ভারতে পাশ্চাত্য শিক্ষা বিস্তারে ডেভিড হেয়ারের ভূমিকা

 ভারতে পাশ্চাত্য শিক্ষা বিস্তারে যে সমস্ত ইওরোপীয় ব্যক্তি গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা নিয়েছিলেন, তাদের মধ্যে অন্যতম ছিলেন ডেভিড হেয়ার। 

স্কটল্যান্ড থেকে ঘড়ির ব্যবসার সূত্রে তিনি ১৮০০ খ্রিঃ এদেশে এসেছিলেন এবং কিছুদিন পর ব্যবসা থেকে সরে এসে নিজেকে সম্পূর্ণ ভাবে শিক্ষা বিস্তারের কাজে নিয়োজিত করেছিলেন। ১৮১৬ খ্রিঃ থেকে আমৃত্যু  শিক্ষা বিস্তারের কাজের সঙ্গে তিনি যুক্ত ছিলেন। 

এদেশে শিক্ষা বিস্তারে তার প্রধান অবদান ও উদ্যোগ গুলি ছিলো -

ভারতে পাশ্চাত্য শিক্ষার বিস্তারে ডেভিড হেয়ারের ভূমিকা
ভারতে পাশ্চাত্য শিক্ষার বিস্তারে ডেভিড হেয়ারের ভূমিকা 

(১.) হিন্দু কলেজ প্রতিষ্ঠা

১৮১৭ খ্রিঃ কলকাতায় যে হিন্দু কলেজ প্রতিষ্ঠিত হয়, তার প্রধান উদ্যোক্তা ও রূপকার ছিলেন ডেভিড হেয়ার। হিন্দু কলেজের কথা তিনিই প্রথম চিন্তা করেছিলেন এবং কলেজ প্রতিষ্ঠার জন্য ১৮১৬ খ্রিঃ ২১ মে, কলকাতায় একটি সভা আহ্বান করেছিলেন। এই সভাতে রামমোহন রায়, রাধাকান্ত দেব, বৈদনাথ মুখোপাধ্যায়ের মতো বিশিষ্ট ব্যক্তিরা অংশ নিয়েছিলেন। এই সভাতেই হিন্দু কলেজ প্রতিষ্ঠিত করার সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়।

(২.) হিন্দু কলেজের পৃষ্ঠপোষকতা ও সাহায্য

কলকাতায় হিন্দু কলেজ গড়ে উঠলে ডেভিড হেয়ার তাকে নানা ভাবে সাহায্য করেন। কলেজ ভবনের জন্য তিনি কলকাতায় কলেজ স্কোয়ারের তার নিজস্ব জমিটি দান করেন। ১৮২৪ খ্রিঃ ২৫ ফেব্রুয়ারি তার দান করা জমিতেই কলেজের ভিত্তি প্রস্তর স্থাপিত হয়। 

হিন্দু কলেজের পরিচালন সমিতির অন্যতম সদস্য হিসাবেও কলেজের নিয়ম, আদর্শ ও আইনবিধি রচনার ক্ষেত্রে তিনি গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেন। 

(৩.) স্কুল বুক সোসাইটি প্রতিষ্ঠা 

এদেশে শিক্ষা বিস্তারের প্রথম পর্বে ডেভিড হেয়ারের একটি স্মরণীয় কীর্তি ছিলো স্কুল বুক সোসাইটির প্রতিষ্ঠা। সমকালীন সময়ে স্কুল গুলির পাঠ্যপুস্তকের অভাব দূর করবার জন্য ১৮১৭ খ্রিঃ "স্কুল বুক সোসাইটি" গড়ে তোলা হয়েছিলো। ডেভিড হেয়ার আমৃত্যু সোসাইটিকে বার্ষিক ১০০ টাকা করে চাঁদা দিতেন। স্কুল বুক সোসাইটি সমকালীন সময়ে পাঠ্যপুস্তকের অভাব অনেকটাই দূর করতে পেরেছিলো। 

(৪.) কলকাতা স্কুল সোসাইটি প্রতিষ্ঠা 

 স্কুল বুক সোসাইটি প্রতিষ্ঠা করার পরের বছর ১৮১৮ খ্রিঃ হেয়ার প্রতিষ্ঠা করেন "কলকাতা স্কুল সোসাইটি"। এর উদ্যোগে কলকাতা ও সন্নিহিত অঞ্চলে বহু বিদ্যালয় প্রতিষ্ঠিত হয়। দেশীয় পাঠশালা গুলিকেও স্কুল সোসাইটির অধিনে নিয়ে আসা হয়।

 স্কুল সোসাইটি হিন্দু কলেজের পশ্চাৎভূমি হিসাবে কাজ করে। এই সোসাইটির মেধাবী ছাত্ররাই হিন্দু কলেজে পড়াশোনা করবার সুযোগ লাভ করতো। 

