এমতাবস্থায়,ইংল্যান্ডে শিল্প বিপ্লব ঘটে যাওয়ার পর ইংল্যান্ড উভয়মুখী ও মুক্ত বানিজ্যের ওপর গুরুত্ব আরোপ করে। চিনের ক্যান্টন বানিজ্যের ক্ষেত্রে চিন ইওরোপীয় দেশ গুলোর কাছ থেকে তেমন কিছুই কিনতো না। এই অবস্থায় ব্যবসা বাণিজ্যে ভারসাম্য বজায় রাখার জন্য ইংল্যান্ডের বনিকরা চিনে আফিমের চোরা চালান আরম্ভ করে।
ইংরেজরা ভারতে চাষিদের নামমাত্র মূল্য দিয়ে আফিমের চাষ করাতো। সেই আফিম তারা ভারত থেকে চিনে চালান করতো এবং আফিম বিক্রির মুনাফা থেকে চিনের সবুজ চা ও সাদা রেশম কিনে ইওরোপের বাজারে চড়া দামে বিক্রি করতো। এই ত্রিকোন বানিজ্যের ফলে ইংল্যান্ডকে এশিয়ায় বানিজ্যের জন্য নতুন করে আর দেশ থেকে টাকা আনতে হয় না।
ত্রিকোন বানিজ্যের ফলে চিনের সঙ্গে ইংল্যান্ডের বানিজ্যে একটি ভারসাম্য স্থাপিত হয়। ক্যান্টন বানিজ্য ইংল্যান্ডের অনুকূলে এসে যায়। এবং এই বানিজ্য থেকে ইংল্যান্ড বিপুল মুনাফা লাভ করতে থাকে।
আফিমের চোরাচালানের পরিনাম
উনিশ শতকের প্রথম দিকে ধীরে ধীরে চিনের অভ্যন্তরে আফিমের চোরাচালান চিনের আর্থ - সামাজিক, এবং রাজনৈতিক ব্যবস্থায় বিরূপ প্রভাব ফেলতে শুরু করে।
- আফিমের নেশাতে চিনের যুব সমাজ স্থবির ও পঙ্গু হয়ে যেতে থাকে,
- সেনাবাহিনীর প্রায় ৯০ % মানুষ আফিমের নেশায় আসক্ত হয়ে পড়ে,
- আফিমের নেশা চিনের পরিবার ও সমাজ জীবনে কালো অন্ধকার ঘনিয়ে আনে,
- সমাজের নৈতিক অধঃপতন ঘটে,
- নেশার প্রভাবে অপরাধ প্রবনতা বৃদ্ধি পায়, জড়ত্ব, কর্মহীনতা ও অকর্মন্যতা ধীরে ধীরে সারা চিনকে গ্রাস করে,
- আফিম কিনতে গিয়ে দেশের রৌপ্যমুদ্রা জলের মতো বেরিয়ে যেতে থাকে,
- রূপার দাম মারাত্মক ভাবে বেড়ে যায়। এর ফলে রৌপ্য ও তাম্র মুদ্রার বিনিময় হারে বিস্তর ফারাক ঘটে,
- সাধারন কৃষকরা তাম্রমুদ্রা ব্যবহার করতেন এবং তা দিয়েই সব রকমের কেনাকাটা করতেন। তাদের মজুরিও তামার টাকাতেই হতো। কিন্তু তারা রুপোর টাকাতেই সরকারকে কর দিতেন।তেমনটাই ঐ দেশের সরকারের নিয়ম ছিলো। এখন রূপার দাম বেড়ে যাওয়ায়, রৌপ্যমুদ্রারও দাম বেড়ে গেলো। ফলে অনেক গুলি তামার মুদ্রার বিনিময়ে একটি মাত্র রূপোর টাকা পাওয়া গেলো। এর ফলে সরকারকে কর দিতে গিয়ে কৃষকরা সর্বস্বান্ত হয়ে যেতে থাকলো। মারাত্মক আর্থিক চাপে তাদের অবস্থা খুবই খারাপ হয়ে পড়লো।
- এর ফলে তীব্র আর্থিক সংকটে দেশে কৃষক বিদ্রোহ ও দাঙ্গা হাঙ্গামা শুরু হয়ে যায়,
- চিনে মাঞ্চু সরকারের জনপ্রিয়তা কমে যায় এবং সরকারের বিরুদ্ধে দেশের মানুষের মনে ক্ষোভ সৃষ্টি হয়।
১৮৩০ পর অবাধ বানিজ্য নীতির চাপ
১৮৩০ খ্রিঃ পর চিনের আভ্যন্তরীণ পরিস্থিতি আরও খারাপ হয়ে গেলো। এই বছরটিতেই ব্রিটিশ পার্লামেন্ট এশিয়ায় বানিজ্যের ক্ষেত্রে ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির একচেটিয়া বানিজ্যের অবসান ঘটায়, এবং সমস্ত ব্রিটিশ পুঁজিপতি গোষ্ঠিগুলিকে চিনে ব্যবসা করার ছাড়পত্র দিয়ে দেয়।
