ইতিহাস চর্চায় Oral Traditions বা মৌখিক ঐতিহ্য

আধুনিক ইতিহাস চর্চার অলিখিত মৌখিক উপাদানের অন্যতম একটি ভাগ হল "Oral Traditions বা মৌখিক ঐতিহ্য

ইতিহাস চর্চায় Oral Traditions বা মৌখিক ঐতিহ্য
ইতিহাস চর্চায় মৌখিক ঐতিহ্য 


মৌখিক ঐতিহ্যের ধারনা 

মৌখিক ঐতিহ্য হলো একধরনের সাংস্কৃতিক ঐতিহ্য যা প্রজন্ম পরম্পরায় মানুষের মুখে মুখে প্রচারিত হয়।

অতীতের যেকোন গুরুত্বপূর্ণ ঘটনাই হোক না কেন, তার বিভিন্ন স্মৃতি ও বিবরন কিছুদিন মানুষের মুখে মুখে প্রচারিত হয়। এই স্মৃতি এবং বিবরন গুলো এক প্রজন্ম থেকে আরেক প্রজন্মে ছড়িয়ে যায়। এগুলিকেই মৌখিক ঐতিহ্য বলা হয়।

  • মৌখিক ঐতিহ্যের মধ্যে যেমন গুরুত্বপূর্ণ কোন ঘটনার বিবরন পড়ে, তেমনই,
  • গান, বক্তিতা, স্মৃতিচারণ, এগুলিও পড়ে।

মৌখিক ঐতিহ্যের সংজ্ঞা 

অডিও টেপ বা রেকর্ডের মাধ্যমে কোন গুরুত্বপূর্ণ ঘটনা, কোন ব্যক্তি, পরিবার বা স্থানীয় এলাকা সম্পর্কে অভিজ্ঞ কোন ব্যক্তির কাছ থেকে সাক্ষাৎকারের মাধ্যমে তথ্য সংগ্রহ এবং চর্চার বিষয়টিই সাধারনত "মৌখিক ঐতিহ্য" বা "মৌখিক ইতিহাস" নামে পরিচিত।

মৌখিক ঐতিহ্যের উদ্ভব ও সূচনা

মৌখিক ঐতিহ্য নতুন কোন বিষয় নয়। হেরোডোটাস মৌখিক ঐতিহ্য অর্থাৎ প্রত্যক্ষদর্শীদের সাক্ষাৎকারের মাধ্যমে তথ্য সংগ্রহ করেই গ্রিসের ইতিহাস লিখেছিলেন। নীল বিদ্রোহের ইতিহাস রচনা করার ক্ষেত্রেও মৌখিক ঐতিহ্য অনুসরন করা হয়েছিলো। এমনকি দাঙ্গার ইতিহাস, উদ্বাস্তু সমস্যার ইতিহাসের ক্ষেত্রেও মৌখিক ঐতিহ্য বা সাক্ষাৎকারের মাধ্যমেই তথ্য সংগ্রহ করা হয়। 

তবে মৌখিক ঐতিহ্যের আধুনিক ধারনার সূত্রপাত ঘটে ১৯৪০ দশকে। মৌখিক ঐতিহ্যের আধুনিক ধারনায় অডিও টেপ বা রেকর্ডের মাধ্যমে সাক্ষাৎকারের বিবরনকে সংরক্ষণ করে রাখা হয়। কলম্বিয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের অ্যালান নেভিনস মৌখিক ঐতিহ্যের আধুনিক ধারনার সূত্রপাত করেন।

পরবর্তীকালে  বিভিন্ন দেশে মৌখিক ইতিহাস চর্চার নানা প্রতিষ্ঠান গড়ে ওঠে। ১৯৬৬ খ্রিঃ আমেরিকাতে প্রতিষ্ঠিত হয় "ওরাল হিস্ট্রি অ্যাসোসিয়েশন"। ব্রিটেনে ১৯৬৯ খ্রিঃ মৌখিক ইতিহাস চর্চার জন্য গড়ে তোলা হয় "ওরাল হিস্ট্রি সোসাইটি"। 

বিংশ শতাব্দীর শেষের দিকে মৌখিক ঐতিহ্য আধুনিক ইতিহাস চর্চার একটি শাখা হিসাবে স্বীকৃতি লাভ করে। 

মৌখিক ঐতিহ্যের বৈশিষ্ট্য 

মৌখিক ঐতিহ্যের প্রধান বৈশিষ্ট্য গুলি হল - 
  1. মৌখিক ঐতিহ্য হল অলিখিত ইতিহাসেরই একটি ভাগ। 
  2. এখানে সাক্ষাৎকারের মাধ্যমে তথ্য সংগ্রহ করা হয়। 
  3. আধুনিক কালে মৌখিক ঐতিহ্যের ক্ষেত্রে অডিও টেপ বা রেকর্ডের মাধ্যমে তথ্য সংগ্রহ করা হয়ে থাকে। 
  4. মৌখিক ঐতিহ্যে যান্ত্রিক মাধ্যমে তথ্য সংগ্রহ করবার পর তাকে যত্ন সহকারে সংরক্ষণ করা হয়। 
  5. ঘটনার সঙ্গে প্রত্যক্ষ যোগ আছে, এমন ব্যক্তিদের কাছ থেকেই এখানে সাক্ষাৎকারের মাধ্যমে তথ্য সংগ্রহ করা হয়। 

