ইতিহাস চর্চায় Legends বা কিংবদন্তি

আধুনিক ইতিহাস চর্চার অলিখিত উপাদান গুলির একটি অন্যতম ভাগ হল কিংবদন্তি বা Legend

ইতিহাস চর্চায় Legends বা কিংবদন্তি
ইতিহাস চর্চায় কিংবদন্তি 


কিংবদন্তির শব্দগত অর্থ 

ইংরেজি "Legend " শব্দটির বাংলা প্রতিশব্দ হলো "কিংবদন্তি"। এই Legend শব্দটি এসেছে লাতিন শব্দ "Legenda" থেকে, যার অর্থ পাঠের বিষয়বস্তু বা অধ্যায়নের বিষয়বস্তু।পরে শব্দটির অর্থ পরিবর্তন হয় এবং অবাস্তব ও অনৈতিহাসিক জীবনধারাকে বোঝানোর জন্য শব্দটিকে প্রয়োগ করা হয়। 

ইওরোপে ধর্মসংস্কার আন্দোলনের সময় প্রোটেস্ট্যান্টরা ক্যাথলিক সাধুদের অনৈতিকহাসিক ও অবাস্তব জীবনচর্চা কে প্রথম "লিজেন্ড" বলে অভিহিত করেছিলেন। পরবর্তীকালে এই লিজেন্ড শব্দটি ইতিহাস চর্চার মধ্যে ঢুকে পড়ে। 

বুৎপত্তিগত অর্থে লোকমুখে প্রচারিত কোন বিশেষ গুন বা ক্ষমতা সম্পন্ন মানুষের অতীতের কাজকর্মের বিবরনকেই "কিংবদন্তি" বা লিজেন্ড বলা হয়ে থাকে। ইতিহাস চর্চায় অবশ্য কিংবদন্তি হল জনশ্রুতি বা অলিখিত মৌখিক উপাদানের একটি ভাগ

কিংবদন্তির সংজ্ঞা ও ধারনা 

কিংবদন্তি বা লিজেন্ড হল, কোন বিশেষ অঞ্চলে সংগঠিত কোন ঘটনা বা চরিত্র ভিত্তিক কাহিনী, যা সেই অঞ্চলের মানুষ প্রজন্ম পরম্পরায় মনে রাখে, বিশ্বাস করে এবং পরবর্তী প্রজন্মের কাছে প্রচার করে। 

 কিংবদন্তির মূল কথা 

আরোও সহজ করে বলতে গেলে - 

  • কিংবদন্তি হলো একটি চরিত্র ভিত্তিক জনশ্রুতি। এখানে অতীতের কোন বিশেষ চরিত্রকে অবলম্বন করে কিংবদন্তির অতিকথা আবর্তিত হয়। 
  • কিংবদন্তির কাহিনীর মধ্যে কোন চমকপ্রদ ঘটনা যুক্ত থাকে, যার আকর্ষনেই মূলত কিংবদন্তির কাহিনী গুলি প্রজন্ম পরম্পরায় প্রবাহিত হয়। 
  • কিংবদন্তির চরিত্র বা ঘটনার সঙ্গে একটি নির্দিষ্ট  অঞ্চলের যোগ থাকে। অর্থাৎ কিংবদন্তির কাহিনী গুলি একটি নির্দিষ্ট ভৌগলিক এলাকার মধ্যেই সীমাবদ্ধ থাকে। 

কিংবদন্তি সম্পর্কে আরো দুটি কথা বলা যায় - 

 (১.) কিংবদন্তির চরিত্র গুলো মিথ বা পৌরাণিক কাহিনীর চরিত্র গুলির মতো কাল্পনিক নয়। এগুলির একটি বাস্তব ভিত্তি থাকে। অর্থাৎ অতীতে কোন এক সময় কিংবদন্তির নায়করা নিশ্চিত ভাবেই বেঁচে ছিলেন। 

(২.) কিন্তু পরবর্তীকালে তাদের অবিস্মরনীয় কাজ, কৃতিত্ব, এবং বীরগাথাকে ফুলিয়ে ফাঁপিয়ে অতিরঞ্জনের সাথে পরিবেশন করা হয়েছিলো। এর সাথে যুক্ত হয়েছিলো নানা আজগুবি বিষয়, যা পরে "অতিকথায়" পরিনত হয়েছিলো। 

কিংবদন্তির উদ্ভব

কিংবদন্তির উদ্ভব কখন ঘটেছিলো, তা নিশ্চিত ভাবে বলা না গেলেও, ঐতিহাসিকরা অনুমান করে থাকেন, পৌরাণিক কাহিনী বা মিথ গড়ে উঠবার পর মানব সমাজে যখন কিছু কিছু ইতিহাস বোধ জেগে উঠতে আরম্ভ করেছিলো, তখন থেকেই কিংবদন্তির সৃষ্টি হয়েছিলো। 

