ঔপনিবেশিক আমলে ভারতে উল্লেখযোগ্য ঘটনা গুলির একটি ছিলো, এদেশে ইংরেজি শিক্ষার প্রচলন করা। শুরুর দিকে অবশ্য ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি কোনমতেই এদেশে ইংরেজি শিক্ষা বিস্তারের পক্ষপাতী ছিলো না।
ঔপনিবেশিক ভারতে ইংরেজি শিক্ষার বিস্তার |
ইংরেজি শিক্ষার বিস্তারে কোম্পানির অনীহা
১৭৯২ খ্রিঃ কোম্পানির প্রশাসক চার্লস গ্রান্ট সর্বপ্রথম এক পুস্তিকায় এদেশে ইংরেজি শিক্ষা প্রচলনের প্রস্তাব দেন। কিন্তু ইংল্যান্ডের কমন্স সভা এবং কোম্পানির ডাইরেক্টর সভা সেই প্রস্তাবকে নাকচ করে দেয়।
আসলে শুরুর দিকে ভারতে ইংরেজি শিক্ষা প্রচলনে কোম্পানির অনীহার প্রধান দুটো কারন ছিলো -
- কোম্পানি আশঙ্কা করেছিলো, ভারতে ইংরেজি শিক্ষার প্রচলন ঘটলে পাশ্চাত্যের জ্ঞান বিজ্ঞানের সংস্পর্শে এসে ভারতীয়দের স্বাধীনতাবোধের জাগরন ঘটবে। তাতে কোম্পানি ক্ষতি ছাড়া আর কিছুই হবে না।
- প্রশাসনিক ক্ষমতা লাভ করবার পরও কোম্পানি নিজেকে একটি ব্যবসায়িক প্রতিষ্ঠান হিসাবেই ভাবতো। তাই ব্যবসায়িক মানসিকতায় শিক্ষা বিস্তারে অর্থ খরচের কোন অর্থই কোম্পানি খুঁজে পায় নি।
মূলত এই দুটি কারনের জন্যই ভারতে ইংরেজি শিক্ষার প্রচলনে ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি যথেষ্ট গড়িমসি করেছিলো।
কেরানি তৈরির মিথ আর বাস্তবতা
(১.) ১৮১৩ খ্রিঃ চার্টার আইনে ভারতীয় রাজস্ব থেকে প্রাপ্ত অর্থের এক লক্ষ টাকা শিক্ষার জন্য খরচের নির্দেশ দেওয়া হয়েছিলো। কিন্তু ১৮১৩ থেকে ১৮২৩ খ্রিঃ পর্যন্ত, প্রথম ১০ বছরে কোম্পানি শিক্ষাখাতে একটা টাকাও খরচ করে নি।
(২.) ১৮২৩ খ্রিঃ শিক্ষা খাতে বরাদ্দ টাকার বেশিরভাগটাই খরচ করা হয়েছিলো প্রাচ্যবিদ্যা চর্চার প্রতিষ্ঠান গুলির উন্নয়নে। ১৮২৩ থেকে ১৮৩৪ খ্রিঃ মধ্যে ইংরেজি শিক্ষার প্রসারে কোন শিক্ষা প্রতিষ্ঠানই সরকার গড়ে তোলে নি।
(৩.) ১৮৩৫ খ্রিঃ "মেকলে মিনিটে" ভারতে ইংরেজি শিক্ষার প্রচলন ও বিস্তার সম্পর্কে কোম্পানির আধিকারিকদের সব সংশয় ও আশঙ্কাকে দূর করে টমাস ব্যাবিংটন মেকলে ভবিষ্যৎবাণী করেছিলেন, ভারতে ইংরেজি শিক্ষার প্রচলন ঘটালে আখেরে সরকারেরই লাভ হবে। কারন ইংরেজি শিক্ষার মধ্য দিয়ে ইওরোপীয় সংস্কৃতিরও প্রসার ভারতে ঘটবে। তাতে মন মানসিকতার একদল ইংরেজ তৈরি হবে। যাদের দ্বারা কোম্পানি প্রভূত লাভবান হতে পারে।
