যে সমস্ত ইংরেজ আধিকারিক ভারতে ব্রিটিশ সাম্রাজ্যকে ভিতের ওপর দাড় করিয়েছিলেন, তাদেরই অন্যতম একজন ছিলেন টমাস ব্যাবিংটন মেকলে। ১৮৩৪ থেকে ১৮৩৮ খ্রিঃ পর্যন্ত মাত্র ৪ বছর তিনি ভারতে ছিলেন। কিন্তু এই চার বছরের মধ্যে তিনি ভারতে অসাধারণ দুটি কাজ করে যান, যেগুলি ভারতে ব্রিটিশ সাম্রাজ্যকে প্রায় শতবৎসর ব্যাপী স্থায়িত্ব প্রদান করেছিলো।
রক্তে ও বর্নে ভারতীয়, চিন্তা ও আচরনে ইংরেজ |
মেকলের এই অসাধারণ দুটি কাজের প্রথমটি ছিলো, ভারতীয় দন্ডবিধি বা ইন্ডিয়ান পেনাল কোডের রূপায়ন করা। দ্বিতীয় কাজটি ছিলো ভারতে শিক্ষা বিস্তারের সুনির্দিষ্ট সরকারি নীতি ও পদ্ধতির ঘোষনা করা। মূলত এই দুটি অসাধারণ কাজের জন্যই মেকলেকে ভারতের ইতিহাসে স্মরন করা হয়ে থাকে।
ভারত সম্পর্কে মেকলের দৃষ্টিভঙ্গি
ভারত এবং ভারতীয়দের সম্পর্কে যদিও মেকলে খুব ভালো ধারনা পোষন করতেন না। বাঙালিদেরকে তিনি মিথ্যাবাদী, ষড়যন্ত্র প্রিয়, হিংসুটে, অলস, ইত্যাদি বাছা বাছা বিশেষনে ভূষিত করেছিলেন। ভারতের জ্ঞান বিজ্ঞান ও সাহিত্য সম্পর্কে তার মূল্যায়ন ছিলো - "ভারতের সমস্ত দেশীয় সাহিত্যের মূল্য হলো ইওরোপের তাকে সাজানো মাত্র কয়েকটা বইয়ের সমান"। ভারত সম্পর্কে মেকলের এই অবমূল্যায়নের জন্য অনেকে আজও মেকলে কে কঠোর ভাবে সমালোচনা করে থাকেন।
মেকলে মনে প্রানে চাইতেন, ভারতে ইংরেজি শিক্ষার মধ্যে দিয়ে যেন ব্রিটিশ ভাবধারা ও সংস্কৃতির প্রসার ঘটে। তিনি চাইতেন, এই ভাবধারায় রঞ্জিত হয়ে এমন একটি সম্প্রদায় তৈরি হোক, যারা বর্নে ও রক্তে ভারতীয় হলেও, রুচি, মানসিকতা ও সংস্কৃতির দিক থেকে হবেন ইওরোপীয়। মেকলে তার শিক্ষা সংক্রান্ত প্রতিবেদনে এইরকম কিছু সম্ভাবনার বীজ রেখে দিয়েছিলেন, যা পরবর্তীকালে মহীরুহ হয়ে ব্রিটিশ সাম্রাজ্যকে "নিরাপত্তা" এবং "স্থায়িত্বের নিশ্চয়তা" দুটোই প্রদান করেছিলো।
ভারতে ইংরেজি ভাষা ও শিক্ষার কথা শুনে কেউ কেউ মেকলেকে সাবধান করে বলেছিলেন, ভারতে পাশ্চাত্য শিক্ষার প্রবর্তন করলে ভারতের দশা আমেরিকার উপনিবেশের মতো হবে। আধুনিক শিক্ষায় শিক্ষিত হয়ে ভারতীয়রা আমেরিকানদের মতো স্বাধীনতা চাইবে।
