নীলদর্পনের রচনা ও প্রকাশনার ইতিহাস

 ১৮৫৯ - ৬০, বাংলাদেশে এক উত্তাল সময়। নীলচাষের বিরুদ্ধে একের পর এক গ্রামে আগুনের লেলিহান শিখার মতো ছড়িয়ে পড়তে শুরু করেছিলো নীল বিদ্রোহ। নীল আন্দোলন যে সময়টাতে একটি "জাতীয় বিদ্রোহের" দিকে মোড় নিচ্ছিলো, ঠিক সেই সময়েই ১৮৬০ খ্রিঃ সেপ্টেম্বর মাসে নীলদর্পন প্রকাশিত হয়

নীলদর্পনের রচনা ও প্রকাশনার ইতিহাস
নীলদর্পনের রচনা ও প্রকাশনার ইতিহাস 


নীলদর্পনের লেখক

নীলদর্পন নাটকটি লিখেছিলেন দীনবন্ধু মিত্র। যদিও নাটকের  কোন জায়গাতেই এর স্রষ্টা হিসাবে দীনবন্ধু মিত্রের নামের উল্লেখ ছিলো না। লেখকের জায়গাায় "কস্যচিৎ পথিকস্য" নামে ছদ্মনামের উল্লেখ ছিলো মাত্র। 

দীনবন্ধু মিত্র সরকারি চাকুরি করতেন। তাই রাজরোষ থেকে বাঁচতেই তিনি তার নামটি গোপন রেখেছিলেন। নীলদর্পন নাটকটি যে দীনবন্ধু মিত্র-ই লিখেছিলেন, এই ঐতিহাসিক তথ্য সর্বপ্রথম তুলে ধরেন বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়

১৮৫৮ খ্রিঃ থেকেই দীনবন্ধু মিত্রের সঙ্গে বঙ্কিমচন্দ্রের পরিচয় ঘটে। নীলদর্পন প্রকাশিত হবার পর সেই পরিচয় প্রগাঢ় বন্ধুত্বে পরিনত হয়। পরবর্তীকালে দীনবন্ধু মিত্র এবং তার লেখা নীলদর্পন সম্পর্কে বঙ্কিমচন্দ্র যে ঐতিহাসিক সাক্ষ্য প্রমাণ রেখে যান, তার ভিত্তিতেই জানা সম্ভব হয় যে, নীলদর্পনের মূল নাটকটি লিখেছিলেন দীনবন্ধু মিত্র। 

প্রসঙ্গত বলে রাখা প্রয়োজন, নীলদর্পনই ছিলো দীনবন্ধু মিত্রের লেখা প্রথম নাটক। পরবর্তীকালে আরোও বেশ কয়েকটি নাটক অবশ্য তিনি লিখেছিলেন। যদিও সেগুলি প্রভাব, খ্যাতি বা ঐতিহাসিক দ্যুতি - কোন দিক থেকেই নীলদর্পনকে ছাড়িয়ে যেতে পারে নি।

নীলদর্পনের প্রকাশ

নীলদর্পন ১৮৬০ খ্রিঃ সেপ্টেম্বর মাসে প্রথম মুদ্রিত ও প্রকাশিত হয় ঢাকায় এবং ঢাকাতেই প্রথম তা অভিনীত হয়।

নীলদর্পন প্রকাশিত হবার সঙ্গে সঙ্গে তা এতটাই জনপ্রিয়তা অর্জন করে যে, একবছরের মধ্যেই নাটকটি পুনঃমুদ্রিত করতে হয়। 

বাংলা নাট্য জগতের ইতিহাসে নীলদর্পনের প্রকাশনা একাধিক দিক থেকে তাৎপর্যপূর্ণ ছিলো। যেমন -

