বিপিনচন্দ্র পাল ছিলেন ভারতের একজন বিখ্যাত বাগ্মী, সুলেখক, দেশপ্রেমিক, সর্বোপরি চরমপন্থী আন্দোলনের একজন বিশিষ্ট নেতা। "সত্তর বৎসর" ছিলো তার আত্মজীবনী। জীবনের সত্তর বৎসরে পদার্পণ করে তিনি এই আত্মজীবনী লিখেছিলেন বলে এর নামকরন করেছিলেন "সত্তর বৎসর"।
বিপিনচন্দ্র পালের "সত্তর বৎসর" |
প্রকাশকাল
"প্রবাসী" পত্রিকার সম্পাদক রামানন্দ চট্টোপাধ্যায়ের অনুরোধেই বিপিন চন্দ্র তার আত্মজীবনী "সত্তর বৎসর" লেখা শুরু করেন। এটি প্রথমে ধারাবাহিক ভাবে "প্রবাসী" পত্রিকাতে প্রকাশিত হয়। পরে ১৯৫৫ খ্রিঃ গ্রন্থাকারে প্রকাশিত হয়।
বিষয়বস্তু
সত্তর বৎসর বিপিনচন্দ্রের সম্পূর্ণ সত্তর বছরের জীবনকথা ছিলো না। তার প্রথম জীবনের মাত্র ২২ বছরের জীবনকথাই তিনি এতে লিখে যেতে পেরেছিলেন। ২৭ টি অধ্যায়ের মধ্য দিয়ে বিপিনচন্দ্র এই আত্মজীবনীতে -
- তার বংশ, জন্ম, শৈশব স্মৃতি ও পারিবারিক ইতিহাসের কথা তুলে ধরেছিলেন।
- শ্রীহট্টের সমাজ জীবন ও পরিবেশের কথা বলেছিলেন ,
- স্কুল জীবনের শিক্ষালাভ এবং সেখানকার পরিবেশের কথা লিখেছিলেন।
- স্কুলের পাঠ শেষ করবার পর উচ্চ শিক্ষা লাভের উদ্দেশ্যে তার কলকাতা আগমন, কলকাতার ছাত্রাবাস, প্রেসিডেন্সি কলেজ ও তৎকালীন কলকাতার সমাজ জীবনের কচড়া সব কিছুই তার আত্মজীবনীতে উঠে এসেছে।
- কলকাতায় ব্রাহ্মসমাজের সংস্পর্শে এসে তার ব্রাহ্ম মতে দীক্ষিত হওয়া, পিতা কর্তৃক ত্যাজ্যপুত্র হওয়া,
- আনন্দমোহন বসু ও সুরেন্দ্রনাথ বন্দ্যোপাধ্যায়ের সংস্পর্শে এসে রাজনীতিতে আকৃষ্ট হওয়া,
- নবগোপাল মিত্রের হিন্দুমেলা প্রতিষ্ঠা এবং নব্য জাতীয়তাবাদের দ্বারা বাঙালি জাতীর রঞ্জিত হওয়ার ইতিহাস তুলে ধরে বিপিনচন্দ্র তার আত্মজীবনী শেষ করেছেন।
ঐতিহাসিক গুরুত্ব
বিপিনচন্দ্র পালের আত্মজীবনী "আত্মকথার" মধ্যেই সীমাবদ্ধ ছিলো না। আত্মকথার থেকেও তার আত্মজীবনীর আখ্যানে গুরুত্বপূর্ণ হয়ে উঠেছিলো তার পারিপার্শ্বিক পরিবেশ ও জগত।
এই কারনে বিপিনচন্দ্র পালের আত্মজীবনীকে উনিশ শতকের ইতিহাস রচনার একটি গুরুত্বপূর্ণ উপাদান বলে মনে করা হয়ে থাকে।
ইতিহাসের উপাদান হিসাবে এই গ্রন্থের মূল ঐতিহাসিক অবদানের দিক গুলিকে আমরা নিন্মলিখিত ভাবে তুলে ধরতে পারি -
(১.) উনিশ শতকের ইতিহাসের ধারাভাষ্য
