ইতিহাস চর্চায় Memories বা স্মৃতিকথা

আধুনিক ইতিহাস চর্চার মৌখিক উপাদানের একটি অন্যতম ভাগ হল স্মৃতিকথা বা Memories

ইতিহাস চর্চায় Memories বা স্মৃতিকথা
ইতিহাস চর্চায় স্মৃতিকথা 


স্মৃতিকথার সংজ্ঞা

স্মৃতিকথা হলো এমন একধরনের সাহিত্য, যেখানে লেখক তার জীবনে ঘটে যাওয়া বা জীবনে প্রত্যক্ষ করা বিভিন্ন ঘটনার বিবরন স্মৃতি থেকে এনে তুলে ধরেন।

অর্থাৎ স্মৃতিকথা হল একধরনের অতীতের স্মৃতিচারণ

স্মৃতিকথার উদ্ভব বা রচনা কাল

স্মৃতিকথা গুলি মিথ, কিংবদন্তি বা লোককথার মতো প্রাচীন নয়। এগুলি ঐতিহাসিক যুগে রচিত একধরনের লিখিত সাহিত্য। সাধারনত কোন পর্যটক, দার্শনিক, সাহিত্যিক, রাজনীতিবিদ এর মতো পন্ডিত ও বিদগ্ধ ব্যক্তিরা তাদের ব্যক্তিগত অভিজ্ঞতার কথা স্মৃতিকথায় লিপিবদ্ধ করেন।

স্মৃতিকথার উদাহরন

কয়েকটি উল্লেখযোগ্য স্মৃতিকথার উদাহরন হল -

  • চৈনিক পর্যটক হিউয়েন সাঙের স্মৃতিকথা - "সি ইউ কি" 
  • ফা হিয়েনের স্মৃতিকথা - "ফো কুয়ো কি", 
  • সুদীপ বন্দ্যোপাধ্যায়ের স্মৃতিকথা - দেশভাগ - স্মৃতি আর সত্তা", 
  • মান্না দের স্মৃতিকথা -" জীবনের জলসাঘরে", 
  • নারায়ন সান্যালের -" আমি নেতাজীকে দেখেছি", 
  • আশালতা সরকারের -" আমি সূর্য সেনের শিষ্যা", 
  • সুফিয়া কামালের - "একাত্তরের ডাইরি"

স্মৃতিকথার বৈশিষ্ট্য

স্মৃতিকথার উল্লেখযোগ্য বৈশিষ্ট্য গুলি হল -
  1. স্মৃতিকথা হল ইতিহাসের একটি মৌখিক উপাদান
  2. স্মৃতিকথা মৌখিক উপাদান হলেও, তা লিখিত আকারে থাকে। 
  3. স্মৃতিকথা কোন মনগড়া কল্পকাহিনী নয়। তার একটি বাস্তব ভিত্তি থাকে
  4. স্মৃতিকথা ব্যক্তির প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষ অভিজ্ঞতার ফসল। এখানে লেখক অতীতের কোন বিশেষ মুহুর্তের বা ঘটনার কথা স্মৃতি থেকে তুলে ধরেন।
  5. স্মৃতিকথায় কোন বিশেষ অনুভূতিপ্রবন ঘটনার উল্লেখ থাকে। 
  6. স্মৃতিকথা ঐতিহাসিক যুগের রচনা ও উপাদান।
  7. স্মৃতিকথায় লেখকের সারা জীবনের অভিজ্ঞতার কথা থাকে না। থাকে জীবনে ঘটে যাওয়া বিশেষ কোন ঘটনার স্মৃতিচারণ। 
  8. স্মৃতিকথায় লেখক নিজস্ব দৃষ্টিভঙ্গি থেকে ঘটনার বিশ্লেষন করে থাকেন।
  9. স্মৃতিকথার প্রধান ভিত্তি হল ব্যক্তির ব্যক্তিগত বা নিজস্ব অভিজ্ঞতা। 
  10. স্মৃতিকথা উপস্থাপনা করা হয় উত্তম পুরুষে। অর্থাৎ বক্তা বা লেখক নিজে কাহিনীর কথক হয়ে স্মৃতিকথার কাহিনীকে এগিয়ে নিয়ে যান।

