হুতোম প্যাঁচার নক্সা

 উনিশ শতকের বাংলা সাহিত্যের একটি অমূল্য গ্রন্থ ছিলো "হুতোম প্যাঁচার নকশা"। এর রচয়িতা ছিলেন কালীপ্রসন্ন সিংহ। মাত্র ২১বছর বয়সে তিনি এই গ্রন্থ রচনা করেন। হুতোম প্যাঁচার নকশা ছিলো - বাংলা ভাষায় লেখা "প্রথম সামাজিক ব্যঙ্গ সাহিত্য"।

হুতোম প্যাঁচার নকশা
হুতোম প্যাঁচার নকশা 


নকশা শব্দের অর্থ 

"নকশা" একটি বাংলা প্রতিশব্দ। কথ্য ভাষায় নকশা বলতে বোঝায় রেখাচিত্র

নকশা'র সংজ্ঞা

"নকশা" হলো হাস্যরস পরিপূর্ণ এক ধরনের ব্যঙ্গাত্মক রচনা, যার মাধ্যমে সামাজিক অনাচার ব্যক্তি বিশেষের চারিত্রিক ত্রুটি এবং অসঙ্গতির দিক গুলিকে বিদ্রুপ করা হতো এবং সামাজিক দোষ দূর করতে শিক্ষাদান করা হতো।

নকশা'র বৈশিষ্ট্য

নকশার মূল ৩ টি বৈশিষ্ট্য রয়েছে -

  1. এটি স্বপ্ন আয়োতনের হয়ে থাকে,
  2. এর ভাষা হয় লঘু ও ইঙ্গিতপূর্ন, অর্থাৎ যাকে ব্যঙ্গ রসে বিদ্রুপ করা হয় তার পরিচয়ের উল্লেখ এখানে সরাসরি থাকে না।
  3. অনেক সময় ব্যঙ্গ বিদ্রুপকে জোরদার করতে অতিরঞ্জন বা ভাড়ামি করা হয়ে থাকে। 

হুতোম প্যাঁচার পরিচয়

"হুতোম প্যাঁচার নকশা" গ্রন্থে "হুতোম প্যাঁচা" ছিলেন স্বয়ং কালীপ্রসন্ন নিজে। এটি ছিলো তার ছদ্মনাম

এই গ্রন্থে কালীপ্রসন্ন কলকাতার নাগরিক সমাজের অন্ধকার দিক গুলিকে তুলে আনেন। তৎকালীন সমাজের সামাজিক শৈথিল্য, অনাচার, দ্বিচারিতা, ভন্ডামি, জাল জোচ্চুরি সব কিছুই তিনি অত্যন্ত নিখুঁত ভাবে বর্ননা করেন।

প্যাঁচা নিশাচর প্রানী। তাই সে অন্ধকারের আড়ালে সবকিছুই প্রত্যক্ষ করে নিতে পারে। অথচ যাকে সে প্রত্যক্ষ করছে, সে কিন্তু তা বুঝতে পারে না। 

হুতোম প্যাঁচার নকশাতে তৎকালীন সময়ের এমন অনেক ব্যক্তির নকশা কালীপ্রসন্ন এঁকেছিলেন, যারা আদতে বুঝতেই পারেন নি, হুতোমের নকশা আসলে তাদেরই নকশা। লেখক নিজেও এই নকশাধারী ব্যক্তিদের দলেই পড়েন। 

প্রকাশকাল 

হুতোম প্যাঁচার নকশা প্রথম প্রকাশিত হয় "বিবিধার্তসমগ্র" দৈনিক পত্রিকায়। 
  • ১৮৬২ খ্রিঃ এর প্রথম ভাগ প্রকাশিত হয়। 
  • ১৮৬৪ খ্রিঃ প্রথমদ্বিতীয় ভাগ একত্রে প্রকাশিত হয়। 

