ভারতে নারী শিক্ষা বিস্তারে বিটনের ভূমিকা

 ভারতে নারী শিক্ষা বিস্তারে যে সমস্ত বিদেশী ব্যক্তি গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা নিয়েছিলেন, তাদের মধ্যে অন্যতম এবং অগ্রগন্য ছিলেন ড্রিঙ্ক ওয়াটার বিটন। মাত্র তিন বছর (১৮৪৮ - ১৮৫১) এদেশে অবস্থান করে নারী শিক্ষায় অভূতপূর্ব উদ্যোগ গ্রহণ করে তিনি চিরস্মরনীয় হয়ে আছেন।

নারী শিক্ষার প্রসারে তার প্রধান অবদান গুলি ছিলো -

ভারতে নারী শিক্ষার বিস্তারে বিটনের ভূমিকা
ভারতে নারী শিক্ষার বিস্তারে বিটনের ভূমিকা 


(১.) স্ত্রী শিক্ষায় উদ্যোগ গ্রহণ 

বিটন ভারতে এসে "কাউন্সিল অব এডুকেশন" এর সভাপতি নিযুক্ত হয়েছিলেন। এই পদে থাকাকালীন সময়ে নারী শিক্ষার প্রসারের জন্য তিনি চিন্তা ভাবনা করেন এবং দক্ষিনারঞ্জন মুখার্জি, ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর, মদনমোহন তর্কালঙ্কার, রাধাকান্ত দেব, প্রমুখ ব্যক্তিদের সঙ্গে আলোচনা করে বিষয়টির গুরুত্ব তুলে ধরেন।

(২.) বেথুন স্কুল প্রতিষ্ঠা

১৮৪৯ খ্রিঃ ৭ ই মে, প্রখ্যাত কয়েকজন ভারতীয় ব্যক্তির সহায়তায় ২১ জন ছাত্রীকে নিয়ে বিটন প্রতিষ্ঠা করেন "নেটিভ ফিমেল স্কুল", যা পরবর্তীকালে বেথুন স্কুল নামে পরিচিত হয়। এটি ছিলো  "ভারতের প্রথম মহিলা বিদ্যালয়"। 

দক্ষিনারঞ্জন মুখোপাধ্যায়ের শিমুলিয়ার বাড়িতে  অস্থায়ী ভাবে বেথুন স্কুলের পড়াশোনা শুরু হয়। পরে স্কুলের নিজস্ব ভবন গড়ে উঠেছিলো। 

(৩.) বেথুন স্কুলের পৃষ্ঠপোষকতা 

 বেথুন স্কুল সমকালীন প্রতিকূল পরিবেশের মধ্যে যাতে হারিয়ে না যায়, সেইজন্য বেথুন এর দায়িত্বভার বিদ্যাসাগরের হাতে অর্পন করেন। ১৮৫০ খ্রিঃ তিনি বিদ্যাসাগরকে স্কুলের সম্পাদক নিযুক্ত করেন। 

রাধাকান্ত দেবের মতো রক্ষনশীল সমাজের প্রধান নেতাকেও তিনি এই উদ্যোগে সামিল করেন। সম্ভ্রান্ত হিন্দু পরিবারের মেয়েরা যাতে নিয়মিত স্কুলে পড়তে আসে, সেই বিষয়টি দেখভালের দায়িত্ব তিনি রাধাকান্ত দেব কে দিয়েছিলেন। 

শুধু তাই নয়, আর্থিক কারনে যাতে স্কুলটি বন্ধ হয়ে না যায়, তারও ব্যবস্থা বিটন করে গিয়েছিলেন। কলকাতায় মৃত্যুর আগে (১৮৫১, ১২ আগস্ট) তার সমস্ত অস্থাবর সম্পত্তি তিনি বেথুন স্কুল কে দান করে যান। 

(৪.) স্ত্রী শিক্ষায় জনমত গঠন

নারী শিক্ষায় বিটনের কৃতিত্ব শুধুমাত্র বেথুন স্কুল তৈরির মধ্যেই সীমাবদ্ধ ছিলো না। স্কুল প্রতিষ্ঠার পাশাপাশি তিনি নারী শিক্ষায় জনমত গঠনেও জোর দেন। এজন্য তিনি নিজে উদ্যোগী হয়ে "স্ত্রী শিক্ষা বিষয়ক" বইটির একটি সংস্করন ছেপে প্রচার করেন। এছাড়া, "ফিমেল জুভেনাইল সোসাইটি" কেও তিনি নানা ভাবে সাহায্য করেন। 

(৫.) ধর্মনিরপেক্ষ শিক্ষার আদর্শ 

বেথুনের পূর্বে মিশনারিরা স্ত্রী শিক্ষায় এগিয়ে এলেও, তারা শিক্ষার মধ্য দিয়ে খ্রিষ্টা ধর্মের প্রচার করায় দেশের মানুষদের মধ্যে তৈরি হয়েছিলো ক্ষোভ এবং ধর্মভীতি। 

