আমাদের দেশের প্রথম পূর্ণাঙ্গ ব্যঙ্গচিত্র শিল্পী গগনেন্দ্রনাথ ঠাকুর তার ব্যঙ্গচিত্রের বেশিরভাগই এঁকেছিলেন ঔপনিবেশিক সমাজের নানা চালচিত্র নিয়ে।
কপিরাইট থাকায় গগনেন্দ্রনাথের কোন আসল ব্যঙ্গচিত্রের ছবি দেওয়া গেলো না। এটি একটি প্রতীক চিত্র। |
ব্যঙ্গচিত্রে ঔপনিবেশিক সমাজের প্রতিফলন
তার ব্যঙ্গচিত্র গুলিকে গভীর ভাবে বিশ্লেষণ করলে ঔপনিবেশিক সমাজের কতকগুলি বিশেষ দিক লক্ষ্য করা যায়, যা তৎকালীন "সমাজ ব্যবস্থা ও জীবনধারার"অন্যতম বৈশিষ্ট্য ছিলো বলে ঐতিহাসিকরা মনে করেন। যথা -
- সমাজের নৈতিক অধঃপতন ও চারিত্রিক দ্বিচারিতা,
- সমাজের সর্বস্তরে মদ্যপানের ব্যপকতা,
- পাশ্চাত্য শিক্ষিত শ্রেনীর সাহেবি সংস্কৃতির অন্ধ অনুকরনের প্রচেষ্টা,
- সমাজে বক্ ধার্মিক ও ধর্ম ব্যবসায়ীদের শঠতা, প্রবঞ্চনা এবং ধর্ম ব্যবসার নানা অভিসন্ধি,
- সমাজে জাতপাতে ও বর্নবৈষম্যের ভয়াবহ পরিনতি,
- ঔপনিবেশিক সমাজে নারী শিক্ষা, নারী মুক্তি আন্দোলন সত্ত্বেও, শিক্ষিত পুরুষতান্ত্রিক সমাজে নারীদের অবহেলা, বঞ্চনা ও অসহায়তার নানা দিক,
- পাশ্চাত্য শিক্ষার যান্ত্রিকতা ও তার পরিনতির মর্মান্তিক দিক, সর্বোপরি,
- চরকাকেন্দ্রীক গান্ধিবাদী কংগ্রেসি রাজনীতির অসাড়তা ও তার সমালোচনা।
উপনিবেশ পূর্ব ও ঔপনিবেশিক সমাজ ব্যবস্থার চরিত্রগত প্রভেদ ও পরিবর্তন
আমাদের মাথায় রাখতে হবে, উপনিবেশ পূর্ব ভারতীয় সমাজ ব্যবস্থার সঙ্গে ঔপনিবেশিক সমাজ ব্যবস্থার একটি মৌলিক চরিত্রগত পার্থক্য ছিলো।
একথা ঠিক, দুটি সমাজেই শ্রেনী শোষন ও বঞ্চনার দিক গুলির উপস্থিতি ছিলো। তা সত্ত্বেও, প্রাক্ ঔপনিবেশিক ভারতীয় সমাজ ব্যবস্থায় মানুষের জীবন চর্চা ছিলো সহজ, সরল ও অনাড়ম্বর। সেখানে কোন কৃত্রিমতা ছিলো না। ছিলো না কোন দেখনদারি, আড়ম্বরপ্রিয়তা, চারিত্রিক দ্বিচারিতা, ভন্ডামি, সর্বোপরি ঠক, প্রবঞ্চনার মাধ্যমে অপরের বিশ্বাস বা সম্পদ আত্মসাৎ করবার মতো মানসিকতার বিষয়।
বলা বাহুল্য, ভারতীয় সমাজে এই সবই এসেছিলো ঔপনিবেশিক শাসনের হাত ধরে। এদেশে দীর্ঘ ঔপনিবেশিক শাসনে মানুষের জীবনে অর্থনৈতিক ক্ষেত্রে এক গভীর অনিশ্চয়তা দেখা গিয়েছিলো।
