ইতিহাসের উপাদান হিসাবে "সরকারি নথিপত্র"

 আধুনিক ভারতের ইতিহাস চর্চার উপাদান গুলির মধ্যে সবথেকে গুরুত্বপূর্ণ হলো "সরকারি নথিপত্র"। 

ইতিহাসের উপাদান হিসাবে সরকারি নথিপত্র
ইতিহাসের উপাদান হিসাবে সরকারি নথিপত্র


সরকারি নথিপত্রের সংজ্ঞা
 

সরকারের অধীনস্থ বিভিন্ন শ্রেণির কর্মচারী ও আধিকারিকদের লিপিবদ্ধ বিবরন, প্রতিবেদন ও চিঠিপত্রকেই এককথায় “সরকারি নথিপত্র” বলা হয়। 

অর্থাৎ সহজ করে বলতে গেলে সরকারের যাবতীয় কাজকর্ম লিখিত ডকুমেন্টের মধ্য দিয়েই পরিচালিত হয়। এই লিখিত ডকুুমেন্ট বা তথ্য গুলিকেই "সরকারি নথিপত্র" বলা হয়। 

সরকারি নথিপত্রের সংরক্ষণ ও মহাফেজখানা

সরকারি নথিপত্র খুব যত্ন করে লেখা হয় এবং তা সংরক্ষণ করা হয়। সরকারি নথিপত্র যেখানে সংরক্ষণ করে রাখা হয় তাকে বলা হয় “মহাফেজখানা” বা আর্কাইভস। ভারতে মুঘল আমলেই প্রথম সরকারি নথিপত্র সংরক্ষণের প্রথা প্রচলিত হয়। ইংরেজ শাসনকালে ব্রিটিশ পদ্ধতি মেনেই সরকারি নথিপত্রের সংরক্ষণ করা হতো। 

ব্রিটিশ আমলে সরকারি মহাফেজখানা ছিলো ৪ টি। 
  1. কলকাতা
  2. দিল্লি
  3. মুম্বাই এবং 
  4. মাদ্রাজ (চেন্নাই)
স্বাধীনতার পর কেন্দ্রীয় সরকারের নথিপত্র সংরক্ষণের জন্য "সেন্ট্রাল আর্কাইভস" এবং রাজ্য সরকারের নথিপত্র সংরক্ষণর জন্য "স্টেটস আর্কাইভস" গড়ে তোলা হয়। সাধারন নিয়ম হলো, ২৫ বছরের পুরাতন সরকারি নথিপত্র গুলিকে আর্কাইভসে পাঠাতে হবে বা সংরক্ষণ করতে হবে। বর্তমানে ভারতের জাতীয় মহাফেজখানা দিল্লিতে অবস্থিত। 

সরকারি নথিপত্রের প্রকারভেদ

 সরকারি নথিপত্রকে সাধারণত ৪ টি ভাগে ভাগ করা হয়ে থাকে। যথা –
  1. পুলিশি প্রতিবেদন
  2. গোয়েন্দা বিভাগের গুপ্ত প্রতিবেদন
  3. সরকারি আধিকারিকদের প্রতিবেদন
  4.  সরকারের বিভিন্ন কর্মচারী ও আধিকারিকদের মধ্যে প্রেরিত চিঠিপত্র। 
এর মধ্যে প্রথম দুটি অর্থাৎ পুলিশি প্রতিবেদন এবং গোয়েন্দা বা স্বরাষ্ট্র দফতরের নথিপত্রকে "গোপন নথিপত্র" হিসাবে ধরা হয়। এই নথিপত্র গুলি নির্দিষ্ট সময় পেরিয়ে গেলেও, সবসময় সর্বসাধারনের কাছে উন্মুক্ত করে দেওয়া হয় না। সরকারি আধিকারিকদের বিবরন, প্রতিবেদন এবং সরকারি দফতরের চিঠিপত্র গুলি "সাধারণ নথি" র মধ্যে পড়ে। 

 সরকারি নথিপত্রের সংক্ষিপ্ত পরিচয় 


(ক) পুলিশ ও গোয়েন্দা বিভাগের প্রতিবেদন :-

এদেশে আইনশৃঙ্খলা রক্ষার জন্য ব্রিটিশ সরকার ১৭৯৩ খ্রিঃ "পুলিশ বিভাগ" (লর্ড কর্নওয়ালিশ) গঠন করে এবং এর ৮৪ বছর পর ১৮৮৭ খ্রিঃ "গোয়েন্দা বিভাগ" স্থাপন করে। ১৯২১ খ্রিঃ এর নাম হয় “ইন্ডিয়ান পলিটিক্যাল ইন্টেলিজেন্স ডিপার্টমেন্ট”। স্বাধীনতা লাভের পর এই গোয়েন্দা দফতরের নতুন নাম হয় “ইন্টেলিজেন্স ব্যুরো” বা IB । আই বি. ছাড়াও বর্তমানে ভারতের গোয়েন্দা বিভাগ গুলি হলCID, ED, CBI ।