বৈশিষ্ট্য 

"হুতোম প্যাঁচার নকশা" গ্রন্থের বেশ কিছু উল্লেখযোগ্য বৈশিষ্ট্য লক্ষ্য করা যায় - 
  1. এই গ্রন্থটি ছিলো ঊনবিংশ শতাব্দীর কলকাতার নাগরিক জীবনের এক "জীবন্ত দর্পন", 
  2. হুতোমের লেখায় লেখক কোন কল্পনার আশ্রয় নেন নি, 
  3. এর সব চরিত্র ও ঘটনাই বাস্তব সমাজ থেকে তুলে আনা হয়েছিলো, 
  4. ব্যঙ্গাত্মক এবং ঈঙ্গিতপূর্ন পরিবেশনা এই গ্রন্থের অন্যতম একটি বৈশিষ্ট্য ছিলো, 
  5. সমকালীন সময়ের ব্যঙ্গ সাহিত্য গুলির তুলনায় এই গ্রন্থ অনেকটাই ভাড়ামিঅশ্লীলতা মুক্ত ছিলো, 
  6. এই গ্রন্থেই প্রথম কলকাতার কথ্য বা চলিত ভাষার প্রয়োগ করা হয়। অর্থাৎ এটি ছিলো চলিত ভাষায় লেখা প্রথম বাংলা গ্রন্থ। 
  7. বাংলা সাহিত্যের ইতিহাসে এই গ্রন্থেই প্রথম সংস্কৃত ঘেষা বাংলাকে সংস্কৃত শব্দের বেড়াজাল থেকে মুক্ত করে কালীপ্রসন্ন কথ্য ভাষায় হাজির করেন। 

গ্রন্থের আলোচ্য বিষয়বস্তু 

হুতোম প্যাঁচার নকশায় গল্প বা উপন্যাসের মতো কোন একক কাহিনীকে তুলে ধরা হয় নি। এখানে উনিশ শতকের নাগরিক কলকাতার কিছু টুকরো টুকরো কচড়া বা কোলাজের বাস্তবিক ছবিকে লেখক তুলে এনেছিলেন। গ্রন্থটির দুটি ভাগ ছিলো। প্রথম ভাগের আলোচ্য বিষয়বস্তুর মধ্যে অন্যতম ছিলো - 
  • কলিকাতার চড়কপার্বন, 
  • কলিকাতার বারোয়ারি পুজা, 
  • হুজুক, 
  • প্রতাপচাঁদ, 
  • মহাপুরুষ, 
  • নানা সাহেব, 
  • আমাদের জাতি ও নিন্দুকেরা, 
  • ছুঁচোর ছেলে বুঁচো, 
  • ছেলেধরা, 
  • ক্রিশ্চানি হুজুগ, 
  • সাতপেয়ে গরু, 
  • দরিয়াই ঘোড়া, 
  • লখনৌয়ের বাদশা, 
  • মিউটিনি, 
  • টেকচাঁদের পিসি, 
  • হঠাৎ অবতার, 
  • পাদ্রি লং ও নীলদর্পন, 
  • নাককাটা বঙ্ক, 
  • হোসেন খাঁ, 
  • রসরাজ ও যেমন কম্ম তেমন ফল, 
  • ভূত নাবানো, মাহেশের স্নানযাত্রা, ইত্যাদি।
দ্বিতীয় ভাগে - 
  • রথ, 
  • দুর্গোৎসব, 
  • রামলীলা ও 
  • রেলওয়ে নিয়ে আলোচনা করা হয়েছে। 