এই ছাড়পত্র দেওয়ার ফলে চিনে আফিমের চোরাচালান আগের থেকে আরোও দ্বিগুন হারে বেড়ে গেলো। এই ঘটনায় খুব স্বাভাবিক ভাবেই চিনের আভ্যন্তরীণ পরিস্থিতি আরোও ঘোরালো হয়ে উঠতে আরম্ভ করলো।
আফিম চালানে চিনের প্রতিরোধ
শেষপর্যন্ত, আফিমের চোরাচালান রুখতে চিনের মাঞ্চু সরকার নানা বিধিনিষেধ আরোপ করলো। ১৮৩৫ খ্রিঃ সরকারের তরফ থেকে কতকগুলো কঠোর বিধিনিষেধের কথা ঘোষনা করা হলো। কিন্তু সেসব কোনটাই কাজে এলো না। এর ফলে ১৮৩৯ খ্রিঃ চিন সরকার আফিমের চোরাচালান বন্ধ করতে সক্রিয় প্রতিরোধের নীতি গ্রহণ করলো।
আফিমের ব্যবসা বন্ধ করতে চিন সরকার লিন সে সু নামে এক কড়া অফিসারকে ক্যান্টন বন্দরে কমিশনার নিযুক্ত করে। লিন ক্যান্টনে নিযুক্ত হবার পর সেখানে আফিমের ব্যবসা নিষিদ্ধ করে দেন এবং জাহাজ গুলিতে তল্লাশি চালাতে আরম্ভ করেন। এই তল্লাশি চালাবার সময় আফিম ব্যবসার সঙ্গে যুক্ত বহু বিদেশী বনিকদের আফিম সহ গ্রেপ্তার করা হয়। লিন প্রায় কুড়ি হাজার পেটি আফিম জনসমক্ষে নষ্ট করে দেন।
আফিম যুদ্ধের প্রত্যক্ষ কারন
লিন সে সু র অভিযানে এবং আফিম নষ্টের ঘটনায় ইংরেজ বনিকরা মারাত্মক অপমানিত বোধ করতে থাকেন। ইংরেজ বনিকরা ভবিষ্যতে আর আফিম চিনে আনবে না - এমন একটি অঙ্গীকার পত্রে লিন সই করতে বললে ইংরেজ বনিকরা তাতে সই করতে অসম্মত হন।
ইংরেজ বনিকদের এই ঔদ্ধত্য দেখে ক্ষুদ্ধ লিন তৎক্ষণাৎ তাদের ক্যান্টন বন্দর ত্যাগ করার নির্দেশ দেন। এর ফলে ইংরেজ বনিকরা ক্যান্টন ত্যাগ করে ম্যাকাও তে চলে আসেন।
ইতিমধ্যেই ইংরেজ বনিকগোষ্ঠী চিনের বিরুদ্ধে যুদ্ধ ঘোষনার জন্য ইংল্যান্ডের মন্ত্রীসভার ওপর একটি চাপ তৈরি করেন। এর কিছুদিনের মধ্যেই চিনে একটি অপ্রীতিকর ঘটনা ঘটে গেলো।
১৮৩৯ খ্রিঃ ১২ জুলাই, ম্যাকাও অঞ্চলে ইংরেজ বনিকদের হাতে এক চিনা কৃষক নিহত হন। লিন সে সু এই ঘটনার সঙ্গে যুক্ত ইংরেজ বনিকদের আত্মসমর্পণের নির্দেশ দিলে, ইংরাজ বনিকরা জানিয়ে দেয়, তাদের বিচার করবার কোন অধিকার চিনের নেই। এই ঘটনাকে কেন্দ্র করে চিনের সঙ্গে ইংল্যান্ডের মনোমালিন্য ও বিরোধ শুরু হয়।
লিন সে সু ইংরেজ বনিকদের ম্যাকাও ত্যাগ করতে চাপ দেন এবং নিজে সদলবলে ম্যাকাও তে হাজির হন। এর ফলে ইংরেজ বনিকরা ম্যাকাও ত্যাগ করে নির্জন হংকং দ্বীপে আশ্রয় নেন।
আফিম যুদ্ধ (১৮৩৯ - ১৮৪২)
এদিকে ১৮৩৯ খ্রিঃ অক্টোবর মাসে ব্রিটিশ মন্ত্রীসভার পাকাপাকি ভাবে চিনের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করার সিদ্ধান্ত নিয়ে ফেলে।১৮৩৯ খ্রিঃ নভেম্বর মাস থেকে সংঘর্ষ ও আক্রমণ শুরু করা হয়।
১৮৪০ খ্রিঃ জুন মাসে অ্যাডমিরাল এলিয়টের নেতৃত্বে ইংরেজরা প্রচুর সৈন্য এবং অস্ত্রশস্ত্র নিয়ে চিন আক্রমণ করে। ১৮৪১ খ্রিঃ এপ্রিল মাসের পর ব্রিটিশ বাহিনীকে নেতৃত্ব দেন কর্নেল স্যার হেনরি পটিংগার। তিনি চিনের বেশ কয়েকটা বন্দর দখল করে নেন।
