"জীবনস্মৃতি" রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের লেখা আত্মজীবনী। রবীন্দ্রনাথ অবশ্য নিজে একে আত্মজীবনী বলবার পক্ষপাতী ছিলেন না। তার ভাষায় - "জীবনস্মৃতি জীবন কথা নয়, স্মৃতিকথা"।
রবীন্দ্রনাথের "জীবনস্মৃতি" |
বিষয়বস্তু
একজন নিঃসঙ্গ বালক থেকে রবীন্দ্রনাথ কিভাবে কবি হয়ে উঠতে পেরেছিলেন, তারই স্মৃতিকথা ৪৫ টি পরিচ্ছেদের মধ্য দিয়ে কবি "জীবনস্মৃতি"তে তুলে ধরেছিলেন।
এখানে রবীন্দ্রনাথ তার ছোটবেলার -
- বাল্যজীবন,
- শিক্ষা জীবন,
- ঠাকুরবাড়ীর গৃহপরিবেশ ও নিয়ম কানুন,
- ঠাকুর বাড়ীর স্বদেশচিন্তা ও দেশাত্মবোধ,
- রবীন্দ্রনাথের সাহিত্য ও সংগীত সাধনা,
- পিতার সহিত হিমালয় যাত্রা,
- বিলেত ভ্রমন, ইত্যাদি বিষয় গুলি নিয়ে আলোচনা করেছিলেন।
প্রকাশকাল
প্রায় ৪৯ বছর বয়সে পদার্পণ করে রবীন্দ্রনাথ তাঁর জীবনকথা "জীবনস্মৃতি" লিখেছিলেন। এটি প্রথমে "প্রবাসী পত্রিকা" তে ধারাবাহিক ভাবে প্রকাশিত হয়েছিলো। পরে ১৯১২ খ্রিঃ এটি গ্রন্থাকারে প্রকাশিত হয়।
ঐতিহাসিক গুরুত্ব
জীবনস্মৃতিকে ইতিহাসের উপাদান হিসাবে ব্যবহার করার বিপদ হিসাবে, রবীন্দ্রনাথ পাঠককে সতর্ক করে দিয়ে বলেছিলেন -" স্মৃতি আর ইতিহাস এক নয়"।
কবির এই সতর্কবাণী সত্ত্বেও ঊনবিংশ শতাব্দীর দ্বিতীয়ার্ধের সামাজিক, এবং কিছু পরিমানে রাজনৈতিক ইতিহাস রচনার উপাদান হিসাবে গ্রন্থটি কে ব্যবহার করা যায়।
সংক্ষেপে এই গ্রন্থের ঐতিহাসিক গুরুত্বকে আমরা নিন্মলিখিত ভাবে তুলে ধরতে পারি -
(১.) রবীন্দ্র গবেষনায় সাহায্য
"জীবনস্মৃতি" রবীন্দ্র গবেষনায় প্রভূত সাহায্য করে থাকে। রবীন্দ্রনাথ তাঁর জীবনের প্রথম ২৫ বছরের ইতিহাস এই আত্মকথাতে তুলে ধরেছিলেন।
খুব স্বাভাবিক ভাবেই রবীন্দ্রনাথের গড়ে ওঠার পশ্চাৎপট এবং তার প্রতিভা বিকাশের প্রেক্ষাপট অনুসন্ধান করতে হলে বইটিতে প্রদত্ত তথ্যের মূল্য অপরিসীম।
(২.) ঠাকুরবাড়ীর অন্দরমহল সম্পর্কে তথ্য
ঊনবিংশ শতাব্দীর দ্বিতীয়ার্ধ থেকে বিংশ শতাব্দীর প্রথমার্ধ পর্যন্ত বাংলার ইতিহাসকে প্রভাবিত করেছিলো যে জোড়াসাঁকো ঠাকুরবাড়ীর, তার -
- অন্দরমহলের পরিবেশ,
- তার নানা প্রথা ও ঐতিহ্য,
- শিক্ষা, সঙ্গীত ও সাহিত্য চর্চা,
- পোশাক পরিচ্ছদ, বেশভূষা, সংস্কৃতি মনস্কতা, এবং
- বাংলা ভাষাচর্চা ও স্বদেশ প্রেম ইত্যাদি সম্পর্কে নানা অজানা কথা জানা যায়।
