সামাজিক ইতিহাস চর্চারই একটি অন্যতম ধারা হলো নারী ইতিহাসের চর্চা। আধুনিক ইতিহাস চর্চার সবথেকে আকর্ষনীয় এবং বিতর্কিত শাখা এটি। এই ইতিহাস চর্চায় পেশাদার ঐতিহাসিকদের পাশাপাশি নারী লেখকরাও নারী জাতির গৌরবময় ইতিহাসকে তুলে ধরছেন।
এখন প্রশ্ন হলো, নারী ইতিহাস বলতে ঠিক কি বোঝায়?
নারী ইতিহাসের সংজ্ঞা :-
সমাজ ও সভ্যতার বিভিন্ন ক্ষেত্র গুলিতে নারীদের - (১.) ভূমিকা, (২.) অংশগ্রহণ, এবং (৩.) অবদানের দিকগুলি পর্যালোচনা করে ইতিহাসে নারীদের অধিকার প্রতিষ্ঠা এবং প্রকৃত মূল্যায়নের লক্ষ্যে যে ইতিহাস চর্চা করা হয়, তাকেই সাধারণত নারী ইতিহাস বলা হয় ।
অর্থাৎ এককথায় নারী ইতিহাসকে আমরা সংশোধনবাদী ইতিহাসও বলতে পারি। আমাদের দীর্ঘ পুরুষতান্ত্রিক সমাজের ছায়া আমাদের ইতিহাসের উপরেও এসে পড়েছিলো। নারী পুরুষ পাশাপাশি থাকা সত্ত্বেও, পৃথিবীর সব দেশের ইতিহাসের পাতায় পাতায় শুধু পুরুষদেরই কীর্তি খোদিত হয়ে এসেছে। দু একটি ব্যতিক্রম ছাড়া সমাজ, সভ্যতার ক্ষেত্র গুলিতে নারীদের কোন অবদানের কথা ইতিহাসে নেই।
নারী ইতিহাস চর্চা এই অন্যায়ের অবসান ঘটাতে চায় এবং সমাজ ও সভ্যতায় নারীদের অবদানের দিক গুলি তুলে ধরে ইতিহাস চর্চায় দীর্ঘ লিঙ্গ বৈষম্যকে দূর করতে চায়।
নারী ইতিহাস |
নারী ইতিহাস চর্চার সূত্রপাত:-
নারী ইতিহাস চর্চার প্রথম সূত্রপাত হয় ১৯৬০ দশকে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে। পরে তা ধীরে ধীরে পশ্চিম ইওরোপের দেশগুলিতে ছড়িয়ে পড়েছিলো। ক্রমে এই ইতিহাসের ধারা পৃথিবীর অন্যান্য দেশ গুলিতেও ছড়িয়ে পড়তে শুরু করে। ভারত সহ এশিয়া মহাদেশের দেশগুলিতে নারী ইতিহাস - ইতিহাসের একটি স্বতন্ত্র শাখা হিসাবে স্বীকৃতি লাভ করে।
ভারতে নারী ইতিহাস চর্চা :-
(১.) ভারতে ১৯৮০ দশক থেকেই কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয় এবং যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয় নারী ইতিহাস নিয়ে গবেষনা চালিয়ে যাচ্ছে।
(২.) যাদবপুরে নারী ইতিহাস চর্চার জন্য ১৯৮৮ খ্রিঃ প্রতিষ্ঠিত করা হয় - "স্কুল অব উইমেন স্টাডিজ" বা মানবীবিদ্যা চর্চা কেন্দ্র।
(৩.) বর্তমানে মানবীবিদ্যা বা ফেমিনিজমের চর্চা করবার জন্য অনেক বিশ্ববিদ্যালয়েই মানবীবিদ্যা চর্চা কেন্দ্র স্থাপিত হয়েছে।
এখন স্বাভাবিক ভাবেই প্রশ্ন জাগে মানবীবিদ্যা বা ফেমিনিজম বলতে ঠিক কাকে বোঝানো হয়েছে? এবং এর মূল উদ্দেশ্যই বা কি?
মানবীবিদ্যা বা ফেমিনিজম কি?
