ছাপা বইয়ের সঙ্গে শিক্ষা বিস্তারের সম্পর্ক

ছাপাখানা বিস্তারের সবচেয়ে বড়ো এবং দীর্ঘমেয়াদী ফল ছিলো শিক্ষার বিস্তার। ছাপাখানা, ছাপা বই এবং শিক্ষা বিস্তারের মধ্যে একটি একটি নিবিড় সম্পর্ক ছিলো। 

শিক্ষা ব্যবস্থায় ছাপা বইয়ের প্রভাব

সহজ কথায়,সহজ ভাষায় বলতে গেলে ছাপাখানা দিয়েছিলো বই। আর বই প্রসার ঘটিয়েছিলো শিক্ষার। ছাপাখানার মুদ্রিত বই ভারতের শিক্ষা ব্যবস্থার প্রচলিত ধাঁচটাই পাল্টে দিয়েছিলো। যেমন - 

  1. ছাপাখানা প্রতিষ্ঠার পূর্বে শিক্ষাদান ব্যবস্থা মূলত উচ্চবিত্তদের মধ্যেই সীমাবদ্ধ ছিলো। কিন্তু ছাপাখানা প্রতিষ্ঠার পর সস্তায় বই পাওয়া সম্ভব হয়। ফলে শিক্ষা অতি সহজেই সাধারন মানুষের মধ্যে ছড়িয়ে পড়ে। 
  2. ছাপাখানার মুদ্রিত বই এসে যাওয়ার ফলে জ্ঞান ব্যক্তিগত মেধার কবলমুক্ত হয়। অর্থাৎ পূর্বে শিক্ষা গ্রহণের ক্ষেত্রে শিক্ষার্থীদের শিক্ষকদের মুখাপেক্ষী হয়ে থাকতে হতো। জ্ঞান বা নলেজ একচেটিয়া ভাবে শিক্ষকদের বা গুরুদের নিয়ন্ত্রনে ছিলো। এখন বইয়ের মধ্য দিয়ে সহজেই তা ছড়িয়ে পড়ে। ফলে শিক্ষার প্রসারের কাজটি অনেক সহজ হয়ে যায়। 
  3. মুদ্রিত বইয়ের ফলে হাতে লেখা পুঁথির দিন শেষ হয়ে যায়। ছাপা বই হাতে লেখা পুঁথির নানা ভুল ভ্রান্তি থেকে অনেকটাই মুক্ত ছিলো। সবচেয়ে বড়ো কথা, ছাপা বই শুধু ছাপা অক্ষরের সমাহার ছিলো না। ছাপা বইয়ে মুদ্রিত নানা চিত্র, মানচিত্র, নকশা ইত্যাদি বিষয় গুলি শিক্ষার্থীদের কাছে শিক্ষাকে আরো সহজ, আকর্ষনীয়আনন্দদায়ক করে তুলেছিলো। 
  4. ছাপা বই সহজলভ্য হওয়ায় সহজেই তা আগ্রহী পাঠক কিনতে পারতেন, পড়তে পারতেন এবং জানতে পারতেন। ফলে বই শুধু "প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষার" প্রসার ঘটায় নি, তা গনশিক্ষা ও জনশিক্ষারও প্রসার ঘটিয়েছিলো। এ প্রসঙ্গে বলে রাখা ভালো, ছাপাখানা থেকে যে অসংখ্য সংবাদপত্র ও সাময়িকপত্র ছেপে বের হতো, সেগুলি বইয়ের মতোই জনশিক্ষার প্রসার ঘটিয়েছিলো। 
  5. ছাপাখানায় মুদ্রিত বইয়ের সংখ্যা ক্রমশ বৃদ্ধি পেলে অনেক গ্রন্থাগার গড়ে ওঠে। এই গ্রন্থাগার জ্ঞান বা নলেজের ক্ষেত্রটিকে যেমন ত্বরান্বিত করেছিলো, তেমনই গবেষনার কাজকেও প্রভাবিত করেছিলো। এছাড়া গ্রন্থাগার গুলি সাধারন মানুষের মধ্যে গন শিক্ষার প্রসারেও সাহায্য করেছিলো। ১৮০০ খ্রিঃ ফোর্ট উইলিয়াম কলেজ প্রতিষ্ঠিত হওয়ার অল্প কিছু কালের মধ্যেই সেখানে একটি গ্রন্থাগার গড়ে উঠেছিলো। 
এইভাবে দেখা যায়, ছাপাখানার "মুদ্রিত বই" ভারতের প্রচলিত শিক্ষা ব্যবস্থার ধাঁচ ও ধরনে এক বৈপ্লবিক পরিবর্তন ঘটায়। 


