উনিশ শতকে শিক্ষা, সাহিত্য ও সংস্কৃতি চর্চা থেকে শুরু করে, সমাজ সংস্কার, ধর্মসংস্কার - সবকিছুই বাংলা ছাপাখানাকে আশ্রয় করে আবর্তিত হয়েছিলো। আধুনিক ভারতের ইতিহাসে তাই বাংলা ছাপাখানার উদ্ভব ও বিকাশ একটি স্মরণীয় ঘটনা ছিলো।
বাংলায় ছাপাখানার বিকাশ - প্রথম পর্ব |
ছাপাখানা উদ্ভবের সংক্ষিপ্ত ইতিহাস
ছাপাখানার প্রথম উদ্ভাবক দেশ ছিলো চিন। সেখানে কাঠের ব্লকের সাহায্যে ছাপার উদ্ভাবনটি প্রথম আবিষ্কৃত হয়। কাঠের ওপর অক্ষর খোদাই করে, ঐ অক্ষরে কালি লাগিয়ে কাগজের ওপর ছাপ মারা হতো, এবং এইভাবেই মুদ্রনের কাজটি চলতো।চিনে এই পদ্ধতিতে ছাপার কৌশলটি শুরু হয় ১০৫ খ্রিঃ চিন সম্রাট হো টির আমলে।
চিন থেকে ছাপার কৌশলটি পরবর্তীকালে ইওরোপে পৌঁছায়।জার্মানিতে জোহান গুটেনবার্গ ছাপার কৌশলের ক্ষেত্রে একটি যুগান্তকারী পরিবর্তন ঘটান, এবং এই পরিবর্তন ঘটানোর মধ্য দিয়েই তিনি আধুনিক মুদ্রন যন্ত্রের আবিষ্কার করে ফেলেন।
গুটেনবার্গ কাঠের ব্লকের বদলে গতিশীল টাইপের অর্থাৎ ধাতুর তৈরি মুভেবল বা অদল বদল করা যায়, এমন হরফ দিয়ে মুদ্রনের কৌশল উদ্ভাবন করেন। এই মুদ্রন কৌশলে প্রতিটি হরফকে পরপর সাজিয়ে মুদ্রনের কাজটি করা হতো। মুদ্রন শেষে হরফ গুলিকে অদলবদল করে সাজিয়ে পুনরায় মুদ্রনের কাজটি করা যেতো। নিঃসন্দেহে চিনের মুদ্রন পদ্ধতি থেকে এই পদ্ধতি অনেক সুবিধাজনক ও সহজ ছিলো।
ভারতে ছাপাখানার আগমন ও প্রথম ছাপাখানা
১৪৫৬ খ্রিঃ গুটেনবার্গের আধুনিক ছাপাখানা আবিষ্কারের পর তা ধীরে ধীরে সারা ইওরোপে ছড়িয়ে পড়ে। গুটেনবার্গের ছাপাখানা আবিষ্কারের ১০০ বছর পর ভারতে ছাপাখানা আসে। ১৫৫৬ খ্রিঃ, পানিপথের দ্বিতীয় যুদ্ধের বছরটিতে অর্থাৎ মুঘল সম্রাট আকবরের আমলে ভারতে প্রথম ছাপাখানার প্রবর্তন করে পর্তুগিজরা। গোয়াতে পর্তুগিজদের বানিজ্য ঘাঁটি ছিলো। পুস্তকের মধ্য দিয়ে খ্রিষ্টধর্মের প্রচারের উদ্দেশ্যে তারা ১৫৫৬ খ্রিঃ গোয়াতে একটি ছাপাখানা প্রতিষ্ঠা করেছিলেন। এই ছাপাখানা টি ছিলো ভারতে প্রতিষ্ঠিত প্রথম ছাপাখানা।
