প্রাচ্যশিক্ষা ও পাশ্চাত্য শিক্ষা বিষয়ক দ্বন্দ্ব

ঔপনিবেশিক আমলে ভারতে শিক্ষা বিস্তারের ইতিহাসে একটি স্মরণীয় ঘটনা ছিলো - প্রাচ্য শিক্ষা বনাম পাশ্চাত্য শিক্ষা বিষয়ক দ্বন্দ্ব। এই দ্বন্দ্ব ১৮১৩ থেকে ১৮৩৯ খ্রিঃ পর্যন্ত প্রায় ২৬ বছর ধরে চলেছিলো। 

প্রাচ্যশিক্ষা ও পাশ্চাত্য শিক্ষা বিষয়ক দ্বন্দ্ব
প্রাচ্যশিক্ষা ও পাশ্চাত্য শিক্ষা বিষয়ক দ্বন্দ্ব 


দ্বন্দ্বটি একদিকে যেমন ইংল্যান্ডের অভ্যন্তরে আলোড়ন সৃষ্টি করেছিলো, ঠিক তেমনই ভারতের ভিতরেও যথেষ্ট বিতর্ক তৈরি করেছিলো। দীর্ঘ সময় ধরে চলা, এই দ্বন্দ্বটি প্রাচ্যবাদী ও পাশ্চাত্যবাদী নামে দুটো গোষ্ঠীর মধ্যে, প্রধানত বৌদ্ধিক বিতর্কের স্তরেরই সীমাবদ্ধ থেকেছিলো, কিন্তু কখনই এই দ্বন্দ্ব সংঘর্ষের বা যুদ্ধের রূপ নেয় নি।

এখন মূল বিতর্কের আলোচনায় যাবার আগে প্রাচ্যবাদ এবং পাশ্চাত্যবাদ বলতে ঠিক কাকে বোঝায়, সেটা সম্পর্কে ধারনাটা পরিষ্কার করে নেওয়া খুবই প্রয়োজন।

প্রাচ্যবাদ

প্রাচ্যের ভাষা, সংস্কৃতি, শিক্ষা এবং ঐতিহ্যের অনুশীলনের সামগ্রিক বিষয়টিকেই এককথায় প্রাচ্যবাদ বলা হয়ে থাকে।

 আরও সহজ ভাষায় বলতে গেলে, ভারতবর্ষ প্রাচ্যের একটি অন্যতম দেশ। এখানকার প্রাচীন ভাষা, শিক্ষা, সংস্কৃতি, ঐতিহ্য এবং রীতি নীতি, এটির যে অনুশীলন, সামগ্রিকভাবে সেটিই প্রাচ্যবাদ নামে পরিচিত। 

পাশ্চাত্যবাদ

অন্যদিকে পাশ্চাত্যের ভাষা, অর্থাৎ ইংরেজি ভাষার চর্চা, পাশ্চাত্যের শিক্ষা, সংস্কৃতি, ঐতিহ্য ও রীতি নীতি অনুসরনের সামগ্রিক বিষয়টিই এককথায় পাশ্চাত্যবাদ নামে পরিচিত।

প্রাচ্য-পাশ্চাত্য বিতর্কের মূল কারন 

মনে রাখতে হবে, ঔপনিবেশিক আমলে শিক্ষা ও শাসনতন্ত্রের ক্ষেত্রে প্রাচ্য ও পাশ্চাত্যবাদ, এই দুই ধারার কোনটি অনুসরন করা হবে, সেটি নিয়েই মূলত যাবতীয় বিতর্ক দানা বেঁধে ছিলো। এটা ঠিক, ঔপনিবেশিক শাসনের প্রথম পর্বে ভারতে প্রাচ্যবাদের প্রয়োগ করা হয়েছিলো।

 কিন্তু কিছুদিন যাবার পর, বিশেষত, উনিশ শতকের একেবারে গোড়া থেকেই  ভারত এবং ইংল্যান্ডের অভ্যন্তরে পাশ্চাত্যবাদী ভাবধারা অতি সক্রিয় হয়ে উঠেছিলো। তাদের এই অতি সক্রিয়তার ফলেই যাবতীয় দ্বন্দ্ব, বিতর্ক এবং অশান্তির সূত্রপাত হয়েছিলো। 