ছাপা বইয়ের সঙ্গে শিক্ষা বিস্তারের সম্পর্ক
ছাপা বইয়ের সঙ্গে শিক্ষা বিস্তারের সম্পর্ক


ছাপাখানা,ছাপা বই ও শিক্ষার মধ্যে সম্পর্ক 

এখানে একটি কথা মাথায় রাখতে হবে, উনিশ শতকে ভারতে শিক্ষার বিস্তার কিন্তু পুঁথির মাধ্যমে ঘটে নি। ঘটেছিলো ছাপা বইকে আশ্রয় করে। সুতরাং ছাপাখানা, ছাপা বই আর শিক্ষার মধ্যে যে এক গভীর সম্পর্ক ছিলো, তা নির্ধিদায় বলা যায়। 

ছাপাখানার আদি পর্বের বই ও শিক্ষা লাভের তাগিদ

এখানে এটিও মনে রাখতে হবে, কোম্পানির কর্মচারীদের বাংলা ভাষা শিক্ষার তাগিদটি পূরন করতে গিয়ে, হ্যালহেডের ব্যাকরন গ্রন্থটি ছাপবার মধ্য দিয়েই বাংলা মুদ্রনের প্রথম আত্মপ্রকাশ ঘটেছিলো। বাংলা ছাপাখানার আদিপর্বে বিভিন্ন আইনের অনুবাদ, ব্যাকরন,অভিধান, শব্দকোষের বই ছাপা হয়েছিলো। মুদ্রনের প্রথম পর্বের এই সমস্ত বই প্রশাসনিক প্রয়োজনের তাগিদে ছাপা হলেও, এর পিছনে শিক্ষা লাভের একটি বড়ো উদ্দেশ্য ও তাগিদ যে ছিলো, তাকে কোনভাবেই অস্বীকার করা যায় না। 

শিক্ষার প্রসারে মিশন প্রেসের বই

১৮০০ খ্রিঃ বাংলায় একদিকে যেমন গড়ে উঠলো শ্রীরামপুর মিশন। অন্যদিকে এই বছরটিতেই গড়ে উঠে ফোর্ট উইলিয়াম কলেজ। আমরা সবাই জানি, ভারতে আগত ইংরেজ সিভিলিয়ানদের ভারতীয় ভাষা, বিশেষত বাংলা ভাষা ও সংস্কৃতি শিক্ষার উদ্দেশ্যেই এই কলেজটি তৈরি হয়েছিলো। কিন্তু কলেজ তৈরি হবার পর শিক্ষা দানের জন্য পাঠ্যপুস্তকের দরকার পড়লো। এই অবস্থায় ফোর্ট উইলিয়াম কলেজের বাংলার অধ্যাপক উইলিয়াম কেরি শ্রীরামপুর মিশন প্রেস থেকে বই ছেপে কলেজকে সরবরাহ করেন। এই সমস্ত বই গুলির মধ্যে অন্যতম ছিল - 
  • রাজা প্রতাপাদিত্য চরিত্র, 
  • লিপিমালা, 
  • কেরির কথোপকথন, 
  • ইতিহাসমালা, 
  • গোলকনাথ শর্মার হিতোপদেশ, 
  • মৃত্যুঞ্জয় বিদ্যালঙ্কারের বত্রিশ সিংহাসন, 
  • রাজাবলি ইত্যাদি। 
মিশন প্রেস ছাপা এই সমস্ত বইয়ের অধিকাংশ লেখক, যেমন - মৃত্যুঞ্জয় বিদ্যালঙ্কার, রামরাম বসু, চনন্ডীচরন মুন্সি, হরপ্রসাদ রায় প্রমুখ ঐ কলেজেরই অধ্যাপক ছিলেন। অল্প কিছুকাল পরে ফোর্ট উইলিয়াম কলেজের ভিতর একটি গ্রন্থাগারও গড়ে উঠেছিলো। 