সরকারি আধিকারিকদের সমস্ত আশঙ্কা দূর করে, তাদের আশ্বস্ত করে মেকলে বলে গিয়েছিলেন, "সেদিন আসতে এক শতাব্দী দেরি আছে। যদি সেই রকম দিন আসে তবে সেটাই হবে ভারতে ব্রিটিশ শাসনের শ্রেষ্ঠ সফলতা।" মেকলের এই আশ্বাস এবং ভবিষ্যৎবাণী একেবারেই মিথ্যা হয়ে যায় নি। এটি থেকেই বোঝা যায়, কি পরিমান প্রজ্ঞা, অভিজ্ঞতা আর জ্ঞানের অধিকারী তিনি ছিলেন।
মেকলের সংক্ষিপ্ত পরিচয়
মেকলে ছিলেন একজন ব্রিটিশ রাজনীতিবিদ, সাহিত্যিক, ঐতিহাসিক, সর্বোপরি উদারনৈতিক চিন্তাধারার একজন বুদ্ধিজীবী। ভারতে পদার্পণের আগে তিনি ব্রিটিশ পার্লামেন্টের অন্যতম একজন সদস্য ছিলেন। ১৮৩২ খ্রিঃ তিনি বোর্ড অফ কন্ট্রোলের সচিব নিযুক্ত হন। ভারত থেকে ফিরে গিয়ে তিনি ব্রিটিশ মন্ত্রীসভার সদস্য নিযুক্ত হয়েছিলেন।
ইন্ডিয়ান পেনাল কোডের রূপায়ণ
১৮৩৩ খ্রিঃ চার্টার আইনে ভারতের গভর্নর জেনারেলকে সারা ভারতের জন্য আইন তৈরির অধিকার দেওয়া হয়। এরই সূত্র ধরে ভারতে ১৮৩৪ খ্রিঃ মেকলের সভাপতিত্বে প্রথম "আইন কমিশন" গঠন করা হয়। এই কমিশনের সুপারিশ অনুযায়ী তৈরি হয় ভারতের প্রথম দন্ডবিধি বা ইন্ডিয়ান পেনাল কোড। ভারতীয় দন্ডবিধির প্রথম খসড়া পত্র মেকলেই রচনা করেছিলেন। পরবর্তীকালে বেশ কয়েকবার সংশোধন ও পরিমার্জন করবার পর ১৮৬০ খ্রিঃ এই দন্ডবিধি আইন হিসাবে স্বীকৃতি লাভ করে এবং সেটি ভারতে বলবৎ করা হয়।
যাবতীয় অপরাধ এবং তার শাস্তির সংকলন গ্রন্থ ছিলো এই দন্ডবিধি। শুধু পরাধীন ভারতেই নয়, স্বাধীন ভারতেও ভারত শাসনের ক্ষেত্রে এই দন্ডবিধিরই অনুসরন করা হয়। এমনকি এশিয়া মহাদেশের অন্যান্য দেশগুলি, যেমন পাকিস্তান, বাংলাদেশ, শ্রীলঙ্কা, মায়ানমার ভারতীয় দন্ডবিধিই অনুসরন করে থাকে। এটি মেকলের একটি অবিস্মরনীয় কীর্তি ছিলো।
মেকলে মিনিট
মেকলের দ্বিতীয় কীর্তিত্বের দিকটি ছিলো, ভারতে শিক্ষার বিস্তার সম্পর্কে সরকারি নীতি নির্ধারন ঠিক করে দেওয়া। এই বিষয়ে তার বিখ্যাত "মেকলে মিনিট" গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেছিলো।
মেকলে মিনিটের প্রেক্ষাপট
(১.) ১৮১৩ খ্রিঃ চার্টার আইনে ব্রিটিশ পার্লামেন্ট ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানিকে ভারতীয় শিক্ষাখাতে প্রতি বছর এক লক্ষ টাকা ব্যয় করার নির্দেশ দিয়েছিলো।
(২.) এই প্রেক্ষাপটেই শিক্ষা খাতে টাকা খরচের জন্য লর্ড আমহাস্ট ১৮২৩ খ্রিঃ ১০ জন সদস্যকে নিয়ে জনশিক্ষা কমিটি বা কমিটি অব পাবলিক ইনস্ট্রাকশন গঠন করেন।
