অবনীন্দ্রনাথ ঠাকুরের "ভারতমাতা" চিত্র

উনিশ এবং কুড়ি শতকে ভারতে শিল্পকলা এবং চিত্রের মাধ্যমেও জাতীয়তাবাদের প্রসার ঘটেছিলো। অবনীন্দ্রনাথ ঠাকুরের আঁকা "ভারতমাতা" ছিলো এই সময়ে আঁকা এমনই একটি ছবি। এই ছবিটি ইতিহাসে মূলত দুটি কারনে স্মরণীয় -

  • এই ছবিটির মধ্য দিয়েই প্রথম ভারতকে মা হিসাবে কল্পনা করে তার একটি রূপক চিত্র অঙ্কন করা হয়েছিলো। এবং
  • এই ছবিটির মধ্য দিয়েই প্রথম ভারতীয় বিমূর্ত (অব্যক্ত) জাতীয়তাবাদের ধারনাকে মূর্ত (দৃশ্যমান ) করে তোলার চেষ্টা করা হয়েছিলো। 

ভারতমাতা চিত্রের প্রেক্ষাপট

এ প্রসঙ্গে বলে রাখা প্রয়োজন, উনিশ শতকের মধ্যভাগ থেকেই ভারতে জাতীয়তাবাদের concept বা ধারনা তৈরি হচ্ছিলো। সংস্কৃত সাহিত্যে বহু আগে থেকেই দেশকে জননী রূপে অভিহিত করা হয়েছিলো। সংস্কৃত "ভারতাম্বা" শব্দটি থেকেই ভারতমাতা শব্দটির উৎপত্তি হয়েছিলো। সংস্কৃতে মা কে "অম্বা" বলে অভিহিত করা হয়েছিলো। 

উনিশ শতকের দ্বিতীয়ার্ধের পর থেকেই ভারতীয় বুদ্ধিজীবীরা মাতৃত্বের আবেগকে জাতীয়তাবাদের সঙ্গে মিশিয়ে দিতে শুরু করেন। ১৮৭৩ খ্রিঃ কিরনচন্দ্র বন্দ্যোপাধ্যায়" ভারতমাতা" নামে একটি নাটক মঞ্চস্থ করেন, যা মানুষের মনে প্রবল আবেগের সঞ্চার করে। 

এর কয়েকবছর পর ১৮৮২ খ্রিঃ বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায় "বন্দেমাতারম" গান রচনা করেন। এই গানের মধ্যে বঙ্কিম স্বদেশের একটি মূর্তিমান জননী রূপ তুলে ধরেন। বঙ্কিমের ভাবগত, বিমূর্ত জননী রূপের ধারনাটিকেই অবনীন্দ্রনাথ ঠাকুর ভারতমাতা চিত্রের মধ্য দিয়ে সহজবোধ্য, বোধগম্য, এবং দৃশ্যমান করে তোলেন। এর ফলে জাতীয়তাবাদের আবেগ সর্বসাধারনের কাছে আরোও সহজ ও বোধগম্য হয়ে যায়।

ভারতমাতা চিত্রটি অবনীন্দ্রনাথ ঠাকুর স্বদেশী আন্দোলনের প্রেক্ষাপটে এঁকেছিলেন বলে জানা যায়। ১৯০৫ খ্রিঃ লর্ড কার্জন বঙ্গভঙ্গ করলে স্বদেশী আন্দোলন শুরু হয়। এই সময় যে জাতীয়তাবাদী আবেগের স্ফুরন দেখা যায়, সেই প্রেক্ষাপটেই অবনীন্দ্রনাথ ঠাকুর ভারতমাতা আঁকেন বলে জানা যায় । অবনীন্দ্রনাথ নিজেই এ প্রসঙ্গে এক ঘরোয়া স্মৃতিচারনায় বলেছিলেন - 

স্বদেশী আন্দোলনের সময় দেখলাম সবাই দেশের হুজুগে মেতে উঠছে। ঠিক সেই সময়েই আমি এঁকে ফেললাম ভারতমাতার এই ছবি। (সূত্র :আনন্দবাজার পত্রিকা) 

কোন সময়ে আঁকা হয় "ভারতমাতা" ? 

ভারতমাতা ছবিটি ঠিক কবে আঁকা হয়েছিলো, তা সঠিক ভাবে জানা না গেলেও, প্রখ্যাত চিত্র বিশ্লেষণ বিনোদবিহারী মুখোপাধ্যায় মনে করেন ১৯০৩ থেকে ১৯০৫ এর কোন এক সময়ে অবনীন্দ্রনাথ ভারতমাতা আঁকেন। এর পেছনে তিনি একটি যুক্তিও দিয়েছেন।

 তার মতে ভারতমাতা ছবিটি জাপানি জলরঙের প্রকরনে আঁকা। ১৯০২ খ্রিঃ প্রখ্যাত জাপানি শিল্পী ওকাকুরা ভারতে আসবার পর এই চিত্র শৈলীর সূচনা ঘটে। ওকাকুরা দেশে ফিরে গিয়ে তাইকানহিসিদা নামে দুজন জাপানি শিল্পীকে ১৯০৩ খ্রিঃ কলকাতায় পাঠান। তাদের কাছ থেকেই অবনীন্দ্রনাথ জাপানি জলরঙের প্রকরন শৈলী শিখেছিলেন। অর্থাৎ তার মতে ভারতমাতা ছবিটি কোনভাবেই ১৯০৩ খ্রিঃ আগে আঁকা সম্ভব নয়। 