ভারতে প্রাচ্যবাদের সূচনা 

ভারতবর্ষে ঔপনিবেশিক শাসনের প্রথম পর্বে ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি মূলত (১.) প্রশাসনিক এবং (২.) শাসনতান্ত্রিক - এই দুটি কারনেই প্রাচ্যবাদের প্রতি উৎসাহী হয়ে উঠেছিলো। 

ভারতবর্ষে প্রাচ্যবাদী ভাবধারার সবথেকে বড়ো সমর্থক এবং রূপকার ছিলেন, ওয়ারেন হেস্টিংস। তিনি মনে করতেন, একটি দেশকে ভালোভাবে শাসন করতে গেলে সেই দেশের ভাষা, সংস্কৃতি, রীতি নীতি এবং ঐতিহ্য সম্পর্কে অবশ্যই জ্ঞান থাকা প্রয়োজন। হেস্টিংসের এই চিন্তাধারা ভারতে প্রাচ্যবাদের প্রসারে সহায়ক হয়েছিলো, বলা যায়। 

হেস্টিংসের চিন্তাধারার অনুসারী ছিলেন - চার্লস উইলকিনস, ন্যাথানিয়েল হ্যালহেড, জোনাথান ডানকান, এইচ টি কোলব্রুক এবং উইলিয়াম জোন্স প্রমুখ। এরা সকলেই প্রাচ্যবাদী প্রবক্তা নামে পরিচিত ছিলেন।  

কোম্পানির প্রাচ্যবাদের প্রতি আগ্রহের কারন

ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির শাসনের প্রথম দিকে দুটি ঘটনা ভারতে প্রাচ্যবাদের প্রয়োগের দিকটিকে ত্বরান্বিত করেছিলো। একটি ছিলো, কোম্পানি দেওয়ানী লাভের ঘটনা। অপরটি ছিলো ১৭৭৩ খ্রিঃ রেগুলেটিং অ্যাক্ট। 

দেওয়ানী লাভ

ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি ১৭৬৫ খ্রিঃ মুঘল সম্রাট দ্বিতীয় বাহাদূর শাহের কাছ থেকে বাংলা প্রদেশের দেওয়ানী লাভ করেছিলো। অর্থাৎ বাংলাদেশের রাজস্ব আদায় এবং জমিজমা সংক্রান্ত বিরোধের মীমাংসা করবার ক্ষমতা ও দায়িত্ব লাভ করেছিলো। এখন এই ক্ষমতা বা  দায়িত্ব সুষ্ঠু ভাবে পালন করবার জন্য কোম্পানিকে অবশ্যই ভারতীয় ভাষা, রীতিনীতি,এবং ঐতিহ্য সম্পর্কে জানতে হতো। কারন ভারতের ঐতিহ্য বা রীতি নীতি সম্পর্কে পূর্ব জ্ঞান না থাকলে কখনই দেওয়ানীর দায়িত্ব কোম্পানির পক্ষে পালন করা সম্ভব ছিলো না। এই কারনটির জন্যই দেখা গিয়েছিলো, কোম্পানি দেওয়ানী লাভ করবার পরও তার দায়িত্ব সরাসরি নিজের হাতে না নিয়ে রেজা খাঁ ও সীতাব রায় নামে দুজন ব্যক্তির হাতে লিজ দিয়েছিলো। 

কিন্তু এইভাবে অস্থায়ী ব্যবস্থার মাধ্যমে বেশিদিন চালানো সম্ভব ছিলো না। দেওয়ানীর দায়িত্ব আজ নয়তো কাল কোম্পানিকে নিজের হাতে তুলে নিতেই হতো। এই কারনে কোম্পানি এবং তার আধিকারিকরা প্রথমদিক থেকেই প্রাচ্যবিদ্যা চর্চায় উৎসাহী হয়ে উঠেছিলেন। 