এই মিনিটের দ্বারা প্রভাবিত হয়েই তৎকালীন গর্ভনর জেনারেল লর্ড উইলিয়াম বেন্টিঙ্ক ১৮৩৫ খ্রিঃ ৭ ই মার্চ সরকারি ভাবে ইংরেজি শিক্ষা বিস্তারের কথা ঘোষনা করেন। এরপর থেকেই ইংরেজি শিক্ষার প্রসারে সরকারি উদ্যোগ লক্ষ্য করা যায়।
এখানে উপরে উল্লেখিত ঘটনা গুলি থেকে তিনটি বিষয় খুব পরিষ্কার ভাবে বোঝা যায় -
(১.) কেরানি তৈরির তাগিদটির জন্যই কোম্পানি এদেশে ইংরেজি শিক্ষার প্রচলন করেছিলো বলে যে কথাটি দীর্ঘদিন ধরে প্রচলিত আছে, তা একটি মিথ বা অতিকথা ছাড়া আর কিছুই নয়। কারন সত্যিই যদি তেমন তাগিদ থাকতো, তাহলে ইংরেজি শিক্ষার প্রচলনে কোম্পানি এত গড়িমসি করতো না। মেকলে মিনিটের আগেই অন্তত সামান্য কিছু তাগিদও লক্ষ্য করা যেতো।
(২.) উপরের ঘটনাপ্রবাহ থেকে এটাও বোঝা যায়, ইংরেজি শিক্ষার প্রচলনে কোম্পানির যথেষ্ট সদিচ্ছা আর উৎসাহেরও অভাব ছিলো।
(৩.) উৎসাহ আর সদিচ্ছার থেকেও বড়ো কথা, ইংরেজি শিক্ষার ফলাফল সম্পর্কে এক অজানা আতঙ্ক কোম্পানিকে গ্রাস করেছিলো। মেকলে মিনিটে এই আশঙ্কা পুরোপুরি দূর হয়ে যাওয়ায় ১৮৩৫ খ্রিঃ পর থেকে ইংরেজি শিক্ষার প্রসারে একটি জোয়ার দেখা দেয়।
সরকারের ওপর চাপ সৃষ্টি
সরকারি উদ্যোগে ইংরেজি শিক্ষার প্রসারের জন্য অবশ্য মেকলে মিনিট কে একক কৃতিত্ব দিলে সত্যের অপলাপ হবে। ইংরেজি শিক্ষার বিস্তারে সরকারি উদ্যোগ নেওয়ার ক্ষেত্রে খ্রিষ্টান মিশনারি এবং বেশকিছু প্রগতিশীল বুদ্ধিজীবীও গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা নিয়েছিলেন। ব্রিটিশ পার্লামেন্টে এরা প্রবল ভাবে সোচ্চার হয়েছিলেন বলেই, শিক্ষা সংক্রান্ত নানা নীতি নির্দেশিকা ব্রিটিশ পার্লামেন্ট থেকে তৈরি হয়ে এদেশে এসেছিলো, এবং এগুলি এখানকার ঔপনিবেশিক সরকারের ওপর একটি চাপ সৃষ্টি করেছিলো। উদাহরন হিসাবে ১৮১৩ খ্রিঃ চার্টার আইন এবং ১৮৫৪ খ্রিঃ উডের নির্দেশনামার কথা বলা যায়।
ইংরেজি শিক্ষা বিস্তারের উদ্যোগ