১৮৫৮ থেকে ১৮৮০ পর্যন্ত সময়কালের ইতিহাসকে বিপিনচন্দ্র তার সত্তর বৎসরে তুলে ধরেছিলেন। উনিশ শতকের দ্বিতীয়ার্ধ ছিলো ভারতের ইতিহাসে এক ঘটনাবহুল সময়। ব্রাহ্ম আন্দোলন থেকে জাতীয়তাবাদের বিকাশ, সমাজ পরিবর্তন থেকে জাতীয় আন্দোলনের সূচনা সবকিছুই এই পর্বে বিকশিত হয়েছিলো।
"সত্তর বৎসরে" উনিশ শতকের এই পরিবর্তনশীল সময়ের একটি ধারাভাষ্য পাওয়া যায়। এই সময়ের চলমান ঘটনা গুলির প্রত্যক্ষদর্শী সাক্ষী ছিলেন লেখক নিজে। তাই তার লিখে যাওয়া বিবরন অতীতের সময়কালকে আমাদের যথার্থ ভাবে বুঝতে সাহায্য করে থাকে।
(২.) সামাজিক ইতিহাস রচনার উপাদান
সত্তর বৎসরে উল্লেখিত তথ্য সামাজিক ইতিহাস রচনার ক্ষেত্রে বিভিন্ন ভাবে সাহায্য করে থাকে। যেমন -
(ক.) পৈল গ্রাম ও বিপিনচন্দ্রের পারিবারিক ইতিহাস
সত্তর বৎসর থেকে পৈল গ্রাম এবং বিপিনচন্দ্রের পারিবারিক ইতিহাসের পরিচয় পাওয়া যায়। বিপিনচন্দ্র পালের পিতা শ্রীহট্টের পৈল গ্রামের জমিদার ছিলেন। তাদের বংশাবলী থেকে জানা যায় তাদের আদি বংশধর হিরন্য পাল গ্রামের নামকরন করেছিলেন পৈল গ্রাম।
বর্ধমানের মঙ্গলকোট থেকে বিপিন পালের বংশধরেরা এসে পৈল গ্রামে জমিদারি স্থাপনা করেছিলেন। "সত্তর বৎসরে" উল্লেখিত বিপিনচন্দ্র পালের পৈল গ্রাম এবং পারিবারিক বংশ পরিচয় সম্পর্কে রেখে যাওয়া তথ্য "শ্রীহট্টের আঞ্চলিক ইতিহাস" রচনার ক্ষেত্রে অনেকখানি সাহায্য করে থাকে।
(খ.) গ্রামীন সংস্কৃতির পরিচয়
"সত্তর বৎসরে" উনিশ শতকের দ্বিতীয়ার্ধের গ্রামীন সংস্কৃতি ও সমাজজীবনের চালচিত্রের এক নিখুঁত ছবি পাওয়া যায়।
- স্থানগত পরিচয় দানের মধ্য দিয়ে বিপিনচন্দ্র পুরোনো কোটের হাট, বাখরগঞ্জ, ফেঁচুগঞ্জ, শ্রীহট্ট প্রভৃতি নানা অঞ্চলের লোকায়ত জীবনের কথা সত্তর বৎসরে তুলে ধরেছিলেন।
- এইসব পল্লী অঞ্চলের মানুষদের জীবনযাত্রার ধরন, সেখানকার হিন্দু মুসলিম সম্পর্ক, মিশনারিদের প্রভাব ইত্যাদি নানা দিকের কথাও উল্লেখ করেছিলেন।
- এছাড়া, গ্রামীন সংস্কৃতির পরিচয় তুলে ধরতে গিয়ে তিনি দোল উৎসব, দুর্গোৎসব, যাত্রা গান, পুরানপাঠ ইত্যাদির কথা উল্লেখ করেন।
- শ্রীহট্টে বহু মনিপুরি একসময় বসবাস করতেন, এ তথ্যও তার আত্মজীবনী থেকে জানা যায়।
সত্তর বৎসরে বর্নীত পুরানো গ্রামাঞ্চল সম্পর্কিত এইসব তথ্য "স্থানীয় ইতিহাস" ও "সামাজিক ইতিহাস" রচনায় গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা নিয়ে থাকে।
(গ.) কলকাতার সমাজজীবন ও সংস্কৃতি
গ্রামীন সমাজ জীবন ও সংস্কৃতির পাশাপাশি সত্তর বৎসর থেকে পুরানো কলকাতা এবং তার সংস্কৃতি জীবন সম্পর্কেও নানা তথ্য পাওয়া যায়।