স্মৃতিকথার গুরুত্ব 

ইতিহাস রচনার উপাদান হিসাবে স্মৃতিকথার গুরুত্ব অপরিসীম-

(১.) গুনিজনদের বিবরন 

স্মৃতিকথা সাধারনত গুনি ও বিদগ্ধ পন্ডিত ব্যক্তিরাই লিখে থাকেন। ফলে এতে অবান্তর, পক্ষপাতমূলকঅতিরঞ্জন ঘটনার প্রবেশ অপেক্ষাকৃত কম থাকে। 


(২.)  প্রত্যক্ষ সাক্ষী 

স্মৃতিকথায় উল্লেখিত ঘটনার সঙ্গে লেখকের প্রত্যক্ষ অভিজ্ঞতা যুক্ত থাকে। ঘটনার তিনি প্রত্যক্ষদর্শী বলে তার দেওয়া বিবরনের ঐতিহাসিক সত্যতা ও নির্ভরযোগ্যতা অনেক বেশি। 

(৩.) স্থানীয় বা আঞ্চলিক ইতিহাস চর্চা

স্থানীয় বা আঞ্চলিক ইতিহাস চর্চার অনেকটাই স্মৃতিকথার ওপর নির্ভরশীল। উদাহরন হিসাবে বলা যায়, কেউ যদি তার শহরের বিবর্তনের ইতিহাস লিখতে চান, তাহলে অবশ্যই তাকে প্রবীন ব্যক্তিদের রেখে যাওয়া স্মৃতির দ্বারস্থ হতে হবে। 


(৪.) ইতিহাস রচনায় স্মৃতিকথার ভূূমিকা 

স্মৃতিকথা ইতিহাস চর্চায় যে কতখানি গুরুত্বপূর্ণ উপাদান হিসাবে ব্যবহৃত হয়, তার উদাহরন হিসাবে বলা যায় - 
  • প্রাচীন ভারতের ইতিহাস জানতে চৈনিক পর্যটক ফা হিয়েন ও হিউয়েন সাঙের স্মৃতিকথা যে কি বিরাট ভূমিকা পালন করে, তা একমাত্র ইতিহাস গবেষক মাত্রই বলতে পারেন। এই স্মৃতিকথা না থাকলে প্রাচীন ভারতের একটা বড়ো অংশের ইতিহাস আমাদের অজানাই থেকে যেতো। 
  • পঞ্চদশ ও ষোড়শ শতকে ইওরোপে ভৌগলিক আবিষ্কার ও নতুন দেশ আবিষ্কারের কথা, একমাত্র স্মৃতিকথা থেকেই জানতে পারা যায়। 
  • ভারতে দেশভাগের ইতিহাস, দাঙ্গার ইতিহাস, উদ্বাস্তু সমস্যার ইতিহাস, জার্মানিতে নাৎসি বাহিনীর অত্যাচারের ইতিহাস, সম্পূর্ণ ভাবেই স্মৃতিকথার ওপর নির্ভর করে গড়ে উঠেছে। 
  • বাংলাদেশে ভাষা আন্দোলন ও স্বাধীনতা যুদ্ধের ইতিহাস রচনার ক্ষেত্রেও স্মৃতিকথা গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা নিয়ে থাকে। 


কয়েকটি  উল্লেখযোগ্য স্মৃতিকথার সংক্ষিপ্ত পরিচয় :-


(১.)  জীবনের জলসাঘরে

লেখক - মান্না দে, 

বিষয়বস্তু - মুম্বাই ও কলকাতার সঙ্গীত জীবন সম্পর্কে জানা যায়। 


(২.) আমি নেতাজীকে দেখেছি

লেখক - নারায়ণ সান্যাল, 
বিষয়বস্তু - সুভাষ চন্দ্র বসুর জীবনী সম্পর্কে লেখা এই স্মৃতিকথা।