অর্থাৎ সময় কালের নিরিখে মিথের পরেই কিংবদন্তির জন্ম হয়েছিলো। কিংবদন্তি মিথের মতো অতো প্রাচীন নয়, তা বর্তমান সময়ের অনেকটাই কাছের।  

কিংবদন্তির উদাহরন 

(১.) ভারতের কয়েকটি উল্লেখযোগ্য কিংবদন্তি হল - 

  • রামচন্দ্রের কাহিনী, 
  • শ্রীকৃষ্ণের কাহিনী, 
  • বিক্রমাদিত্যের কাহিনী, 
  • গোপাল ভাঁড়ের কাহিনী, 
  • শিবাজীর কাহিনী, 
  • কালিদাসের কাহিনী, 
  • বাংলার রঘু ডাকাতের কাহিনী, 
  • সাঁওতাল বিদ্রোহের শহীদ সিধু কানুর কাহিনী, 
  • মুন্ডা বিদ্রোহের নায়ক বীরসা মুন্ডার কাহিনী। 
(২.)  ইওরোপের উল্লেখযোগ্য কিংবদন্তি গুলি হল - 
  • ইংল্যান্ডে রবিন হুডের কাহিনী, 
  • গ্রিসের হারকিউলিসের কাহিনী, এবং প্রমিথিউসের কাহিনী।

কিংবদন্তির বৈশিষ্ট্য 


কিংবদন্তির প্রধান যে বৈশিষ্ট্য গুলি দেখা যায় তা হল - 
  1. কিংবদন্তি সাধারণত কোন অঞ্চলে বা স্থানে সংগঠিত কোন স্মরণীয় ঘটনা বা চরিত্রকে কেন্দ্র করে গড়ে ওঠে।
  2. কিংবদন্তির চরিত্র গুলির একটি বাস্তব ভিত্তি থাকে। অর্থাৎ কিংবদন্তির চরিত্রগুলি অতীতে কোন এক সময় জীবন্ত ছিলেন। 
  3. কিংবদন্তিতে প্রকৃত বা বাস্তবিক কোন ব্যক্তিত্বকে কল্পনার সাহায্যে ফুলিয়ে ফাঁপিয়ে অতিমানব চরিত্রের গল্পে পরিনত করা হয়। অর্থাৎ কিংবদন্তি অতিরঞ্জন দোষে দুষ্ট। 
  4. কিংবদন্তির বিষয়বস্তু বিভিন্ন ধরনের হয়ে থাকে। যেমন - ইতিহাস নির্ভর, প্রেম বিরহ নির্ভর, বীরগাথা মূলক, ভূত, প্রেত, সন্ন্যাসী - ফকিরের কাহিনী মূলক। 
  5. কিংবদন্তি - গল্প বা কাহিনীর আকারে মুখে মুখে প্রজন্ম পরম্পরায় প্রবাহিত হয়। অর্থাৎ কিংবদন্তি হলো মৌখিক ঐতিহ্য অনুসারি। 
  6. কিংবদন্তির সঙ্গে আজগুবি বিষয় বা গুজবের সংস্রব লক্ষ্য করা যায়। 
  7. কিংবদন্তি গুলি সাধারনত দীর্ঘকাল স্থায়ী হয়। লোকমুখে প্রচারিত হতে হতে তা বংশানুক্রমিকভাবে প্রবাহিত হতে থাকে। 
  8. কিংবদন্তির বিষয় গুলির সত্যতা বিষয়ে নিশ্চিত হওয়া যায় না। কিন্তু তাই বলে এগুলি সম্পূর্ণ অসত্য বা সন্দেহের উর্দ্ধে, তাও জোর দিয়ে বলা যায় না। 
  9. মিথের চেয়ে কিংবদন্তির ঘটনা বর্তমানের নিকটবর্তী হয়ে থাকে। 
  10. কিংবদন্তির চরিত্র গুলি অনেক সময় মানুষের সাংস্কৃতিক ধারার সঙ্গে যুক্ত হয়ে জনসমাজের সংস্কৃতির ধারণ ও বাহক হয়ে ওঠে। কিংবদন্তিকে তাই দেশ বা জাতির ঐতিহ্যগত লোককথাও বলা হয় ।

কিংবদন্তির গুরুত্ব

(১.) বৌদ্ধ বিহারের আবিষ্কার 

কিংবদন্তির কাহিনীর ওপর ভিত্তি করে বহু প্রাচীন বৌদ্ধ বিহারের নিদর্শন আবিষ্কৃত হয়েছে। উদাহরন হিসাবে বলা যায় - 