গ্রামের শিক্ষা জীবন সমাপ্ত করার পর উচ্চতর শিক্ষা লাভের জন্য বিপিনচন্দ্র কলকাতায় আসেন। সত্তর বৎসরে -
- পুরানো কলকাতার পথঘাট,
- খাদ্যাভ্যাস,
- মদ্যপানের ব্যপকতা,
- মেয়েদের স্বাধীনতা,
- তৎকালীন কলকাতার ছাত্রাবাস,
- যাত্রা ও থিয়েটার,
- পুরানো প্রেসিডেন্সি কলেজ,
- ব্রাহ্মসমাজের প্রভাব ও ভাঙ্গন, ইত্যাদির কথা তিনি তুলে ধরেছেন।
ঘটনার প্রত্যক্ষদর্শী হিসাবে তার রেখে যাওয়া এইসব তথ্য - (ক.) উনিশ শতকের সময়কালকে বুঝতে যেমন সাহায্য করে, (খ.) তেমনি পুরাতন "কলকাতার ইতিহাস" রচনাতেও প্রভূত সাহায্য করে থাকে।
(৩.) রাজনৈতিক ইতিহাসের উপাদান
উনিশ শতকের দ্বিতীয়ার্ধ থেকে ভারতে জাতীয়তাবাদী আন্দোলন ও ভাবাদর্শ দানা বাঁধতে শুরু করেছিলো। বিপিনচন্দ্রের "সত্তর বৎসরে" তার অনেক পরিচয় পাওয়া যায়।
বিপিনচন্দ্র লেখেন -
- ইতালির কার্বোনারিদের মতো উনিশ শতকের দ্বিতীয়ার্ধে কলকাতাতেও ছাত্ররা নিজেদের মধ্যে ছোট ছোট গুপ্ত সমিতি গড়ে তুলেছিল।
- শিবনাথ শাস্ত্রীর নেতৃত্বে নব্য যুবাদের নিয়ে গঠিত হয়েছিলো "সাধক দল"। লেখক নিজেও এর সদস্য হয়েছিলেন।
- ব্রিটিশ সরকারের অন্যায়ের বিরুদ্ধে এই সময় সুরেন্দ্রনাথ বন্দ্যোপাধ্যায় ও ভারত সভার কথা সত্তর বৎসর থেকে জানা যায়।
- সুরেন্দ্রনাথ বন্দ্যোপাধ্যায়ের আকর্ষনেই বিপিনচন্দ্র রাজনীতিতে অংশ নেওয়ার চিন্তা ভাবনা করেন।
- নবগোপাল মিত্রের "হিন্দুমেলা" কিভাবে তৎকালীন যুব সম্প্রদায় ও দেশবাসীকে দেশাত্মবোধের ভাবনায় উদ্দীপ্ত করেছিলো, তারও বিস্তৃত বর্ননা সত্তর বৎসর থেকে পাওয়া যায়।
"সত্তর বৎসরে" বর্নীত কলকাতার এইসব রাজনৈতিক ঘটনাক্রম ঐতিহাসিকদের ভারতে জাতীয়তাবাদী আন্দোলনের বিকাশ ও উত্থানকে বুঝতে অনেকটাই সাহায্য করে থাকে।
সীমাবদ্ধতা
আত্মজীবনী হিসাবে বিপিনচন্দ্রের "সত্তর বৎসরের" প্রধান দুটি সীমাবদ্ধতা ছিলো -
- এটি বিপিনচন্দ্র পালের পূর্ণাঙ্গ আত্মজীবনী ছিলো না। তার প্রথম দিকের মাত্র ২২ বছরের জীবনের কথাই এই আত্মজীবনী থেকে জানা যায়। এবং
- বিপিনচন্দ্রের মূল রাজনৈতিক জীবন সম্পর্কে এই গ্রন্থ থেকে কোন তথ্য পাওয়া যায় না।
তবে এই সীমাবদ্ধতা সত্ত্বেও, ১৮৫৮ - ১৮৮০ সময়কালের যে পারিপার্শ্বিক আখ্যান বিপিনচন্দ্র তার আত্মজীবনীতে তুলে এনেছিলেন,"সামাজিক ইতিহাস" রচনায় তার ঐতিহাসিক মূল্য ছিলো অপরিসীম। একে কোন ভাবেই উপেক্ষা করা যায় না।