ব্যঙ্গচিত্র বা কার্টুন হলো চিত্রকলারই একটি ভাগ। যদিও চিত্রকলার অন্যান্য শাখা গুলির মতো কৌলিন্য বা সম্ভ্রম কোনটাই এর নেই। তা সত্ত্বেও প্রথম থেকে আজ অবধি এর জনপ্রিয়তায় একটুও ভাঁটা পড়ে নি।
গগনেন্দ্রনাথ ঠাকুরের ব্যঙ্গচিত্র |
ব্যঙ্গচিত্রের সংজ্ঞা
আমরা যে সমাজে বাস করি সেই সমাজে যদি বিপরীতধর্মী কিছু দেখি, যা আমাদের চোখে বেমানান, তার আঁকা ছবিকেই সাধারনত ব্যঙ্গচিত্র বা কার্টুন বলা হয়ে থাকে।
ব্যঙ্গচিত্র আঁকার মূল উদ্দেশ্য
ব্যঙ্গচিত্র বা কার্টুন মূলত আঁকা হয় - (১.) সামাজিক এবং রাজনৈতিক নানা ঘটনার ত্রুটি বিচ্যুতি,অন্যায় এবং (২.) আচরনের অসঙ্গতিকে তুলে ধরবার জন্য। যা দেখে রসিক মন পায় এক তিক্ত ব্যঙ্গরসাত্মক আনন্দ।
ব্যঙ্গচিত্র বা কার্টুন চর্চার উদ্ভব
কার্টুন বা ব্যঙ্গচিত্রের প্রথম উদ্ভব ঘটে ইওরোপে, অষ্টাদশ শতাব্দীতে। বিলিতি কার্টুনের পথিকৃৎ ছিলেন উইলিয়াম হোগার্থ। আমাদের দেশে কার্টুনের প্রবেশ ঘটে ঊনবিংশ শতাব্দীতে, হাটখোলা দত্ত বংশের দুই ভাই প্রাননাথ ও গিরীন্দ্রকুমারের হাত ধরে। অবশ্য এদেশে কার্টুন চর্চার শুরুর ক্ষেত্রে ইংরেজ সাহেবদের অবদানও কম ছিলো না। যদিও বাংলার কার্টুনিস্টদের মতে, ভারতীয় কার্টুনচর্চার যথার্থ পথিকৃৎ ছিলেন গগনেন্দ্রনাথ ঠাকুর।
গগনেন্দ্রনাথ ঠাকুরের ব্যঙ্গচিত্র আঁকার প্রেক্ষাপট
গগনেন্দ্রনাথ ঠাকুর সম্পর্কের দিক থেকে ছিলেন রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের ভাইপো এবং অবনীন্দ্রনাথ ঠাকুরের দাদা। তার পিতার নাম ছিলো গুনেন্দ্রনাথ ঠাকুর।
গগনেন্দ্রনাথ ঠাকুরের সেই অর্থে ছবি আঁকার কোন প্রথাগত শিক্ষা ছিলো না। ভাই অবনীন্দ্রনাথের অন্তত ১০ বছর পরে তিনি ছবি আঁকতে আরম্ভ করেন। গগনেন্দ্রনাথ ঠাকুরের এই হঠাৎ করে ছবি আঁকারও একটি কারন ছিলো।
১৯০৫ খ্রিঃ গগনেন্দ্রনাথের বড়ো ছেলে গেহেন্দ্রনাথের মাত্র ১৭ বছর বয়সে মৃত্যু হয়। পুত্রশোকে গগনেন্দ্রনাথ এতটাই ভেঙ্গে পড়েছিলেন যে, পুত্রশোক ভুলতে তিনি ছবি আঁকতে আরম্ভ করেন।
এই ঘটনার পাশাপাশি গগনেন্দ্রনাথের ছবি আঁকার পেছুনে আরেকটি কারনেরও প্রভাব ছিলো। ১৯০২ খ্রিঃ বিখ্যাত জাপানি চিত্র শিল্পী ওকাকুরা কলকাতায় আসেন। তিনি জোড়াসাঁকো ঠাকুরবাড়ীতে গগনেন্দ্রনাথের অতিথি হয়েই কিছুদিন ছিলেন। ওকাকুরার সঙ্গে আরও কয়েকজন জাপানি চিত্রশিল্পী এসেছিলেন। তাদের ছবি আঁকা দেখে গগনেন্দ্রনাথ ঠাকুর ভীষণ ভাবে অনুপ্রাণিত হন এবং ছবি আঁকতে মনস্থ করেন।
গগনেন্দ্রনাথ ঠাকুর অবশ্য ব্যঙ্গচিত্রের পাশাপাশি প্রথাগত ছবিও এঁকেছিলেন। কিন্তু আমরা আজকের আলোচনা শুধুমাত্র গগনেন্দ্রনাথ ঠাকুরের ব্যঙ্গচিত্রের মধ্যেই সীমাবদ্ধ রাখবো।
ব্যঙ্গচিত্র ও উপাদান
গগনেন্দ্রনাথ ঠাকুরের ব্যঙ্গচিত্রের বিশ্লেষন করতে গিয়ে সবার প্রথমে দুটি বিষয় পর্যালোচনাতে উঠে আসে -
(১.) গগনেন্দ্রনাথ ঠাকুর তার ব্যঙ্গচিত্রের উপাদান গুলি কোথা থেকে সংগ্রহ করেন? এবং
(২.) কেনই বা তাঁর আঁকা ব্যঙ্গচিত্র গুলিকে ইতিহাস চর্চায় গুরুত্বপূর্ণ উপাদান বলে মনে করা হয়?