গোয়ার পর কুইলন, কন্যাকুমারীর কয়েক মাইল উত্তরে পুন্ডিকয়েল, কোচিন এবং বোম্বাইয়ে ছাপাখানা প্রতিষ্ঠিত হয়। ভারতে প্রথম ছাপা বইয়ের যে নিদর্শনটি পাওয়া যায় তা ১৫৬১ খ্রিঃ ছাপা। বইটির নাম হলো - "কম্পেনডিও স্পিরিচুয়াল দ্য ভিডা খ্রিষ্টা" (Compendio Espiritual da vida Christa)। বইটি মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের নিউনিয়র্কের পাবলিক লাইব্রেরিতে সংরক্ষিত আছে।
বাংলায় ছাপাখানার বিকাশ
ভারতে পশ্চিম উপকূল থেকে বাংলায় ছাপাখানা আসতে সময় লেগেছিলো প্রায় ২২২ বছর। বাংলার হুগলি তে ১৭৭৮ খ্রিঃ প্রতিষ্ঠিত হয়েছিলো বাংলার প্রথম ছাপাখানা। বাংলা ছাপাখানার বিকাশ কে আমরা মোট ৪ টি পর্বে ভাগ করে আলোচনা করতে পারি -
- বাংলা ছাপাখানার সূচনা পর্ব (১৭৭৮ - ১৭৯৯)
- বাংলা ছাপাখানার বিকাশ পর্ব (১৮০০ - ১৮১৬)
- বাংলা ছাপাখানার বিস্তার পর্ব (১৮১৭ - ১৮৩৪)
- বাংলা ছাপাখানার আধুনিক পর্ব (১৮৩৫ থেকে পরবর্তী সময়কাল)
বাংলা ছাপাখানা বিকাশের প্রেক্ষাপট
তবে মূল আলোচনা শুরু করবার আগে অবশ্যই একটি বিষয়ের পর্যালোচনা করা খুবই প্রয়োজন। তা হল, কোন বিশেষ প্রেক্ষাপট বাংলায় ছাপাখানার উদ্ভব ও সূচনার দিকটিকে ত্বরান্বিত করেছিলো।
মাথায় রাখতে হবে, বাংলায় ছাপাখানা প্রতিষ্ঠার প্রধান তাগিদটি কিন্তু ছিলো - (১.) রাজনৈতিক এবং (২.) প্রশাসনিক।
বাংলায় ছাপাখানা প্রতিষ্ঠার প্রধান পৃষ্ঠপোষক ছিলেন ওয়ারেন হেস্টিংস। হেস্টিংস বাংলায় গভর্নর হয়ে আসবার পর দেওয়ানীর ক্ষমতা সরাসরি কোম্পানির হাতে তুলে নিলেন। ১৭৭৩ খ্রিঃ নতুন রেগুলেটিং আইন অনুযায়ী কোলকাতা, বোম্বাই ও মাদ্রাজ প্রেসিডেন্সি নিয়ে কোম্পানির একটি কেন্দ্রীয় সরকার গঠন করা হয়, যার রাজধানী করা হয় কোলকাতাকে। এছাড়া এই আইনে একটি সুপ্রিম কোর্টও গঠন করা হয়। ক্রমে বিচার ব্যবস্থাকে সুদৃঢ় করে তোলার জন্য জেলায় জেলায় দেওয়ানী ও ফৌজদারী আদালত তৈরি হয়। ভারতীয় জনগন যাতে কোম্পানির শাসনে অসন্তুষ্ট না হয় সেইজন্য বলা হয়, বিচারব্যবস্থায় হিন্দু ও মুসলিমরা প্রচলিত আইন অনুযায়ী পরিচালিত হবে।
খুব স্বাভাবিক ভাবেই (১.) রাজস্ব সংক্রান্ত কাজকর্ম, (২.) শাসক ও শাসিতের মধ্যে সম্পর্ক স্থাপন, এবং (৩.) বিচার বিভাগীয় কাজের জন্য দেশীয় ভাষা, অর্থাৎ বাংলা ভাষা শিক্ষা একটি প্রয়োজনীয় বিষয় হয়ে দাড়ালো।
কোম্পানির কর্মচারীদের বাংলা ভাষা শিক্ষার প্রয়োজনীয়তার তাগিদটি পূর্ন করতে গিয়েই যে বাংলা ছাপাখানার বিকাশ ঘটেছিলো, এ বিষয়ে কোন সন্দেহ নেই।