ঔপনিবেশিক শাসনের পূর্ব পর্যন্ত ভারতের অর্থনৈতিক অবস্থা ছিলো যথেষ্টই সুদৃঢ়। নূন্যতম রসদ সহ বেঁচে থাকবার জন্য যেটুকু আর্থিক স্বাচ্ছন্দ্য প্রয়োজন, সেটা সমাজের বেশিরভাগ মানুষেরই ছিলো। অর্থনীতির একটি বড়ো জায়গা জুড়ে ছিলো কৃষি ও কুটির শিল্প। এর ফলে গ্রামীন অর্থনীতি এবং জীবনের ভিত ছিলো যথেষ্ট সচ্ছল। অপরের সম্পদ হরনের মতো শঠতা বা ভন্ডামিকে তখন সমাজের একটি ব্যতিক্রম ঘটনা বলেই মনে করা হতো। কখনই তা সমাজ ব্যবস্থার অন্যতম একটি বৈশিষ্ট্য হয়ে ওঠেনি।
কিন্তু দীর্ঘ ঔপনিবেশিক শাসনের প্রথম পর্বে দেখা গেলো, ভারতের কৃষি এবং কুটির শিল্প দুটোই ধ্বংস হয়ে গেলো। ঔপনিবেশিক অর্থনীতির কুফলের জন্য ভারতের সমৃদ্ধ বর্হিবানিজ্যের ধারাটিও ধীরে ধীরে শুকিয়ে গেলো। বহু রাজন্য বর্গের উচ্ছেদ অথবা অধিনতামূলক মিত্রতা নীতির কুফলের জন্যও দেখা গেলো, বহু দেশীয় সৈনিক কর্মচ্যুত হলেন। ধীরে ধীরে দেশে বৃদ্ধি পেলো বেকারত্ব, দারিদ্রতা, অর্থনৈতিক ক্ষেত্রে অনিশ্চয়তা এবং জীবনের প্রতিটি ক্ষেত্রে শূন্যতা ও অভাববোধের চেতনা।
শেষপর্যন্ত এই অর্থনৈতিক অনিশ্চয়তা কাটানোর জন্য এবং অভাববোধ দূর করবার জন্য ঔপনিবেশিক সমাজে নানা শঠ, প্রবঞ্চক, ভন্ডামি এবং চতুরতার মানসিকতার জন্ম হয়। বিশেষ কিছু শ্রেনী এই অভ্যাসের বশবর্তী হয়ে সমাজে টিকে থাকার চেষ্টা করে অথবা অপরের সম্পদ আত্মসাৎ করে নিজের শ্রীবৃদ্ধি ঘটানোর চেষ্টা করে।
(১.) বক্ ধার্মিকদের শঠতা ও প্রবঞ্চনা
ঔপনিবেশিক আমলে ইংরেজদের ব্যবসা বাণিজ্যের সূত্র ধরে কলকাতা এবং তার পার্শ্ববর্তী অঞ্চলে অর্থের ব্যপক পুঞ্জিভবন ঘটে। হঠাৎ করে এইসব এলাকায় অর্থের আমদানি ও চলাচল বেড়ে যায়। এই অবস্থায় বেশ কিছু মানুষ নানা রকম ছদ্মবেশে ও ভাড়ামির অন্তরালে অপরের সম্পদ আত্মসাৎ এর চেষ্টা চালায়।
গগনেন্দ্রনাথ ঠাকুর তার ব্যঙ্গচিত্রে এরকম কিছু শঠ, প্রবঞ্চক বক্ ধার্মিকদের ছবি তুলে ধরেছিলেন, যারা ছদ্মবেশে বা ভাড়ামির অন্তরালে অপরের সম্পদ আত্মসাৎ করবার চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছিলেন।
গগনেন্দ্রনাথ ঠাকুরের আঁকা "শান্তি জল" এই ধরনেরই একটি ব্যঙ্গচিত্র, যেখানে দেখা যায়, একজন ব্রাহ্মন তার ভক্তদের টাকার বিনিময়ে গঙ্গাজল ছিটিয়ে দিচ্ছেন। তার এক হাতে রয়েছে টাকাদেবীর থলি। ব্রাহ্মন গুরুদেবের মুখটি এখানে রাক্ষসের আদলে দেখিয়ে গগনেন্দ্রনাথ প্রকৃতপক্ষে ধর্মব্যবসার কদর্য রূপটিকেই তুলে আনতে চেয়েছেন।
