আধুনিক ইতিহাস চর্চার দুটি অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ উপাদান হলো - "আত্মজীবনী" ও "স্মৃতিকথা"।
ইতিহাসের উপাদান হিসাবে আত্মজীবনী ও স্মৃতিকথা |
আত্মজীবনীর সংজ্ঞা
আত্মজীবনী হলো কোন ব্যক্তির "নিজস্ব জীবনকথা" । এটি এমন একধরনের অ - উপন্যাসধর্মী সাহিত্য, যেখানে ব্যক্তি জীবনের আখ্যানের সঙ্গে জড়িয়ে থাকে সমকালীন নানা ঘটনা ও সমাজ সংস্কৃতির আখ্যান।
আত্মজীবনীর উদাহরণ
সাধারনত স্বনামধন্য বিখ্যাত ব্যক্তিরাই আত্মজীবনী লিখে থাকেন। আত্মজীবনীর অনেক উদাহরণ দেওয়া যেতে পারে। যেমন -
- বিপিনচন্দ্র পালের - "সত্তর বৎসর",
- রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের - "জীবনস্মৃতি",
- সরলাদেবী চৌধুরানীর - "জীবনের ঝরাপাতা",
- মহাত্মা গান্ধীর - "My Experiment with Truth",
- জওহরলাল নেহেরুর - "An Autobiography",
স্মৃতিকথার সংজ্ঞা
অন্যদিকে স্মৃতিকথা হলো কোন ব্যক্তির অতীত জীবনে ফেলে আসা স্মরণীয় কোন ঘটনা বা বিশেষ কোন মুহূর্তের "স্মৃতিচারণ মূলক বিবরন"।
স্মৃতিকথার উদাহরণ
আত্মজীবনীর মতো স্মৃতিকথাও স্বনামধন্য, বিখ্যাত ব্যক্তিরাই সাধারনত লিখে থাকেন। স্মৃতিকথার অনেক উদাহরণ দেওয়া যেতে পারে। যেমন -
- অন্নদাশঙ্কর রায়ের - "যুক্তবঙ্গের স্মৃতি",
- দক্ষিনারঞ্জন বসুর - "ছেড়ে আসা গ্রাম",
- মনিকুন্তলা সেনের - "সেদিনের কথা",
- হিরন্ময় বন্দ্যোপাধ্যায়ের - "উদ্বাস্তু",
- মান্না দের - জীবনের জলসাঘরে",
- আশালতা সরকারের -" আমি সূর্য সেনের শিষ্যা",
- মৌলানা আবুল কালাম আজাদের - "ইন্ডিয়া উইন্স ফ্রিডম"।
আত্মজীবনী ও স্মৃতিকথার মধ্যে সাদৃশ্য ও বৈসাদৃশ্য
মিল /সাদৃশ্য
- আত্মজীবনী ও স্মৃতিকথা দুটোই অতীতের স্মৃতি থেকে লেখক লিখে থাকেন।
- সাধারনত বিখ্যাত বা স্বনামধন্য ব্যক্তিরাই আত্মজীবনী বা স্মৃতিকথা লিখে থাকেন।
অমিল / বৈসাদৃশ্য
- আত্মজীবনী হলো ব্যক্তির জীবনী মূলক আখ্যান। কিন্তু স্মৃতিকথা ব্যক্তির জীবনের সঙ্গে যুক্ত অতীতের স্মরণীয় কোন ঘটনা বা বিশেষ মূহুর্তের কথন।
- আত্মজীবনী কিছুটা আত্মবিশ্লেষনের ঢঙে লেখা। যেখানে ব্যক্তি জীবনের আখ্যানের সঙ্গে সমকালীন সমাজ জীবনের আখ্যানেরও পরিচয় পাওয়া যায়। কিন্তু স্মৃতিকথা অতীতের প্রত্যক্ষ বিবরন, যেখানে জড়িত থাকে লেখকের নিজস্ব অনুভূতি ও আবেগ।
আত্মজীবনী ও স্মৃতিকথার গুরুত্ব