ভারতে ইংরেজি শিক্ষার বিস্তারকে দুটো পর্বে ভাগ করে আলোচনা করা যায় -
(ক.) ১৮৩৪ খ্রিঃ পর্যন্ত বেসরকারি উদ্যোগ এবং
(খ.) ১৮৩৫ খ্রিঃ থেকে সরকারি উদ্যোগ,
ইংরেজি শিক্ষা বিস্তারের উদ্যোগ |
(ক.) বেসরকারি উদ্যোগ
ঔপনিবেশিক আমলে ১৮৩৫ খ্রিঃ সরকারি উদ্যোগ গ্রহণের আগে, ইংরেজি শিক্ষার প্রসারে যেটুকু কাজ হয়েছিলো, তার সবটাই হয়েছিলো বেসরকারি উদ্যোগে। আলোচনার সুবিধার্থে এই উদ্যোগ গুলিকে আমরা ৩ টি ভাগে ভাগ করতে পরি -
- বিদেশীয় ব্যক্তিগত উদ্যোগ,
- খ্রিষ্টান মিশনারিদের উদ্যোগ,
- দেশীয় ও বিদেশীয়দের সম্মিলিত উদ্যোগ,
(১.) বিদেশীয় ব্যক্তিগত উদ্যোগ
প্রথম দিকে এদেশে ইংরেজি বিদ্যালয় খুলতে এগিয়ে এসেছিলেন বেশ কিছু ইওরোপীয় ব্যক্তি। তৎকালীন সময়ে ইংরেজি শিক্ষার চাহিদা ও প্রয়োজনীয়তার দিকটি পূরনের জন্যই তারা সেই সব বিদ্যালয় খুলেছিলেন।
ভারতের প্রচলিত শিক্ষায় ভাঙ্গন
ইংরেজি শিক্ষা প্রচলনের আগে ভারতে প্রচলিত শিক্ষা ব্যবস্থা ছিলো অনেকটাই গতানুগতিক ধাঁচের। হিন্দুরা পাঠশালা আর টোলে পড়াশোনা করতো। মুসলিমদের জন্য ছিলো মক্তব আর মাদ্রাসা। কিন্তু যুগসন্ধিক্ষনে দাড়িয়ে এই সব দেশীয় শিক্ষা প্রতিষ্ঠান গুলি রাজা মহারাজাদের পৃষ্ঠপোষকতার অভাবে ধুঁকতে থাকে, এবং কোনরকমে টিকে থাকে। ভারতে কোম্পানির শাসন প্রতিষ্ঠিত হওয়ায় ফার্সি বা সংস্কৃত শিখে সরকারি চাকুরি লাভের কোন সম্ভাবনাও আর তেমন ছিলো না।
ইংরেজি শিক্ষার চাহিদা
ইতিমধ্যে কোম্পানির সঙ্গে ব্যবসা বাণিজ্যের সূত্রে ইংরেজি ভাষা জানাটা অত্যন্ত প্রয়োজনীয় বলে মনে হলো। ইংরেজদের বানিজ্য কুঠি ও প্রশাসনিক দপ্তর গুলোতে ইংরেজি জানা কাজের লোকেরও দরকার ছিলো। এই সুযোগে অনেক সম্ভ্রান্ত ব্যক্তি ইংরেজি শিক্ষা লাভ করতে চাইছিলেন। কারন ইংরেজি শিক্ষা লাভের সঙ্গে চাকুরি এবং ব্যবসা বাণিজ্যে সুবিধা, দুটো দিকই জড়িত ছিলো।
অ্যাংলো ইন্ডিয়ানদের বিদ্যালয় স্থাপন
সময়ের এই চাহিদা পূরনের জন্য বেশ কিছু অ্যাংলো ইন্ডিয়ান ব্যক্তি এইসময় কলকাতায় ইংরেজি বিদ্যালয় খুলে বসলেন।
- ডেভিড ড্রামন্ড "ধর্মতলা একাডেমী" স্থাপন করেন।
- জোড়াসাঁকোতে শেরবোর্ন একটি ইংরেজী বিদ্যালয় স্থাপন করেন।