এখানে মাথায় রাখতে হবে, গগনেন্দ্রনাথ ঠাকুর তার চারপাশের সমাজ এবং রাজনীতির পরিচিত - অপরিচিত মানুষদের অসততা, ভন্ডামি এবং সুবিধাবাদকে খুব কাছ থেকে দেখেছিলেন। বক্ ধার্মিকদেরও কাছ থেকে দেখেছিলেন। এইসব অভিজ্ঞতাই তাকে ব্যঙ্গচিত্র রচনায় উদ্বুদ্ধ করেছিলো।
আসলে প্রচলিত সমাজের দ্বিচারিতা এবং মুখ আর মুখসের পার্থক্যের দিক গুলোকে গগনেন্দ্রনাথ ঠাকুর কিছুতেই মেনে নিতে পারেন নি। তার কাছে এসব যান্ত্রিক, অবাস্তব, বেমানান, উদ্ভট এবং কিছুটা বিদঘুটে বলেই মনে হয়েছিলো। খুব স্বাভাবিক ভাবেই প্রচলিত সমাজের অসঙ্গতির বিষয় গুলিকে তিনি তার রসিক মনে কৌতুকের দৃষ্টিতে দেখেছিলেন এবং তাদের নানা অসঙ্গতি গুলিকে ব্যঙ্গচিত্রের মাধ্যমে ফুটিয়ে ফুটিয়ে তুলেছিলেন।
অর্থাৎ সহজ ভাবে বলতে গেলে -
- গগনেন্দ্রনাথ ঠাকুরের ব্যঙ্গচিত্র গুলি কোন কাল্পনিক ব্যঙ্গচিত্র ছিলো না।
- ব্যঙ্গচিত্রের উপাদান গুলি তিনি প্রচলিত সমাজ থেকেই সংগ্রহ করেছিলেন।
- এই সব ব্যঙ্গচিত্র গুলির মাধ্যমে তিনি প্রচলিত সমাজের ভন্ডামি, অসততা, কৃত্রিমতা, সুবিধাবাদ, চিন্তার দৈনতা এবং আচরনের অসঙ্গতি গুলির মুখোস খুলে দিতে চেয়েছিলেন। আর ঠিক এই কারনটির জন্যই গগনেন্দ্রনাথের ব্যঙ্গচিত্র গুলি নিছক ব্যঙ্গ রসের উপাদান না হয়ে, হয়ে উঠেছে সমকালীন সময়ের ইতিহাস উন্মোচনের এক আকর উপাদান - সমাজ বিশ্লেষনের হাতিয়ার ।
ব্যঙ্গচিত্রের প্রকাশনা এবং গ্রন্থ
- বিরুপ বজ্র,
- অদ্ভুত লোক,
- নব হুল্লোড়।
গগনেন্দ্রনাথ ঠাকুরের উল্লেখযোগ্য ব্যঙ্গচিত্র
- জাতাসুর,
- বিদ্যার কারখানা,
- বিশ্ববিদ্যালয়ে অগ্নিযোগ,
- খল ব্রাহ্মন,
- মোহনবাগান ক্লাব,
- বাঙালি মেম,
- শংকর বাঙালি,
- রবীন্দ্রনাথের বিদেশ ভ্রমণ,
- জগদীশের ধ্যানভঙ্গ,
- সর্বাঙ্গের অস্রুপাত,
- অন্তরালে যৎকিঞ্চিৎ,
- শান্তিজল,
- অতিভক্তি,
- জাতপাতের কালি,
- উড়ন্ত চরকা,
- পুচ্ছ পরিবর্তন,
- রূপান্তর,
- H. E old Bengal,
- প্রচন্ড মমতা,
- প্রাচ্য ও পাশ্চাত্য, ইত্যাদি।
গগনেন্দ্রনাথের ব্যঙ্গচিত্রের বৈশিষ্ট্য
- ব্যঙ্গচিত্র গুলির অনেক গুলি কালো রঙে আঁকা।
- বেশ কিছু ব্যঙ্গচিত্র গগনেন্দ্রনাথ ওয়াশ পদ্ধতিতে আঁকেন। এই পদ্ধতিতে কার্টুনের অবয়বে তিনি আনেন রঙের মায়াবি স্পর্শ। ওয়াশ পদ্ধতি ছিলো কার্টুন আঁকার এক অভিনব টেকনিক।
- গগনেন্দ্রনাথ কোন পুরান বা কিংবদন্তির বিষয় নিয়ে ছবি আঁকেন নি।
- সামাজিক বিভিন্ন ঘটনা, ব্যক্তির কাজকর্ম ও আচরনের নানা অসঙ্গতি, চিন্তার দৈনতা এবং দ্বিচারিতার বিষয় গুলোকে অবলম্বন করেই তিনি ব্যঙ্গচিত্র গুলি আঁকেন।
- রাজনৈতিক বিষয় অপেক্ষা সামাজিক নানা বিষয় ও ঘটনাবলী নিয়েই তিনি বেশি ছবি আঁকেন।