পঞ্চদশ ও ষোড়শ শতাব্দী থেকে ইওরোপে সাম্রাজ্যবাদের বিকাশ দেখা যায়। সপ্তদশ ও অষ্টাদশ শতাব্দীতে এবং ঊনবিংশ ও বিংশ শতাব্দীতে এই সাম্রাজ্যবাদ চরমে ওঠে।
উপনিবেশবাদ ও সাম্রাজ্যবাদের সাধারণ কারন |
সাম্রাজ্যবাদের উদ্ভবের কারন
ইওরোপীয় সাম্রাজ্যবাদের এই উদ্ভবের পিছনে কিছু সাধারন কারন গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা নিয়েছিলো। যেমন -
(১.) রেনেসাঁ ও ভৌগলিক আবিষ্কারের প্রভাব
পঞ্চদশ শতাব্দীতে ইওরোপে নবজাগরন বা রেনেসাঁ হয়। নবজাগরনের সূত্রে অনুসন্ধিৎসা ও অজানাকে জানার আগ্রহ দেখা যায়। এই জানার আগ্রহ থেকে মানুষের মনে প্রশ্ন জাগে, ঐ বিশাল সমুদ্রের ওপারে কি কোন দেশ আছে?
পরবর্তীকালে জানবার অদম্য আগ্রহ ও অনুসন্ধিৎসা থেকে শুরু হয় ভৌগলিক অভিযান। বিভিন্ন দেশের নাবিকরা জাহাজ নিয়ে সমুদ্রে ভৌগলিক আবিষ্কারে বেরিয়ে পড়েন। এই ভৌগলিক আবিষ্কারের ফলে নতুন নতুন দেশ ও জলপথ আবিষ্কৃত হয়। ইওরোপের দেশ গুলো এর ফলে এশিয়া, আফ্রিকা ও আমেরিকা মহাদেশে পৌঁছে যায়, এবং সেখানকার সম্পদ নিজেদের একচেটিয়া অধিকারের জন্য উপনিবেশবাদ স্থাপন করে।
(২.) মানচিত্র ও বৈজ্ঞানিক আবিষ্কার
পঞ্চদশ শতাব্দীতে গ্রেগোরাস সর্বপ্রথম ইওরোপের একটি মানচিত্র আঁকেন। খ্রিষ্টান ধর্মে বলা হয়েছিলো পৃথিবীটা হলো চ্যাপ্টা শ্লেটের মতো। কিন্তু বৈজ্ঞানিক আবিষ্কারের পর বিজ্ঞানীরা ব্যাখ্যা দিলেন পৃথিবীটা গোল।
পৃথিবীর এই নতুন ধারনা নাবিকদের ভরসা দিয়েছিলো। তারা ভেবেছিল, পৃথিবীটা যখন গোল ফুটবলের মতো তখন ঘুরতে ঘুরতে ঠিক এক জায়গাতেই আবার ফিরে আসা যাবে। হারিয়ে যাওয়ার কোন ভয় থাকবে না। বুকে অদম্য সাহস আর মনে প্রচন্ড শক্তিকে সম্বল করে তারা জাহাজ নিয়ে সমুদ্রে নেমে পড়েছিলো। এই সময় জাহাজে পালের ব্যবহার, কম্পাসের আবিষ্কার হয়ে যাওয়ায় নৌ অভিযান সহজ হয়ে যায়।
এর ফলে নতুন নতুন দেশ আবিষ্কার হয়। পরবর্তীকালে সেই দেশ গুলিতেই উপনিবেশবাদ ও সাম্রাজ্যবাদ প্রয়োগ করা হয়।
(৩.) অর্থনৈতিক সম্পদ আহরন
উপনিবেশবাদ বা সাম্রাজ্যবাদের উদ্ভবের পিছনে একটি বড়ো কারন ছিলো অর্থনৈতিক সম্পদ সংগ্রহ। ১৪৫৩ খ্রিঃ তুর্কিদের হাতে কনস্ট্যানটিনোপেলের পতনের পর এশিয়ার সঙ্গে ইওরোপের বানিজ্য মার খায়।
এর ফলে ইওরোপের দেশ গুলো এশিয়া মহাদেশের সঙ্গে যোগাযোগ করার জন্য বিকল্প পথের সন্ধান করতে থাকে। এশিয়ার সূতিবস্ত্র, রেশম, এবং মশলার ব্যপক চাহিদা ছিলো ইওরোপের দেশ গুলিতে।
এই চাহিদা আর বুকে অদম্য সাহসের বলে ইওরোপের দেশ গুলো জলপথে নেমে পড়ে। ১৪৯৮ খ্রিঃ ভাস্কো দা গামার ভারতের কালিকট বন্দরে আসার সূত্র ধরে প্রাচ্যে আসার নতুন জলপথের আবিষ্কার হয়। এবং এই জলপথকে ব্যবহার করেই পরবর্তীকালে বিভিন্ন শক্তি এশিয়ায় সম্পদ সংগ্রহের উদ্দেশ্যে এখানকার দেশ গুলিতে উপনিবেশবাদের প্রসার ঘটায়।