(৫.) হেয়ার স্কুল প্রতিষ্ঠা 

হেয়ার প্রতিষ্ঠিত আরপুলি বাংলা স্কুল এবং পটলডাঙ্গা ইংরেজি স্কুল একত্রিত হয়ে ১৮১৮ খ্রিঃ "হেয়ার স্কুলের" জন্ম হয়। হেয়ার স্কুলের প্রতিষ্ঠা ছিলো ডেভিড হেয়ারের এক চিরস্মরনীয় কীর্তি। এই স্কুল সমকালীন সময়ে পাশ্চাত্য শিক্ষার বিস্তারে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। 

(৬.) মেডিক্যাল কলেজ প্রতিষ্ঠায় সাহায্য 

১৮৩৫ খ্রিঃ কলকাতা মেডিক্যাল কলেজ প্রতিষ্ঠিত হলে ডেভিড হেয়ার তাকে নানা ভাবে পৃষ্ঠপোষকতা করেন। 

  • তিনি মেডিক্যাল কলেজের ছাত্র জোগাড় করে দেন, 
  • কলেজে শব ব্যবচ্ছেদকে সমর্থন করেন, 
  • পাশ্চাত্য চিকিৎসা বিদ্যা ও শব ব্যবচ্ছেদের যৌক্তিকতার বিষয়টি রক্ষনশীল ব্যক্তিদের বোঝান, 
  • কলেজ কাউন্সিলের সেক্রেটারি হিসাবে তিনি  পরিকাঠামোর অভূতপূর্ব অগ্রগতি ঘটান এবং ১৮৩৯  খ্রিঃ ৮০ শয্যার একটি হাসপাতাল ভবন তৈরি করেন। 

(৭.) ধর্মনিরপেক্ষ শিক্ষার আদর্শ 

ডেভিড হেয়ার এদেশে ধর্মনিরপেক্ষ শিক্ষা আদর্শের আদিকল্পক ও রূপকার ছিলেন। শিক্ষার মধ্য দিয়ে ধর্মপ্রচারের তিনি ঘোর বিরোধী ছিলেন। তার সময়ে শিক্ষা সংস্কারকদের একদল ধর্মের ধজ্বাধারী তৈরি করতে চেয়েছিলেন, আরেকদল চেয়েছিলেন ইংরেজদের অন্ধ তল্পিবাহক গড়তে। ডেভিড হেয়ার এই দুটোর কোনটাই চান নি। 

তিনি চেয়েছিলেন ছাত্ররা প্রকৃত আধুনিক শিক্ষায় স্বাবলম্বী হয়ে উঠুক। তার শিক্ষা চিন্তার অন্যতম বৈশিষ্ট্য ছিলো - যুক্তিবাদ, স্বাধীন চিন্তা ও ধর্মনিরপেক্ষতা। তার মতে শিক্ষার মূল উদ্দেশ্য হওয়া উচিত প্রকৃত মানুষ তৈরি করা। 

মূল্যায়ন 

ভারতে পাশ্চাত্য শিক্ষা বিস্তারে ডেভিড হেয়ারের মূল্যায়ন করতে গিয়ে এ কথা অবশ্যই বলা যায়, ১৮৩৫ খ্রিঃ আগে এদেশে যে বৃহৎ শিক্ষা প্রতিষ্ঠান গুলির হাত ধরে ভারতে পাশ্চাত্য শিক্ষার বিস্তার ঘটেছিলো, তার প্রায় সব কটিই হেয়ার প্রতিষ্ঠা করে গিয়েছিলেন। হিন্দু কলেজ থেকে শুরু করে হেয়ার স্কুল, স্কুল বুক সোসাইটি, স্কুল সোসাইটি ইত্যাদির কথা প্রসঙ্গক্রমে উল্লেখ করা যায়। 

এই পর্বে তিনি - 
  • পাশ্চাত্য শিক্ষা বিস্তারে ব্যক্তিগত উদ্যোগকে সম্মিলিত উদ্যোগে পরিনত করেন, 
  • বিক্ষিপ্ত শিক্ষা ব্যবস্থাকে সংঘবদ্ধ করে তোলার চেষ্টা করেন। স্কুল সোসাইটির অধীনে কলকাতা ও সংলগ্ন অঞ্চলের স্কুল গুলিকে এক ছাতার তলায় আনার কথা এ প্রসঙ্গে স্মরন করা যেতে পারে, 
  • এছাড়া প্রকৃত ধর্মনিরপেক্ষ ও উদার শিক্ষা চিন্তার আদর্শ দেশবাসীর সামনে তুলে ধরেন। 
১৮৩৫ খ্রিঃ পরও পাশ্চাত্য শিক্ষা প্রতিষ্ঠান গুলির প্রশাসনিক দায়িত্ব ভার তিনি গুরুত্বের সঙ্গে পালন করেন। এই ভাবে দেখা যায়, এদেশে পাশ্চাত্য শিক্ষা বিস্তারে ডেভিড হেয়ার গুরুত্বপূর্ণ অবদান রাখেন।

1 Comments

Post a Comment
Previous Post Next Post