- এছাড়া বাউল, আরটুন পিট্রাস প্রমুখ ব্যক্তিরাও একটি করে বিদ্যালয় খুলেছিলেন।
এই সমস্ত বিদ্যালয় গুলিতে হেনরী ভিভিয়ান ডিরোজিও, প্রিন্স দ্বারকানাথ ঠাকুর, রামগোপাল ঘোষের মতো নবজাগরনের কান্ডারিরা ইংরেজি শিক্ষার সুযোগ লাভ করেছিলেন।
(২.) খ্রিষ্টান মিশনারিদের উদ্যোগ
ভারতে ইংরেজি শিক্ষার বিস্তারে খ্রিষ্টান মিশনারিরা দুটি ক্ষেত্রে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা নিয়েছিলেন -
(ক.) সরকারি উদ্যোগে যাতে ভারতে ইংরেজি শিক্ষার প্রচলন ঘটে, সেইজন্য ইংল্যান্ডের অভ্যন্তরে তারা একটি চাপ ও জনমত তৈরি করেছিলেন। এবং
(খ.) সরকারি উদ্যোগের অপেক্ষায় না থেকে নিজেরাই উদ্যোগী হয়ে একাধিক ইংরেজি বিদ্যালয় স্থাপন করেছিলেন। এইসব খ্রিষ্টান মিশনারিদের উদ্যোগের ফলে কলকাতা ও তার পার্শ্ববর্তী অঞ্চল গুলিতে বেশ কিছু ইংরেজি বিদ্যালয় গড়ে উঠেছিলো।
মিশনারিদের এই প্রয়াসের ফলে ভারতে ইংরেজি শিক্ষার প্রসারে উল্লেখযোগ্য অগ্রগতি ঘটেছিলো। যেমন -
- শ্রীরামপুর ব্যাপটিস্ট মিশনের উদ্যোগে প্রতিষ্ঠিত ১২৬ টি বিদ্যালয়ে ১০,০০০ ছাত্র ইংরেজি শিক্ষার সুযোগ লাভ করেছিলো।
- ১৮১৮ খ্রিঃ এই মিশন উচ্চশিক্ষার জন্য শ্রীরামপুরে একটি কলেজ প্রতিষ্ঠা করেছিলো।
- লন্ডন মিশনারি সোসাইটির উদ্যোগে আয়োজিত ৩৬ টি স্কুলে বহু ভারতীয় ইংরেজি শিক্ষার অধিকার লাভ করেন।
- চার্চ মিশনারিরা কলকাতা, বর্ধমান, কালনা এবং দক্ষিণ ভারতে অনেক গুলি ইংরেজি বিদ্যালয় খোলেন।
- স্কটিশ মিশনের প্রতিষ্ঠাতা আলেকজান্ডার ডাফ বেশ কয়েকটি ইংরেজি বিদ্যালয় খোলেন। এগুলির মধ্যে উল্লেখযোগ্য ছিলো, ১৮৩০ খ্রিঃ প্রতিষ্ঠিত "জেনারেল অ্যাসেম্বলিজ ইনস্টিটিউশন" ( বর্তমান নাম স্কটিশ চার্চ কলেজ)।
(৩.) দেশীয় ও বিদেশীয়দের সম্মিলিত উদ্যোগ
উনিশ শতকের প্রথমার্ধে কয়েকজন উদার মুক্তমনা ভারতীয় ও বিদেশী ব্যক্তিদের সম্মিলিত উদ্যোগে বেশ কিছু ইংরেজি শিক্ষা প্রতিষ্ঠান গড়ে ওঠে।
- ১৮১৬ খ্রিঃ রামমোহন রায় নিজ উদ্যোগে কলকাতায় "অ্যাংলো হিন্দু স্কুল" নামে একটি ইংরেজি বিদ্যালয় খোলেন।