ঐতিহাসিক গুরুত্ব 

হুতোম প্যাঁচার নকশা লেখক কোন কাল্পনিক প্রেক্ষাপটে রচনা করেন নি। বাস্তবে যা দেখেছিলেন, সেটাই তুলে ধরেছিলেন। ছদ্মনাম ব্যতিত এর সব চরিত্র ও ঘটনা গুলিই ছিলো বাস্তব। তৎকালীন কলকাতা শহরের বাঙালির আচরন, মানসিকতা, জীবনযাত্রা, ভাষা, সংস্কৃতি সবকিছুই তিনি হুবহু তার নকশাতে তুলে ধরেছিলেন। এত জীবন্ত, প্রানবন্ত বাস্তবিক ছবি ইতিহাসের আর অন্য কোন উপাদান থেকে পাওয়া যায় না। 

এইজন্য উনিশ শতকের কলকাতার নাগরিক জীবনের যথার্থ পরিচয় জানতে হুতোমের নকশাতে ঐতিহাসিকরা এত বেশি গুরুত্ব আরোপ করে থাকেন। উনিশ শতকে কলকাতার নাগরিক সমাজের বাস্তব ছবিকে খুঁজে পেতে হুতোমের নকশা ব্যতিত আর কোন যথার্থ বিকল্প উপাদান ইতিহাসে তেমন নেই।এই কারনে বাংলা সাহিত্যের এই গ্রন্থটির ইতিহাসে এত গুরুত্বপূর্ণ বলে মনে করা হয়। 

হুতোমের লেখায় কলকাতা শহরের সমাজ চিত্র 

আঠারো শতকের শেষদিক থেকে উনিশ শতকের ৭০ এর দশক পর্যন্ত, কলকাতার নাগরিক সমাজের ছবি হুতোম প্যাঁচার নকশা থেকে পাওয়া যায়। 

এই গ্রন্থে লেখক (ক) কলকাতার সমাজ জীবনের শৈথিল্য, (খ) চরিত্রহীনতা এবং (গ) নাগরিক সমাজের অন্ধকার দিক গুলিকে তুলে ধরেছিলেন। এককথায়, এটি ছিলো সমগ্র উনিশ শতকের সমাজ জীবনের এক জীবন্ত দর্পন। 

হুতোমের নকশা থেকে উনিশ শতকের কলকাতা নাগরিক সমাজের যে চিত্র গুলি উঠে আসে তা আমরা নিন্মলিখিত ভাবে তুলে ধরতে পারি - 

(১.) সমাজ বিন্যাসের বদল

ইংরেজ শাসনের সূত্র ধরে কলকাতার সমাজ বিন্যাসে বদল আসে। আগেকার কৃষ্ণচন্দ্র, রাজবল্লভ, মানসিংহ, নন্দ কুমার, জগৎ শেঠ প্রভৃতি বড়ো বড়ো বংশ গুলির পতন ঘটে এবং তার জায়গায় নতুন জাতি ও বংশের উত্থান ঘটে। এদের মধ্যে অন্যতম ছিলো মল্লিক পরিবার, শীল পরিবার, ঘোষ পরিবার, মিত্তির পরিবার ইত্যাদি। 

(২.) সামাজিক শ্রেনী বিন্যাস

উনিশ শতকে কলকাতার উচ্চবর্গের সমাজ সাধারনত ৩ টি শ্রেনীতে বিভক্ত ছিলো - 
  1. ইংরেজি শিক্ষিত সাহেবি চালচলনের অন্ধ অনুকরনকারী
  2. ইংরেজি শিক্ষিত নব্য পন্থী, যারা সাহেবি চালচলনের অনুকরনকারী নয়, এবং 
  3. ইংরেজি না জানা গোড়া হিন্দু সমাজ। 
লেখক নিজেও স্বয়ং এই তিনটি সমাজের একটিতে অন্তর্ভুক্ত ছিলেন বলে উল্লেখ করেছেন। 

(৩.) সামাজিক কপটতা

উপরে উল্লেখিত ৩ টি শ্রেনীই কমবেশি জাল জোচ্চুরি ও নানা ফন্দি ফিকির করে প্রচুর অর্থ উপার্জন করতেন। "মহাপুরুষ", "সাতপেয়ে গরু", "ভুত নাবানো" ইত্যাদি নকশায় লেখক এই কপটতাকে তুলে ধরেছেন। 