  1. নীলদর্পন ছিলো সাধারন মানুষকে নিয়ে লেখা এবং   মঞ্চস্থ করা প্রথম বাংলা নাটক।
  2. নীলদর্পন নাটক দিয়েই বাংলা পেশাদারি নাটকের যাত্রা শুরু হয়। ১৮৭২ খ্রিঃ কলকাতার ন্যাশনাল থিয়েটারে এই নাটক পেশাদারি ভাবে মঞ্চস্থ হয়।
  3. ১৮৭২ খ্রিঃ অর্ধেন্দুশেখর মুস্তফি কলকাতায় ন্যাশনাল থিয়েটার স্থাপন করে সর্বপ্রথম জনসাধারণের কাছে টিকিট বিক্রি করে যে নাটক মঞ্চস্থ করেছিলেন, তা ছিলো এই নীলদর্পন।
  4. নীলদর্পনই প্রথম বাংলা নাটক ছিলো, যা বাংলা থেকে কোন বিদেশী (ইংরেজী) ভাষায় প্রথম অনুবাদ করা হয়।
নীলদর্পনের প্রকাশনা ও  তার বিরাট প্রভাবের দিকটি পর্যবেক্ষণ করে বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায় নীলদর্পনকে হ্যারিয়েট রিচার্ড স্টোরের লেখা বিখ্যাত নাটক "আংকেল টমস্ কেবিনের" সঙ্গে তুলনা করেন।

নীলদর্পনের অনুবাদ

নীলদর্পনের প্রবল জনপ্রিয়তা দেখে শ্রীঘ্রই এই নাটক বাংলা থেকে ইংরেজিতে অনুবাদ করা হয়।

 ১৮৬১ খ্রিঃ দীনবন্ধু মিত্র নীলদর্পনের একটি কপি তাঁর মাস্টারমশাই রেভারেন্ড জেমস্ লঙকে উপহার দেন। নাটকটি পড়বার পর তা ইংরেজিতে অনুবাদ করার সিদ্ধান্ত নেন লঙ সাহেব। নাটকটি গ্রাম্য কথ্য ভাষায় রচিত হওয়ায় তা অনুবাদের জন্য ইংরেজি এবং বাংলা দুই ভাষাতেই সমান দিগগজ মাইকেল মধুসূদন দত্তের দ্বারস্থ হন লঙ সাহেব। শেষপর্যন্ত, পাদরি রেভারেন্ড জেমস লঙের অনুরোধে নীলদর্পনের ইংরেজী অনুবাদ করেন কবি মাইকেল মধুসূদন দত্ত।

শোনা যায়, মাইকেল মধুসূদন দত্ত ১৮৬১ খ্রিঃ ডেপুটি ম্যাজিস্ট্রেট তারকনাথ ঘোষের ঝামাপুকুরের বাড়িতে বসে এক রাতের মধ্যে নীলদর্পনের ইংরেজী অনুবাদের কাজ শেষ করেন।

অনুবাদ হয়ে যাওয়ার পর লঙ সাহেব নীলদর্পনের পান্ডুলিপিটি ছাপাবার জন্য ক্যালকাটা প্রিন্টিং অ্যান্ড পাবলিশিং এর মালিক হেনরী ম্যানুয়েলের কাছে পাঠিয়ে দেন। এই প্রেস থেকে - "Nil Darpan, The Indigo planting Mirror" নামে বইটি প্রকাশিত হয়। 

বইটিতে মূল রচনাকার, অনুবাদক বা প্রকাশক কারো নামেরই উল্লেখ ছিলো না। এর জায়গায় শুধুমাত্র একটি কথাই লেখা ছিলো - "Translate from the Bengali by a Native"

নীলদর্পনের প্রতি শ্বেতাঙ্গ সমাজের প্রতিক্রিয়া 

নীলদর্পনের অনুবাদ বই ছেপে বের হবার পর লঙ সাহেব এর কিছু কপি ডাকযোগে ইংল্যান্ডে বিশিষ্ট ব্যক্তিদের কাছে পাঠিয়ে দেন। এই ঘটনায় এক তীব্র প্রতিক্রিয়া লক্ষ্য করা গেলো। 