- ১৮১৭ খ্রিঃ ডেভিড হেয়ার, রাধাকান্ত দেব, বৈদনাথ মুখোপাধ্যায়, সুপ্রিম কোর্টের প্রধান বিচারপতি স্যার এডওয়ার্ড হাইড ইস্ট হিন্দু কলেজ প্রতিষ্ঠা করেন।
- ১৮১৭ খ্রিঃ ডেভিড হেয়ার পটলডাঙ্গা একাডেমী প্রতিষ্ঠা করেন, যার পরে নাম হয়েছিলো - "হেয়ার স্কুল"।
- হেয়ারের উদ্যোগেই পাঠ্যপুস্তক রচনা ও ইংরেজ বিদ্যালয় প্রতিষ্ঠার উদ্দেশ্যে ১৮১৭ খ্রিঃ "স্কুল বুক সোসাইটি" এবং ১৮১৮ খ্রিঃ "কলকাতা স্কুল সোসাইটি" প্রতিষ্ঠিত হয়।
এই সময় রাজা রাধাকান্ত দেব, রাজা রামমোহন রায়, প্রিন্স দ্বারকানাথ ঠাকুর, ডেভিড হেয়ার, বর্ধমানের রায়বাহাদূর তেজচন্দ্র রায় প্রমুখ ব্যক্তিরা পাশ্চাত্য ইংরেজি শিক্ষার বিস্তারে একে অপরের উদ্যোগে পাশে এসে দাঁড়ান। এমনকি তারা খ্রিষ্টান মিশনারিদের ইংরেজি শিক্ষা বিস্তারের উদ্যোগেও নানারকম সহায়তা করেন।
(খ.) সরকারি উদ্যোগ
ভারতে ইংরেজি শিক্ষার বিস্তারে সবার শেষে এসেছিলো সরকারি উদ্যোগ। ১৮১৩ খ্রিঃ সনদ আইনে ভারতে শিক্ষা খাতে কোম্পানিকে বার্ষিক এক লক্ষ টাকা খরচ করবার নির্দেশ দেওয়া হলে, কোন শিক্ষা খাতে এই টাকা খরচ হবে তা নিয়ে দীর্ঘদিন যাবৎ প্রাচ্য - পাশ্চাত্য শিক্ষা বিতর্ক চলে। অবশেষে ১৮৩৫ খ্রিঃ মেকলে মিনিটে এই বিতর্কের অবসান ঘটানো হয়, এবং ১৮৩৫ খ্রিঃ ৭ ই মার্চ সরকারি ভাবে ইংরেজি শিক্ষার প্রসারের কথা ঘোষনা করা হয়।
এই সময় সরকারি উদ্যোগে বেশ কিছু শিক্ষা প্রতিষ্ঠান গড়ে তোলা হয়। এগুলি হল -
- কলকাতা মেডিক্যাল কলেজ,
- থমাসোন ইঞ্জিনিয়ারিং কলেজ,
- মাদ্রাজ ইউনিভার্সিটি হাই স্কুল,
- বোম্বাই এ এলফিনস্টোন ইনস্টিটিউশন,
কাউন্সিল অব এডুকেশন গঠন
(১.) ১৮৩৫ খ্রিঃ ইংরেজি শিক্ষার প্রসারে সরকার যে সব উদ্যোগ গ্রহন করছিলো, তার মধ্যে কোন শৃঙ্খলা ছিলো না।
(২.) এই কারনে জেনারেল কমিটি অব পাবলিক ইনস্ট্রাকশন বা জনশিক্ষা কমিটিকে নতুন করে পুনর্গঠন করে ১৮৪২ খ্রিঃ "কাউন্সিল অব এডুকেশন" গঠন করা হয়।
(৩.) এই সংস্থার উদ্যোগে ১৮৫৫ খ্রিঃ মধ্যে ১৫১ টি ইংরেজি বিদ্যালয়ে ১৩ হাজারের বেশি ছাত্রের ইংরেজি শিক্ষার ব্যবস্থা করা হয়।
(৪.) ১৮৪৪ খ্রিঃ বড়লাট হার্ডিং সরকারি চাকরিতে ইংরেজি ভাষাকে অগ্রাধিকার দেওয়ার ঘোষনা করলে, ইংরেজি শিক্ষার প্রতি আগ্রহ এবং উৎসাহ অনেকখানি বেড়ে যায়।