পূর্ব বঙ্গের সীতারকোট, অরুনধাপ ঢিবি, ও টুঙ্গির শহরের ঢিবি সম্পর্কে যে কিংবদন্তি প্রচলিত ছিলো তার সূত্র ধরে খননকার্য চালিয়ে বহু প্রাচীন বৌদ্ধ বিহারের নিদর্শন পাওয়া যায় । ১৯৬৮ খ্রিঃ সীতারকোটে এবং ১৯৭২ ও ১৯৭৮ খ্রিঃ বাকি জায়গা গুলিতে খননকার্য চালিয়ে অন্যান্য বৌদ্ধ বিহারের ধ্বংসাবশেষ আবিষ্কৃত হয়। 

(২.) ঐতিহাসিক সত্যতার অনুসন্ধান

কিংবদন্তির সূত্র ধরে নানা ঐতিহাসিক ঘটনার সত্যতা সম্পর্কেও জানা গেছে - 
  • বাংলার রঘু ডাকাতের কিংবদন্তির সূত্র ধরে ঐতিহাসিকরা হুগলি জেলার বাসুদেব পুরের একটি প্রাচীন কালী মন্দিরকে চিহ্নিত করেছেন।
  • দেবী চৌধুরানীর কিংবদন্তির সূত্র ধরে জলপাইগুড়িতে বেশ কিছু প্রাচীন কালী মন্দির আবিষ্কৃত হয়েছে। 
  • কিংবদন্তির বিক্রমাদিত্যকে গুপ্ত সম্রাট দ্বিতীয় চন্দ্র গুপ্তের সঙ্গে অভিন্ন বলে অনেক ঐতিহাসিক চিহ্নিত করেছেন। 
  •  রামচন্দ্রের দক্ষিণ ভারত যাত্রা ও শ্রীলঙ্কায় আগমনের কিংবদন্তির সূত্র ধরে রামসেতুর আবিষ্কার হয়েছে। ঐতিহাসিকরা রামচন্দ্রের দক্ষিণ ভারত যাত্রা কে দক্ষিণ ভারতের আর্যীকরন বা আর্য সংস্কৃতির বিস্তার হিসাবে দেখেছেন। রামচন্দ্রের কিংবদন্তির ঐতিহাসিকত্বের জন্যই বর্তমান পক্ প্রনালীর অ্যাডামস্ রিজ বা সেতুবন্ধটি বানিজ্যিক জাহাজ চলাচলের জন্য ভেঙ্গে ফেলা সম্ভব হয় নি।

(৩.) সাংস্কৃতিক বোধের জাগরনে কিংবদন্তি 

একটি দেশ বা জাতির সামাজিক ও সাংস্কৃতিক বোধের নির্মানজাগরনের ক্ষেত্রে কিংবদন্তির একটি গভীর সম্পর্ক থাকে। তাই কোন দেশের সাংস্কৃতিক ইতিহাসের অনুসন্ধান করতে হলে কিংবদন্তিকে কখনই উপেক্ষা করা যায় না। উদাহরন হিসাবে বলা যায় - 

ভারতীয় সমাজ ও সংস্কৃতির ক্ষেত্রে রামচন্দ্রশ্রীকৃষ্ণের এক বিরাট প্রভাব ছিলো। ভারতের স্বাধীনতা আন্দোলনের সময় এই কিংবদন্তির চরিত্র গুলিকে ব্যবহার করেই সাংস্কৃতিক পুনরুদ্ধার ও জাতীয়তাবোধের জাগরনের চেষ্টা করা হয়েছিলো। এ প্রসঙ্গে তিলকের শিবাজি উৎসব এবং চরমপন্থীদের শ্রীকৃষ্ণ বন্দনার কথা বলা যায়। কিংবদন্তিকে তাই একটি দেশের ঐতিহ্যগত লোককথাও বলা হয়।

(৪.) স্থানীয় ইতিহাস চর্চায় কিংবদন্তি 

কিংবদন্তির মধ্যে নানা অবাস্তব ঘটনা যুক্ত থাকলেও, স্থানীয় ইতিহাস রচনার ক্ষেত্রে এর গুরুত্বকে উপেক্ষা করা যায় না। উদাহরন হিসাবে বলা যায়, মুর্শিদাবাদে সিরাজদৌল্লা ও তার পরিবার নিয়ে নানা কিংবদন্তি প্রচলিত আছে। আবার বিষ্ণুপুরের মল্ল রাজাদের নিয়েও ঐ অঞ্চলে নানা কিংবদন্তি দেখা যায়।স্থানীয় ইতিহাস চর্চায় তথ্যের অভাবের জন্য, ঐ সমস্ত কিংবদন্তিকে সূত্র করে ঐতিহাসিকরা অনেক সময়েই প্রকৃত ইতিহাসের কাছাকাছি পৌঁছাতে চেষ্টা করেন। 


এই ভাবে দেখা যায়, কিংবদন্তিকে ব্যবহার করে মানুষ তার "অতীত গৌরবের" পুর্নগঠন করতে চায় এবং তার "গৌরবময় অতীতের" কাছাকাছি পৌঁছে যেতে চায়। 



Post a Comment (0)
Previous Post Next Post