এ থেকে দুটো বিষয় বোঝা যায় - 
  • এক, উনিশ শতকে ঔপনিবেশিক শাসনের হাত ধরে কলকাতা ও সংলগ্ন এলাকায় প্রচুর অর্থের সমাগম হয়েছিলো। এবং 
  • দুই, সেই সময় নাগরিক সমাজে ভয়ঙ্কর রকম নৈতিক অধঃপতন ঘটেছিলো। 

(৪.) সামাজিক অনাচার ও অসঙ্গতি 

হুতোমের নকশায় কলকাতার উচ্চবর্নের নানা সামাজিক অনাচার ও অসঙ্গতির দিক গুলোও উঠে এসেছিলো। এর মধ্যে অন্যতম ছিলো - "গনিকা বিলাস", "ভ্রুনহত্যা", "মদ্যপানের এলাহি আয়োজন" ইত্যাদি। 

এই ঘটনা গুলি থেকে বোঝা যায়, কি পরিমান চারিত্রিক শৈথিল্য সেসময় কলকাতার সমাজে বিদ্যমান ছিলো। 

(৫.) উল্লেখযোগ্য নাগরিক শ্রেনীর পরিচয় 

হুতোমের নকশা থেকে উনিশ শতকে কলকাতা শহরের বেশ কিছু প্রভাবশালী শ্রেনীর কথা জানতে পারা যায়। এরা কেউই ধোওয়া তুলসিপাতা ছিলেন না। সবার মধ্যেই ছিলো শৈথিল্য, দ্বিচারিতা ও নানা অনাচার। 

এইসব মানুষজনের মধ্যে ছিলেন - শিক্ষিত যুবক, ঘোর ব্রাহ্ম, মোসাহেব পরিবৃত জমিদার, কেরানি, দোকানি, পুরুত ঠাকুর, "মিশিদাঁতে রংদার", জুতোপায়ে নবীন সাগর ইত্যাদি। 

এদের দ্বিচারিতার উদাহরন দিতে গিয়ে হুতোম সেই সময়ের জনৈক কিছু ব্রাহ্মের আড়ালে বিষ্ণু নাম ভজন, দুর্গাপুজো, ইত্যাদি হিন্দুয়ানী পালন, এবং প্রকাশ্যে চোখ বন্ধ করে ব্রাহ্ম উপাসনার ধ্যান করার ন্যাকামিকে তীব্র ব্যঙ্গ রসে বিদ্ধ করেছিলেন।

(৬.) কলকাতার বাবু কালচার

হুতোমের নকশায় কলকাতায় হঠাৎ করে ফুলে ফেঁপে ওঠা ধনী বাবু সমাজের কথা জানা যায়। এই ধনী বাবুরা সাহেবদের অন্ধ অনুকরন করতেন এবং নানা হুজুগে অর্থের অপচয় করতেন। কুকুরে বিয়েতে লাখ টাকা খরচ করা থেকে শুরু করে "তেল মেখে চার ঘোড়ার গাড়ি চড়ে ভেঁপু বাজিয়ে স্নান কত্তে যাওয়া" সবকিছুতেই তারা অঢেল টাকা ওড়াতেন। 

মদ্যপান, বাঈজীয়ানা এবং নানা হুজুগে অর্থব্যায় করে দেখনদারির যে সংস্কৃতির জন্ম তারা দিয়েছিলেন, তাকেই "বাবু কালচার" বলা হয়। হুতোমের নকশায় লেখক এই বাবু সমাজের বহু বিচিত্র ও বহু উদ্ভট বাবুয়ানির উল্লেখ করেছিলেন। 