আধুনিক ইতিহাস চর্চার উপাদান হিসাবে "স্মৃতিকথা" এবং "আত্মজীবনী" অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ -
- সরকারি নথিপত্রের বাইরে বহু ঐতিহাসিক তথ্য ও ঘটনার কথা আত্মজীবনী ও স্মৃতিকথা থেকে জানা যায়।
- আত্মজীবনী ও স্মৃতিকথা সাধারণত গুনি ও বিদগ্ধ ব্যক্তিরা লিখে থাকেন। তাই এতে অবান্তর, পক্ষপাতমূলক ও অতিরঞ্জন ঘটনার প্রবেশ অপেক্ষাকৃত কম থাকে।
- আত্মজীবনী থেকে ঐতিহাসিক কোন ব্যক্তির মনস্তাত্ত্বিক পরিচয় এবং তার জীবনের সঙ্গে যুক্ত নানা অজানা ঘটনার কথা জানতে পারা যায়। উদাহরন হিসাবে মহাত্মা গান্ধীর আত্মজীবনীর কথা উল্লেখ করা যায়। গান্ধীজি অকপটে তার জীবনের সব ঘটনা গুলির কথা তার আত্মজীবনীতে তুলে ধরেছিলেন। এগুলি থেকে গান্ধীর জীবনের বহু অজানা দিকের কথা যেমন জানা যায়, তেমনই উপলব্ধি করা যায়, কোন ঐতিহাসিক প্রেক্ষাপটে রচিত হয়েছিলো গান্ধীজির সত্যাগ্রহ ও অহিংসার আদর্শ।
- ভারতে দেশভাগের ইতিহাস, দাঙ্গার ইতিহাস, স্বাধীনতার পর উদ্বাস্তু সমস্যার ইতিহাস, জার্মানিতে নাৎসি বাহিনীর ইহুদি নিধন ও অত্যাচারের নানা ইতিহাস আত্মজীবনী ও স্মৃতিকথার ওপর নির্ভর করেই গড়ে উঠেছে।
- বাংলাদেশের ভাষা আন্দোলন ও স্বাধীনতা যুদ্ধের ইতিহাস রচনার ক্ষেত্রেও আত্মজীবনী ও স্মৃতিকথা গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা নিয়ে থাকে।
- আবার স্থানীয় বা আঞ্চলিক ইতিহাস চর্চার অনেকটাই স্মৃতিকথার ওপর নির্ভরশীল।
আত্মজীবনী ও স্মৃতিকথার সীমাবদ্ধতা
মনে রাখতে হবে, ইতিহাসের উপাদান হিসাবে আত্মজীবনী ও স্মৃতিকথা গুরুত্বপূর্ণ হলেও, কখনই সন্দেহ ও সমালোচনার উর্ধে নয়। এর কিছু সীমাবদ্ধতাও আছে। যেমন -
- আত্মজীবনী ও স্মৃতিকথা দুটোই হলো ব্যক্তির মননের কথন। সুতরাং তা সবসময় নিরপেক্ষ হবে এমন নয়।
- আত্মজীবনী ও স্মৃতিকথা দুটোর ক্ষেত্রেই লেখক প্রধানত তার স্মৃতির ওপর নির্ভরশীল। স্মৃতিচারনার ক্ষেত্রে অনেক সময়েই সাল, তারখ ও নানা তথ্যগত ভুল থেকে যেতে পারে।
তাই আত্মজীবনী ও স্মৃতিকথা থেকে তথ্য গ্রহনের ক্ষেত্রে যথেষ্ট সাবধানতা অবলম্বন করতে হবে। এক্ষেত্রে -
- আত্মজীবনী ও স্মৃতিকথা যিনি লিখেছেন প্রথমেই তার মানসিকতা যাচাই করতে হবে। ঐতিহাসিক উপাদানের সাহায্যে বুঝে নিতে হবে, তিনি কতটা নৈর্ব্যক্তিক বা নিরপেক্ষ। এবং
- তার দেওয়া তথ্য গুলি সঠিক কিনা তা অন্য উপাদানের সাহায্যে যাচাই করে দেখে নিতে হবে।
Very good answer .. I liked it ...
ReplyDelete