ভারতে পাশ্চাত্য শিক্ষা বিস্তারে রামমোহন রায়ের ভূমিকা

ভারতে পাশ্চাত্য শিক্ষার বিস্তারে ভারতীয় ব্যক্তিদের মধ্যে (১.) সবার প্রথমে সোচ্চার হয়ে ছিলেন, এবং (২.) সবথেকে বেশি সোচ্চার হয়েছিলেন, রাজা রামমোহন রায়

ভারতে পাশ্চাত্য শিক্ষা বিস্তারে রামমোহন রায়ের ভূমিকা
ভারতে পাশ্চাত্য শিক্ষার বিস্তারে রামমোহন রায়ের ভূমিকা 


 এ বিষয়ে রামমোহন রায়ের প্রধান উদ্যোগ ও পদক্ষেপ গুলি ছিলো নিন্মরূপ -

(১.) ইংরেজি ভাষা শিক্ষায় গুরুত্ব আরোপ

রামমোহন রায় প্রথম উপলব্ধি করেন, ইংরেজি ভাষা না শিখলে কখনোই পাশ্চাত্যের জ্ঞান বিজ্ঞানের ভান্ডার ভারতীয়দের কাছে উন্মুক্ত হবে না। কেননা পাশ্চাত্যের জ্ঞান বিজ্ঞান, দর্শন সবকিছুই ইংরেজি ভাষায় রচিত। তাই এদেশে  ইংরেজি ভাষা শিক্ষার প্রসারে রামমোহন রায় একেবারে শুরু থেকেই সোচ্চার হন এবং উদ্যোগ গ্রহণ করেন।

(২.) পাশ্চাত্য শিক্ষার স্বপক্ষে জনমত গঠন

ভারতে পাশ্চাত্য শিক্ষার স্বপক্ষে রাজা রামমোহন রায় জোরালো জনমত গঠন করেন। ১৮১৩ খ্রিঃ চার্টার আইনে ভারতে শিক্ষাখাতে বার্ষিক এক লক্ষ টাকা খরচের কথা বলা হলে  প্রাচ্য নাকি পাশ্চাত্য  কোন শিক্ষায় এই অর্থ বরাদ্দ করা হবে, তা নিয়ে বিতর্কটি দেখা যায়।

এই বিতর্কের সময় (ক.) ভারতে পাশ্চাত্য শিক্ষার স্বপক্ষে রামমোহন রায় সরকারকে জোরালো যুক্তি ও জনমত গঠন করে দেন, এবং (খ.) ১৮২৩ খ্রিঃ বড়োলাট আমহাস্টকে পাশ্চাত্য বিজ্ঞান ও শিক্ষার স্বপক্ষে দাবি জানিয়ে একটি পত্র লেখেন।

(৩.) শিক্ষা প্রতিষ্ঠান নির্মান ও শিক্ষা উদ্যোগে সহায়তা

রামমোহন রায় ইংরেজি ও পাশ্চাত্য শিক্ষার প্রসারের জন্য -

  • নিজ উদ্যোগে ১৮২২ খ্রিঃ অ্যাংলো হিন্দু স্কুল খোলেন,
  • হিন্দু কলেজ প্রতিষ্ঠায় পরোক্ষ ভাবে সাহায্য করেন, 
  • ডেভিড হেয়ারকে শিক্ষা বিস্তারের কর্মকান্ডে নানাভাবে সহায়তা করেন,
হেয়ারের বিভিন্ন বিদ্যালয় প্রতিষ্ঠা, কলকাতা স্কুল বুক সোসাইটি, এবং কলকাতা স্কুল সোসাইটির কর্মকান্ড গুলিতে কোন না কোনভাবে রামমোহন রায় জড়িয়ে ছিলেন। স্কুল বুক সোসাইটির তিনি একজন সক্রিয় সদস্য ছিলেন।

(৪.) মিশনারিদের শিক্ষা বিস্তারে সাহায্য

ভারতে পাশ্চাত্য শিক্ষার বিস্তারে রামমোহন রায় খ্রিষ্টান মিশনারিদের নানা ভাবে সাহায্য করেন এবং তাদের উৎসাহিত করেন। ১৮৩০ খ্রিঃ আলেকজান্ডার ডাফ কলকাতায় জেনারেল অ্যাসেম্বলিজ ইনস্টিটিউশন প্রতিষ্ঠায় উদ্যোগী হলে, তার প্রধান পরিপোষক ছিলেন রামমোহন রায়।