পুলিশ ও গোয়েন্দা বিভাগ নানা সময়ে যে গুপ্ত প্রতিবেদন গুলি সরকারের কাছে পাঠায়, তাই "সরকারি নথিপত্র" হিসেবে  পরবর্তী কালে মহাফেজখানায় সংরক্ষিত হয়।

(খ) সরকারি আধিকারিকদের প্রতিবেদন :-

সরকারি প্রশাসন পরিচালনায় একেবারে শীর্ষে থাকেন সরকারি আধিকারিকরা। সরকারের কর্মদক্ষতা এদের ওপরেই নির্ভর করে। 

  1. সাধারণত কোন অঞ্চলে, বড়ো কোন ঘটনা ঘটলে তার বিবরন, কারন ও প্রকৃতি অনুসন্ধানের জন্য স্থানীয় উচ্চপদস্থ আধিকারিকদের কাছ থেকে সরকারের তরফ থেকে রিপোর্ট চেয়ে পাঠানো হয়। 
  2.  এছাড়া, কোন বিতর্কিত বিষয়ের সমাধানের জন্য আধিকারিকদের নিয়ে অনেক সময়েই সরকার কমিশন, কমিটি, বা সমীক্ষক, নিয়োগ করে থাকে। এক্ষেত্রে আধিকারিকরা যে রিপোর্ট বা বিবরন সরকারের কাছে পেশ করে, তাকেই "আধিকারিকদের প্রতিবেদন" বলা হয়ে থাকে। এই প্রতিবেদন গুলি ইতিহাস রচনায় সরকারি নথি হিসাবে খুবই গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে থাকে। 

উদাহরন  হিসাবে এক্ষেত্রে আমরা - ১. হান্টার কমিশনের রিপোর্ট, ২. নীল কমিশনের রিপোর্ট, ৩.মেকলের প্রতিবেদন, এবং ৪. ১৯০৩ খ্রিঃ স্বরাষ্ট্র সচিব হার্বাট রিজলের বঙ্গভঙ্গের প্রতিবেদনের কথা বলতে পারি। 

(গ) সরকারি চিঠিপত্র :-

১. সরকারি কাজ নিয়ে বিভিন্ন দপ্তরের মধ্যে প্রায়ই চিঠি চালাচালি চলে, 

২. অনেক সময় সরকারের তরফ থেকে বিভিন্ন রাজনৈতিক দল ও নেতাদের কাছে চিঠি পাঠানো হয়, 

৩. আবার রাজনৈতিক দল বা প্রভাবশালী ব্যক্তিদের তরফ থেকেও বিভিন্ন দাবি দাওয়া বা সমস্যা সম্পর্কে সরকারকে চিঠি পাঠানো হয়, 

এই চিঠিগুলিই একসঙ্গে "সরকারি চিঠিপত্র" নামে পরিচিত। সরকারি নথি হিসাবে সরকারি চিঠিপত্র খুবই গুুরুত্বপূর্ণ। অনেক সময়ে সরকারি চিঠিপত্র থেকেও অনেক নতুন তথ্য পাাওয় যায়। 

 দুটি গুুরুত্বপূর্ণ সরকারি চিঠির উদাহরন হল - 
  •  এদেশে পাশ্চাত্য শিক্ষার বিস্তারের অনুরোধ জানিয়ে লর্ড আমহার্স্টকে রামমোহন রায়ের পাঠানো চিঠি।
  • বঙ্গভঙ্গের প্রকৃত উদ্দেশ্যকে ব্যাখ্যা করে ১৯০৫ খ্রিঃ ভারত সচিব ব্রোডরিখকে লেখা লর্ড কার্জনের চিঠি।

সরকারি নথিপত্রের গুরুত্ব

ইতিহাসের উপাদান হিসেবে সরকারি নথিপত্র খুবই গুরুত্বপূর্ণ,

প্রথমত, সরকারি নথিপত্রের মধ্যে পুলিশ ও গোয়েন্দা বিভাগের রিপোর্ট এবং ভারত সরকারের স্বরাষ্ট্র দফতরের প্রতিবেদন গুলি ব্যবহার করেই (১.) ভারতের স্বাধীনতা সংগ্রামের ইতিহাস (২.) শ্রমিক ও কৃষক আন্দোলনের ইতিহাস (৩.) বিপ্লবী আন্দোলনের ইতিহাস যথার্থ ভাবে রচনা করা সম্ভব হয়েছে।