(৭.) কলকাতার উৎসব ও পার্বন 

হুতোমের নকশা থেকে জানা যায়, উনিশ শতকে কলকাতার সমাজে "বারো মাসে তেরো পার্বন" লেগেই থাকতো। এই সব উৎসব গুলির মধ্যে অন্যতম ছিলো - চরকপুজা, নীল ষষ্ঠী, রামলীলা, রথযাত্রা, বারোয়ারি দুর্গাপুজো, মাহেশের রথযাত্রা ইত্যাদি। 

এইসব উৎসব পার্বন গুলি থেকে বোঝা যায়, গ্রামীন সংস্কৃতির ধারা থেকে কলকাতা তখনও  পুরোপুরি পৃথক হয়ে যায় নি। 

(৮.) কলকাতা শহরের সংস্কৃতি 

হুতোমের নকশা থেকে উনিশ শতকে কলকাতা শহরের সংস্কৃতির পরিচয় পাওয়া যায়। এই সময়ের শহর কলকাতার উল্লেখযোগ্য সংস্কৃতির মধ্যে ছিলো - 
  • নীলের ব্রত, 
  • রাধাষ্টমী পালন, 
  • গাজন সন্ন্যাসীদের শিবের কাছে মাথা দোলানো, 
  • যাত্রা গান, 
  • বুলবুলের গান, 
  • খ্যামটা নাচ, 
  • অশ্লীল শব্দযুক্ত আখরাই গান ইত্যাদি। এসব ছাড়াও বাঈজীগান, মদ্যপান ও হুজুগে বাবু সংস্কৃতি তো ছিলোই। 

(৯.) সমাজের হুজুগ প্রিয়তা 

হুতোমের লেখনী থেকে বোঝা যায়, উনিশ শতকে কলকাতার সমাজ ছিলো অনেক বেশি হুজুগ প্রিয়। "কলিকাতার চড়ক পার্বন" , "কলিকাতার বারোয়ারি পুজা", "মাহেশের স্নানযাত্রা" , "হঠাৎ অবতার" - ইত্যাদি নকশায় তৎকালীন সমাজের হুজুক প্রিয়তার ছবি ধরা পড়েছে। 

এইসব হুজুগ এমনই যে এর উদাহরন দিতে গিয়ে লেখক লিখেছেন - "বারোইয়ারি পুজার প্রতিমা পুজা শেষ হলেও বারো দিন ফ্যালা হয় না। চড়কও বাসি.."। 

এইসব অনুষ্ঠান গুলিতে নানা ধরনের অপকর্ম কিভাবে অবলীলায় অনুষ্ঠিত হতো, তা হুতোমের নকশা না থাকলে কখনোই জানা যেতো না। 

(১০.) সমাজের নানা গুজব ও কেচ্ছা 

উনিশ শতকে" কৃশ্চানি হুজুগ"," মিউটিনি" অর্থাৎ ১৮৫৭ খ্রিঃ সিপাহী বিদ্রোহ, বিধবা বিবাহ, নীল বিদ্রোহ নিয়ে নানা ধরনের গুজব রটেছিলো কলকাতার সমাজে। এ থেকে বোঝা যায়, উল্লেখিত ঘটনা গুলি কিভাবে কলকাতার নাগরিক সমাজকে প্রভাবিত করেছিলো। 

এরকমই একটি গুজব ছিলো - "বিধবাবিবাহ হওয়াতে সেপাইরে খেপেচে, গবর্নমেন্ট বিধবাবিবাহ আইন তুলে দিয়েছেন - বিদ্যাসাগরের কম্ম গিয়েছে - প্রথম বিধবাবিবাহের বর শিরিশের ফাঁসি হবে।" 