কিন্তু বিটন স্ত্রী শিক্ষাকে ধর্মীয় ছোঁয়া থেকে দূরে রাখেন। রাধাকান্ত দেবকে তিনি আশ্বস্ত করেন, স্ত্রী শিক্ষায় কখনই খ্রিষ্টধর্মের প্রচার করা হবে না। বেথুন স্কুলকে কখনই তিনি মিশনারিদের পথে পরিচালিত হতে দেন নি। 

(৬.) ভারতের প্রথম মহিলা স্নাতকের কারিগর

বেথুন শুধুমাত্র একটি বিদ্যালয় প্রতিষ্ঠা করে গেলেও, তা সমকালীন সময়ের প্রতিষ্ঠিত অন্যান্য বিদ্যালয় গুলির মতো কখনই অঙ্কুরে বিনষ্ট হয়ে যায় নি। বরং অল্প কিছু কালের মধ্যেই মহীরুহ হয়ে উঠেছিলো। 

১৮৭৮ খ্রিঃ তাঁর প্রতিষ্ঠিত বেথুন স্কুল "বেথুন কলেজে" পরিনত হয়, যার প্রথম মহিলা স্নাতক ছিলেন কাদম্বিনী গাঙ্গুলী এবং চন্দ্রমুখী বসু। এই দুজন শুধু বেথুন কলেজেরই প্রথম স্নাতক ছিলেন না, ভারতেরও প্রথম মহিলা স্নাতক ছিলেন। এ থেকেই বোঝা যায়, এদেশে নারী শিক্ষায় বিটন ঠিক কতটা অবদানের সাক্ষ্য রেখে যেতে পেরেছিলেন। 

মূল্যায়ন 

নারী শিক্ষায় বিটনের অবদানের মূল্যায়ন করতে গিয়ে একথা অবশ্যই মনে রাখতে হবে, বিটনের আগে সরকারি স্তরে শিক্ষা বিস্তারের কাজ শুরু হলেও, নারী শিক্ষার প্রসারে তেমন অগ্রগতি ঘটে নি। সরকার নারীদের জন্য কোন পৃথক বিদ্যালয়ও প্রতিষ্ঠা করে নি।

 সরকারের শিক্ষা সচিব হিসাবে নারী শিক্ষার কথা আলাদা ভাবে গুরুত্ব দিয়ে বিটনই প্রথম চিন্তা ভাবনা করেন। সরকারি সহায়তার জন্য কালবিলম্ব না করে ভারতীয়দের একত্রিত করে নিজেই উদ্যোগী হয়ে মেয়েদের জন্য প্রথম স্কুল খোলেন। 

তার আগে খ্রিষ্টান মিশনারিরা নারী শিক্ষায় এগিয়ে এলেও, তাদের মূল উদ্দেশ্য ছিলো খ্রিষ্টধর্মের প্রচার করা। এজন্য নারী শিক্ষা সেভাবে এগিয়ে যেতে পারে নি। সম্ভ্রান্ত হিন্দু ঘরের মেয়েরা মিশনারিদের ঐ সব স্কুল গুলিতে পড়তে যেতো না। গ্রামাঞ্চলের নিন্মবর্গের মেয়েরা অর্থ ও নানা প্রলভনে মিশনারিদের বিদ্যালয়ে গেলেও তা ছিলো অনিয়মিত। ফলে নারী শিক্ষার ধারাটি ব্যর্থতায় পর্যবসিত হয়েছিলো।

বিটন গভীর অন্তর্দৃষ্টিতে মিশনারিদের নারী শিক্ষা বিস্তারের এই ব্যর্থতার দিকটিকে উপলব্ধি করেছিলেন। তিনি তাই নারী শিক্ষাকে খ্রিষ্টধর্মের ছোঁয়া কে দূরে সরিয়ে রাখেন। রক্ষনশীল সমাজের আস্থা ও বিশ্বাস অর্জনের জন্য এটি খুবই প্রয়োজনীয় ছিলো। এর থেকেও বড়ো কথা, বেথুন স্কুল প্রতিষ্ঠা করতে গিয়ে ভারতীয় সমাজের রক্ষনশীল ও প্রগতিশীল সমস্ত স্তরের নেতৃত্বকে যেভাবে তিনি তার উদ্যোগে সামিল করতে পেরেছিলেন, তা ইতিপূর্বে আর কেউই করতে পারেন নি। ফলে সমাজের সমস্ত স্তরের মানুষই এর পর নারী শিক্ষার কথা গুরুত্ব দিয়ে ভাবতে থাকেন।

আর নারী শিক্ষায় এই মৌলিক অবদানটির জন্যই বিটনকে আজও ভারতের ইতিহাসে শ্রদ্ধার সঙ্গে স্মরণ করা হয়ে থাকে।

Post a Comment (0)
Previous Post Next Post