ভারতে পাশ্চাত্য শিক্ষা বিস্তারের ইতিহাসে যেসব সনদ,আইন, এবং নির্দেশনামা গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা নিয়েছিলো, তার মধ্যে সবথেকে উল্লেখযোগ্য ছিলো চার্লস উডের নির্দেশনামা। ভারতের শিক্ষা বিস্তারের ক্ষেত্রে এর মূল গুরুত্ব ছিলো ৩ টি -
(১.) এই নির্দেশনামার ফলেই ভারতের এলোমেলো ঔপনিবেশিক শিক্ষা ব্যবস্থা এক ছাতার তলায় এসে একটি সুসংবদ্ধ রূপ লাভ করেছিলো।
(২.) ভারতের শিক্ষার কাঠামো, কর্মসূচি এবং পরিকল্পনার একটি পূর্ণাঙ্গ রূপরেখা এই নির্দেশনামায় তুলে ধরা হয়েছিলো।যার ফলে ভারতের শিক্ষা কর্মসূচি এবং কার্যক্রম একটি সুনির্দিষ্ট পথের দিশা খুঁজে পেয়েছিলো।
(৩.) শিক্ষা সম্পর্কে সরকারের ভূমিকা কিরকম হওয়া উচিৎ, তার একটি দায়বদ্ধতার দলিল এই নির্দেশনামায় তুলে ধরা হয়েছিলো।
চার্লস উড দ্বিধাহীন ভাবে ঔপনিবেশিক সরকারকে স্মরন করিয়ে দেন, শিক্ষা বিস্তারের কাজ হল সরকারের একটি গুরুত্বপূর্ণ দায়িত্ব। এইজন্য filtration তত্ত্বের ওপর নির্ভর না করে সরকারকে সক্রিয় নীতি গ্রহণ করতে হবে।
ব্রিটিশ পার্লামেন্টে বিতর্কের পর উডের ডেসপ্যাচ প্রবর্তন |
উডের ডেসপ্যাচ
শিক্ষা সম্পর্কে ভারতের ঔপনিবেশিক সরকারের (১.) গৃহীত নীতি, (২.) শিক্ষার মূল কাঠামো এবং (৩.) শিক্ষা ক্ষেত্রে সরকারের পালনীয় দায়িত্ব ও কর্মসূচির এক বিস্তৃত খসড়া তৈরি করে ১৮৫৪ খ্রিঃ ইংল্যান্ড থেকে ভারতে পাঠিয়ে দেওয়া হয়। খসড়া পত্রটি রচনা করেছিলেন, ইংল্যান্ডের বোর্ড অব কন্ট্রোলের সভাপতি চার্লস উড। তাই তার নামানুসারেই এই নির্দেশনামাকে "উডের ডেসপ্যাচ" বলা হয়ে থাকে।
উডের নির্দেশনামার প্রেক্ষাপট
(১.) ১৮১৩ খ্রিঃ চার্টার আইনে সরকারি ভাবে ভারতে শিক্ষা বিস্তারের নির্দেশ দেওয়া হলেও, সরকারি উদ্যোগে অত্যন্ত শ্লথ গতিতে শিক্ষা বিস্তারের কাজটি চলছিলো। এই শ্লথ গতির একটি বড়ো কারন ছিলো কোন সুনির্দিষ্ট পরিকল্পনা বা নীল নকশা না থাকা।
(২.) ১৮৫৩ খ্রিঃ ব্রিটিশ পার্লামেন্টে কোম্পানির সনদ আইন পুনঃনবীকরনের সময় ভারতের শিক্ষা ব্যবস্থার অগ্রগতি নিয়ে বিশদে আলোচনা হয়।
(৩.) এই সময় ভারতে শিক্ষা ব্যবস্থার অগ্রগতির দিকটি নিয়ে অনেকেই সোচ্চার হন। তাদের আলোচনায় ভারতীয় শিক্ষা ব্যবস্থার অব্যবস্থা এবং বিশৃঙ্খলার বেশ কিছু দিক উঠে আসে। যেমন - পাঠ্যক্রম এবং পাঠ্যসূচির মধ্যে কোন সামঞ্জস্য না থাকা, উচ্চশিক্ষার জন্য কোন শিক্ষা প্রতিষ্ঠান না থাকা, অঞ্চল ভেদে নিয়মের বিভিন্নতা, ইত্যাদি।
(৪.) পার্লামেন্টের বিভিন্ন পর্যবেক্ষণ ও সুপারিশ করা সংস্কারকে গুরুত্ব দিয়ে বোর্ড অব কন্ট্রোলের সভাপতি চার্লস উড শিক্ষা সংক্রান্ত একটি প্রস্তাব রচনা করে ভারতে পাঠিয়ে দেন। এটি "উডের ডেসপ্যাচ" নামে পরিচিত হয়।