১৭৭৩ খ্রিঃ রেগুলেটিং অ্যাক্ট 

ভারতে প্রাচ্যবিদ্যা চর্চার আরও একটি বড়ো কারন ছিলো ১৭৭৩ খ্রিঃ রেগুলেটিং অ্যাক্ট। এই আইন অনুযায়ী কলকাতা, বোম্বাই ও মাদ্রাজ প্রেসিডেন্সী নিয়ে কোম্পানির একটি কেন্দ্রীয় সরকার গঠন করা হয়। বাংলা প্রেসিডেন্সীর গভর্নরকে এই কেন্দ্রীয় সরকারের প্রধান নিযুক্ত করা হয়। এই ব্যবস্থার পাশাপাশি এই আইনে বিচারের জন্য কলকাতায় একটি সুপ্রীমকোর্টও গঠন করা হয়। 

১৭৭৩ খ্রিঃ রেগুলেটিং আইনের সংশোধিত অ্যাক্টে বিচার প্রক্রিয়ার ক্ষেত্রে একটি গুরুত্বপূর্ণ কথা বলা হয়। বলা হলো, ভারতে বিচারের ক্ষেত্রে হিন্দু এবং মুসলমানরা প্রচলিত আইন অনুযায়ী পরিচালিত হবে। অর্থাৎ ব্রিটিশ আইন এখানে ওপর থেকে চাপিয়ে দেওয়া হবে না। 

এখন ভারতের প্রচলিত আইন গুলির সবগুলিই হয় সংস্কৃত, নয়তো ফার্সি ভাষায় রচিত ছিলো। খুব স্বাভাবিক ভাবেই ভারতের প্রচলিত আইন গুলো সম্পর্কে জানবার জন্য সংস্কৃত, আরবী ও ফার্সি ভাষা জানা অত্যন্ত প্রয়োজনীয় হয়ে উঠলো। 

এই কারনের জন্যই মূলত কোম্পানির শাসনের প্রথমদিকে প্রাচ্যবিদ্যা চর্চার প্রয়োজনীয়তা দেখা যায়। এই প্রয়োজনীয়তার চাহিদা পূরনের জন্যই তাই এইসময় থেকে কোম্পানির উদ্যোগে একের পর এক প্রাচ্য শিক্ষা প্রতিষ্ঠান ভারতে গড়ে উঠতে আরম্ভ করে। 

  • ১৭৮১ খ্রিঃ ওয়ারেন হেস্টিংসের উদ্যোগে আরবি,ফার্সী ভাষা চর্চা এবং মুসলিম আইন চর্চার উদ্দেশ্যে গড়ে উঠে কলকাতা মাদ্রাসা। 
  • ১৭৮৪ খ্রিঃ স্যার উইলিয়াম জোন্সের উদ্যোগে প্রাচ্যবিদ্যা চর্চার জন্য গড়ে উঠে এশিয়াটিক সোসাইটি। 
  • ১৭৯২ খ্রিঃ সংস্কৃত চর্চার জন্য জোনাথান ডানকানের উদ্যোগে গড়ে উঠে সংস্কৃত কলেজ। 
  • ১৮০০ খ্রিঃ লর্ড ওয়েলেসলির উদ্যোগে কলকাতায় যে ফোর্ট উইলিয়াম কলেজ তৈরি হয়েছিলো, তার মূল উদ্দেশ্য ছিলো ভারতে আসা ইংরেজ অফিসারদের ভারতীয় ভাষা, রীতিনীতি, সংস্কৃতি ও ঐতিহ্য সম্পর্কে শিক্ষা দেওয়া, যাতে তারা সুষ্ঠুভাবে কাজকর্ম করতে পারেন। 
কোম্পানির শাসনের প্রথমদিকে এই সমস্ত প্রতিষ্ঠান গুলির হাত ধরেই ভারতে প্রাচ্যবাদের সূচনা ও বিকাশ ঘটেছিলো। 

ভারতে পাশ্চাত্যবাদের সূচনা 


ভারতে পাশ্চাত্যবাদের সূচনার ক্ষেত্রে ১৮০৬ খ্রিঃ ভেলোরের সিপাহী বিদ্রোহ গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা নিয়েছিলো।

