ইতিহাস চর্চার অলিখিত মৌখিক উপাদানের একটি অন্যতম ভাগ হল Folktales বা লোককথা।
|
ইতিহাস চর্চায় লোককথা |
লোককথার সংজ্ঞা
লোককথা হলো এমন একধরনের কাল্পনিক গল্পকথা, যেগুলি প্রাচীন কাল থেকেই প্রজন্ম পরম্পরায় জনসমাজে প্রবাহিত হয়ে চলেছে এবং যেগুলি বর্তমানেও প্রচলিত আছে।
সহজ কথায় বলতে গেলে লোককথা হল অবাস্তব,আজগুবি এবং কাল্পনিক রূপকথার গল্প।
লোককথার উদ্ভব
লোককথার উদ্ভব কখন হয়েছিলো, সে সম্পর্কে নিশ্চিত ভাবে কিছু জানা না গেলেও, এ ব্যাপারে ঐতিহাসিক ও গবেষকরা অনুমান করে থাকেন মানব সভ্যতার আদি লগ্নেই লোককথা গুলি রচিত হয়েছিলো।
আদিম যাযাবর জীবন থেকে মানুষ যখন কৃষিকাজের জীবনে প্রবেশ করেছিল, তখন সে পেয়েছিলো অবসর।এই অবসর সময়কে কাজে লাগিয়ে মানুষ শিল্প, সাহিত্য ও সংস্কৃতির চর্চা শুরু করেছিলো। লোককথা গুলি এই পর্যায়েই শিশুদের বিনোদনের জন্য রচনা করা হয়েছিলো।
লোককথা গুলি দীর্ঘ দিন ধরে মানুষের মুখে মুখে প্রচারিত হলেও, উনিশ শতক থেকে ইওরোপের বিভিন্ন গবেষকরা লোককথা গুলিকে সংগ্রহ করে বইয়ের আকারে প্রকাশ করতে শুরু করেন। এই সমস্ত গবেষকদের মধ্যে অন্যতম ছিলেন, জার্মানির জেকব গ্রিম এবং উইলহেম গ্রিম।
আমাদের দেশে অবশ্য সাহিত্যের মধ্যেই অনেক আগে থেকেই লোককথা গুলিকে সংকলিত করা হয়েছিলো। মহাকবি কালিদাসের রচনায় অনেক রূপকথার উদাহরন পাওয়া যায়। পরবর্তীকালে বিষ্ণুশর্মা, নারায়ন পন্ডিত, দক্ষিণারঞ্জন মিত্র অনেক লোককথার গল্প সংগ্রহ করে তা বইয়ের আকারে প্রকাশ করেন।
লোককথার উদাহরণ
ভারতের কয়েকটি উল্লেখযোগ্য লোককথার উদাহরন হল -
- বিষ্ণু শর্মার "পঞ্চতন্ত্রের" নানা গল্প,
- নারায়ন পন্ডিতের "হিতোপদেশের" গল্প,
- দক্ষিণারঞ্জন মিত্র মজুমদারের "ঠাকুরমার ঝুলির" গল্প,
- বেহুলা লখিন্দরের গল্প,
ভারতের বাইরের কয়েকটি উল্লেখযোগ্য লোককথার উদাহরণ হল -
- আরব্য রজনীর নানাগল্প,
- টম থাম্ব ও দৈত্যের গল্প। (এই লোককথা টি ইওরোপে দীর্ঘদিন ধরে প্রচলিত ছিলো। টম থাম্বের গল্পের অনুকরনে অবনীন্দ্রনাথ ঠাকুর লিখেছিলেন "বুড়ো আংলা")
লোককথার বৈশিষ্ট্য
(১.) পৃথিবীর বিভিন্ন দেশের লোককথা গুলিকে প্রধানত ৩ টি ভাগে ভাগ করা হয়। যথা -
- (ক) পশুকথা - এখানে বিভিন্ন পশু পাাখি, জীব জন্তুর ওপর ব্য্যক্তিত্ব আরোপ করে গল্প রচনা করা হয়। যেমন নীল শেয়ালের গল্প। পঞ্চতন্ত্রের নানা গল্প ইত্যাদি।
- (খ) রূপকথা - এখানের গল্প গুলির মূল চরিত্র মানুষ। গল্প গুলি রূপকধর্মী। নানা অদ্ভুত, অলৌকিক, আজগুবি বিষয় এই গল্প গুলির মধ্যে থাকে। যেমন আলিবাবা ও চল্লিশ চোরের গল্প, ঠাকুরমার ঝুলির নানা গল্প, পক্ষীরাজ ঘোড়ার গল্প ইত্যাদি।
- পরীকথা - ইওরোপীয় দেশগুলির লোককথার মধ্যে পরীকথার গল্প দেখা যায়। একজন ডানাওয়ালা পরী কিভাবে সমস্ত বিপদ থেকে মানুষকে উদ্ধার করে, তাই নিয়েই মূলত এই গল্প গুলি হয়ে থাকে।
(২.) লোককথা গুলির সৃষ্টিকর্তা বা রচনাকারদের পরিচয় সম্পর্কে তেমন করে কিছু জানা যায় না।
(৩.) লোককথা গুলি প্রথমদিকে লিখিত আকারে ছিলো না এবং এগুলি মুখে মুখে প্রজন্ম পরম্পরায় প্রচারিত হয়েছিলো।অনেক পরে লোককথার গল্প গুলিকে লিপিবদ্ধ করা হয়।
(৪.) লোককথা গুলি সাধারনত শিশুদের বিনোদনের জন্যই রচনা করা হয়েছিলো।
