১৯২৮ খ্রিঃ জওহরলাল নেহেরু তাঁর দশ বছরের কন্যা ইন্দিরাকে ধারাবাহিক ভাবে ৩০ টি চিঠি পাঠিয়ে ছিলেন। এই চিঠিগুলি ১৯২৯ খ্রিঃ একত্রিত হয়ে একটি বইয়ের আকারে প্রকাশিত হয়। এই বইটিরই নাম ছিল "Letters from a father to his Daughter"।
Letters from a father to his Daughter |
প্রেক্ষাপট
১৯২৮ খ্রিঃ নেহেরু যখন চিঠিগুলি লেখেন, তখন তিনি এলাহাবাদে ছিলেন। এই সময় তার ছোট্ট কন্যা ইন্দিরা ছিলেন মুসৌরিতে। রাজনৈতিক নানা কর্মসূচির জন্য জওহরলালকে প্রায়ই বাড়ির বাইরে থাকতে হতো।এমতাবস্থায় প্রিয় কন্যার সঙ্গে সংযোগ স্থাপনের একমাত্র উপায় ছিলো চিঠি। চিঠির মধ্য দিয়ে কন্যার কাছে জ্ঞান ও স্নেহের পরশ পৌঁছে দেওয়ার জন্য এলাহাবাদ থেকে এইসময় জওহরলাল অনেক গুলি চিঠি ইন্দিরাকে পাঠান।
জওহরলাল চিঠিগুলির ভাষ্যকে নিছক ব্যক্তিগত সম্পর্কের সংকীর্ণ গোন্ডির মধ্যে বেঁধে রাখেন নি। আর ঠিক এই কারনেই পরিচিত কয়েকজন বন্ধু জওহরলালকে চিঠিগুলিকে সর্বসাধারনের কাছে বইয়ের আকারে প্রকাশ করতে অনুরোধ করেন।
শেষপর্যন্ত বন্ধু বান্ধব ও আত্মীয় স্বজনদের অনুরোধে নেহেরু ১৯২৯ খ্রিঃ এলাহাবাদের ল জার্নাল প্রেস থেকে চিঠিগুলো "Letters from a father to his Daughter" নামে বইয়ের আকারে প্রকাশ করেন।
হিন্দি ও বাংলা অনুবাদ
"Letters from a father to his Daughter" - এর মূল চিঠিগুলি ইংরেজি ভাষায় লেখা ছিল। কিন্তু প্রচন্ড জনপ্রিয়তার জন্য পরবর্তীকালে এই চিঠিগুলি অন্যান্য ভারতীয় ভাষায় অনুবাদ করা হয়।
- চিঠি গুলিকে হিন্দিতে অনুবাদ করেন প্রখ্যাত হিন্দি সাহিত্যিক মুন্সি প্রেমচাঁদ। হিন্দি অনুবাদের নাম ছিল – “পিতা কা পত্র পুত্রীকে নাম”।
- বাংলাতেও চিঠিগুলি অনুবাদ করা হয়েছিলো। বাংলা অনুবাদের নাম ছিল “কল্যাণীয়াসু ইন্দু”।
চিঠিগুলির মূল বিষয়বস্তু
জওহরলাল নেহেরু এলাহাবাদ থেকে ইন্দিরাকে দুটি উদ্দেশ্যে নিয়ে চিঠি গুলি পাঠিয়েছিলেন -- চিঠির মধ্য দিয়ে কন্যাকে সঙ্গদান করা, এবং
- জ্ঞান বিজ্ঞানের পরশ প্রিয় কন্যার কাছে পৌঁছে দেওয়া,
(১.) পৃথিবীর সৃষ্টি কিভাবে হলো,(২.) প্রানের আর্বিভাব কেমন করে হয়েছিলো, (৩.) মানুষের জন্ম ও বিবর্তন কেমন করে ঘটেছিলো, (৪.) কিভাবে মানুষ আগুনের ব্যবহার শিখেছিলো, (৫.) পৃথিবীর ভাষাবৈচিত্র, ধর্মের উদ্ভব, দলপতি ও রাজার সৃষ্টি, শ্রমের বিভাজন, পুরানো সভ্যতা ও শহরের জন্ম, এসব কিভাবে হয়েছিলো, তা খুব সহজভাবে গল্পের ছলে নেহেরু চিঠিগুলিতে তুলে ধরেছিলেন।