ভেলোরের বিদ্রোহ

 ভেলোরের বিদ্রোহে বেশকিছু ভারতীয় সিপাহী বেশ কয়েকজন ইংরেজকে মেরে ফেলেছিলো। এই ঘটনা ভারতে খ্রিষ্টান মিশনারি ও ইংরেজ আধিকারিকদের মনে প্রবল আতঙ্ক সৃষ্টি করেছিলো। তারা অনেকেই এই বিদ্রোহকে ভারতীয়দের নৈতিক ও সাংস্কৃতিক অবক্ষয়ের দৃষ্টান্ত হিসাবে দেখেন। 

এই বিদ্রোহের প্রেক্ষিতে ভারতীয়দের নৈতিক ও সাংস্কৃতিক পুনঃজাগরনের জন্য খ্রিষ্টান মিশনারিদের অনেকে এবং বেশ কিছু ইংরেজ বুদ্ধিজীবী ভারতে পাশ্চাত্যবাদ প্রয়োগের কথা বলেন। এই সমস্ত ইংরেজ বুদ্ধিজীবীদের মধ্যে চার্লস গ্রান্ট এবং উইলিয়াম উইলবারফোর্স অন্যতম ছিলেন।

খ্রিষ্টান মিশনারিদের উদ্যোগ


কিন্তু মাথায় রাখতে হবে, ভারতে পাশ্চাত্যবাদের সবথেকে বড়ো সমর্থক ছিলেন খ্রিষ্টান মিশনারিরা। বহুদিন থেকেই তারা ভারতীয়দের অন্ধবিশ্বাস ও নানা কুসংস্কারের দিক গুলিকে নিয়ে প্রচার করে আসছিলেন। এর পাশাপাশি তারা ভারতে খ্রিষ্টধর্মের প্রচারের কাজটিও করছিলেন। 

মিশনারিরা চেয়েছিলেন, ভারতে যদি পাশ্চাত্যবাদের সূচনা হয়, তাহলে পাশ্চাত্যের ভাষা, সংস্কৃতি, ঐতিহ্য, শিক্ষার সংস্পর্শে এসে ভারতীয়রা তাদের সনাতন ধর্ম, সংস্কৃতি এবং ঐতিহ্যের অসাড়তার দিক গুলি বুঝতে পারবে। এই উপলব্ধি থেকে তারা পাশ্চাত্যবাদে আকৃষ্ট হবে, এবং তার দিকে ঝুঁকে পড়বে। পাশ্চাত্য জীবনধারা ও দর্শন গ্রহন করবার ফলে ভারতে খ্রিষ্টান ধর্মের প্রচারের কাজটিও অনেক সহজ হয়ে যাবে। 

খুব স্বাভাবিক ভাবেই ভেলোরের বিদ্রোহের সূত্র ধরে ১৮০৬ খ্রিঃ পর ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির ভিতরে এবং ইংল্যান্ডের অভ্যন্তরে প্রাচ্যবাদের পাল্টা পাশ্চাত্যবাদী নামে একটি গোষ্ঠী তৈরি হলো। 

ইংল্যান্ডের অভ্যন্তরে "প্রাচ্য - পাশ্চাত্য" বিতর্ক 

এখন ভারতের শাসনব্যবস্থার ক্ষেত্রে প্রাচ্যবাদের অনুসরন করা হবে, নাকি পাশ্চাত্যবাদের অনুসরন করা হবে, এই নিয়ে ইংল্যান্ডের অভ্যন্তরে একটি বিতর্ক চলে। এটি প্রাচ্যবাদী ও পাশ্চাত্যবাদী বিতর্ক নামে পরিচিত। 

কিছুদিনের মধ্যেই দেখা গেলো, ভারতে পাশ্চাত্যবাদের প্রবক্তারা অল্প সময়ের মধ্যেই ইংল্যান্ডে শক্তিশালী হয়ে পড়তে আরম্ভ করলেন। এর প্রমান পার্লামেন্টের একটি ঘটনায় পাওয়া যায়। ভারতে পাশ্চাত্য শিক্ষা এবং মিশনারি কাজকর্ম চালানোর জন্য ব্রিটিশ পার্লামেন্টের সদস্য চার্লস উইলবারফোর্সের উদ্যোগে ব্রিটিশ পার্লামেন্টে এইময় ৮৫০ টি আবেদন জমা পড়ে। অর্থাৎ খ্রিষ্টধর্মের প্রচার এবং পাশ্চাত্যবাদ প্রবর্তনের জন্য ইংল্যান্ডের অভ্যন্তরে পাল্টা একটি চাপ সৃষ্টি হয়। 