(৫.) লোককথায় ধর্মীয় বিষয়ের তেমন গুরুত্ব বা উপস্থিতি লক্ষ্য করা যায় না।
(৬.) লোককথায় বিভিন্ন অতিপ্রাকৃতিক বিষয়, যেমন ভুত প্রেত, দৈত দানব, পক্ষীরাজ ঘোড়া, ডানা লাগানো পরী ইত্যাদি চরিত্রের উপস্থিতি লক্ষ্য করা যায়।
(৭.) সব লোককথার মধ্যেই একটি বিশেষ ঘটনার উল্লেখ থাকে, যা লোককথার আকর্ষনের কেন্দ্রীয় বিষয় হয়ে ওঠে।
(৮.) লোককথা গুলির মধ্যে অনেক আজগুবি বিষয় যেমন থাকে, তেমনি সেখানে বাস্তব চরিত্রও থাকে।
(৯.) লোককথার গল্প গুলিতে পশুপাখি ও কীটপতঙ্গের মধ্যে ব্যক্তিত্ব আরোপ করা হয়, অর্থাৎ তারাও মানুষের মতো কথা বলে এবং নিজেদের চিন্তার প্রকাশ ঘটায়।
(১০.) লোককথার গল্প গুলিতে স্থান, কাল, পাত্রের কোন সুনির্দিষ্ট উল্লেখ নেই। এক যে ছিলো রাজা..., একদা এক দেশে এক রাজা বাস করতো, কোন এক সময়ে... - এইভাবে লোককথার গল্প গুলি শুরু হয়।
লোককথার গুরুত্ব
লোককথার প্রধান গুরুত্বের দিক গুলি হল -
(১.) ঐতিহ্য ও সংস্কৃতির আভাস
লোককথা কে ইতিহাস বলে গন্য করা যায় না। তবে কেউ কেউ লোককথা কে আধা ইতিহাস বলে মনে করে থাকেন।লোককথা থেকে সামান্য হলেও একটি দেশের সামাজিক ও সাংস্কৃতিক ঐতিহ্য সম্পর্কে একটি আভাস পাওয়া যায়।
যেমন -
(ক) ভারতীয় লোককথা গুলি শিশুদের নানা নীতি শিক্ষা দেওয়ার জন্যই তৈরি করা হয়েছিলো। এগুলি থেকে অনুমান করা যায়, প্রাচীনকালে ভারতীয় সমাজ ব্যবস্থায় নীতি নৈতিকতার মান ছিলো অতি উচ্চে। ইতিহাসের অন্যান্য তথ্য সূত্র থেকেও প্রায় একই কথা জানতে পারা যায়। এছাড়া,
(খ) যে কোন সময়কালের গল্প বা সাহিত্যে তৎকালীন সমাজ, সংস্কৃতি এবং ঐতিহ্যের একটি ছাপ খুঁজে পাওয়া যায়। লোককথার গল্প থেকেও প্রাচীন সময়কালের ঐতিহ্য, সংস্কৃতির ও সমাজের একটা অস্পষ্ট ছাপ পাওয়া যেতে পারে অনেক লোকসংস্কৃতির গবেষক মনে করে থাকেন।
(২.) ঐতিহাসিক তথ্যের আভাস
লোককথা থেকে অনেক সময় নানা ঐতিহাসিক তথ্যেরও আভাস পাওয়া যায়। উদাহরন হিসাবে বেহুলা লখিন্দরের গল্পের কথা বলা যায়। এখানে চাঁদ সদাগরের সপ্তডিঙা নিয়ে দূরদেশে বানিজ্য করতে যাওয়ার, দিকটি থেকে বোঝা যায়়, অতীতে বাংলার বনিকরা দূর দেশে বানিজ্য করতে যেতেন। পরবর্তীকালে প্রাচীন ভারতের ইতিহাসের বিশ্লেষন থেকেও একই তথ্যের কথা জানা যায়।
(৩.) শিশুশিক্ষার গুরুত্বপূর্ণ মাধ্যম
শিশুশিক্ষার মাধ্যম হিসাবে লোককথা গুলি গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা নিয়ে থাকে। সভ্যতার শুরুর দিকে শিশুদের বৌদ্ধিক শিক্ষার তেমন কোন ব্যবস্থা ছিলো না। সেই সময়ে এই লোককথা গুলির মধ্য দিয়েই শিশুদের নৈতিক শিক্ষা দান করা হতো।
লোককথা গুলি মানুষকে যথার্থ পথে চলার শিক্ষা দেয়। পৃথিবীর সব দেশের লোককথা গুলিতেই দেখা যায়, যে সৎ এবং ভালো, সব শেষে তারই জয় হয়। লোককথা গুলি শিশুদের বুদ্ধিমান এবং তাদের কাল্পনিক হতে সাহায্য করে। স্বপ্ন দেখতে শেখায়। তাদের ভাবনা ও বুদ্ধিমত্তার বিকাশ ঘটায়। আইনস্টাইন তাই বলেছিলেন - সন্তানকে বুদ্ধিমান করতে চাইলে তাদের লোককথার গল্প পড়তে দাও।
(৪.) মনোরঞ্জন ও বিনোদনের মাধ্যম
লোককথা গুলির আরেকটি গুরুত্বের দিক হলো এগুলি যুগ যুগ ধরে মানুষকে মনোরঞ্জন এবং আনন্দদান করে আসছে। বর্তমান কালেও কার্টুন, টিভি সিরিয়াল, সিনেমা ইত্যাদির মাধ্যমে এগুলি মনোরঞ্জন ও বিনোদন ঘটিয়ে চলেছে।