সাধারনত নারী সংক্রান্ত সামগ্রিক বিদ্যাচর্চাকেই মানবীবিদ্যা / নারীবিদ্যা বা ফেমিনিজম বলা হয়ে থাকে।
এর মূল উদ্দেশ্য হল - (১.) নারীদের শিক্ষা, (২.) নারী প্রগতি, নারীদের স্বাধীনতা,স্বতন্ত্র্যতা এবং (৩.) সমাজ ও সভ্যতায় নারীদের অবদানের দিকগুলো নিয়ে পঠনপাঠন করা,গবেষনা করা, আলোচনা করা, লেখালেখি করা, এবং বিতর্কে অংশ নেওয়া। অর্থাৎ এককথায়, নারী ইতিহাসের চর্চার ধারাটিকেই ফেমিনিজম বলা হয়ে থাকে।
এবার দেখে নেওয়া যাক, নারী ইতিহাস চর্চার মূল উদ্দেশ্য এবং বৈশিষ্ট্যের দিক গুলি কি কি ছিলো।
নারী ইতিহাসের মূল উদ্দেশ্য এবং বৈশিষ্ট্য :-
- নারীর ঐতিহাসিক অবদান গুলিকে মূল্য দেওয়া এবং সেগুলিকে ইতিহাসে তুলে ধরা,
- নারীর অবমূল্যায়নকারী বিষয় গুলির সমালোচনা করা,
- নারী সম্পর্কে আর্থ - সামাজিক ও নৈতিক বোধ তৈরি করা,
- ইতিহাস চর্চায় দীর্ঘ পুরুষতান্ত্রিক ধারার সংশোধন করা এবং ইতিহাস পর্যালোচনায় লিঙ্গ বৈষম্যের অবসান ঘটানো,
- নারী কেন্দ্রীয় বিষয় গুলিকে ইতিহাস চর্চার আওতায় নিয়ে আসা,
- পুরুষতন্ত্র কিভাবে নারীর বিকাশের পথে বাধা হয়ে দাঁড়ায় তা আলোচনা করা,
- নতুন উপাদানের সাহায্যে ইতিহাসের বিভিন্ন ক্ষেত্র গুলিতে নারীদের অংশগ্রহণ এবং ভূমিকার যথাযথ মূল্যায়ন করা,
- প্রচলিত বৈষম্যমূলক দৃষ্টিভঙ্গির অবসান ঘটিয়ে নারীর মর্যাদা, অধিকার এবং গুরুত্বকে প্রতিষ্ঠিত করা।
নারী ইতিহাস চর্চা শুরু হওয়ার ফলে বর্তমান ইতিহাস চর্চার ধারার মধ্যে বেশ কিছু পরিবর্তন এবং অভিনবত্বের দিক লক্ষ্য করা যাচ্ছে । ইতিহাসের ব্যাখ্যা ও আলোচনার মধ্যে বহু নতুন নতুন বিষয় সংযোজিত হচ্ছে, যেগুলো এতদিন ইতিহাস আলোচনায় উপেক্ষিত ছিল। সংক্ষেপে দেখে নেওয়া যাক, ইতিহাস চর্চায় নারী ইতিহাসের প্রধান গুরুত্বের দিক গুলি কি কি ছিলো।
নারী ইতিহাস চর্চার গুরুত্ব :-
- নারী ইতিহাস চর্চার ফলে প্রচলিত পুরুষতান্ত্রিক ইতিহাস ধারার বদল ঘটেছে।
- এখন ইতিহাসে সমাজ, রাজনীতি, শিক্ষা, স্বাধীনতা আন্দোলন, প্রভৃতি নানা ক্ষেত্র গুলিতে পুরুষদের পাশাপাশি নারীদের ভূমিকার নানা দিক গুলিও আমরা জানতে পারছি।
- ইতিহাসে অনালোচিত ও উপেক্ষিত নারীদের নানা ঐতিহাসিক অবদানের দিক গুলিও এই ইতিহাস চর্চায় উঠে আসছে। নারী ইতিহাস চর্চার ফলেই জানা গেছে, নারীরা প্রথম কৃষিকাজের উদ্ভব ঘটিয়ে ছিলেন। ঋকবৈদিক যুগে আর্য পুরুষরা অনার্যদের সঙ্গে যুদ্ধে ব্যস্ত থাকার সময়ে নারীরাই সেযুগের অর্থনীতি সচল রেখেছিলেন। একই ভাবে বিশ শতকে মহাযুদ্ধের সময়ে পুরুষরা রনাঙ্গনে চলে গেলে নারী শ্রমিকরাই অর্থনীতি সচল রেখেছিলেন।