ইতিমধ্যেই ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির ভারতে ব্যবসার সনদের মেয়াদ শেষ হয়ে আসে। ইংল্যান্ড এক একটি সনদ বা চার্টার আইনের মধ্য দিয়ে ভারতে কোম্পানির বানিজ্যের মেয়াদ ২০ বছর করে বৃদ্ধি করছিলো। ১৭৯৩ খ্রিঃ সনদ আইনের মেয়াদ ফুরিয়ে গেলে, বানিজ্যের নবীকরনের জন্য আরেকটি সনদ আইনের প্রয়োজন পড়লো। 

১৮১৩ খ্রিঃ সনদ আইন 


এরফলে ভারতে কোম্পানির বানিজ্যিক অধিকারের মেয়াদ নবীকরনের জন্য ইংল্যান্ডে ১৮১৩ খ্রিঃ একটি সনদ আইন নিয়ে আসা হয়। এই আইনে ভারতে কোম্পানির একচেটিয়া বানিজ্যের অধিকার আরও ২০ বছরের জন্য বাড়িয়ে দেওয়া হয়। এর পাশাপাশি এই আইনে আরও দুটি গুরুত্বপূর্ণ কথা বলা হয় - 

(১.) এই আইনের ১৩ নং ধারায় বলা হয়, ভারতে শিক্ষা ও উন্নয়নের জন্য যে কেউ ভারতে আসতে পারবে। এবং 
(২.) ৪৩ নং ধারায় বলা সাহিত্য ও বিজ্ঞান শিক্ষার জন্য ভারতে কোম্পানি প্রতি বছর একলক্ষ টাকা খরচ করবে। 

প্রাচ্য - পাশ্চাত্য বিতর্ক 

এখন ১৮১৩ খ্রিঃ চার্টার আইনে শিক্ষা খাতে যে এক লক্ষ টাকা ব্যায় করার কথা বলা হলো, সেই টাকাটা কোন শিক্ষা খাতে ব্যায় করা হবে, প্রাচ্য নাকি পাশ্চাত্য, এই নিয়ে পূর্বে বিবাদমান দুই গোষ্ঠীর মধ্যে (প্রাচ্যবাদী ও পাশ্চাত্যবাদী) বিতর্ক বেঁধে গেলো। এই বিতর্কটিই "প্রাচ্যশিক্ষা বনাম পাশ্চাত্য শিক্ষা বিষয়ক দ্বন্দ্ব" নামে পরিচিত ।

বিতর্কের প্রকৃতি

এখানে দুটি গোষ্ঠী যে কাজটি করেছিলো তা হল - 
(১.) যারা প্রাচ্যবাদের সমর্থক ছিলেন, তারা প্রাচ্যের ভাষা, সংস্কৃতি, সাহিত্য এবং ঐতিহ্যের চর্চা করা কেন প্রয়োজন, তার যৌক্তিকতার দিকটি তুলে ধরেছিলেন। 

এইসব প্রাচ্যবাদী ইওরোপীয় প্রবক্তাদের মধ্যে ছিলেন, এইচ টি প্রিন্সেপ, কোলব্রুক, উইলসন প্রমুখ পন্ডিত। এই বিতর্কে এদের পাশে এসে দাড়িয়েছিলেন, রাধাকান্ত দেব, মৃত্যুঞ্জয় বিদ্যালঙ্কার, রামকমল সেনের মতো ভারতীয় রক্ষনশীল ব্যক্তিরা। 

(২.) অপরদিকে যারা পাশ্চাত্যবাদের সমর্থক ছিলেন,তারা ভারতে প্রাচ্য শিক্ষার অসাড়তার দিকগুলিকে তুলে ধরে সমকালীন প্রেক্ষাপটে পাশ্চাত্য শিক্ষার উপযোগীতার দিকটি তুলে ধরেছিলেন।