আরোও একটি ব্যঙ্গচিত্র "অতিভক্তি" তে আমরা দেখতে পাই একটি গাছকে ফুল, মালা পরিয়ে দৈববৃক্ষ বানানো হয়েছে। একজন ভক্ত গাছটিকে প্রনাম করছেন এবং দক্ষিনা দিচ্ছেন। আড়াল থেকে এসবই লক্ষ্য করছিলেন দুজন ভন্ড সাধু।
আসলে ঔপনিবেশিক সমাজে ধর্ম ব্যবসার ফাঁদ তৈরি করে, ধর্মব্যবসায়ীরা আড়ালে থেকে এইরকম ভাবেই অপরের সম্পদ আত্মসাৎ করার নিরন্তর চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছিলেন। বিষয়টি একেবারেই গগনেন্দ্রনাথের নজর এড়িয়ে যায় নি। এসবই ছিলো ঔপনিবেশিক সমাজের নৈতিক অবক্ষয়ের চিত্র।
(২.) সামাজিক দ্বিচারিতা ও নৈতিক অবক্ষয়
ঔপনিবেশিক আমলে অবশ্য নৈতিক অবক্ষয়ের সবথেকে বড়ো কারনটি ছিলো পাশ্চাত্য ইংরেজি শিক্ষা ও সংস্কৃতির প্রভাব। পাশ্চাত্য শিক্ষার প্রসারের সঙ্গে সঙ্গে এদেশে পাশ্চাত্য সংস্কৃতির একাধিক কুফলও মানুষের জীবনে প্রবেশ করেছিলো। এমনই একটি কুফল ছিলো মদ্যপান, নিষিদ্ধ খাদ্য ভক্ষন এবং অন্ধভাবে ইওরোপীয় লাইফস্টাইল কে অনুসরন করার সংস্কৃতি।
তবে সরল ও স্বাভাবিক ভাবে এইসব বিদেশী সংস্কৃতির অনুসরনের থেকেও গগনেন্দ্রনাথকে সবথেকে বেশি বিস্মিত করেছিলো, এই বিষয় গুলি নিয়ে সমাজের বিশেষ কিছু শ্রেনীর প্রকাশ্যে দ্বিচারিতা এবং অন্তরালে অস্বাভাবিক ভাবে বিষয় গুলিকে অনুসরন করা।
গগনেন্দ্রনাথ একবার স্পেন্সেস হোটেলে গিয়ে দেখেন, পর্দার আড়ালে একদল রক্ষণশীল ব্রাহ্মন নিষিদ্ধ খাবার খাচ্ছেন। পরে এই বাস্তব চিত্রটিকে তিনি তার আঁকা এক ব্যঙ্গচিত্রে ফুটিয়ে তুলেছিলেন।
১৯২৫ খ্রিঃ বার্ষিক বসুমতিতে প্রকাশিত হয় গগনেন্দ্রনাথের একটি ব্যঙ্গচিত্র - "অন্তরালে যৎকিঞ্চিত" । এই ব্যঙ্গচিত্রে দেখা যায়, দেশীয় রাজা, টিকিধারী ব্রাহ্মন, এক সাহেবি হোটেলে গিয়ে মাটন ভক্ষনে ব্যস্ত। ওখানেই আবার জমিদার বাবুটি মদ্যপানে একেবারে বেসামাল হয়ে গেছেন।
"খল ব্রাহ্মন" ব্যঙ্গচিত্রটি সমাজের নৈতিক অধঃপতন ও দ্বিচারিতার আরেকটি কোলাজ। এই ব্যঙ্গচিত্রে দেখা যায় একজন ব্রাহ্মন তার শিষ্যের বাড়িতে গিয়ে ভোজনে ব্যস্ত। পুঁথি ছেড়ে তিনি রক্ষিতা ও মদ্যপান নিয়েই বেশি ব্যস্ত। এখানে ব্রাহ্মনের মুখের আদলটি রাক্ষসের মতো এঁকে গগনেন্দ্রনাথ আপাত সাধু মানুষের আড়ালে সমাজের অসাধুতার কদর্য রূপটিকে তীব্র ব্যঙ্গ রসে বিদ্ধ করেছিলেন।
(৩.) অন্ধ অনুকরন প্রিয়তা ও সাহেবি কালচার