(৫.) স্ত্রী শিক্ষায় উদ্যোগ গ্রহণ

রামমোহন স্ত্রী শিক্ষার প্রসারেও উদ্যোগী হন। তিনি মিশনারিদের স্ত্রী শিক্ষার উদ্যোগ গুলিকে সমর্থন করেন এবং ১৮২২ খ্রিঃ "স্ত্রী শিক্ষা বিষয়ক" পুস্তিকা প্রকাশ করে প্রাচীন ভারতে নারী শিক্ষার ঐতিহ্যকে তুলে ধরেন। নারী শিক্ষার প্রসারে প্রতিষ্ঠান তৈরির জন্য তিনি জনমত সংগঠিত করেন।

(৬.) পাশ্চাত্য শিক্ষার উপযোগী পুস্তক রচনা

ভারতে পাশ্চাত্য শিক্ষার প্রসারে রামমোহন রায় - 
  • বিজ্ঞান বিষয়ক একাধিক বইও রচনা করেন। 
  • জ্যামিতি চর্চার জন্য তিনি "দ্রাঘিজা" নামে একটি পুস্তক রচনা করেন।
  •  গনিতশাস্ত্রে Geomerty র বাংলা জ্যামিতি নামকরন করেন। 
  • বিজ্ঞান বিষয়ক বেশ কিছু প্রবন্ধ "সম্বাদ কৌমুদি" পত্রিকায় প্রকাশ করেন। 
আধুনিক বিজ্ঞান শিক্ষায় এই বিপুল অবদানের জন্য অধ্যাপক ক্ষিতিমোহন সেন রামমোহনকে "ভারতে বিজ্ঞান চর্চার আদি গুরু" বলেছেন। 

(৭.) দেশীয় শিক্ষার অসাড়তার প্রমান 

রামমোহন রায়ই প্রথম শানিত যুক্তিতে দেশীয় শিক্ষার অসাড়তার দিকটি তুলে আনেন। যা পরোক্ষভাবে পাশ্চাত্য শিক্ষার বিস্তারের পথকে অনেকটাই সুগম করে দিয়েছিলো। এর যথার্থতার দিক সরকার ও জনগন পরবর্তীকালে উপলব্ধি করতে পেরেছিলেন। 

মূল্যায়ন 

১৮৩৫ খ্রিঃ ব্রিটিশ সরকার যখন পাশ্চাত্য শিক্ষাকে সরকারি "শিক্ষা নীতি" হিসাবে ঘোষনা করে, তখন রামমোহন রায় বেঁচে ছিলেন না ঠিকই । কিন্তু পাশ্চাত্য শিক্ষার স্বপক্ষে সরকারের এই ঘোষনায় পরোক্ষে তারই জয় সূচিত হয়। পাশ্চাত্য শিক্ষার প্রসারে রামমোহনের নিরলস প্রচেষ্টা, উদ্যোগ এবং স্বপ্ন এই সরকারি ঘোষনায় পূর্নতা লাভ করে।

 মনে রাখতে হবে - 
  1. ভারতে পাশ্চাত্য শিক্ষার উপকারীতার কথা  রামমোহনই প্রথম দেশবাসীকে বোঝান, 
  2. ভারতে পাশ্চাত্য শিক্ষার স্বপক্ষে এক অনুকূল পরিবেশের সৃষ্টি করেন। 
  3. সর্বোপরি, রামমোহনের মতো একজন  দক্ষ, শক্তিশালী দূরদর্শী ভারতীয়র সমর্থন,পৃষ্ঠপোষকতা এবং উদ্যোগের জন্যই তৎকালীন সময়ে পাশ্চাত্য শিক্ষার কার্যক্রম গুলি নির্ভয়ে প্রতিকূল পরিবেশের মধ্যেও এগিয়ে যেতে পেরেছিলো। 
ভারতে পাশ্চাত্য শিক্ষার বিস্তারে রামমোহন রায়ের ভূমিকাকে তাই "ভগীরথের" সঙ্গে তুলনা করা যায়। 


Post a Comment (0)
Previous Post Next Post