সমকালীন কলকাতার এইসব গুজব ও নানা ধরনের কেচ্ছার রটনা থেকে দুটো বিষয় বোঝা যায় - 
  • এক, আকার ও আয়তনে তখন কলকাতা ছিলো বেশ ছোটো। এর জনসংখ্যা ছিলো কম। আধা গ্রাম আধা শহরাঞ্চলের উপস্থিতির জন্য গ্রামীন সমাজের বৈশিষ্ট্য গুলি তখনও কলকাতার সমাজে সমান মাত্রায় উপস্থিত ছিলো। 
  • দুই, কোলকাতায় অবস্থিত লোকেদের একটা বড়ো অংশ ছিলো নিষ্কর্মা ও অজ্ঞ। এইসব লোকেদের জন্যই কেচ্ছা ও গুজব গুলি দ্রুত নাগরিক সমাজে ছড়িয়ে পড়তো। 

(১১.) কলকাতার কথ্য ভাষা ও সামাজিক আচরন

হুতোমের নকশা তৎকালীন সময়ের অন্যান্য সাহিত্য গ্রন্থ গুলির মতো সাধু ভাষায় লেখা হয় নি। সমকালীন সময়ের  কথ্য ভাষায় লেখা হয়েছিলো। এটিই ছিলো এই গ্রন্থের সবচেয়ে মূল্যবান সম্পদ। 

এ থেকে আমরা উনিশ শতকের কলকাতার কথ্য ভাষার রূপ কেমন ছিলো, তা জানতে পারি। 

কথ্য ভাষা ছাড়াও, মোটামুটি এই সময় কলকাতার বাঙালি সমাজের চিন্তা ভাবনা, আচার আচরন, স্বভাব চরিত্র, কেমন ছিলো তারও একটি আভাস পেয়ে থাকি। 

হুতোমের লেখনীতে বাংলা পঞ্জিকার নানা সাল, তারিখের উল্লেখ থেকে এটিও অনুমান করা যায়, উনিশ শতকে কলকাতায় বাঙালিদের মধ্যে বাংলা পঞ্জিকার চল ও জনপ্রিয়তা ছিলো গ্রামীন সমাজের মতোই। অন্তত ইংরেজী সাল তারিখের ব্যবহার এযুগের মতো তখন অতটা জনপ্রিয় হয়ে ওঠে নি। 

(১২.) কলকাতার খাদ্যাভ্যাস ও পোশাক পরিচ্ছদ 

হুতোম প্যাঁচার নকশা থেকে উনিশ শতকে কলকাতার উচ্চবর্নের লোকেদের খাদ্যাভ্যাস, পোশাক আশাকযানবাহন সম্পর্কে অনেক তথ্য পাওয়া যায়। 
  • মুক্ত ভষ্মের চূর্ন দিয়ে বড়োলোকেদের পান খাওয়ার রেওয়াজ,
  • তামাক টানা, 
  • পেয়ালা করা চা, 
  • চুরোট খাওয়া,
  •  জগে করে জল পান, 
  • চেয়ার টেবিলে কাঁচের গ্লাসে মদ্যপান,
  •  বাবুদের হরেক রকম কায়দায় টুপি পড়ার বাহার,
  • আটপৌরে ধুতির ব্যবহার, 
  •  কমোডের ব্যবহার,
  • বাহারি শালের ব্যবহার, 
  • কলকাতার রাস্তায় গরুর গাড়ির ব্যবহার, 
  • স্কয়াভেঞ্জরের গাড়ি, 
  • ইত্যাদির কথা প্রসঙ্গক্রমে বলা যায়। 

মূল্যায়ন - শেষকথা 

সবথেকে বড়ো কথা, গ্রামীন সমাজ থেকে কলকাতার নাগরিক সমাজে উত্তরনের মধ্যবর্তী পর্যায়টির এক পরিপূর্ণ ইতিহাস হুতোম প্যাঁচার নকশা থেকে পাওয়া যায়। 

হুতোমের লেখনী থেকে তাই সমাজ কলকাতার ইতিবৃত্ত যেমন জানা যায়, তেমনই উনিশ শতকের গ্রাম বাংলার সামাজিক বৈশিষ্ট্য গুলিকেও খুঁজে পাওয়া যায়। 

Post a Comment (0)
Previous Post Next Post