- আসলে নারী ইতিহাস চর্চা আমাদের দেখিয়ে দিতে পেরেছে - অর্থনীতি এবং উৎপাদন ব্যবস্থায় পুরুষদের পাশাপাশি নারীরা সমান গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা নিলেও, সমাজের অর্থনীতির সুফল একতরফা ভাবে পুরুষরাই ভোগ করে এসেছে।
- শুধু অর্থনীতি নয়, পরিবেশ আন্দোলনের ক্ষেত্রেও নারীদের অংশগ্রহণ ছিলো যথেষ্টই গুরুত্বপূর্ণ। স্বাধীন ভারতে পরিবেশ রক্ষায় মেধা পটেকর, চিপকো আন্দোলনে গৌরীদেবী, পশুরক্ষা আন্দোলনে মেনকা গান্ধী গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা নেন। নারী ইতিহাস নারীদের এই ঐতিহাসিক অবদান গুলিকে তুলে ধরে।
- নারী এবং প্রকৃতি কে সমার্থক ভাবা হয়।নারী ইতিহাস চর্চা থেকে পরিবেশ প্রধান নারীবাদ বা ইকোফেমিজমের ধারনা এসেছে। নারী ইতিহাস চর্চার গুরুত্ব বৃদ্ধির ফলে তাই বিভিন্ন বিষয় অধ্যায়নে প্রকৃতি বা পরিবেশের বিষয়কে এখন যুক্ত করা হচ্ছে। ইতিহাস, ভূগোল, বিজ্ঞান প্রভৃতি নানা বিষয় গুলোতে পরিবেশের বিষয়টি সংযোজিত হচ্ছে।
নারী ইতিহাস চর্চার সঙ্গে যুক্ত বিভিন্ন ঐতিহাসিক ও তাদের গ্রন্থ :-
ইংল্যান্ড এবং মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের নারীবাদী ঐতিহাসিকরাই প্রথম এই ইতিহাস চর্চার সূত্রপাত করেন। ভারতে নারী ইতিহাস চর্চায় অভিনবত্বের দিশা দেখিয়েছিলেন, সুকুমারী ভট্টাচার্য। প্রাচীন ভারতে নারীদের অবস্থানের ওপর তিনি একাধিক গবেষণা মূলক গ্রন্থ রচনা করেছিলেন। "প্রাচীন ভারতে নারী ও সমাজ", "বিবাহ প্রসঙ্গ" এর মধ্যে অন্যতম ছিলো।
নারী ইতিহাস চর্চার অন্যান্যদের মধ্যে ছিলেন -
- নীরা দেশাই। তার উল্লেখযোগ্য গ্রন্থ ছিল - "উইমেন ইন মর্ডান ইন্ডিয়া"।
- জেরান্ডিন ফোর্বস। গ্রন্থ - "উইমেন ইন মর্ডান ইন্ডিয়া"।
- ফ্রাঁসোয়া দোবান। গ্রন্থ -" ফেমিজম অব ডেথ"।
- কমলা ভাসিন। গ্রন্থ - "হোয়াট ইজ প্যাট্রিয়ার্কি"।
- হিরন্ময় বন্দ্যোপাধ্যায়। গ্রন্থ - "ভারতের নারী মুক্তি আন্দোলন"।
- জোয়ান খেলি। গ্রন্থ -" ডিড উইমেন হ্যাভ আ রেনেসাঁ"
- গের্ডা লার্নার। গ্রন্থ -" দ্য ক্রিয়েশন অব প্যাট্রিয়ার্কি"।
নারী সংক্রান্ত কতকগুলি গুরুত্বপূর্ণ স্মরণীয় দিন, দশক ও বর্ষ:-
- আন্তর্জাতিক নারীবর্ষ - ১৯৭৫
- আন্তর্জাতিক নারী দশক - ১৯৭৫ - ১৯৮৫
- আন্তর্জাতিক নারী দিবস - ৮ মার্চ।