(৪.) ধর্মীয় অনুপ্রেরণা
সাম্রাজ্যবাদের প্রসারের ক্ষেত্রে ধর্ম প্রচারের অনুপ্রেরণা গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা নিয়েছিলো। খ্রিষ্টের বানীকে বিশ্বের অন্যান্য জায়গায় ছড়িয়ে দিতে গিয়ে পাশ্চাত্যের দেশ গুলো উপনিবেশবাদের প্রসার ঘটায়।
খ্রিষ্টান মিশনারিরা বিভিন্ন দুর্গম স্থানে ধর্মপ্রচার করতে গিয়ে নানা গুরুত্বপূর্ণ তথ্য বনিক ও শাসক শ্রেণীর কাছে পৌঁছে দিতেন। বিনিময়ে মিশনারিদের নিরাপত্তা ও নিশ্চিত ধর্মপ্রচারের পুন্য লাভের আশায় পাশ্চাত্যের দেশ গুলি যেকোন এলাকার ওপর নিয়ন্ত্রন স্থাপন জরুরি মনে করতে থাকেন। এই নিয়ন্ত্রন স্থাপন করতে গিয়েই উপনিবেশবাদ ও সাম্রাজ্যবাদের উদ্ভব হয়েছিলো।
পঞ্চদশ ও ষোড়শ শতাব্দীর সাম্রাজ্যবাদের এই কারন গুলি ছাড়াও, আঠারো, উনিশ ও বিশ শতকে সাম্রাজ্যবাদ ও উপনিবেশবাদের প্রসারের পিছনে আরোও কিছু স্বতন্ত্র কারন গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা নেয় । যেমন -
(৫.) শিল্প বিপ্লবের প্রভাব
আঠারো শতকের শেষ দিকে প্রথমে ইংল্যান্ডে, পরে ইওরোপের অন্যান্য দেশ গুলোতে শিল্প বিপ্লব ঘটে। শিল্প বিপ্লবের ফলে -
- সস্তায় কাঁচামাল সংগ্রহ,
- শ্রমিক সংগ্রহ, এবং
- উৎপাদিত পন্য বিক্রির জন্য বড়ো ও নিশ্চিত ভাবে বিক্রিবাটা করা যাবে এমন একচেটিয়া বাজারের দরকার পড়লো।
(৬.) উগ্র জাতীয়তাবাদ ও ক্ষমতার বিস্তার
(৭.) অন্যান্য কারন
- জনসংখ্যা বৃদ্ধি ও বিকল্প বাসস্থানের জন্য অনেক দেশ উপনিবেশ স্থাপনে জোর দিয়েছিলো। ঊনবিংশ শতাব্দীর শেষ দিক থেকে ইওরোপের দেশ গুলিতে বিপুল ভাবে জনসংখ্যা বৃদ্ধি পেলে উপনিবেশবাদ প্রতিষ্ঠার এই তত্ত্ব অনেক দেশকে উপনিবেশ স্থাপনে উদ্বুদ্ধ করেছিলো। উদাহরন হিসাবে জার্মানির হিটলারের কথা বলা যায়।
- ১৮৭০ থেকে ১৯১৪ সময়কালে ইওরোপের দেশ গুলো সাম্রাজ্য বিস্তার নিয়ে পারস্পরিক দ্বন্দ্ব ও বিবাদে জড়িয়ে পড়লে, সব দেশের মনেই নিরাপত্তার অভাব বোধ দেখা যায়। এমতাবস্থায়, নিরাপত্তা সুনিশ্চিত করে তোলার জন্য এবং পৃথিবীর গুরুত্বপূর্ণ স্থানে সামরিক ঘাঁটি গড়ে তোলার জন্য বৃহৎ শক্তি গুলি নানা গুরুত্বপূর্ণ অঞ্চলে প্রভাব বিস্তার করতে থাকে এবং উপনিবেশবাদ স্থাপন করতে থাকে।
- ইওরোপীয় সাম্রাজ্যবাদকে "মহত্বের ছোঁয়া" দিয়ে সাম্রাজ্যবাদের উদ্ভবের পিছনে আরোও একটি কারনের উল্লেখ পশ্চিমি ঐতিহাসিকরা করে থাকেন। তা হল সাদা চামড়ার দায়বদ্ধতা ও সভ্যতার প্রসার। এশিয়া আফ্রিকার অনুন্নত জাতি গুলিকে সভ্য করে তোলার নৈতিক দায়িত্বে উপনিবেশবাদের বিস্তার হওয়া প্রয়োজন বলে ইওরোপের অনেক বুদ্ধিজীবীই মনে করতেন। ইংরেজ কবি রুডইয়ার্ড কিপলিং এদেরই অন্যতম ছিলেন।