ইতিহাসের গল্প শোনানোর ফাঁকে নেহেরু দেশের ঐতিহ্য ও সংস্কৃতি সম্পর্কেও কন্যাকে স্মরন করিয়ে দিয়েছিলেন। খুব সহজ ভাবে শুনিয়েছিলেন রামায়ণ ও মহাভারতের গল্প।
চিঠিগুলির মূল বৈশিষ্ট্য
ইন্দিরাকে লেখা জওহরলালের চিঠিগুলির ৩ টি বিশেষ অভিনবত্বের দিক ছিলো -
- প্রতিটি চিঠিরই আকার ছিলো বেশ ছোটো এবং উপস্থাপন ভঙ্গী ছিলো খুবই মজার।
- সংক্ষিপ্ত পরিসরে লেখা শিশু উপযোগী চিঠিগুলির কোন জটিল তথ্যের ভারে ভারাক্রান্ত ছিলো না।
- শিশু চিন্তার সামর্থের দিকটি কে খেয়াল রেখে নেহেরু কোন বিস্তারিত বিবরনে যান নি। কিন্তু এমনভাবে তিনি ইতিহাসের বিষয় গুলোকে চিঠিতে তুলে ধরেছিলেন, যা পাঠককে উৎসাহী করে নিয়ে যেতে চায় জ্ঞান জগতের বিস্তৃত প্রান্তরে।
চিঠিগুলির ঐতিহাসিক গুরুত্ব
- চিঠিগুলির প্রাথমিক উদ্দেশ্য ছিল নিঃসঙ্গ ইন্দিরার জীবনে পিতার স্নেহ এবং জ্ঞানের পরশকে পৌঁছে দেওয়া। পরবর্তীকালে ইন্দিরা গান্ধী স্বীকার করেছিলেন, তার উদারনৈতিক দৃষ্টিভঙ্গি ও চিন্তাধারার পিছনে পিতার লেখা এই চিঠি গুলি গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেছিলো।
- জওহরলালের লেখা চিঠিগুলি পড়ে উপলব্ধি করা যায় , এই পৃথিবীতে "প্রকৃতি", "মানুষ" আর "ইতিহাসের" মধ্যে এক নিবিড় এবং অবিচ্ছেদ্য সম্পর্ক রয়েছে।
- চিঠিগুলিতে মানব সভ্যতার ইতিহাস আলোচনা করতে গিয়ে নেহেরু কোন জাতি বা দেশের প্রতি বিদ্বেষ পোষন করেন নি। খুব স্বাভাবিক ভাবেই চিঠিগুলির ভাষ্য পাঠককে সংকীর্ণ জাতি পরিচয়ের উর্ধ্বে উঠে বৃহত্তর বিশ্ব পরিবারের সঙ্গে একাত্ম করে তোলে।
চিঠিগুলির ঐতিহাসিক মূল্য
একথা ঠিক, জওহরলাল নেহেরুর চিঠিগুলিতে সমকালীন সময়ের কোন তথ্য বা ঘটনাবলীর উল্লেখ পাওয়া যায় না। তাই আপাত ভাবে আধুনিক ভারতের ইতিহাস রচনার উপাদান হিসাবে চিঠিগুলির গুরুত্ব সামান্যই,মনে হতে পারে।
কিন্তু মাথাায় রাখতে হবে চিঠিগুলির মনস্তাত্ত্বিক মূল্য অপরিসীম। শিশু কন্যার ইতিহাস চেতনা গড়ে তোলার জন্য লেখা এই চিঠিগুলির মধ্যে আমরা –
- নেহেরুর বিশ্বজনীন উদারনৈতিক দৃষ্টিভঙ্গি,
- ধর্মনিরপেক্ষ চেতনা,
- পঞ্চশীল আদর্শ এবং
- সমাজতান্ত্রিক দৃষ্টিভঙ্গির পরিচয় পাই,