(৩.) সামাজিক ইতিহাস চর্চার উপাদান
জীবনস্মৃতি থেকে সামাজিক ইতিহাস রচনার নানা উপাদানও পাওয়া যায়। এই গ্রন্থ থেকে -
- তৎকালীন অভিজাত জমিদার বাড়ির জীবন ধারন পদ্ধতির এক ভিন্ন রূপের পরিচয় পাওয়া যায়,
- জানা যায় তৎকালীন অভিজাত পরিবারের সন্তানরা মা বাবা ও গুরুজনদের বদলে পরিচারক বা ভৃত্যদের তত্ত্বাবধানেই বড়ো হয়ে উঠতেন। রবীন্দ্রনাথের ছোটবেলাটা পরিচারকদের তত্ত্বাবধানেই কেটেছিলো।
- ঘরের কাজে নিযুক্ত পরিচারকরা প্রায়ই ছোটদের ওপর কর্তৃত্ব ফলাতো। তাদের কঠোর শাসনের মধ্যে রাখতো। অযথা বাড়ির বাইরে বেরোনোর ক্ষেত্রেও নিষেধাজ্ঞা আরোপ করতো।
- ঠাকুরবাড়ীর মেয়েরা যে যথেষ্ট স্বাধীনতা ভোগ করতেন, তারও নানা আভাস গ্রন্থটি থেকে পাওয়া যায়।
- জীবনস্মৃতিতে কলকাতা শহরের চাকচিক্য ও শৌখিনতার পাশাপাশি পল্লী স্বভাবের নানা চিহ্নও ধরা পড়ে। শহর কলকাতার ক্রম বিবর্তনের একটি রূপের আভাস জীবনস্মৃতি থেকে পাওয়া যায়।
- এছাড়া, তৎকালীন শিক্ষাদান পদ্ধতি, মাস্টারমশাইদের কঠোর অনুশাসন, শিশু শিক্ষার উপযোগী পাঠ্যপুস্তকের অভাব, নিরস শিক্ষা ব্যবস্থা সম্পর্কে নানা তথ্যের আভাস গ্রন্থটি থেকে পাওয়া যায়।
(৪.) রাজনৈতিক ইতিহাস চর্চার উপাদান
জীবনস্মৃতি থেকে খুব সামান্য রাজনৈতিক ইতিহাস চর্চার উপাদান পাওয়া যায়, তার গুরুত্ব যদিও ঠাকুরবাড়ীর ইতিহাস চর্চার ধারার সঙ্গেই সম্পৃক্ত।
জীবনস্মৃতির "স্বাদেশিকতা" পরিচ্ছেদ রবীন্দ্রনাথ এ সম্পর্কে কয়েকটি তথ্যের উল্লেখ করেছেন -
(ক.) হিন্দুমেলার পরিচয়
ঠাকুরবাড়ীর সহায়তায় নবগোপাল মিত্রের হিন্দুমেলা গঠনের তথ্য "জীবনস্মৃতি" থেকে পাওয়া যায়। হিন্দুমেলাকে সাংস্কৃতিক দিক থেকে পরিপুষ্ট করে তুলতে ঠাকুরবাড়ীর বিভিন্ন সদস্যরা যে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা নিয়েছিলেন, তার কিছু কিছু তথ্য রবীন্দ্রনাথ জীবনস্মৃতিতে তুলে ধরেছিলেন।
এই মেলা সেই সময় দেশবাসীর মনে কিভাবে জাতীয়তাবোধের জাগরন ঘটাতে পেরেছিলো, সে সম্পর্কে বলতে গিয়ে রবীন্দ্রনাথ লিখেছিলেন -
ঠাকুরবাড়ীর সাহায্যে "হিন্দু মেলা" নামে একটি মেলা তৈরি হয়েছিলো। ভারতকে ভক্তির সঙ্গে "স্বদেশ" মনে করবার উপলব্ধি এই মেলা থেকেই প্রথম হয়।
(খ.) গোপন স্বদেশী সভা
