"জীবনের ঝরাপাতা" ছিলো সরলাদেবী চৌধুরানীর লেখা আত্মজীবনী। সরলাদেবী চৌধুরানী ছিলেন রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের দিদি স্বর্নকুমারী দেবীর কন্যা, এবং সম্পর্কে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের ভাগনী।
সরলাদেবী চৌধুরানীর "জীবনের ঝরাপাতা" |
প্রকাশকাল
জীবনের ঝরাপাতা প্রথমে সাপ্তাহিক "দেশ" পত্রিকায় ১৯৪৪ - ৪৫ খ্রিঃ ধারাবাহিক ভাবে প্রকাশিত হয়। পরে ১৯৭৫ খ্রিঃ আন্তর্জাতিক নারীবর্ষে এটি গ্রন্থাকারে প্রকাশিত হয়।
বিষয়বস্তু
"জীবনের ঝরাপাতায়" সরলাদেবী চৌধুরানী ১৮৭২ থেকে ১৯০৫ সময়কালের আখ্যানে এক বালিকা থেকে তাঁর বড়ো হয়ে ওঠার জীবনকাহিনী তুলে ধরেছেন। এখানে তার আত্মকথনে উঠে এসেছে -
- বৃহৎ জোরাসাঁকো ঠাকুরবাড়ীর অন্দরমহলের কথা,
- সরলাদেবীর জন্মবৃত্তান্তের ইতিকথা,
- ঠাকুরবাড়ীর মুক্ত ও কঠোর অনুশাসনের আবহে তার বেড়ে ওঠা ও শিক্ষা লাভের গল্প,
- তাঁর কর্মজীবন, বাইরের জগতে প্রবেশ, গৌরবলাভ এবং সমকালীন প্রখ্যাত ব্যক্তিবর্গের সঙ্গে তাঁর আলাপের পরিচয়,
- ভারতের জাতীয় চেতনা ও রাজনৈতিক কর্মকান্ডের সঙ্গে তার সংযোগ,
- "ভারতী" পত্রিকার সম্পাদক রূপে তার কর্মকান্ড এবং স্বদেশচিন্তা - প্রায় সমস্ত কিছুই সরলাদেবী অকপটে তাঁর আত্মকথায় তুলে ধরেছেন।
ঐতিহাসিক গুরুত্ব
ইতিহাসের উপাদান হিসাবে সরলাদেবীর "জীবনের ঝরাপাতা" ছিলো এক অমূল্য ঐতিহাসিক উপাদান।
এর প্রধান ঐতিহাসিক গুরুত্বের দিক গুলি আমরা নিন্মলিখিত ভাবে তুলে ধরতে পারি -
(১.) নারী ইতিহাস রচনার উপাদান
প্রাথমিক ভাবে এই গ্রন্থটি সরলাদেবী সম্পর্কে জানতে এবং উনিশ শতকে নারীদের ক্ষমতায়ন ও নারী জাগরন সম্পর্কে জানতে আকর উপাদান হিসাবে কাজ করে থাকে।
- সরলাদেবী নিজে নারী জাগরনের জ্বলন্ত প্রতিমূর্তি ছিলেন,
- নারী পুরুষের সক্ষমতা ও অধিকারের ব্যবধান সম্পর্কে নারী মননের বিশ্লেষন তাঁর আত্মজীবনীতে সচেতনতার সঙ্গে প্রকাশিত হয়েছিলো।
- বিভিন্ন সভা সমিতির মধ্য দিয়ে তিনি অন্তঃপুরে আবদ্ধ ভারতীয় নারীদের সংঘবদ্ধ ও সচেতন করে তোলার চেষ্টা করেছিলেন।
উনিশ শতকের শেষ দিক থেকে বিশ শতকের প্রথম দিক পর্যন্ত ভারতের নারী ইতিহাস রচনায় তাই ঐতিহাসিকদের কাছে গ্রন্থটির মূল্য ছিলো অপরিসীম।
(২.) ঠাকুরবাড়ীর অন্দরমহলের কথা
সরলাদেবীর আত্মজীবনী থেকে ঠাকুরবাড়ীর নিজস্ব কিছু "প্রথা ও ঐতিহ্য" সম্পর্কে জানতে পারা যায়। যেমন -
- ঠাকুরবাড়ীর মেয়েদের বিবাহের পর ঘরজমাই রাখার প্রথা,
- জামাইদের বিবাহের পূর্বে ব্রাহ্ম মতে দীক্ষিত হওয়ার নিয়ম,
- ঠাকুরবাড়ীর সন্তানদের ভূমিষ্ঠ হওয়ার পর দুধমা ও ধাইমা দিয়ে সন্তান প্রতিপালন,
- সুবৃহৎ পরিবারে বিরাট সরকারি ও বেসরকারি রন্ধনশালার ব্যবস্থা,
- পরিচারকদের কঠোর অনুশাসন,
- নারী শিক্ষার ব্যবস্থা,
- গৃহশিক্ষক রাখার ঐতিহ্য,
- সাহিত্য, সঙ্গীত ও সংস্কৃতি চর্চা,
- ঠাকুরবাড়ীর অন্দরমহলে রাখিবন্ধন, বসন্ত উৎসব, মাঘোৎসব পালনের রীতি,
- শাড়ি পরার আধুনিক রীতি,
- মেয়েদের যাতায়াতে পালকির ব্যবহার, ইত্যাদি।
(৩.) বিপ্লবী আন্দোলন সম্পর্কে তথ্য
- বাংলায় বিপ্লবী আন্দোলন বিকাশের ক্ষেত্রে সরলাদেবীই প্রথম সক্রিয় ভূমিকা নেন এবং
- বাঙালি যুবকদের "মৃত্যুচর্চার আহ্বান" জানিয়ে স্বদেশ প্রেমে দীক্ষিত করেন।
- "ভারতী" পত্রিকায় "বিলিতি ঘুষি বনাম দেশী কিল" প্রবন্ধে পথে ঘাটে ইংরেজদের অনাচারের বিরুদ্ধে তিনি যুবকদের পাল্টা প্রহারের পরামর্শ দেন।
- যুবশক্তির জাগরনের ব্যায়মচর্চা, "প্রতাপাদিত্য উৎসব" , "উদয়াদিত্য উৎসব"," বীরাষ্টমীব্রত" এবং "লক্ষীর ভান্ডার" গড়ে তোলেন।
- যতীন্দ্রনাথ বন্দোপাধ্যায়কে কলকাতায় গুপ্ত সমিতি গঠনে নানা ভাবে সাহায্য করেন।
(৪.) উল্লেখযোগ্য ব্যক্তিদের পরিচয়
- রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর,
- স্বামী বিবেকানন্দ,
- ভগিনী নিবেদিতা,
- বাল গঙ্গাধর তিলক,
- মহাত্মা গান্ধী,
- বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়,
- লালা লাজপত রায়, প্রমুখ।
সীমাবদ্ধতা
- সরলাদেবীর এই আত্মজীবনীটিতে তার সমগ্র জীবনের পরিচয় পাওয়া যায় না। বিবাহের আগে পর্যন্ত অর্থাৎ ১৮৭২ থেকে ১৯০৫ পর্যন্ত সময়কালের ইতিহাসটুকুই পাওয়া যায়।
- এই আত্মজীবনীটিতে ভারতের জাতীয়তাবাদী আন্দোলন ও নারী জাগরনে সরলাদেবীর সমগ্র কর্মকান্ড ও দৃষ্টিভঙ্গির সম্পূর্ণ প্রতিফলন ঘটে নি।