নামকরন :"বঙ্গমাতা" থেকে "ভারতমাতা" 

শুরুর দিকে অবশ্য ভারতমাতা চিত্রটি এই নামে পরিচিত ছিলো না। ছবিটির নাম ছিলো "বঙ্গমাতা"। পরে ছবিটির গুনগ্রাহী ভগিনী নিবেদিতা এর নামকরন করেছিলেন "ভারতমাতা"। এর পর থেকে ছবিটি এই নামেই ভারতবিখ্যাত হয়ে ওঠে। 

ভারতমাতার রূপ বিশ্লেষন ও বৈশিষ্ট্য 

ভারতমাতা চিত্রটির বেশ কিছু বৈশিষ্ট্য লক্ষ্য করা যায়, যা এর রূপ ভাবনায় প্রতিফলিত হয়েছিলো। 

(১.) ছবিটির প্রধান বৈশিষ্ট্য হলো এটি জাপানী জলরঙের প্রকরন আঁকা। 

অবনীন্দ্রনাথ ঠাকুরের ভারতমাতা চিত্র
ভারতমাতার প্রতীক চিত্র 


(২.) ছবিটিতে একজন সাধারন নারী গেরুয়া পোশাক পরিহিত। তিনি চর্তুভূজা। তার চারটি হাতের একটিতে রয়েছে সাদা কাপড়, যা তাঁত বস্ত্রের প্রতীক। তার অপর হাতে রয়েছে পুঁথি, যা জ্ঞান বা শিক্ষার প্রতীক। আরেকটি হাতে রয়েছে ধানের শিষ, যা অন্নের প্রতীক, কৃষির প্রতীক বা আত্মনির্ভরতার প্রতীক। অন্যহাতে রয়েছে কন্ঠীমালা, যা সাধনা বা ধ্যানের প্রতীক। 

প্রসঙ্গত বলে রাখা প্রয়োজন, বঙ্গভঙ্গের প্রতিবাদে ১৯০৫ খ্রিঃ যে স্বদেশী আন্দোলন শুরু হয়েছিলো, তার ৩ টি ধারা ছিলো - 
  • বয়কট অর্থাৎ বিদেশী সব কিছুকে বর্জন করা। 
  • স্বদেশী অর্থাৎ দেশীয় জিনিসপত্রের উৎপাদন ও ব্যবহার করা অর্থাৎ স্বনির্ভর হয়ে ওঠা। এবং
  • জাতীয় শিক্ষা। 
স্বদেশী আন্দোলনের মূল "স্বদেশী" ভাবনাটি অর্থাৎ আত্মনির্ভরতার মন্ত্রটি ভারতমাতা চিত্রের মাধ্যমে প্রতিফলিত হয়েছিলো। এখানে বলা প্রয়োজন, ভারতমাতা চিত্রের চারটি হাতের চারটি প্রতীক অর্থাৎ তাঁতবস্ত্র, ধানের শিষ, পুঁথি এবং কন্ঠীমালা ছিলো স্বদেশী ভাবনার প্রতীক।

 অন্ন, বস্ত্র, শিক্ষা এবং সাধনার মাধ্যমেই "ব্যক্তি ও দেশ," তার সমস্ত পরনির্ভরশীলতা দূর করে প্রকৃত অর্থে আত্মনির্ভর ও স্বাধীন হয়ে উঠতে পারে, এই চিরন্তন সত্যের ভাবনাটিকেই ভারতমাতা ছবিটির তুলে ধরেছিলো। 

(৩.) ছবিটির আরেকটি বৈশিষ্ট্য হচ্ছে, ছবিটির মুখাবয়ব যদি আমরা ভালো করে দেখি, তাহলে দেখবো, মুখাবয়ব অদ্ভুদ রকমের শান্ত, যা শান্তির প্রতীক

 ভারতের ঐতিহ্যের একটি বিশেষ দিক হলো শান্তিপ্রিয়তা।ভারত চিরকাল শান্তির কথাই বলে এসেছে। যুগে যুগে, কালে কালে বিভিন্ন বিদেশি জনজাতি ভারতকে আক্রমণ করেছে। লুন্ঠন করেছে। অত্যাচার করেছে। তা সত্ত্বেও, ভারতমাতা নির্বিকার। তার মুখে অদ্ভুতরকম প্রশান্তি, যা শান্তির কথাই তুলে ধরে।

(৪.) ভারতমাতা চিত্রটির আরেকটি বিশেষ দিক হলো, ভারতমাতা গেরুয়া বসন পরিহিত, যা ত্যাগের প্রতীক। সনাতন ভারতবর্ষের ঐতিহ্যের একটি বিশেষ দিক ছিলো ত্যাগ। গেরুয়া বসন পরিহিত ভারতমাতা যেন এই ত্যাগেরই প্রতিমূর্তি ছিলেন। 