ইংরেজি শিক্ষাকে সুসংবদ্ধকরনের উদ্যোগ
ভারতে সরকারি - বেসরকারি উদ্যোগে অনেক শিক্ষা প্রতিষ্ঠান গড়ে উঠলেও, সেই সমস্ত প্রতিষ্ঠান গুলি পরিচালনার ক্ষেত্রে নানা ত্রুটি বিচ্যুতি লক্ষ্য করা যায়।
- শিক্ষা প্রতিষ্ঠান গুলিতে পাঠ্যক্রম ও পঠন পাঠন রীতির মধ্যে কোন সামঞ্জস্য ছিলো না।
- শিক্ষা ব্যবস্থার মধ্যে কোন শৃঙ্খলা ছিলো না।
- অনেক বিদ্যালয় আর্থিক কারনে ধুঁকতে থাকে।
- শিক্ষা বিস্তারে সরকারের উদ্যোগ ভারতের সব জায়গায় একই রকম ছিলো না।
- শিক্ষা গ্রহণের স্তর বা শ্রেনী সম্পর্কে কোন স্বচ্ছ ধারণা ছিলো না।
- সর্বোপরি, ভারতে উচ্চ শিক্ষা লাভের জন্য কোন শিক্ষা প্রতিষ্ঠানও ছিলো না।
উডের নির্দেশনামা
১৮৫৩ খ্রিঃ ব্রিটিশ পার্লামেন্টে ভারতের ইংরেজি শিক্ষা বিস্তারের ত্রুটি বিচ্যুতি ও প্রধান সমস্যা গুলিকে সামনে নিয়ে আসা হয়। এর পরিপ্রেক্ষিতে এগুলির সমাধানের জন্য শিক্ষা সংক্রান্ত এক খসড়া পত্র লিখে ১৮৫৪ খ্রিঃ ইংল্যান্ড থেকে ভারতে পাঠিয়ে দেওয়া হয়।
এই খসড়া পত্রটি রচনা করেছিলেন বোর্ড অব কন্ট্রোলের সভাপতি চার্লস উড। তাই তার নাম অনুসারেই এই খসড়া পত্র কে "উডের ডেসপ্যাচ" বা "উডের নির্দেশনামা" বলা হয়ে থাকে।
এই নির্দেশনামাতে ভারতে ইংরেজি শিক্ষার বুনিয়াদকে শক্ত ভিতের ওপর দাড় করানোর জন্য চার্লস উড বেশ কিছু সুপারিশ করেন। যেমন -
- একটি পৃথক শিক্ষা দপ্তর গঠন,
- সমগ্র শিক্ষা ব্যবস্থাকে ৫ টি স্তরে ভাগ করা,
- কলকাতা, বোম্বাই, মাদ্রাজ প্রেসিডেন্সিতে একটি করে বিশ্ববিদ্যালয় স্থাপন,
- সরকারি উদ্যোগে প্রাথমিক, মাধ্যমিক ও মডেল স্কুল স্থাপন,
- বিদ্যালয় গুলিকে আর্থিক অনুদান প্রদান,
- শিক্ষক - শিক্ষন বিদ্যালয় প্রতিষ্ঠা,
- নারী শিক্ষার প্রসার করা,
- শিক্ষা প্রতিষ্ঠান গুলি নিয়মিত পরিদর্শনের ব্যবস্থা করা,
ইংরেজি শিক্ষার উল্লেখযোগ্য অগ্রগতি
উডের সুপারিশের পরিপ্রেক্ষিতে ভারতে ইংরেজি শিক্ষার বিস্তারে উল্লেখযোগ্য অগ্রগতি ঘটে।
- ১৮৫৫ খ্রিঃ সরকারি শিক্ষা দপ্তর ডিরেক্টর অব পাবলিক ইনস্ট্রাকশন প্রতিষ্ঠিত হয়।