মৌখিক ঐতিহ্যের উদাহরন 

কোন ঐতিহাসিক ঘটনার সঙ্গে জড়িত প্রত্যক্ষদর্শীদের যেকোন সাক্ষাৎকারই মৌখিক ঐতিহ্যের উদাহরন হতে হবে। যেমন - 
  • ১৯৬৯ খ্রিঃ শৈলেশ দে কলকাতায় লেক গার্ডেন এর একটি বাড়িতে কয়েকজন পদস্থ ব্যক্তির সহযোগিতায় শিবলাল ডোমের সাক্ষাৎকার নিয়েছিলেন। শিবলাল ডোম বিপ্লবী সূর্য সেনকে ফাঁসি দিয়েছিলেন। কিভাবে সূর্য সেনকে ফাঁসি দেওয়া হয়েছিলো, সেই সম্পর্কে তথ্য সংগ্রহ করা হয়। এটি হল মৌখিক ঐতিহ্যের বা ইতিহাসের একটি উদাহরণ। 
  • বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের সময় পাক বাহিনী কিভাবে বাংলাদেশীদের ওপর বর্বর অত্যাচার চালিয়েছিলো, সে সম্পর্কে প্রত্যক্ষদর্শীদের কাছ থেকে অথবা ঐ ঘটনায় ভুক্তভোগীদের কাছ থেকে তথ্য সংগ্রহ করা হয়। এটি হল মৌখিক ঐতিহ্যের উদাহরন।
  • একই ভাবে, হিটলারের নাৎসি বাহিনীর বন্দী বিভিন্ন  ব্যক্তিদের সাক্ষাৎকার নিয়ে নাৎসি বাহিনীর ইহুদী নিধনের যে ভয়ঙ্কর ইতিহাস তুলে ধরা হয়েছিলো, তা মৌখিক ইতিহাস বা ঐতিহ্যের উদাহরন।
  • দেশভাগের পর যারা পূর্ব পাকিস্তান থেকে ভারতে চলে আসেন, তাদের অনেকের সাক্ষাৎকার নিয়েই বোঝা গিয়েছিলো, দেশভাগের মানসিক ক্ষত এবং যন্ত্রণা কতখানি বেদনাদায়ক ছিলো।সাক্ষাৎকারের মাধ্যমে দেশভাগের এই মনস্তাত্ত্বিক প্রভাবের সংকলনও মৌখিক ঐতিহ্য বা ইতিহাসের উদাহরন হতে পারে। 

মৌখিক ঐতিহ্যের গুরুত্ব 

ইতিহাসের উপাদান হিসাবে মৌখিক ঐতিহ্যের প্রধান গুরুত্ব ৩ টি। যেমন - 

(১.) ইতিহাসের প্রাথমিক উপাদান 

মৌখিক ঐতিহ্য হল ইতিহাসের একটি প্রাথমিক উপাদানের উৎস। কোন ঘটনার সঙ্গে যুক্ত প্রত্যক্ষদর্শী ব্যক্তিরাই হলেন ইতিহাসের primary বা প্রাথমিক উপাদানের source। এই সকল ব্যক্তিরা ঘটনার সঙ্গে প্রত্যক্ষ ভাবে জড়িত থাকেন বলে তাদের সাক্ষ্য অন্যান্য উপাদানের থেকে অনেক বেশি নির্ভরযোগ্য বলে বিবেচিত হয়। 

(২.) নিন্মবর্গের ইতিহাস রচনা

সমাজে প্রান্তিক মানুষদের জীবন সংগ্রামের তথ্য সেভাবে নথিভুক্ত থাকে না। তাই প্রান্তিক মানুষদের ইতিহাস রচনার একমাত্র উপায়ই হলো মৌখিক ঐতিহ্য। বিলুপ্ত কোন আদিবাসী জনজাতির ইতিহাস, কোন গ্রাম বা শহরের বিবর্তনের ইতিহাস রচনার একমাত্র উপায়ই হলো প্রবীন অভিজ্ঞ ব্যক্তিদের সাক্ষাৎকার বা মৌখিক ঐতিহ্যকে অনুসরন করা। 

(৩.) গুরুত্বপূর্ণ তথ্যের প্রাপ্তি

মৌখিক ঐতিহ্য থেকে ইতিহাসের অনেক অজানা গুরুত্বপূর্ণ তথ্যেরও হদিস মেলে। 
  • নাৎসি বাহিনীর হাতে বন্দী ব্যক্তিদের সাক্ষাৎকারের মাধ্যমে জার্মানিতে ইহুদী নিধন এবং নাৎসি বাহিনীর অত্যাচারের অনেক অজানা দিকের কথা জানা যায়। 
  • নীল বিদ্রোহে নীলচাষীদের বর্বর অত্যাচারের কাহিনী একমাত্র একমাত্র নীলচাষীদের প্রদত্ত সাক্ষাৎকারের মাধ্যমেই জানা সম্ভব হয়েছে। 
  • বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধে পাক বাহিনীর অত্যাচারের কথা, দেশভাগের মানসিক যন্ত্রণার কথা, এবং দাঙ্গার ইতিহাসের বর্বর নারকীয় দিকগুলি একমাত্র মৌখিক ঐতিহ্য বা সাক্ষাৎকারের মাধ্যমেই জানা গেছে। 
  • নেতাজী সুভাষচন্দ্র বসুর বিমান দুর্ঘটনার যথার্থতা বা অন্তর্ধান রহস্যের উন্মোচনের ক্ষেত্রেও প্রত্যক্ষদর্শীদের সাক্ষাৎকার বা মৌখিক ঐতিহ্য, ইতিহাস রচনার এক বড়ো আকর। 
এইভাবেই দেখা যায়, মৌখিক ঐতিহ্য যেকোন ইতিহাস রচনার ক্ষেত্রেই প্রাথমিক উপাদান হিসাবে একটি গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা নিয়ে থাকে। 

Post a Comment (0)
Previous Post Next Post