(৫.) ভারতমাতা চিত্রটি গভীরভাবে বিশ্লেষন করলে ছবিটিতে বাস্তবের সাথে কল্পনার একটি সংমিশ্রন লক্ষ্য করা যায়। সাধারন নারী হলো বাস্তব, কিন্তু তার চার হাত হলো কাল্পনিক। তাতে মাহাত্ম্য যোগ হয়েছে মাথার পেছনে জ্যোতি। 

অর্থাৎ এই ছবিটিতে সাধারন নারী মূর্তিতে দেবত্ব আরোপ করা হয়েছে। ভারতের মাটিতে বহু সাধারন মানুষ তার মহত্বের গুনে
দেবতা হয়ে ওঠেন। উপনিষদ বলা হয়েছিলো,সাধারন মানুষের মধ্যেই রয়েছে ঈশ্বরের উপস্থিতি। ভারতমাতা চিত্রটি যেন এই পরম সত্যকে তুলে ধরে সনাতন ভারতের মূল দর্শনকেই মেলে ধরেছিলো। 

এইভাবে দেখা যায়, সনাতন ভারতের ঐতিহ্য, এবং সংস্কৃতির মূল ভাবনাটি অত্যন্ত সুনিপুন ভাবে ভারতমাতা ছবিটিতে তুলে ধরা হয়েছিলো। এইজন্য সমকালীন সময়ে তো বটেই, পরবর্তীকালেও, এই ছবিটি ভারতীয় জাতীয়তাবাদের প্রতীক হয়ে উঠেছিলো। এমনকি বর্তমান কালেও ছবিটি তার প্রাসঙ্গিকতা হারায় নি। 

ভারতমাতা চিত্রের ঐতিহাসিক গুরুত্ব 

ভারতমাতা চিত্রটির একাধিক ঐতিহাসিক গুরুত্ব রয়েছে - 
  1. ভারতমাতা ছবিটির মধ্য দিয়ে বিমূর্ত অর্থাৎ অদৃশ্য জাতীয়তাবাদের ধারনা মূর্ত অর্থাৎ দৃশ্যমান হয়ে উঠেছিলো। 
  2. ছবিটির মধ্য দিয়ে স্বদেশী আন্দোলনের "আত্মনির্ভরশীলতার ভাবধারা" এবং "সনাতন ভারতের ঐতিহ্যের রূপটিকে" একত্রিত করে ফুটিয়ে তোলা হয়েছিলো। 
  3. স্বদেশী আন্দোলনে ছবিটি জাতীয়তাবাদের প্রসারে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা নিয়েছিলো।
  4. স্বদেশী আন্দোলনের সমস্ত সভা সমিতিতে ছবিটি ব্যবহার করা হতো। জাপানী শিল্পি টাইকান এই ছবিটি দিয়ে জাতীয় পতাকা তৈরি করেন। এই পতাকা দিয়েই স্বদেশী আন্দোলন দুর্বার হয়ে উঠেছিলো। 
  5. ভারতের অন্যান্য জাতীয় আন্দোলনেও ছবিটি ব্যবহার করা হয়েছিলো। বিপ্লবী ও স্বাধীনতা সংগ্রামীদের কাছে ভারতমাতা ছিলেন প্রেরনার প্রতিমূর্তি। 
  6. ছবিটি হিন্দু জাতীয়তাবাদের বিবর্তনকেও বহুলাংশে ত্বরান্বিত করেছিলো।
  7. এই ছবিটি ছিলো ভারতীয় চিত্রকলার বেঙ্গল স্কুল ঘরানার বা ওরিয়েন্টাল আর্টের একটি শ্রেষ্ঠ নিদর্শন। 

সমালোচনা 

ভারতমাতা চিত্রটিকে নিয়ে অনেকেই পরবর্তীকালে সমালোচনা করেছিলেন। এই ছবিটির বিরুদ্ধে মূল অভিযোগ ছিলো দুটি - 
  • বহু ধর্ম ও জাতির দেশে ভারতমাতা কেন হবেন একজন হিন্দু দেবী? 
  • বহু ধর্ম, জাতি ও সংস্কৃতির দেশে ভারতীয় জাতীয়তাবাদের প্রতিনিধিত্বই বা কেন একজন হিন্দু দেবী করবেন? 
তবে সমালোচনা যাই হোক না কেন, তা দিয়ে কিন্তু ছবিটির ঐতিহাসিকত্ব এবং ভারতীয় জাতীয়তাবাদে প্রভাবের দিকটি কে কখনই অস্বীকার করা যায় না। 
 

2 Comments

  1. Thank you so much sir/mam ei lekha ta sotti khub e osadahron , Ei lekha ta hocche black diamond ja diamond er thekeo rare . Amar school a project ei bishoi niei tai ami google a khujjilam , kintu seguli khubi choto and tader quality khubi kom .tai thank you ei rokom blog jonno , keep Growing my blogger, ar apni Sandeep Maheshwari k dekhen?

    ReplyDelete
Post a Comment
Previous Post Next Post