পাশ্চাত্যবাদী পন্ডিতদের মধ্যে ছিলেন - সন্ডার্স, কলভিল, আলেকজান্ডার ডাফ, মেকলে প্রমুখ। এদের পাশে এসে দাড়িয়েছিলেন রাজা রামমোহন রায় এবং ইয়ং বেঙ্গল দলের অনেক সদস্য। 

অর্থাৎ "প্রাচ্য - পাশ্চাত্যবাদী" পুরো বিতর্কটি একটি বৌদ্ধিক আলোচনার পর্বেই সীমাবদ্ধ ছিলো। 

GCPI  গঠন ও বিতর্ক অবসানের উদ্যোগ


প্রাচ্য শিক্ষা ও পাশ্চাত্য শিক্ষা বিতর্কটি দীর্ঘদিন ধরেই চলেছিলো। শেষপর্যন্ত এই বিতর্কের অবসানের জন্য লর্ড আমহাস্টের উদ্যোগে ১৮২৩ খ্রিঃ ১০ জন সদস্যকে নিয়ে" "General committee of public Instruction" বা জনশিক্ষা কমিটি গঠন করা হয়। এই কমিটির হাতেই ১ লক্ষ টাকা ব্যয়ের দায়িত্ব দেওয়া হয়। 

কিন্তু GCPI এর ১০ জন সদস্যদের মধ্যে অধিকাংশই ছিলেন প্রাচ্যবিশারদ। যাদের মধ্যে অন্যতম ছিলেন - উইলসন, প্রিন্সেপ প্রমুখ। ফলে GCPI প্রথমদিকে প্রাচ্য শিক্ষা খাতেই অর্থ বরাদ্দ করতে থাকে। ১৮২৩ খ্রিঃ পর কলকাতা মাদ্রাসা, সংস্কৃত কলেজ এবং নবদ্বীপের টোলগুলির জন্য অর্থ বরাদ্দ করা হতে থাকে। 

অবস্থার পরিবর্তন এবং দ্বন্দ্বের চূড়ান্ত রূপ


জনশিক্ষা কমিটি প্রাচ্য শিক্ষায় অর্থ ব্যয় করায় পাশ্চাত্যবাদীরা যথেষ্ট ক্ষুব্ধ এবং অসন্তুষ্ট ছিলেন। কিন্তু কিছুদিনের মধ্যেই অবস্থা আরও ঘোরালো হয়ে উঠলো, যখন অল্প কিছু দিনের মধ্যে জনশিক্ষা কমিটিতে দুই গোষ্ঠীর সদস্য সংখ্যা প্রায় সমান হয়ে পড়লো। এর ফলে শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে অর্থ বরাদ্দের প্রশ্নে জনশিক্ষা কমিটির দুই গোষ্ঠীর মধ্যে বিতর্কটি ১৮৩৪ খ্রিঃ পর্যন্ত চলতে থাকে। এই সময় নানা দ্বন্দ্ব ও বিতর্কের জন্য কোন শিক্ষা কার্যক্রম বাস্তবায়িত হতে পারে নি। শেষপর্যন্ত প্রাচ্য - পাশ্চাত্য বিতর্ক নিরসনের জন্য জনশিিক্ষা কমিটির দুই গোষ্ঠীই পৃথক পৃথক ভাবে সরকারের কাছে আবেদন পেশ করে। 

লর্ড উইলিয়াম বেন্টিঙ্কের উদ্যোগ


১৮২৮ খ্রিঃ লর্ড উইলিয়াম বেন্টিঙ্ক ভারতের গভর্নর জেনারেল হয়ে আসেন। তিনি ভারতে আসার অল্প কিছুদিনের মধ্যেই জনশিক্ষা কমিটির অচলাবস্থা এবং বিতর্কের চূড়ান্ত  একটা নিষ্পত্তি করতে উদ্যোগী হন।

 এই প্রেক্ষাপটেই তিনি তার আইন সচিব টমাস ব্যবিংটন মেকলে কে জনশিক্ষা কমিটির সভাপতি নিযুক্ত করেন। বেন্টিঙ্ক তাকে প্রাচ্যশিক্ষা ও পাশ্চাত্য শিক্ষার বিতর্কের অবসান করতে বলেন। কারন যতদিন এই বিতর্ক চলবে, সরকারি নীতি নির্ধারণ করা কঠিন হয়ে পড়বে। 