এরফলে বাংলায় নীলকর সাহেবদের অবর্ননীয় অত্যাচারের নগ্ন চিত্রটি ইংল্যান্ডের নাগরিক সমাজের সামনে প্রকাশিত হয়ে পড়লো। সেখানে নীলকর সাহেবদের অত্যাচারের শুধু সমালোচনাই করা হলো না, এর বিরুদ্ধে জনমতও সংগঠিত হতে লাগলো। এই ঘটনায় ভারতীয় শ্বেতাঙ্গ সমাজ রাগে অগ্নিশর্মা হয়ে ওঠে। 

শেষপর্যন্ত শ্বেতাঙ্গরা সিদ্ধান্ত নেয়, নীলদর্পনে যেভাবে ইওরোপীয়দের কদর্যভাবে দেখিয়ে অপমান করা হয়েছে, তার বিরুদ্ধে আদালতে মানহানির মামলা করা হবে। ছাপাখানার মালিকের সূত্র ধরে জানা যায়, নীলদর্পন নাটকের প্রধান প্রকাশক ছিলেন রেভারেন্ড জেমস্ লঙ। 

লঙের বিরুদ্ধে মানহানির মামলা 

নীলদর্পন প্রকাশের অপরাধে কলকাতার "ইংরেজ জমিদার ও ব্যবসায়ী সংঘ" লঙের বিরুদ্ধে মানহানির মামলা দায়ের করে। ১৮৬১ খ্রিঃ ১৯,২০ এবং ২১ জুলাই, - তিনদিন ধরে কলকাতা সুপ্রিমকোর্টে লঙের বিরুদ্ধে মামলা চলে। 

মামলার সময় ইংরেজ উকিলরা এমনকি স্বয়ং প্রধান বিচারপতি ওয়েলস নীলদর্পনের মূল লেখক ও অনুবাদকের নাম প্রকাশ করার জন্য লঙের ওপর অনেক চাপ সৃষ্টি করলেও, লঙ এই বিষয়ে একটি কথাও বলেন নি। 

এর ফলে বিরক্ত হয়ে জুরীরা লঙকেই দোষী সাব্যস্ত করেন এবং বিচারে তার একহাজার টাকা জরিমানা ও একমাসের কারাদন্ড হয়। বিচারের রায় শুনে লঙ সদম্ভে ঘোষনা করেন - আমি এমন অপরাধ বার বার করব। 

বিচারের রায় বের হওয়া মাত্র কালীপ্রসন্ন সিংহ লঙের এক হাজার জরিমানার টাকা আদালতে সঙ্গে সঙ্গে দিয়ে দেন। শুধু তাই নয়, নীলদর্পনের প্রথম সংস্করণ শেষ হওয়া মাত্র কালীপ্রসন্ন নিজ খরচে দ্বিতীয় সংস্করন ছেপে বের করেন এবং তা বিনামূল্যে বিতরন করেন। এছাড়া, রাজা প্রতাপচন্দ্র সিংহ এবং দীনবন্ধু মিত্র লঙের মামলার সমস্ত খরচ বহন করেন। 

বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায় লিখেছিলেন - নীলদর্পনের সঙ্গে যারা যুক্ত ছিলেন, তারা কিছু না কিছু বিপদের সম্মুখীন হয়েছিলেন। নীলদর্পনের প্রচার করে লঙ সাহেব কারারুদ্ধ হন। এর ইংরেজী অনুবাদ করে মাইকেল মধুসূদন দত্ত গোপনে তিরস্কৃত ও অপমানিত হন। এমনকি শেষপর্যন্ত সুপ্রিমকোর্টের চাকুরি পর্যন্ত তিনি ত্যাগ করতে বাধ্য হন। এর মূল রচনাকার কর্মচ্যুত না হলেও, একাধিক বিপদের সম্মুখীন হয়েছিলেন। 