বাংলা ছাপাখানার সূচনা পর্ব (১৭৭৮ খ্রিঃ - ১৭৯৯ খ্রিঃ)
কোম্পানির কর্মচারীরা যাতে সহজেই বাংলা ভাষা শিখতে পারে এবং তার অর্থ বুঝতে পারে, সেইজন্য ওয়ারেন হেস্টিংসের অন্যতম বন্ধু ন্যাথানিয়েল ব্র্যাসি হ্যালহেড সাহেব রচনা করেন - "A Grammer of the Bengali Language"। হেস্টিংস এই বইটি মুদ্রনের দায়িত্ব দেন তার অপর বন্ধু এবং তৎকালীন ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির রাইটার চার্লস উইলকিন্সকে।
বাংলার প্রথম ছাপাখানা ও প্রথম মুদ্রন
বলে রাখা ভালো, ইতিমধ্যেই ১৭৭৮ খ্রিঃ বিদেশী বই ব্যবসায়ী জন অ্যানড্রুজ সাহেব হুগলি তে একটি ছাপাখানা স্থাপন করেন। এই ছাপাখানা থেকেই ১৭৭৮ খ্রিঃ ছেপে বের হয় হ্যালহেডের বাংলা ব্যাকরণ। এই বইটি প্রকাশনার মধ্য দিয়েই বাংলা মুদ্রন ব্যবস্থার প্রথম সূচনা ঘটে। বাংলা ছাপাখানায় মুদ্রিত প্রথম বাংলা বই ছিলো হ্যালহেডের ব্যাকরন।
হ্যালহেডের বইটি ছাপার ক্ষেত্রে প্রধান মুদ্রাকর ছিলেন, চার্লস উইলকিন্স। তিনি হুগলি নিবাসী পঞ্চানন কর্মকারের সহায়তায় কয়েকটি ছেনিকাটা বাংলা হরফ নির্মান করেছিলেন। তিনিই ছিলেন, বাংলা মুভেবল টাইপের বা বিচল হরফের আবিষ্কার। এইজন্য তাকে "বাংলার ক্যাসটন" বা "বাংলা মুদ্রন শিল্পের জনক" বলা হয়।
এইভাবে ওয়ারেন হেস্টিংসের পৃষ্ঠপোষকতা এবং চার্লস উইলকিন্স ও পঞ্চানন কর্মকারের অক্লান্ত পরিশ্রমের ফলে বাংলা মুদ্রন ব্যবস্থার প্রথম সূচনা ঘটে। হ্যালহেডের ব্যাকরনটি ছাপা হয় হুগলির জন এন্ড্রুজের ছাপাখানায়। এটিই ছিলো বাংলা দেশের প্রথম ছাপাখানা। কিন্তু আশ্চর্যের বিষয়, এই ছাপাখানা থেকে আর কোন ছাপা বইয়ের নিদর্শন আজ পর্যন্ত পাওয়া যায় নি। সম্ভবত, এই ছাপাখানাটি সরকার অধিগ্রহণ করেছিলো এবং তার সরঞ্জাম গুলি পরবর্তীকালে কলকাতায় কোম্পানির প্রেসে স্থানান্তরিত হয়েছিলো।
বাংলার দ্বিতীয় ছাপাখানা
হ্যালহেডের ব্যাকরন প্রকাশের পরের বছর ১৭৮৯ খ্রিঃ ওয়ারেন হেস্টিংসের পৃষ্ঠপোষকতায় কলকাতাতে প্রতিষ্ঠিত হয় "কোম্পানির প্রেস"। এটি ছিলো বাংলার দ্বিতীয় ছাপাখানা।উইলকিন্স এর প্রথম অধ্যক্ষ হিসাবে নিযুক্ত হন।
অ্যানড্রুজ বনাম হিকি : বাংলার প্রথম ছাপাখানার দাবিদার কে?