মেকলে মিনিট 


মেকলে ছিলেন ঘোর পাশ্চাত্যবাদী। তিনি ১৮৩৫ খ্রিঃ তার বিখ্যাত "মেকলে মিনিট" এর মধ্য দিয়ে ভারতে ইংরেজি ভাষা এবং পাশ্চাত্য শিক্ষার উপযোগীতার বিষয়টি তুলে ধরেন। কেন সরকারের পাশ্চাত্য শিক্ষায় অর্থ বরাদ্দ করা প্রয়োজন, তার স্বপক্ষে জোরালো যুক্ত প্রমান তুলে ধরেন। 

কোনরকম দ্বিধা দ্বন্দ্ব ছাড়াই মেকলে ১৮১৩ খ্রিঃ সনদ আইনে বরাদ্দকৃত অর্থের পুরোটাই পাশ্চাত্য শিক্ষায় ব্যায় করার স্বপক্ষে তার মত ও যুক্তি তুলে ধরলেন। এর দ্বারা প্রভাবিত হয়ে বেন্টিঙ্ক মেকলের প্রতিবেদনকে সরকারি নীতি হিসাবে গ্রহন করে, পাশ্চাত্য শিক্ষায় সরকারি অর্থ ব্যয়ের ঘোষনা করেন। 

অকল্যান্ড মিনিট 


মেকলে এবং বেন্টিঙ্কের ঘোষনায় প্রাচ্যবাদী দের অনেকেই অসন্তুষ্ট ছিলেন। বেন্টিঙ্কের পরবর্তীকালে ভারতে গভর্নর জেনারেল হয়ে আসেন অকল্যান্ড( বেন্টিঙ্কের পরে চার্লস মেটকাফ ১৮৩৫-৩৬, অল্প কিছুদিনের জন্য গভর্নর জেনারেল ছিলেন)। ১৮৩৯ খ্রিঃ তিনি একটি মিনিটের মধ্য দিয়ে পাশ্চাত্য শিক্ষায় অর্থ বরাদ্দের পাশাপাশি প্রাচ্য শিক্ষাতেও অর্থ বরাদ্দের কথা ঘোষণা করেন। এই ঘোষনার ফলে প্রাচ্যবাদীরা অনেকটাই নিশ্চিন্ত হন। এবং এই প্রস্তাবের ফলে ভারতের প্রাচ্য শিক্ষা পাশ্চাত্য শিক্ষা সংক্রান্ত দীর্ঘ বিতর্কের চূড়ান্ত সমাপ্তি ঘটে। 

"প্রাচ্য - পাশ্চাত্য শিক্ষা" বিতর্কের ঐতিহাসিক গুরুত্ব 


ভারতের ইতিহাসে "প্রাচ্য- পাশ্চাত্য শিক্ষা" বিতর্কের প্রধান ঐতিহাসিক গুরুত্বের দিকগুলি ছিলো - 
  • এই  দ্বন্দ্বের ফলে শিক্ষা প্রতিষ্ঠান গুলিতে অর্থ বরাদ্দের ক্ষেত্রে সাময়িক একটি জটিলতা দেখা যায়, 
  • এই বিতর্কের শেষে দেখা যায়,প্রাচ্যবাদী ধারনার পরাজয় ঘটে, 
  • এই পরাজয় থেকে প্রাচ্য শিক্ষার অসাড়তার দিকটি দেশবাসী বুঝতে পারে। 
  • ভারতে শিক্ষা বিস্তার সম্পর্কে প্রাচ্য - পাশ্চাত্য ভাবধারা নিয়ে যাবতীয় সংশয়ের অবসান ঘটে, 
  •  বিতর্কের শেষে পাশ্চাত্য শিক্ষার বিস্তারকে সরকারী নীতি হিসাবে ঘোষনা করায় ভারতে আধুনিক শিক্ষার বুনিয়াদ গড়ে উঠে, 
  • সর্বোপরি, এই বৌদ্ধিক বিতর্ক থেকে ভারতবাসী পাশ্চাত্য শিক্ষার উপযোগীতার দিকটি উপলব্ধি করতে পারেন। 

 

Post a Comment (0)
Previous Post Next Post