মনে রাখতে হবে, বহু ধর্ম, জাতি, সংস্কৃতি ও ভাষাভাষির এই বিচিত্র দেশে ঔপনিবেশিক শাসনের প্রথম পর্বে ইংরেজরা ছিলো অনেকটাই অসহায় ও নির্বান্ধব। ফলতঃ ঔপনিবেশিক শাসনকে সুস্থিতভাবে পরিচালনা করবার জন্য তারা এদেশে একদল অনুগামী অনুচর শ্রেনী তৈরি করেন। যারা ঔপনিবেশিক অর্থ ব্যবস্থা থেকেই তাদের বেঁচে থাকার রসদ সংগ্রহ করতে থাকেন।
ইংরেজদের ব্যবসায় সাহায্যের জন্য যেমন মাঝখানের একদল দালাল, জমিদার বা ফঁড়ে তৈরি হয়েছিলো, তেমনই প্রশাসনে সাহায্য করবার জন্য ইংরেজি শিক্ষিত একদল কেরানি বা চাকুরে মধ্যবিত্ত "বাবু" শ্রেনীর জন্ম হয়েছিলো। যারা রক্তে ভারতীয় হলেও, ধনে মানে, বশে বেশে, হাবে ভাবে হয়ে পড়েছিলেন আদ্যান্ত দেশীয় সাহেব।
গগনেন্দ্রনাথ শিক্ষিত বাবু শ্রেনীর সাহেব সাজার এই হাস্যকর ও বেমানান বিষয়টি নিয়ে একাধিক ব্যঙ্গচিত্র এঁকেছিলেন। "সর্বাঙ্গের অস্রুপাত" এমনই একটি ব্যঙ্গচিত্র, যেখানে এক বাঙালি বাবু কালো কোর্ট প্যান্ট পড়ে ঘেমে নেয়ে একাকার। একজন ইংরেজ রেলকর্মচারী পতাকা নিয়ে সিগন্যাল দিচ্ছেন। বাঙালি বাবুটির অনেক সাধ, ইংরেজ কর্মচারিটি তাকে সাহেব বলে ডাকুন। কিন্তু ইংরেজ কর্মচারী টি বাঙালি বাবুটি কে বাবু বলেই ডাকেন। বেচারা বাঙালি বাবুটির তাই শুনে সর্বাঙ্গে হচ্ছে ঘামের অশ্রুপাত।
"প্রনাম বিভ্রাট" গগনেন্দ্রনাথ ঠাকুরের আঁকা এইধরনেরই একটি ব্যঙ্গচিত্র, যেখানে দুজন বাঙালি বাবু কোর্ট প্যান্ট, টুপি ও চুরুট নিয়ে মন্দির দর্শন করছেন। এদেরই একজন নতমস্তক হওয়ার বদলে মাথার টুপি আলতো করে উপরে তুলে ভগবানকে শ্রদ্ধা নিবেদন করছেন।
"শংকর জাতের বাঙালি" বলে এক ব্যঙ্গচিত্রে দেখা যায়, হাফ কোর্ট প্যান্ট জুতো এবং হাফ ধুতিশাল পরিহিত এক শংকর বাঙালি চিনামাটির একটি পাত্রের ওপর দাড়িয়ে আছেন। যা যে কোন সময়ে ভেঙ্গে পড়তে পারে। যার ভিত আলগা, ঠুনকো এবং ক্ষনস্থায়ী।
"Find the Indian" ব্যঙ্গচিত্রটিতে ইওরোপীয় ক্লাবের সদস্য পদ পাবার জন্য সাহেবি পোশাকে সজ্জিত বাঙালি বাবুদের ব্যগ্রতাকে গগনেন্দ্রনাথ তীব্র ব্যঙ্গ রসে বিদ্ধ করেছিলেন।
"পুচ্ছ পরিবর্তন" এই ধরনেরই একটি কার্টুন। যেখানে একজন কালো ভারতীয় সাদা সাহেবের মতো উকিল সাজার চেষ্টা করেছেন। উকিলের মুখের আদলটি কাকের মতো। বিষয়টা অনেকটা কাক হয়ে ময়ূর সাজার মতো।
