১৯১৯ খ্রিঃ ৪ ঠা মে, চিনের রাজধানী পিকিং এ কয়েক হাজার চিনা ছাত্র যে জাতীয়তাবাদী আন্দোলন ও বিক্ষোভ কর্মসূচি সংগঠিত করে তা অল্প সময়ের মধ্যেই এক বৃহৎ গনআন্দোলনের রূপ নেয়। এটি চিনের ইতিহাসে "৪ ঠা মে আন্দোলন" বা "মে ফোর্থ আন্দোলন" নামে পরিচিত।
চিনে ৪ ঠা মে আন্দোলন ও তার গুরুত্ব |
কারন
ইতিহাসে যেকোন আন্দোলনের ক্ষেত্রেই দুটি কারন গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা নিয়ে থাকে, একটি প্রত্যক্ষ কারন, অন্যটি পরোক্ষ কারন। চিনে ৪ ঠা মে আন্দোলনের ক্ষেত্রেও এই দুটো কারন গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা নিয়েছিলো।
প্রত্যক্ষ কারন
প্রথম বিশ্বযুদ্ধে চিন মিত্রপক্ষে যোগ দিয়েছিলো। চিন আশা করেছিলো, মিত্রপক্ষে যোগ দিলে বিদেশীদের কাছে হারিয়ে যাওয়া রাজ্যগুলো চিন পুনরুদ্ধার করতে পারবে। অসম চুক্তি গুলিও বাতিল হবে।
কিন্তু যুদ্ধ শেষে হিসেব নিকেষের জন্য যখন ১৯১৯ খ্রিঃ ফ্রান্সের রাজধানী প্যারিসে শান্তি সম্মেলন বসলো, তখন সেখানে চিনের সমস্ত মোহ ভঙ্গ হয়ে গেলো।
- বারংবার অনুরোধ সত্ত্বেও মিত্রপক্ষ চিনের সমস্যা গুলির কোন সমাধান করেন নি,
- চিন অসম চুক্তি সহ চিনের ওপর জাপানের ২১ দফা দাবিকে বাতিলের প্রস্তাব দিলে মিত্রপক্ষ তাকে "আলোচনা বহির্ভূত বিষয়" বলে বাতিল করে দেয়।
পরোক্ষ কারন
(১.) প্রজাতান্ত্রিক সরকারের ব্যর্থতা
(২.) ইউয়ান সি কাই এর একনায়কতন্ত্র
(৩.) ইউয়ান সি কাই এর নৃশংসতা
- তিনি নিজেকে সম্রাট হিসাবে প্রতিষ্ঠিত করার স্বপ্ন দেখতে থাকেন,
- এইজন্য বিদেশী শক্তি গুলিকে গোপনে নানা সুযোগ সুবিধা দিতে থাকেন,
- এর বিরুদ্ধে সান ইয়াৎ সেন "দ্বিতীয় বিপ্লবের" ডাক দিলে ইউয়ান বিরোধী শক্তির কন্ঠরোধ করেন,
- তিনি সেনাবাহিনী দিয়ে বিপ্লবীদের দমন ও হত্যা করেন,
- চিনে কুয়োমিনতাং দলকে নিষিদ্ধ করেন।
(৪.) চিনের ওপর জাপানের ২১ দফা দাবি
(৫.) গোপন সন্ধি এবং গন আন্দোলন
(৬.) জাতীয়তাবাদী বিভিন্ন শ্রেনীর জন্ম
(ক.) বনিক ও শিল্পপতি
(খ.) শিল্প শ্রমিকের উদ্ভব
(গ.) জাতীয়তাবাদী ছাত্র ও শিক্ষিত শ্রেনীর উদ্ভব
- আন্দোলন প্রথম শুরু করেছিলেন,
- আন্দোলনের নেতৃত্ব দিয়েছিলেন এবং
- অন্যদের আন্দোলনে এগিয়ে আসতে অনুপ্রাণিত করেছিলেন।
- পিকিং বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্ররাই প্রথম দেন,
- তারাই নেতৃত্ব দেন,
- আন্দোলনকে এগিয়ে নিয়ে যান,
- দেশবাসীকে আন্দোলনে সামিল হতে আহ্বান করেন।
আন্দোলনের সূচনা ও গতি প্রকৃতি
(১.) ছাত্রদের আন্দোলনের ডাক
- ১৯১৯ খ্রিঃ ৪ ঠা মে পিকিং এর ৩,০০০ ছাত্র তিয়েন আন মেন স্কোয়ারে সমবেত হয় এবং ২১ দফা দাবির সম্মতিপত্রে সই করা দেশদ্রোহী মন্ত্রীদের পদত্যাগ দাবি করে।
- ছাত্রদের দ্বারা মন্ত্রীদের বাড়িঘর আক্রান্ত হলে, সামরিক বাহিনী ও পুলিশদের সঙ্গে ছাত্রদের খন্ডযুদ্ধ বেঁধে যায়।
- এই ঘটনায় চিন সরকার পিকিং বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্যকে পদত্যাগ করলে আন্দোলন তীব্র হয়ে ওঠে।
- উপাচার্যকে পদত্যাগ করানোর প্রতিবাদে সমগ্র পিকিং জুড়ে ধর্মঘট পালিত হয়।
- ছাত্রদের দেশপ্রেমমূলক ও সাম্রাজ্যবাদ বিরোধী গান ও শ্লোগানে চিনা রাজপথ মুখরিত হয়ে ওঠে।