- ১৮৫৫ খ্রিঃ ২১৯ টি উচ্চ ও মধ্য ইংরেজি বিদ্যালয় সরকারি আর্থিক অনুদান লাভ করে ।
- শিক্ষা ব্যবস্থায় অনেকটাই সামঞ্জস্য ও শৃঙ্খলা স্থাপিত হয়।
- ১৮৫৭ খ্রিঃ উচ শিক্ষার জন্য কলকাতা, বোম্বাই ও মাদ্রাজে একটি করে বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠিত হয়,এবং বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠার মধ্য দিয়েই ভারতে ইংরেজি শিক্ষার বিস্তারের বৃত্ত সম্পূর্ণ হয়।
ইংরেজি শিক্ষার ফলাফল
- ইংরেজি শিক্ষার প্রসারের সঙ্গে সঙ্গে পাশ্চাত্যের জ্ঞান বিজ্ঞানের দরজা ভারতীয়দের কাছে উন্মুক্ত হয়ে যায়।
- ভারতীয়রা ইংরেজি শিক্ষার সংস্পর্শে এসে পাশ্চাত্য সভ্যতা, জ্ঞান বিজ্ঞান, জাতীয়তাবাদ, গনতন্ত্র, স্বাধীনতা, মানবতাবোধ, ইত্যাদি আদর্শের সঙ্গে পরিচিত হয়।
- পাশ্চাত্য সভ্যতার সংস্পর্শে এসে ভারতীয়রা নিজ সমাজ, দেশ ও জাতির দুর্বলতা গুলি বুঝতে পারে।
- এগুলি দূর করবার জন্য তারা পাশ্চাত্য যুক্তিবাদ ও মানবতাবাদের আদর্শে সমাজ ও ধর্ম সংস্কার আন্দোলন শুরু করে।
- ইংরেজি ভাষা শিক্ষিত ভারতবাসীকে ঐক্যসূত্রে আবদ্ধ করে এবং ভারতীয়দের জাতীয়তাবাদী চেতনার বিকাশ ঘটায়।
ইংরেজি শিক্ষার ত্রুটি বিচ্যুতি
ভারতে ইংরেজি শিক্ষার বিস্তার একটি অংশের ভারতীয়দের আশা আকাঙ্ক্ষা পূর্ন করতে পারলেও, সাধারন ভারতবাসী এর সুফল থেকে বঞ্চিতই ছিলেন।
- ইংরেজি শিক্ষার প্রসারে উচ্চ ও মধ্য শিক্ষা প্রতিষ্ঠান গড়ে তোলার দিকে যতটা জোর দেওয়া হয়েছিলো, প্রাথমিক বিদ্যালয় প্রতিষ্ঠার দিকে তা একেবারেই করা হয় নি। তার ফলে ইংরেজি শিক্ষার সুফল সাধারন মানুষের মধ্যে ছড়িয়ে পড়তে পারে নি।
- প্রাথমিক বিদ্যালয় যথেষ্ট না থাকায় সাধারণ মানুষ ইংরেজি শিক্ষা লাভের পর্যাপ্ত সুযোগ লাভ করতে পারেন নি।
- ইংরেজি শিক্ষার বিস্তারের ক্ষেত্রে কারিগরি ও বৃত্তিমূলক শিক্ষাকে উপেক্ষা করা হয়। তার ফলে অল্প কিছু দিনের মধ্যেই ইংরেজি শিক্ষিত ভারতবাসীর মধ্যে চাকুরি না পাওয়ার ক্ষোভ এবং তীব্র হতাশা দেখা যায়।
- ইংরেজি শিক্ষা গ্রহণে মুসলিমদের আকৃষ্ট করা যায় নি। স্ত্রী শিক্ষারও উল্লেখযোগ্য অগ্রগতি ঘটে নি।