নীলদর্পন নাটকের প্রভাব 

বলা হয়ে থাকে,আমেরিকার দাসপ্রথার বিরুদ্ধে "Uncle Tom's cabin" যে ভূমিকা পালন করেছিলো, বাংলাদেশে নীলচাষের বিরুদ্ধে জনমত গঠনের ক্ষেত্রে "নীলদর্পন" নাটকও সেই একই রকমের ভূমিকা নিয়েছিলো। 

মনে রাখতে হবে, দীনবন্ধু মিত্রের নীলদর্পন কোন কল্পকাহিনীর নাট্যরূপ মাত্র ছিলো না। এটি ছিলো সমকালীন সময়ের নীলচাষীদের ওপর নীলকর সাহেবদের অত্যাচার কাহিনীর এক জীবন্ত দর্পন। যে দর্পনে নিজেদের বিভিষিকাময় রূপ দেখে নীলকররা শুধু আঁতকে উঠে নি, চরম ক্ষিপ্ত হয়ে এই নাটক বন্ধ করবার জন্য উঠে পড়ে লেগেছিলো। নাটক বন্ধে মরিয়া হয়ে মামলা ঠুকেছিলো আদালতে। 

আর তাদের এই সমস্ত কর্মকান্ড নীলদর্পনকে আরোও জনপ্রিয় ও গ্রহনযোগ্য করে তোলে শিক্ষিত সমাজের কাছে। যারা এতদিন মুখ ফিরিয়ে ছিলো, তারাও এই নাটক দেখে নীলচাষের বিরোধী হয়ে ওঠে। নীলদর্পন প্রকাশিত হবার পর থেকে একের পর এক বুদ্ধিজীবী, লেখক এবং সাহিত্যিক নীলচাষের বিরুদ্ধে লেখালেখি শুরু করেন। 

এককথায়, নীল বিদ্রোহে শিক্ষিত বাঙালির মধ্যে জনমত সংগঠনে নীলদর্পন এক বিরাট ঐতিহাসিক ভূমিকা নিয়েছিলো।

পন্ডিত ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর নীলদর্পনের অভিনয় দেখবার পর এতটাই ক্রুদ্ধ ও উত্তেজিত হয়ে পড়েন যে, নিজের জুতো ছুড়ে মারেন নাটকের অন্যতম চরিত্র নীলকর রোগ সাহেবের মাথায়। একই রকম ভাবে নীলদর্পন নাটক যখন লখনৌতে মঞ্চস্থ হয়, তখন একদল ইংরেজ টমি নগ্ন তলোয়ার হাতে নিয়ে মঞ্চ আক্রমন করে। 

এইসব ঘটনা থেকে বোঝা যায়, নীলদর্পন নাটকটি দেশী ও বিদেশী সব শ্রেণীর মানুষদের মনকে কতটা আন্দোলিত করতে সক্ষম হয়েছিলো। এই কারণের জন্যই নীলদর্পনে যারা অভিনয় করতেন, তাদের সব সময়েই পুলিশের হাতে লাঞ্ছিত ও অপমানিত হবার আশঙ্কা নিয়ে থাকতে হতো। 


নীলদর্পনের ওপর সরকারি নিষেধাজ্ঞা 

নীলদর্পন নাটক ভারতে শ্বেতাঙ্গদের নানা অন্যায় ও অত্যাচারের বিরুদ্ধে যে ভাবে জনমনে ইংরেজদের প্রতি ঘৃণা ও প্রবল জাতীয়তাবাদের সঞ্চার করে, তাতে ব্রিটিশ সরকার প্রবলভাবে আতঙ্কিত হয়ে ওঠে। 

এই জন্য শেষপর্যন্ত ব্রিটিশ সরকার ১৯০৮ খ্রিঃ নীলদর্পন কে ইংরেজ বিদ্বেষীরাজদ্রোহীতার অজুহাতে এর অভিনয়ে নিষেধাজ্ঞা আরোপ করে। 

Post a Comment (0)
Previous Post Next Post