- ছাত্র আন্দোলন তীব্র হয়ে উঠলে পিকিং সরকার তীব্র দমন নীতি নিয়ে কয়েক হাজার ছাত্রকে গ্রেফতার করে।
(২.) শ্রমিক ও মধ্যবিত্ত, ব্যবসায়ী শ্রেনীর যোগদান
- শ্রমিক শ্রেণী ছাত্রদের সমর্থনে এগিয়ে আসে,
- প্রায় ৭০ হাজার শ্রমিক ছাত্রদের ধর্মঘটকে সমর্থন করে ও তাতে সামিল হয়,
- শিক্ষিত মধ্যবিত্ত শ্রেণী ও ব্যবসায়ীরাও বয়কট সহ নানা ধরনের প্রতিবাদী আন্দোলনে সামিল হয়।
মে ফোর্থ আন্দোলনের গুরুত্ব
- এই আন্দোলন চিন দেশে প্রবল দেশাত্মবোধের সঞ্চার করে। এই আন্দোলনের জনপ্রিয় শ্লোগান ছিলো - "জিউগুয়ো" অর্থাৎ দেশ বাঁচাও,
- এই আন্দোলনের চাপে শেষপর্যন্ত প্যারিস সম্মেলনে চিনা প্রতিনিধি দল ভার্সাই সন্ধিপত্রে স্বাক্ষর করা থেকে বিরত থাকে,
- এই আন্দোলনের তীব্রতা থেকে পশ্চিমি সাম্রাজ্যবাদীরা বুঝতে পেরেছিলো, চিনাদের মনে গভীর ক্ষত সৃষ্টি হয়েছে। তাতে প্রলেপ দেওয়ার প্রয়োজন আছে। বৃহৎ শক্তি গুলি তাই চিনের সমস্যা আলোচনা করবার জন্য ১৯২১ খ্রিঃ ওয়াশিংটন কনফারেন্স আহ্বান করেছিলো,
- ৪ ঠা মে আন্দোলন চিন দেশের আধুনিকতার পথ প্রশস্ত করেছিলো। চিনের আধুনিকীকরনের প্রকৃত সূচনা এই সময় থেকেই ঘটতে শুরু করে,
- ৪ ঠা মে আন্দোলনের মধ দিয়েই চিনে প্রথম ছাত্র ও শ্রমিক আন্দোলনের সূত্রপাত ঘটে,
- এই আন্দোলনে বৌদ্ধিক ও সাংস্কৃতিক জ্ঞান চর্চা থেকে জাতীয়তাবাদ প্রসারের যে চেষ্টা করা হয়, তা থেকে চিন সমৃদ্ধ হয় এবং ভবিষ্যত চিনের রূপরেখা তৈরি হয়ে যায়।
- বহু বইপত্র ও পত্র পত্রিকা প্রকাশ ও সাহিত্য রচনার মাধ্যমে চিনের সাংস্কৃতিক জাগরন ঘটে। পুরাতন ধ্যান ধারনার বদলে আধুনিক মতাদর্শ ও চিন্তা ভাবনার প্রসার ঘটে,
- এই সময় থেকে চিন দেশে মার্কসবাদ জনপ্রিয় হয়ে ওঠে। এক শ্রেণীর চিন্তাশীল মানুষ সমাজতন্ত্রের পথকেই চিনের উন্নতির একমাত্র সোপান বলে ভাবতে থাকেন।
- এই আন্দোলনের ফলে চিনের শ্রমিক শ্রেণী রাজনৈতিক সংগ্রামের আঙ্গিনায় প্রবেশ করে। কুয়োমিনতাং দলের পুনর্গঠন হয় এবং কমিউনিস্ট পার্টির উত্থান ঘটে,
- এই আন্দোলন থেকে চিনা জনগন উপলব্ধি করে স্বদেশের স্বাধীনতা এবং অখন্ডতা বজায় রাখতে সাম্রাজ্যবাদের বিরুদ্ধে আন্দোলন করা জরুরি। আর এই আন্দোলন একমাত্র সংগঠিত করতে পারে মার্কসীয় মতাদর্শ। রাজতন্ত্র ও প্রজাতন্ত্র অপেক্ষা সমাজতন্ত্রই মুক্তির শেষ এবং একমাত্র পথ।
মে ফোর্থ আন্দোলনের চরিত্র বা প্রকৃতি
- প্রথম পর্বে এটি ছাত্র আন্দোলন হিসাবে শুরু হলেও অচিরেই তা গন আন্দোলনে পরিনত হয়,
- জাতীয়তাবাদ ও সাম্রাজ্যবাদের বিরোধীতা ছিলো এই গন আন্দোলনের মূল ভিত্তি,
- অর্থাৎ জাতীয়তাবাদী চরিত্র এবং সাম্রাজ্যবাদ বিরোধী চরিত্র এই আন্দোলনের গুরুত্বপূর্ণ বৈশিষ্ট্য ছিলো,
- এই আন্দোলনের অর্থনৈতিক চরিত্রকেও অস্বীকার করা যায় না। বিদেশী শক্তি চিনের অর্থনীতিকে যেভাবে পঙ্গু করে দিয়েছিলো, তার বিরুদ্ধে এই আন্দোলনে ক্ষতিগ্রস্ত শ্রেনী গুলি ঐক্যবদ্ধ হয় এবং প্রতিবাদে সোচ্চার হয়,
- সর্বোপরি, এই আন্দোলনের একটি সাংস্কৃতিক দিকও ছিলো। এই আন্দোলনকে কেন্দ্র করে নানা সৃষ্টিশীল রচনা, গান, মতাদর্শের চর্চা, পুস্তক ও পত্র পত্রিকার প্রকাশ চিনের সাংস্কৃতিক জাগরন ঘটায়।