আধুনিক ইতিহাস চর্চার একটি গুরুত্বপূর্ণ ঐতিহাসিক উপাদান হলো চিঠিপত্র।
ইতিহাসের উপাদান হিসাবে চিঠিপত্র |
চিঠিপত্রের পরিচয়
বর্তমান কালে ইন্টারনেট এবং তার সঙ্গে সম্পৃক্ত উপাদান গুলোর সাহায্যে আমরা সংযোগ স্থাপন করলেও,মনে রাখতে হবে, ঊনবিংশ এবং বিংশ শতাব্দীতে "সংযোগ স্থাপনের" সবচেয়ে শক্তিশালী মাধ্যম ছিলো চিঠিপত্র।
সাধারনত ভাব বিনিময় এবং পারিবারিক সংবাদ সংগ্রহের জন্য যেমন এই সময়ে চিঠি লেখা হতো। তেমনই সরকারি স্তরে আধিকারিকরা প্রশাসনিক নানা সিদ্ধান্তের ব্যাপারে নিজেদের মনোভাব ও মতের প্রকাশ ঘটানোর জন্যও চিঠি লিখতেন। সরকারের সঙ্গে সাধারন কোন ব্যক্তি বা প্রতিষ্ঠানের মতবিনিময় ও যোগাযোগ, আজও চিঠির মাধ্যমেই ঘটে থাকে। ঊনবিংশ এবং বিংশ শতকেও চিত্রটা একই রকমের ছিলো।
চিঠিপত্র থেকে তাই যে কোন সময় কালের মনস্তাত্ত্বিক দিকটি সহজেই বুঝে নেওয়া যায়। এর পাশাপাশি চিঠিপত্র অনেক গুরুত্বপূর্ণ তথ্যও সরবরাহ করে থাকে।
এইজন্য ঐতিহাসিকরা চিঠিপত্রকে একটি গুরুত্বপূর্ণ ঐতিহাসিক উপাদান বলে মনে করে থাকেন।
চিঠিপত্রের প্রকারভেদ
চিঠিপত্র সাধারণত দু রকমের হয়ে থাকে -
- সরকারি চিঠিপত্র
- ব্যক্তিগত চিঠিপত্র
সরকারি চিঠিপত্র
ব্যক্তিগত চিঠিপত্র
ইতিহাসের উপাদান হিসেবে ইতিহাস রচনায় "সরকারি চিঠিপত্র" যেমন গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা নেয়, একই ভাবে "ব্যক্তিগত চিঠিপত্রও" গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা নিয়ে থাকে।
কিছু ঐতিহাসিক চিঠিপত্রের উদাহরন
- ভারতে পাশ্চাত্য শিক্ষা বিস্তারের অনুরোধ জানিয়ে বড়লাট লর্ড আমহাস্টকে লেখা ১৮২৩ খ্রিঃ রামমোহন রায়ের চিঠি,
- বঙ্গ ভঙ্গের প্রকৃত উদ্দেশ্যকে ব্যাখ্যা করে ১৯০৫ খ্রিঃ ভারত সচিব ব্রোডরিখকে লেখা লর্ড কার্জনের চিঠি,
- ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির নানা চিঠিপত্র,
- ব্রিটিশ সরকারকে দেওয়া গান্ধীজির ৯৩ টি এবং গান্ধীজিকে দেওয়া সরকারের ৪৮ টি চিঠি,
- ইন্দিরা গান্ধীকে লেখা জওহরলাল নেহেরুর চিঠিপত্র সমূহ,
- আমেরিকা থেকে পাঠানো স্বামী বিবেকানন্দের নানা চিঠিপত্র,
- রবীন্দ্রনাথের "ভানুসিংহের পত্রাবলী", "রাশিয়ার চিঠি", "ছিন্নপত্র", য়ুরোপ প্রবাসীর পত্র",
- নেতাজি সুভাষচন্দ্র বসু ও মহাত্মা গান্ধীর মধ্যে প্রেরিত নানা চিঠিপত্র,
- দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময় সৈনিকদের উদ্দেশ্যে তাদের পরিবার স্বজনদের চিঠিপত্র সমূহ, ইত্যাদি ।
ইতিহাসের উপাদান হিসেবে চিঠিপত্রের গুরুত্ব
প্রথমত, চিঠিপত্রে লেখকের ব্যক্তিগত অভিজ্ঞতা ও মতামতের প্রকাশ ঘটে থাকে। ফলত, চিঠিপত্র অন্যান্য উপাদান থেকে কিছুটা স্বতন্ত্র তথ্য সরবরাহ করে।
দ্বিতীয়ত, সরকারি বিভিন্ন চিঠিপত্র থেকে সরকারের বিভিন্ন কর্মসূচি, প্রকল্প, সিদ্ধান্ত ইত্যাদি বিষয়ে সরকারের মনোভাবের কথা জানা যায়। যেমন ১৯০৫ খ্রিঃ ভারত সচিব জন ব্রোডরিখকে লেখা লর্ড কার্জনের চিঠি থেকে বঙ্গভঙ্গের রাজনৈতিক উদ্দেশ্যের কথা জানা যায়।
তৃতীয়ত, দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময় আমেরিকাতে সেনাদের কাছে তাদের পরিবারের তরফ থেকে প্রায় এক কোটি ষাট লক্ষ চিঠি লেখা হয়। এই চিঠিগুলি থেকে সমকালীন সময়ে যুদ্ধের প্রতি সাধারণ মানুষের চাওয়া, পাওয়া, ইচ্ছা, অনিচ্ছার কথা ধরা পড়েছে।
চতুর্থত, চিঠি ব্যক্তিগত অনুভূতির প্রকাশ মাধ্যম। তাই এর মধ্যে মনস্তাত্ত্বিক পরিবর্তনের নানা দিকগুলি ধরা থাকে।
উদাহরন হিসেবে বলা যায় -
- জওহরলাল নেহেরু তাঁর কন্যা ইন্দিরাকে যে চিঠিগুলি পাঠিয়েছিলেন, তা থেকে তাঁর উদারনৈতিক দৃষ্টিভঙ্গি ও সমাজতান্ত্রিক মননের পরিচয় পাওয়া যায়।
- একই ভাবে শিষ্যদের উদ্দেশ্যে পাঠানো স্বামী বিবেকানন্দের চিঠিগুলি থেকে তাঁর চিন্তাভাবনার অনেক নতুন দিকের সন্ধান পাওয়া যায়।
- মহাত্মা গান্ধীকে পাঠানো সুভাষ চন্দ্র বসুর চিঠি গুলি থেকে গান্ধীজির প্রতি সুভাষ চন্দ্র বসুর ব্যক্তিগত শ্রদ্ধা ও অনুরাগের কথা জানা যায়,
- পাশ্চাত্য দেশগুলি সম্পর্কে কবিগুরুর মনোভাবের কথা রবীন্দ্রনাথের পাঠানো বিভিন্ন চিঠিপত্র গুলি থেকে সহজেই বুঝে নেওয়া যায়,
- অসহযোগ আন্দোলনের সময় ইংল্যান্ড থেকে চিত্তরঞ্জন দাশের উদ্দেশ্যে লেখা সুভাষ চন্দ্র বসুর চিঠি গুলি থেকে সুভাষ চন্দ্র বসুর গভীর দেশপ্রেমের কথা জানা যায়,
- রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর ও মহাত্মা গান্ধীর মধ্যে পাঠানো চিঠি গুলি থেকে উভয়ের প্রতি পারস্পরিক শ্রদ্ধা ও মতাদর্শ গত পার্থক্যের নানা দিক গুলি সম্পর্কেও জানা যায়,
চিঠিপত্রের সীমাবদ্ধতা
- চিঠিপত্রের তথ্য সবসময় পুরোপুরি নৈর্ব্যক্তিক বা নিরপেক্ষ হয় না।
- চিঠিতে লেখকের মনের বক্তব্যটুকুই জানা যায়। সেটা সবসময় নিরপেক্ষ হবে এমন নয়।