মিশন প্রেসের ছাপা বই একদিকে যেমন ফোর্ট উইলিয়াম কলেজের শিক্ষাদানে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেছিলো, তেমনই মিশনের নিজের উদ্যোগে প্রতিষ্ঠিত স্কুল গুলির শিক্ষাদানের ক্ষেত্রেও গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা নিয়েছিলো। 

স্কুল শিক্ষার প্রসার ও ছাপা বইয়ের চাহিদা

ফোর্ট উইলিয়াম কলেজ প্রতিষ্ঠিত হওয়ার অল্প কিছু দিনের মধ্যেই ভারতে ইংরেজি ও বাংলা ভাষা শিক্ষার প্রয়োজনীয়তা লক্ষ্য করা গেলো। প্রশাসনিক তাগিদে যেমন বাংলা জানার প্রয়োজন পড়লো, তেমনই কোম্পানির ক্ষমতা লাভের সূত্রে এদেশে যে অফিস আদালত গড়ে উঠতে আরম্ভ করেছিলো, সেখানে ইংরেজি জানা লোকের প্রয়োজন পড়লো। ফলে স্বাভাবিক ভাবেই নতুন পেশার প্রয়োজনে ইংরেজি জানার ও শেখার তাগিদটি দেখা যেতে লাগলো। 

এই তাগিদ গুলো থেকেই উনিশ শতকের প্রথম দিকে একের পর এক স্কুল গড়ে উঠতে আরম্ভ করেছিলো। ঐ সমস্ত স্কুল গুলিতে শিক্ষা দানের ক্ষেত্রে ছাপা বই এক বিরাট গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা নিয়েছিলো।

বলে রাখা ভালো, ইতিপূর্বে আমাদের দেশে যে অসংখ্য পাঠশালা গুলি ছিলো, সেখানে শিক্ষাব্যবস্থা ছিলো পুঁথি নির্ভর। পুঁথি হাতে লেখা হতো, এবং তা থাকতো গুরুমশাইয়ের কাছে। ছাত্ররা মুখস্ত করেই সেসব মনে রাখতো। তাদের কাছে কোন পুঁথি থাকতো না। অর্থাৎ শিক্ষা ব্যবস্থার ধরনটা ছিলো গুরুমুখী এবং স্মৃতিনির্ভর। 

কিন্তু উনিশ শতকে ছাপা বইকে ব্যবহার করেই ভারতে আধুনিক শিক্ষার বিস্তার ঘটে। 

পাঠ্যপুস্তকের যুগ 

শ্রীরামপুর মিশনের উদ্যোগে বেশ কিছু স্কুল খোলা হয়েছিলো, যেখানেই প্রথম ছাপানো বইয়ের সাহায্যে পড়াশোনা শুরু হয়। তবে প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষার ক্ষেত্রে ভারতে পাঠ্যপুস্তকের যুগ শুরু হয় ১৮১৭ খ্রিঃ। 

১৮১৭ খ্রিঃ কলকাতায় প্রতিষ্ঠিত হয় হিন্দু কলেজ। আবার এই বছরটিতেই ডেভিড হেয়ারের উদ্যোগে প্রতিষ্ঠিত হয় ক্যালকাটা স্কুল বুক সোসাইটি। যার অন্যতম উদ্দেশ্য ছিলো কলকাতা ও কলকাতা সংলগ্ন স্কুল গুলির শিক্ষার জন্য পাঠ্যপুস্তক রচনা ও বিপনন করা। এর একবছর পরে স্কুল তৈরির জন্য ১৮১৮ খ্রিঃ হেয়ারের উদ্যোগেই গড়ে ওঠে কলকাতা স্কুল সোসাইটি। 