(৩.) আমি সূর্য সেনের শিষ্যা

লেখিকা - আশালতা সরকার, 
বিষয়বস্তু - সূর্য সেন ও বিপ্লবী আন্দোলন সম্পর্কে লেখা। 

(৪.) সেদিনের কথা 

লেখিকা - মনিকুন্তলা সেন, 
বিষয়বস্তু - ১৯৪৬ খ্রিঃ কলকাতার সাম্প্রদায়িক দাঙ্গা সম্পর্কে লেখা। 

(৫.) দেশভাগ - স্মৃতি আর সত্বা

লেখক - সুদীপ বন্দ্যোপাধ্যায়, 
বিষয়বস্তু - দেশভাগ সম্পর্কে লেখা। 


(৬.) একাত্তরের ডায়েরি 

লেখক - সুফিয়া কামাল, 
বিষয়বস্তু - বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধ সম্পর্কে লেখা। 


(৭.) ইন্ডিয়া উইন্স ফ্রিডম 

লেখক - মৌলানা আবুল কালাম আজাদ, 
বিষয়বস্তু - ভারতের স্বাধীনতা সংগ্রামে জাতীয় কংগ্রেসের ভূমিকা সম্পর্কে লেখা। 

(৮.) দ্যা স্টোরি অব মাই এক্সপেরিমেন্ট উইথ ট্রুথ

লেখক - মহাত্মা গান্ধী, 
বিষয়বস্তু - সত্যগ্রহ আদর্শ ও রাজনৈতিক জীবন সম্পর্কে লেখা। 


(৯.) যুক্ত বঙ্গের স্মৃতি 

লেখক - অন্নদাশঙ্কর রায়, 
বিষয়বস্তু - অবিভক্ত বাংলাদেশ সম্পর্কে লেখা। 

(১০.) উদ্বাস্তু 

লেখক - হিরন্ময় বন্দোপাধ্যায়, 
বিষয়বস্তু - দেশভাগের পর উদ্বাস্তু জীবন সম্পর্কে লেখা। 


(১১.) ছেড়ে আসা গ্রাম 

লেখক - দক্ষিনারঞ্জন বসু, 
বিষয়বস্তু - দেশ ভাগের ফলে পূর্ব বঙ্গ থেকে হিন্দুদের বিতাড়ন ও দেশভাগের যন্ত্রণা নিয়ে লেখা। 


(১২.) জীবনস্মৃতি 

লেখক - রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর, 
বিষয়বস্তু - রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের জীবনের প্রথম ২৫ বছর ও ঠাকুরবাড়ী সম্পর্কে লেখা। 

(১৩.) দেশভাগ - স্মৃতি ও স্তব্ধতা 

লেখক - সেমন্তী ঘোষ 
বিষয়বস্তু - দেশভাগ সম্পর্কে লেখা। 


(১৪.) আমার জীবন

লেখক - বুদ্ধদেব বসু
বিষয়বস্তু - পূর্ব বাংলার গ্রামীন জীবন সম্পর্কে লেখা। 


(১৫.) সি ইউ কি

লেখক - চৈনিক পর্যটক হিউয়েন সাঙের লেখা,
বিষয়বস্তু - প্রাচীন ভারতের বৌদ্ধধর্ম ও রাজনৈতিক, সামাজিক ব্যবস্থা সম্পর্কে লেখা। 

(১৬.) ফো কুয়ো কি

লেখক - চৈনিক পর্যটক ফা হিয়েনের লেখা,
বিষয়বস্তু - প্রাচীন ভারতের বৌদ্ধধর্ম ও রাজনৈতিক, সামাজিক ব্যবস্থা সম্পর্কে লেখা। 



 

Post a Comment (0)
Previous Post Next Post