আফিম যুদ্ধের অবসান
আফিমের যুদ্ধে প্রায় ২০,০০০ চিনা সেনা মারা গিয়েছিলো। অন্যদিকে ইংল্যান্ডের পক্ষে এই যুদ্ধে মাত্র ৫০০ জন ইংরেজ সেনা নিহত হয়। আধুনিক অস্ত্র ও সমর কৌশলের অভাবে চিন শেষ পর্যন্ত পরাজিত হয়। ১৮৪২ খ্রিঃ ২৯ আগস্ট নানকিংয়ের সন্ধি দ্বারা প্রথম আফিম যুদ্ধের অবসান ঘটে।
নানকিংয়ের সন্ধিতে চিন পরাজয় স্বীকার করে প্রচুর ক্ষতিপূরণ দিতে বাধ্য হয়। ইংল্যান্ডের কাছে গুরুত্বপূর্ণ বন্দর গুলি উন্মুক্ত করে দিতে বাধ্য হয়।
আফিম যুদ্ধের প্রকৃত কারন
বলা হয়ে থাকে, ১৮৩৯ খ্রিঃ আফিম যুদ্ধে আফিম ছিলো একটি উপলক্ষ মাত্র। এই যুদ্ধের আসল কারনটি আফিমের অন্তরালেই ছিলো।
আসলে ১৮৩৯ খিঃ ইংল্যান্ড - চিন আফিম যুদ্ধের পশ্চাতে মূল কারন ছিলো ৩ টি। যেমন -
(১.) ত্রিকোন বানিজ্যে ভাঙ্গন
চিন সরকার চিনে আফিম আমদানি তে নিষেধাজ্ঞা আরোপ করলে ইংল্যান্ডের ত্রিকোন বানিজ্য ভেঙ্গে পড়ার উপক্রম শুরু হয়। এমতাবস্থায়,শক্তিশালী প্রতিরোধ ভিন্ন ইংল্যান্ডের সামনে দ্বিতীয় কোন বিকল্প খোলা ছিলো না।
(২.) চিনের রুদ্ধদ্বার নীতি
আফিম যুদ্ধের পিছনে চিনের রুদ্ধদ্বার নীতিও সমান দায়ী ছিলো। ইংল্যান্ডের দৌত্য ব্যবস্থার বিফলতা, সমমর্যাদার বৈদেশিক ও বানিজ্যিক সম্পর্কের প্রস্তাবকে প্রত্যাখান, বিদেশী বনিকদের নিকৃষ্ট নজরে দেখা, তাদের ওপর কঠোর শর্ত আরোপ, কো হং দের দুর্নীতি এবং নিয়ন্ত্রনকে মেনে নিয়ে, দীর্ঘদিন ধরে ইংল্যান্ডের পক্ষে সুস্থিতভাবে কখনই ব্যবসা করা সম্ভব ছিলো না। চিনের রুদ্ধদ্বারকে ভাঙতে বলপ্রয়োগ করতেই হতো।আফিম যুদ্ধ এই সম্ভবনারই অনিবার্য ফলশ্রুতি ছিলো।
(৩.) ইংল্যান্ডের সাম্রাজ্যবাদী আগ্রাসন
আফিম যুদ্ধের পিছনে সবচেয়ে বড়ো কারন ছিলো ইংল্যান্ডের সাম্রাজ্যবাদী আগ্রাসন। ইউরোপীয় দেশ গুলির মধ্যে একমাত্র ইংল্যান্ডই প্রথম থেকে সর্বতোভাবে ক্যান্টন বানিজ্যকে নিজের অধিকারে রাখতে চেয়েছিলো।
এইজন্য বার বার দূত প্রেরন করে ইংল্যান্ড বানিজ্যিক সুযোগ সুবিধা লাভ করতে চেয়েছিলো। শেষপর্যন্ত ব্যর্থ হয়ে চিনের বানিজ্যকে নিজের অনুকূলে আনতে সে আফিম ব্যবসা শুরু করে। আফিমের মধ্য দিয়ে -
- একদিকে যেমন বানিজ্যে ভারসাম্য আসে, তেমনই
- অবাধ বানিজ্যের কাজটিও সহজ হয়ে যায়। অফিমকে কেন্দ্র করে বৈদেশিক বানিজ্য চিনের অভ্যন্তরে প্রবেশ করে যায়।
আফিম নিষিদ্ধ হওয়ায় আফিমকে কেন্দ্র করে আবর্তিত হওয়া ইংল্যান্ডের সমস্ত বানিজ্যিক ও অর্থনৈতিক সুযোগ সুবিধা গুলি ভেঙ্গে পড়ার উপক্রম হয়। এমতাবস্থায় সেগুলিকে অক্ষুন্ন রাখতে যুদ্ধ করা আবশ্যিক হয়ে পড়েছিলো।
আফিমের যুদ্ধ তাই এইসব ঘটনাক্রমেরই একটি অনিবার্য ফলশ্রুতি ছিল। আফিম অজুহাত ছিলো, আসল কারনটি ছিলো আফিমের অন্তরালে সহজ ও অনুকূল বানিজ্যের ধারণাটিকে সমান্তরাল ভাবে বজায় রাখা এবং অক্ষুন্ন রাখা।