জীবনস্মৃতি থেকে জানা যায় জ্যোতিরীন্দ্রনাথ ঠাকুরের সহায়তায় রাজনারায়ন বসুর সভাপতিত্বে কলকাতায় একটি স্বদেশী সভা গড়ে উঠেছিলো। এই সভার সমস্ত কাজ কর্ম ও অনুষ্ঠান ভয়ংকরভাবে গোপন রাখা হতো।
স্বদেশী দেশলাই তৈরি বা স্বদেশী কাপড়ের কল তৈরির মতো স্বাদেশিকতামূলক বিভিন্ন কাজকর্মে এই সভা গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা নিয়েছিলো বলে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর উল্লেখ করেছেন। এ থেকে ঠাকুরবাড়ীর স্বাদেশিকতা চর্চার পরিচয় পাওয়া যায়।
(গ.) ভারতবর্ষের সর্বজনীন পরিচ্ছেদ
এই গ্রন্থ থেকে জানা যায়, দেশাত্মবোধ জাগরনে জ্যোতিরীন্দ্রনাথ ঠাকুর ভারতবর্ষের একটি সর্বজনীন পরিচ্ছেদের কথা ভেবেছিলেন এবং ধুতি পায়জামা সহযোগে একটি জাতীয় পোশাক তৈরি করেছিলেন।
আধুনিক ও রুচিশীল পোশাকবিধি রচনায় ঠাকুরবাড়ী যে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা নিয়েছিলো, সে সম্পর্কে এরকম অনেক তথ্যের আভাস জীবনস্মৃতি থেকে পাওয়া যায়।
সীমাবদ্ধতা
ইতিহাসের উপাদান হিসাবে রবীন্দ্রনাথের জীবনস্মৃতির বেশ কিছু সীমাবদ্ধতার কথা উল্লেখ করা যায় -
- এর সবথেকে বড়ো সীমাবদ্ধতা হলো, রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের সমগ্র জীবনের কথা এই আত্মজীবনী থেকে পাওয়া যায় না। মাত্র ২৫ বছরের কথাই জানা যায়।
- রাজনৈতিক ইতিহাস সম্পর্কে খুব বেশি তথ্য এই গ্রন্থ থেকে পাওয়া যায় না।
- এই গ্রন্থের আলোচনা মূলত ঠাকুরবাড়ীর অন্দরমহল ও কবির কাব্য - সংস্কৃতি চর্চার আখ্যানের মধ্যেই সীমাবদ্ধ।
- রবীন্দ্র গবেষকরা দেখিয়েছেন, রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের স্মৃতিশক্তি ছিলো খুবই দুর্বল। কোন কিছু খুব দীর্ঘ সময় তিনি মনে রাখতে পারতেন না। সম্ভবত একারনেই জীবনস্মৃতিতে এমন অনেক ভুল তথ্যের উল্লেখ তিনি করেছিলেন। যেমন তিনি ছেলেবেলায় ওরিয়েন্টাল সেমিনারিতে পড়ার কথা লিখেছিলেন। গবেষনায় দেখা যায়, এমন কোন স্কুলে রবীন্দ্রনাথ কখনো পড়েন নি। এছাড়া তিনি ছোটবেলায় গৃহভৃত্য শ্যামের যে ভয়ঙ্কর শাসনের উল্লেখ করেছিলেন, বাস্তবে দেখা যায় ঠাকুরবাড়ীতে সেই শ্যামের পদার্পণ ঘটে রবীন্দ্রনাথের পরিনত বয়সে।
সুতরাং ইতিহাসের উপাদান হিসাবে জীবনস্মৃতিকে ব্যবহার করতে হলে অবশ্যই এর সীমাবদ্ধতা এবং অন্যান্য উপাদান থেকে প্রাপ্ত তথ্যের সাথে এর সত্যতার দিক গুলিকে মিলিয়ে নিয়ে তবেই গ্রহন করতে হবে।