অনেকেই মনে করেন, হিকি তার বেঙ্গল গেজেটের প্রথম কয়েকটি সংখ্যা কোম্পানির প্রেস থেকেই ছেপে বের করতেন। পরে নিজে একটি ছাপাখানা গড়ে তোলেন। আবার অনেকের মতে, বাংলার প্রথম ছাপাখানাটি হিকিই গড়ে তুলেছিলেন। ১৭৭৭ খ্রিঃ তিনি ব্যক্তিগত উদ্যোগে একটি ছাপাখানা খুলেছিলেন। সেই ছাপাখানাতে প্রথমে কোম্পানির সামরিক বিভাগের কিছু কাগজপত্র প্রিন্ট করা হতো। পরে কোম্পানির প্রেস গড়ে উঠলে হিকির কাজের বরাদ কমে যায় এবং তিনি সংবাদপত্র প্রকাশ করেন।
এক্ষেত্রে মনে রাখতে হবে, ১৭৭৭ খ্রিঃ হিকি মুদ্রনযন্ত্র স্থাপন করলেও যেহেতু ১৭৮০ খ্রিঃ আগে পর্যন্ত তার ছাপাখানার কোন কাগজপত্রের নিদর্শন পাওয়া যায় নি, এবং বাংলা মুদ্রনেরও কোন ঐতিহাসিক নিদর্শন পাওয়া যায় নি, সেহেতু হিকির ছাপাখানাকে বাংলার প্রথম ছাপাখানার স্বীকৃতি দিতে অনেক ঐতিহাসিকই দ্বিধাবোধ করেন।
আর ঠিক এই কারনেই ১৭৭৮ খ্রিঃ অ্যানড্রুজের ছাপাখানাকেই বাংলার প্রথম ছাপাখানা বলে মনে করা হয়। যাইহোক, কলকাতায় যে কোম্পানির প্রেস তৈরি হয়, সেখানে বাংলা মুদ্রনের ব্যাপক আয়োজন ছিলো। এই সময় কোম্পানির প্রেস থেকে বেশ কিছু আইনের বঙ্গানুবাদ বই ছেপে বের হয়।
কোম্পানি প্রেসের সমসাময়িক কোলকাতায় আরোও কিছু প্রেসের উদ্ভব ঘটে। যেমন - "ক্যালকাটা গ্যাজেট প্রেস", "ক্রনিকল প্রেস" ইত্যাদি।
বাংলা ছাপাখানার সূচনা পর্বের বৈশিষ্ট্য
বলা বাহুল্য, বাংলা ছাপাখানার এই সূচনা পর্বের বেশ কিছু বৈশিষ্ট্য আমরা লক্ষ্য করি। যেমন -
- এই সময় বিক্ষিপ্ত ও এলোমেলো ভাবে প্রকাশনী সংস্থা গুলো ছাপার কাজটি চালাচ্ছিলো,
- সারা দেশব্যাপী কোন অখন্ড মুদ্রন পরিমন্ডল গড়ে উঠতে পারে নি,
- এই সময়ের ছাপাখানা গুলিতে মূলত প্রশাসনিক তাগিদে আইনের অনুবাদ, ব্যাকরন, অভিধান, শব্দকোষ, বাংলা বিজ্ঞপ্তি ইত্যাদি ছেপে বের হতো,
- এই পর্বে বাংলা ছাপার হরফের বিন্যাসের ক্ষেত্রেও পরিবর্তন দেখা যায়। হস্তাক্ষরের বাঁকা, জটিল রূপ থেকে বাংলা হরফ কে সহজ সরল করার প্রবনতা লক্ষ্য করা যায়। প্রথমদিকে বাংলা ছাপার হরফ গুলি আকার আয়তনে বেশ বড়ো ছিলো। ছাপাখানা সূচনা পর্বের শেষ দিকে বাংলা হরফ গুলিকে আকার আয়তনে ছোট করার প্রবনতা লক্ষ্য করা যায়।
চলবে......
Super
ReplyDelete