দ্বিতীয়ত, সরকারি আধিকারিকদের প্রতিবেদন ও চিঠিপত্র থেকেই ভারতে –
  1.  ১৯০৫ খ্রিঃ বঙ্গভঙ্গের প্রকৃত কারণ ও উদ্দেশ্য জানা সম্ভব হয়েছে,
  2. নীল কমিশনের রিপোর্ট থেকে নীলবিদ্রোহের কারন এবং বিদ্রোহের প্রতি সরকারের মনোভাব জানা সম্ভবপর হয়েছে,
  3.  হান্টার কমিশনের রিপোর্ট থেকে ঔপনিবেশিক ভারতে শিক্ষার অগ্রগতির দিকটি পরিমাপ করা গেছে, এছাড়া,
  4.  ভারতছাড়ো আন্দোলনের সময় ইংল্যান্ডে প্রেরিত ভারতের ব্রিটিশ সরকারের প্রতিবেদন থেকে বোঝা গেছে, ভারতে ব্রিটিশ সাম্রাজ্যের অবসান সম্পর্কে তৎকালীন ব্রিটিশ সরকার একরকম নিশ্চিত ছিল।

তৃতীয়ত, সরকারের প্রদত্ত বিভিন্ন সমীক্ষা ও জনগননার রিপোর্ট গুলিও ইতিহাস রচনায় গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা নিয়ে থাকে। 

সরকারি নথিপত্র যে ইতিহাস রচনায় কতটা গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা নিতে পারে তার সবথেকে বড়ো উদাহরন হল নেতাজী অর্ন্তধান সংক্রান্ত নথি। ঐতিহাসিকরা এবিষয়ে সকলেই একমত যে, একমাত্র সরকারি নথির ভিত্তিতেই নেতাজীর বহু অজানা ও অমিমাংসিত ইতিহাস জানা সম্ভব হবে, নচেৎ নয়। 

ইতিহাসের উপাদান হিসাবে সরকারি নথিপত্রের মূল্যায়ন করতে গিয়ে একটি কথা অবশ্যই মাথাায় রাখতে হবে, আমাদের দেশে ইংরেজরা বাইরে থেকে এসেছিলেন। খুব স্বাভাবিক ভাবেই এদেশের আঞ্চলিক বৈশিষ্ট্য, প্রথা, স্থানীয় সমস্যা, রীতিনীতি, অভ্যাস এগুলি সম্পর্কে তাদের তেমন ধারনা ছিলো না। তাই ইংরেজ আধিকারিকরা অনেক পড়াশোনা, সমীক্ষা ও পরিশ্রম করে তাদের প্রতিবেদন বা বিবরন গুলি রচনা করতেন। এদের কর্মদক্ষতা ও রিপোর্টের ওপরেই ব্রিটিশ সরকারের স্থায়িত্ব নির্ভরশীল ছিলো। তাই খুব সতর্ক ও সচেতন ভাবেই সরকারি নথি গুলিকে  আধিকারিকরা রচনা করতেন। নথিপত্র গুলি তারা ঔপনিবেশিক দৃৃৃষ্টিভঙ্গির প্রেক্ষিতে লিপিবদ্ধ করলেও,তাদের নথিপত্রে প্রদত্ত তথ্যের সত্যতাকে কখনই ইতিহাস রচনায় উপেক্ষা করা যায় না। আর ঠিক এই কারনটির জন্যই ইতিহাস রচনায় সরকারি নথিকে এতটা গুরুত্বপূর্ণ বলে ঐতিহাসিকরা মনে করে থাাকেন। 

সরকারি নথিপত্রের সীমাবদ্ধতা 

সবশেষে বলা যায়, সরকারি নথিপত্র গুলি ইতিহাস রচনায় গুরুুত্বপূর্ণ ভূূমিকা নিলেও, এর বেশ কিছু সীমাবদ্ধতাও আছে। যেমন – 

  1.  সরকারি নথিপত্র হিসাবে আধিকারিকদের প্রতিবেদন, রিপোর্ট ও চিঠিপত্র গুলি থেকে কেবলমাত্র সরকারি বক্তব্যটুকুই জানতে পারা যায়। 
  2. এইসব রিপোর্টগুলি শাসকগোষ্টির দৃষ্টিকোন থেকেই লেখা হয়েছিলো। সুতরাং তা সবসময় নিরপেক্ষ ছিলো না। উদাহরন হিসাবে বলা যায়, উনিশ শতকের উপজাতি ও কৃষক বিদ্রোহ গুলিকে সরকারি নথিপত্রে অসভ্য মানুষদের হাঙ্গামা বলা হয়েছিলো। কিন্তু বাস্তবে তা ছিল না।
  3.  বহু ক্ষেত্রেই দেখা যায়, গোয়েন্দা ও পুলিশ রিপোর্ট ভুলে ভরা ও বিকৃত থাকে। 
  4. অনেক সময় সরকারি রিপোর্ট গোপনই থেকে যায়। তা প্রকাশ্যে আনা হয় না। যেমন নেতাজী সংক্রান্ত স্বরাষ্ট্র তফতরের হাতে থাকা নথি গুলি স্বাধীনতার এত বছর পরও প্রকাশ্যে আসে নি। 
  5. বহু সরকারি নথি নষ্টও করে দেওয়া হয়। সরকারি নথির এই সকল সীমাবদ্ধতার জন্য অতীত ইতিহাসের অনেক দিক আজও অজানাই থেকে গেছে। 
Post a Comment (0)
Previous Post Next Post