পাশ্চাত্য শিক্ষার "Magna Carta"
উডের ডেসপ্যাচকে ভারতে পাশ্চাত্য শিক্ষা বিস্তারে "Magna Carta" বলা হয়ে থাকে।
"Magna Carta" একটি ল্যাটিন শব্দ। এর অর্থ হল, মহাসনদ। ১২১৫ খ্রিঃ ইংল্যান্ডের রাজা জনের সঙ্গে সেখানকার ভূস্বামী বা ব্যারনদের Magna Carta চুক্তি স্বাক্ষরিত হয়েছিলো। এই চুক্তির মধ্য দিয়ে ঘোষনা করা হয়, রাজা যা খুশি তাই করতে পারবেন না। তিনি কি কি করবেন, আর কি কি করতে পারবেন না, তার বিষয় গুলোকে এই চুক্তিতে নির্দিষ্ট করে দেওয়া হয়। এই চুক্তিতে যেভাবে সিংহাসনের চারপাশে সীমারেখা টেনে দিয়ে রাজাকে একটি সংবিধানের ছত্রছায়ায় বেঁধে ফেলা হয়েছিলো, ঠিক একই রকম ভাবে উডের ডেসপ্যাচে ভারতীয় বিশৃঙ্খল শিক্ষা ব্যবস্থাকে একটি সংবিধানের মাধ্যমে সুসংবদ্ধ করে তোলার চেষ্টা করা হয়েছিলো। এই কারনেই উডের ডেসপ্যাচকে ভারতে পাশ্চাত্য শিক্ষার বিস্তারে "Magna Carta" বলা হয়ে থাকে।
উডের নির্দেশনামার সুপারিশসমূহ
চার্লস উড তার শিক্ষা সংক্রান্ত নির্দেশনামাটিতে প্রধান যে সুপারিশ গুলো করেছিলেন, সেগুলি হল -
- একটি পৃথক শিক্ষা দপ্তর গঠন করা,
- কলকাতা, বোম্বাই, মাদ্রাজ এই ৩ টি প্রেসিডেন্সিতে লন্ডন বিশ্ববিদ্যালয়ের আদলে একটি করে বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠা করা,
- সরকারি উদ্যোগে মডেল স্কুল প্রতিষ্ঠা করা,
- বিদ্যালয় গুলিতে সরকারি অনুদান প্রদান,
- শিক্ষক - শিক্ষন বিদ্যালয় প্রতিষ্ঠা করা এবং শিক্ষকদের প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা করা,
- প্রাথমিক শিক্ষার উন্নতি বিধান করা এবং সরকারি উদ্যোগে প্রাথমিক বিদ্যালয় স্থাপন করা,
- নারী শিক্ষার প্রসার ঘটানো,
- শিক্ষা প্রতিষ্ঠান গুলি নিয়মিত পরিদর্শনের ব্যবস্থা করা,
- সমগ্র শিক্ষা ব্যবস্থাকে ৫ টি স্তরে ভাগ করা, যেমন প্রাথমিক, মাধ্যমিক, উচ্চমাধ্যমিক, ইত্যাদি।
- সাধারণ শিক্ষার মাধ্যম হিসাবে মাতৃভাষার ব্যবহার,
- দরিদ্র ও মেধাবী ছাত্রদের বৃত্তিদানের ব্যবস্থা করা।
উডের নির্দেশনামার ঐতিহাসিক গুরুত্ব
- উডের নির্দেশনামার ওপর ভিত্তি করেই আধুনিক ভারতের শিক্ষা ব্যবস্থার বুনিয়াদ গড়ে ওঠে।
- ভারতের বিশৃঙ্খল, অগোছালো শিক্ষা ব্যবস্থায় একটি শৃঙ্খলা প্রতিষ্ঠিত হয়।
- ১৮৫৫ খ্রিঃ শিক্ষা বিষয়টি পরিচালনা করবার জন্য "সরকারি শিক্ষা দপ্তর" বা "ডিরেক্টর অব পাবলিক ইনস্ট্রাকশন" প্রতিষ্ঠিত হয়।
- ১৮৫৫ খ্রিঃ প্রায় ৭৯ টি উচ্চ ইংরেজি এবং ১৪০ টি মধ্য ইংরেজি বিদ্যালয় সরকারি আর্থিক অনুদান লাভ করে, এছাড়া,
- উডের সুপারিশের ভিত্তিতেই ১৮৫৭ খ্রিঃ ২৪ শে জানুয়ারি, কলকাতায়, ১৮ ই জুলাই বোম্বাইয়ে এবং ৫ ই সেপ্টেম্বর মাদ্রাজে একটি করে বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠা করা হয়।