(৩.) জনশিক্ষা কমিটি গঠন করবার অল্প কিছুদিনের মধ্যেই, প্রাচ্য না পাশ্চাত্য কোন শিক্ষাখাতে অর্থ ব্যয় করা হবে, তা নিয়ে সদস্যদের মধ্যে তীব্র বিতর্ক ও বাদানুবাদ দেখা যায়।
(৪.) এই অবস্থায় বিতর্ক নিরসনের জন্য এবং চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত নেওয়ার জন্য "প্রাচ্য ও পাশ্চাত্য" জনশিক্ষা কমিটির দুই গোষ্ঠীর সদস্যরাই পৃথক পৃথক ভাবে সরকারের কাছে আবেদন পেশ করে।
(৫.) লর্ড উইলিয়াম বেন্টিঙ্ক এই আবেদনের পরিপ্রেক্ষিতে ১৮৩৪ খ্রিঃ তার আইন সচিব টমাস ব্যাবিংটন মেকলে কে জনশিক্ষা কমিটির সভাপতি নিযুক্ত করেন, এবং মূল বিতর্ক নিরসনের দায়িত্ব দেন।
এই প্রেক্ষাপটেই ১৮৩৫ খ্রিঃ ২ রা ফেব্রুয়ারি মেকলে তার বিখ্যাত "মেকলে মিনিট" পেশ করেন। এই মিনিটের মধ্য দিয়েই মেকলে ভারতে শিক্ষা বিস্তারের (ক.) নীতি, (খ.) উদ্দেশ্য এবং (গ.) পদ্ধতির নীল নকশা এঁকে দেন।
মেকলে মিনিটের মূল বক্তব্য
মেকলে তার প্রতিবেদনে বলেন -
- প্রাচ্যের শিক্ষা বৈজ্ঞানিক চেতনাহীন এবং পাশ্চাত্যের তুলনায় নিকৃষ্ট,
- প্রাচ্যের সভ্যতা "দুর্নীতিগ্রস্থ এবং অপবিত্র"। তাই এদেশে পাশ্চাত্য শিক্ষা প্রবর্তিত হওয়া উচিৎ,
- এদেশের উচ্চ ও মধ্যবিত্তদের মধ্যে ইংরেজী শিক্ষার প্রসার ঘটলে "ক্রমনিন্ম পরিশ্রুত নীতি" বা চুঁইয়ে পড়া নীতি অনুসারে তা ক্রমশ সাধারন দেশবাসীর মধ্যে ছড়িয়ে পড়বে,
- পাশ্চাত্য শিক্ষার বিস্তারের ফলে এদেশে এমন একটি সম্প্রদায়ের আত্মপ্রকাশ ঘটবে, যারা "রক্তে ও বর্নে" ভারতীয় হলেও রুচি, আদর্শ, নৈতিকতা এবং বুদ্ধিমত্তায় হবে ইংরেজ।
মেকলে মিনিটের গুরুত্ব
- মেকলে মিনিটের দ্বারা দীর্ঘ প্রাচ্য - পাশ্চাত্য শিক্ষা সংক্রান্ত বিতর্কের নিরসন হয় এবং ভারতে পাশ্চাত্য শিক্ষার বিস্তার সম্পর্কে যাবতীয় সংশয়, ও দ্বিধা দ্বন্দ্বের অবসান ঘটে।
- এই মিনিটের দ্বারা "প্রাচ্য - পাশ্চাত্য শিক্ষা" সংক্রান্ত বিতর্কে পাশ্চাত্যবাদীদের জয় সুনিশ্চিত হয়।
- মেকলে মিনিটের প্রস্তাব মেনে নিয়েই বেন্টিঙ্ক সরকারি ভাবে ১৮৩৫ খ্রিঃ ৭ ই মার্চ ইংরেজি শিক্ষার প্রসারকে সরকারের শিক্ষা নীতি হিসাবে ঘোষনা করেন।
- মেকলের শিক্ষানীতির দ্বারা প্রভাবিত হয়েই ভারতে পরবর্তীকালে পোশাকে আশাকে একটি ইংরেজ অনুগত শ্রেনী গড়ে ওঠে।