গগনেন্দ্রনাথ ঠাকুরের আঁকা আরোও এক ব্যঙ্গচিত্র "রুপান্তরে" দেখা যায়, এক বাঙালি বাবু টিকিট পরীক্ষকের হাত থেকে বাঁচতে তড়িঘড়ি করে কোর্ট প্যান্ট পড়ে সাহেব সাজার চেষ্টা চালাচ্ছেন। অন্য আরেকটি ব্যঙ্গচিত্রে এক বাঙালি রমনী শাড়ি আর হিল জুতো পড়ে এক বাঙালি সাহেবের সঙ্গে নৃত্য করছেন।
আসলে বাঙালিদের অন্ধ ইংরেজ অনুকরনের ব্যঙ্গচিত্র গুলিতে গগনেন্দ্রনাথ বারে বারে বোঝাতে চেয়েছেন, অন্ধভাবে বিদেশীদের অনুকরন করে বা তাদের অভ্যাস গুলি আয়ত্ত্ব করে কখনই আধুনিক হয়ে ওঠা যায় না। বিদেশী ভাষা, চিন্তা ভাবনা গুলি আত্মস্থ করে, বিদেশী সংস্কৃতিতে মস্তিষ্ক ভরাট করে বা তার দ্বারা পরিচালিত হয়ে অথবা তাকে অন্ধভাবে অনুকরন করে কখনই আধুনিক হয়ে ওঠা যায় না।
গগনেন্দ্রনাথের মতে, আধুনিকতার নামে বিদেশীদের অন্ধ অনুকরন চিন্তার দৈনতা ছাড়া আর কিছুই নয়। উনিশ এবং কুড়ি শতকে ঔপনিবেশিক সমাজ ব্যবস্থায় শিক্ষিত শ্রেনীর মধ্যে চিন্তার এই দৈনতা বড়োই প্রকট হয়ে দেখা দিয়েছিলো।
(৪.) নারী সমাজের অসহায়তার ছবি
নারী শিক্ষা এবং নারী মুক্তি আন্দোলন ছিলো ঔপনিবেশিক সমাজ ব্যবস্থার একটি অন্যতম বৈশিষ্ট্য। কিন্তু এই প্রগতিশীল আন্দোলন সত্ত্বেও পুরুষতান্ত্রিক সমাজে নারীদের প্রতি অবহেলা, বঞ্চনা ও অসহায়তার দিক গুলো তখনও একইরকম ভাবে বজায় ছিলো। নারী সমাজের নানা অসহায়তার দিক গুলি নিয়ে গগনেন্দ্রনাথ একাধিক ব্যঙ্গচিত্র এঁকেছিলেন।
তার আঁকা এইরকমই এক ব্যঙ্গচিত্রে দেখা যায়, এক মস্ত ভুড়িওয়ালা বাবু সিগারেট খেতে খেতে বাবুর চালে চলেছেন। তার পিছনে স্ত্রীলোকটি বাক্স, বেডিং আর ছেলে মেয়ে নিয়ে স্বামীকে অসহায় ভাবে অনুসরন করে এগিয়ে চলেছেন। অন্য আরেক চিত্রে গগনেন্দ্রনাথ একাদশী তিথিতে এক বিধবার নির্জলা উপাবাস অন্যদিকে ব্রাহ্মনদের ভুড়িভোজের ছবি পাশাপাশি ফুটিয়ে তুলেছিলেন।
গগনেন্দ্রনাথের আঁকা আরেকটি ব্যঙ্গচিত্রে দেখা যায়, এক বর্ষনমুখর দিনে একটি বাঙালি বাবু ছাতা ও কুকুর নিয়ে বাড়ির উদ্দেশে যাত্রা করছেন। পিছনে তার স্ত্রী শিশু সহ প্রবল বৃষ্টিতে ভিজতে ভিজতে স্বামীকে অনুসরন করছেন।
(৫.) জাতপাত ও বর্নবৈষম্যবাদের সমালোচনা