 স্কুল সোসাইটির উদ্যোগে এই সময় অনেক নতুন নতুন বিদ্যালয় গড়ে উঠেছিলো। ঐ সমস্ত স্কুল গুলিতে পড়ানোর ক্ষেত্রে স্কুল বুক সোসাইটির ছাপা বই গুলি গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা নিয়েছিলো। স্কুল বুক সোসাইটি ১৮১৭ - ১৮২৫ খ্রিঃ মধ্যে এক লক্ষের বেশি বই বিক্রি অথবা বিলি করেছিলো কলকাতা ও মফস্বলের স্কুল গুলিতে। শুধু অ্যাংলো - বেঙ্গলি স্কুল গুলি নয়, দেশীয় বাংলা পাঠশালা গুলিও তখন ছিলো স্কুল বুক সোসাইটির ছাপা বইয়ের দখলে।

"সংস্কৃত প্রেসের" বই ও শিশু শিক্ষা 


১৮৩৪ - ৩৫ খ্রিঃ নানা কারনে স্কুল বুক সোসাইটির প্রকাশনা বন্ধ হয়ে গেলে সেই শূন্যস্থান পূরন করতে এগিয়ে আসে সংস্কৃত প্রেস

উনিশ শতকের পাঁচের দশকে স্কুল বুক সোসাইটির চেয়ে বেশি নামডাক ছিলো সংস্কৃত প্রেসেরসংস্কৃত প্রেস গড়ে উঠেছিলো বিদ্যাসাগরের উদ্যোগে। এখান থেকে শিশু পাঠের উপযোগী বেশ কিছু পাঠ্যপুস্তক ছেপে বের হয়েছিলো।যার মধ্যে অন্যতম ছিলো -
  • মদনমোহন তর্কালঙ্কারের শিশুশিক্ষা,
  • বিদ্যাসাগরের বর্নপরিচয়, 
  • কথামালা,
  • শকুন্তলা, 
  • বেতাল পঞ্চবিংশতি ইত্যাদি।
সংস্কৃত প্রেসে ছাপা বিদ্যাসাগরের লেখা বই গুলি উনিশ শতকে শিশু শিক্ষার প্রসারে এক যুগান্তকারী পরিবর্তন নিয়ে এসেছিলো। বিদ্যাসাগরই প্রথম সফলভাবে শিশু শিক্ষার বই লিখতে পেরেছিলেন। তার ছাপা এই বই গুলিকে অবলম্বন করেই উনিশ শতকে প্রাথমিক শিক্ষার বিস্তার ঘটেছিলো।

ছাপা বই ও ইংরেজি শিক্ষা 

১৮৩৫ খ্রিঃ মেকলে মিনিটের প্রতিবেদন, ১৮৪৪ খ্রিঃ ইংরেজি ভাষাকে সরকারি ভাষা হিসাবে স্বীকৃতি প্রদান, ইত্যাদির ফলে ইংরেজি ভাষা শিক্ষার প্রয়োজনীয়তা কয়েক কদম বেড়ে যায়। এইজন্য অবশ্য প্রয়োজনীয় ছিলো বই।

ছাপাখানায় ছাপা বইয়ের সাহায্যেই যে এইসময় ইংরেজি শিক্ষার প্রসারের বৃত্তটি সম্পূর্ণ হয়েছিলো ,তা নির্ধিদায় বলা যায়।

ছাপা বই ও বিজ্ঞান শিক্ষা 

শুধু ইংরেজি শিক্ষা নয়,পরবর্তীকালে প্রথাগত শিক্ষার বিকল্প চিন্তা ভাবনা থেকে কারিগরি ও বিজ্ঞান শিক্ষার প্রসার ঘটেছিলো। কারিগরি ও বিজ্ঞান শিক্ষার প্রসারের ক্ষেত্রেও ছাপা বই একটি গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা নিয়েছিলো। ছাপা বইয়ের নানা চিত্র, অঙ্কন, ইত্যাদি দিক গুলি কারিগরি ও বিজ্ঞান শিক্ষাকে অনেক বেশি সহজ ও বোধগম্য করে তুলেছিলো। 

এইভাবেই দেখা যায়, ছাপাখানার ছাপা বই শিক্ষার প্রসারের ক্ষেত্রে এক যুগান্তকারী বিপ্লব ঘটিয়ে দিয়েছিলো।

Post a Comment (0)
Previous Post Next Post