ঔপনিবেশিক সমাজে জাতপাত ও বর্নবৈষম্য নিয়েও গগনেন্দ্রনাথ একাধিক ব্যঙ্গচিত্র এঁকেছিলেন। "জাঁতাসুর" তার আঁকা এমনই একটি ছবি, যেখানে দেখা যায় - এক মুন্ডিত মস্তকের ব্রাহ্মন জাঁতার ওপর বসে হোম যজ্ঞ করছেন। জাঁতাটি ঘোরাচ্ছে হাস্যরত এক কঙ্কাল, আর তাতে পিষে মারা যাচ্ছে সমাজের নিন্মবর্গের মানুষেরা।
ব্যঙ্গচিত্রটিতে গগনেন্দ্রনাথ ঠাকুর দেখিয়েছেন, ভারতে জাতপাতের সবথেকে বড়ো সমর্থক হলেন, জাতি ব্যবস্থার শীর্ষে থাকা ব্রাহ্মনরা।
আচার্য প্রফুল্ল চন্দ্র রায়কে নিয়ে এমনই এক ব্যঙ্গচিত্র গগনেন্দ্রনাথ এঁকেছিলেন, যেখানে রসায়নের যুগান্তকারী সব আবিষ্কার সত্ত্বেও প্রফুল্ল চন্দ্র কিছুতেই সমাজের জাতপাতের কালি মুছতে পারছেন না।
(৬.) ঔপনিবেশিক যান্ত্রিক শিক্ষা ব্যবস্থা
ঔপনিবেশিক আমলের শিক্ষা ব্যবস্থার যান্ত্রিকতাকেও গগনেন্দ্রনাথ তীব্র ব্যঙ্গ রসে বিদ্ধ করেছিলেন। এক্ষেত্রে তার "বিদ্যার কারখানা" ছিলো, এমনই এক ব্যঙ্গচিত্র। এই ব্যঙ্গচিত্রটিতে বিদ্যালয়কে একটি কারখানার আদলে আঁকা হয়। সময় ধরে এই কারখানায় ছাত্ররা প্রবেশ করে এবং বইয়ে পিষে চ্যাপ্টা ও বিকলঙ্গ হয়ে বেরিয়ে আসে।
আসলে এই ছবিটির মধ্য দিয়ে গগনেন্দ্রনাথ ঠাকুর মুখস্ত নির্ভর শিক্ষা ব্যবস্থার অর্ন্তসারশূন্যতাকে তীব্র ব্যঙ্গ রসে কটাক্ষ করেছিলেন।
(৭.) কংগ্রেসি রাজনীতির অসাড়তা ও তার ফলাফল
গগনেন্দ্রনাথ গান্ধীবাদী কংগ্রেসি রাজনীতির অসাড়তার দিক গুলিকে নিয়েও ব্যঙ্গচিত্র আঁকেন। তার আঁকা এক ব্যঙ্গচিত্রে দেখা যায়, পৃথিবীর সব কিছু ধ্বংস হয়ে গেলেও চরকা দিব্যি উড়ে বেরাচ্ছে। আরেকটি ব্যঙ্গচিত্রে দেখা যায়, অসহযোগ আন্দোলন শুরু হলে চিওরঞ্জন দাশ ছাত্রদের স্কুল কলেজ বয়কটের ডাক দেন। ব্যঙ্গচিত্রে তিনি চুরুট ধরাবার জন্য এক ছাত্রকে বই গুলিতে আগুন লাগাতে প্ররোচিত করছেন।
"বিশ্ববিদ্যালয়ে অগ্নিযোগ" এই ধরনেরই আরেকটি ব্যঙ্গচিত্র, যেখানে স্যার আশুতোষ বিখ্যাত ভিমনাগের মিষ্টির হাড়িকে ব্যবহার করে ছাত্রদের বয়কট ঠেকানোর চেষ্টা করছেন।
"জগদীশের ধ্যানভঙ্গ" কার্টুনটিতে দেখা যায়, বাঁশ গুলি চাঁদা চাইছে, লজ্জাবতী শেম শেম ধ্বনি তুলছে। পদ্মফুল বন্দেমাতারম ধ্বনি দিচ্ছে। আর এসব হৈ হট্টগোলে জগদীশের ধ্যান ভেঙে যাচ্ছে, অর্থাৎ বিজ্ঞান সাধনায় বিঘ্ন ঘটছে।
আসলে এইসব ব্যঙ্গচিত্র গুলির মধ্য দিয়ে গগনেন্দ্রনাথ ঠাকুর কংগ্রেসের হৈ হট্টগোল ভিত্তিক অর্ন্তসারশূন্যতার রাজনীতিকে প্রবলভাবে কটাক্ষ করেছিলেন।