উনিশ শতকে সমাজসংস্কার থেকে ধর্মসংস্কার সব কিছুই "মানবতাবাদী ভাবধারার" আলোকে আবর্তিত হয়েছিলো। রামকৃষ্ণদেবের সর্বধর্ম সমন্বয়ের আদর্শেরও মূল ভিত্তিভূমি ছিলো মানবতাবাদী দর্শন ।
শ্রীরামকৃষ্ণদেবের সর্বধর্ম সমন্বয়ের আদর্শ |
উনিশ শতকে হিন্দুধর্ম একদিকে যখন - (১.) খ্রিষ্টধর্ম এবং ব্রাহ্ম ধর্মের ষাঁড়াশি আক্রমণে জর্জরিত, (২.) হিন্দু সমাজ বহু মত, পথ, আচার অনুষ্ঠানের জটিলতা এবং জাতপাতে বহুবিভক্ত, (৩.) সাধারণ মানুষ সাকার আর নিরাকারের দ্বন্দ্বে দিগভ্রষ্ট, পথভ্রষ্ট - ঠিক সেই সময়ে আসল আধ্যাত্মিক পথের সন্ধান দেখাতে আর্বিভূত হন শ্রীরামকৃষ্ণ পরমহংসদেব।
সংক্ষিপ্ত জীবনী
শ্রীরামকৃষ্ণ পরমহংসদেবের আদি নাম ছিলো গদাধর চট্টোপাধ্যায়। ১৮৩৬ খ্রিঃ হুগলি জেলার কামারপুকুর গ্রামে তাঁর জন্ম হয়।
কলকাতার বিখ্যাত জমিদার রানী রাসমনি ১৮৫৫ খ্রিঃ দক্ষিণেশ্বরে ভবতারিনী কালীমন্দির প্রতিষ্ঠা করেন। এই মন্দিরেই দাদা রামকুমার চট্টোপাধ্যায়ের সঙ্গে গদাধর সহকারী পুরোহিত হিসাবে কাজে যোগ দেন।
১৮৫৬ খ্রিঃ দাদা রামকুমারের মৃত্যু ঘটলে গদাধর মন্দিরের প্রধান পুরোহিত হিসাবে নিযুক্ত হন। কিছু দিন পর এখান থেকেই তিনি তার সাধনা শুরু করেন এবং অল্প কিছু দিনের মধ্যেই একজন প্রখ্যাত কালীসাধক হয়ে ওঠেন। এই সময় তোতাপুরি নামে এক বৈদান্তিক সাধুর কাছে তিনি দীক্ষা নিয়েছিলেন। তোতাপুরিই গদাধরের নামকরন করেন শ্রীরামকৃষ্ণ পরমহংসদেব। পরবর্তীকালে এই নামেই তিনি জগৎবিখ্যাত এবং প্রসিদ্ধ হন।
রামকৃষ্ণদেব তাঁর জীবনের প্রায় ১২ বছর বিভিন্ন ধর্মমতে দীক্ষিত হন এবং সেই ধর্ম গুলিকে অনুশীলন করেন। তিনি এক ভৈরবির কাছে তন্ত্রসাধনা করেন। রামাইত নামে এক সাধুর কাছে বৈষ্ণবধর্ম চর্চা করেন। আচার্য তোতাপুরির কাছে বেদান্ত অনুশীলন করেন। ওয়াজেদ আলির কাছে ১৮৬৬ খ্রিঃ ইসলাম ধর্মে দীক্ষিত হন এবং ইসলামের সাধনা শুরু করেন। ১৮৭৩ খ্রিঃ শেষদিকে থেকে রামকৃষ্ণদেব খ্রিষ্টধর্মের সাধনা শুরু করেন এবং শম্ভুচরন মল্লিকের কাছে যিশুখ্রিষ্টের জীবনী ও ধর্মমত সম্পর্কে শিক্ষা লাভ করেন। বৌদ্ধ মতেও তিনি সাধনা করেন এবং বুদ্ধদেবকে তিনি ঈশ্বরের অবতার বলেই পুজা করতেন।এককথায়়, হিন্দুধর্ম এবং বিশ্বের প্রধান ধর্ম গুলির সবগুলিরই তিনি অনুশীলন করেন।
রামকৃষ্ণদেবর মূল ধর্মীয় মতবাদ
রামকৃষ্ণদেব তাঁর দীর্ঘ ধর্ম অনুশীলনের অভিজ্ঞতা থেকে কতকগুলি মূল সত্যে উপনীত হন -
- সব ধর্মই সত্য,
- সব ধর্মমত অনুসরন করেই মানুষ ঈশ্বরের সান্নিধ্য লাভ করতে পারেন,
- ঈশ্বর এক ও অভিন্ন। ধর্ম এবং ধর্মমত গুলি সেই ঈশ্বরের কাছে পৌঁছানোর এক এক ধরনের মার্গ বা পথ ব্যতিত আর কিছুই নয়। তাঁর ভাষায়, "যত মত তত পথ, কালী, খ্রিষ্ট, আল্লাহ সবই এক",
- ঈশ্বর লাভের জন্য পান্ডিত্য, শাস্ত্রজ্ঞান, মন্ত্র তন্ত্র, আচার অনুষ্ঠান, কৃচ্ছসাধন, সংসার ত্যাগ অপরিহার্য নয়,
- ঈশ্বর এই জগতের মধ্যেই বিরাজ করছেন। যত্র জীব, তত্র শিব। একমাত্র জীব সেবার মধ্য দিয়েই প্রকৃত শিব সেবা হয়ে থাকে,
- ঈশ্বরের নামে কর্মত্যাগ, কর্তব্যকর্মে অবহেলা, ও সর্বপ্রকার পলায়নী মনোবৃত্তিকে তিনি নিন্দা করেন। তাঁর মতে, ঈশ্বর লাভের জন্য কর্মত্যাগের প্রয়োজন নেই. প্রয়োজন নিষ্কাম কর্মের,
- সর্বপরি, সত্য, সহিষ্ণুতা এবং সমন্বয়ের মধ্য দিয়েই ঈশ্বরের কাছে পৌঁছানো যায়।
সর্বধর্ম সমন্বয়বাদের আদর্শ
- কোন ধর্মের প্রতি বিরূপ মনোভাব পোষণ না করা,
- সকল ধর্মকেই সমদৃষ্টিতে ও ঈশ্বরীয় মার্গ হিসাবে দেখা,
- ধর্মীয় সহিষ্ণুতার অনুসরন ও পালন করা। সহিষ্ণুতা ব্যতিত সমন্বয় অসম্ভব,
- সব ধর্মের প্রতিই শ্রদ্ধাশীল হওয়া,
- ধর্মকে সংকীর্ণ গন্ডিতে আবদ্ধ না রেখে, তাকে জীবকল্যান, মানবসেবা ও মনুষ্যত্ব জাগরনের লক্ষ্যে উন্নীত করা,
- আধ্যাত্মবাদের সঙ্গে মানবতাবাদের সমন্বয় ঘটিয়ে মানবসেবা ও লোককল্যানের আদর্শ প্রচার করা,
সর্বধর্ম সমন্বয়বাদের ঐতিহাসিক তাৎপর্য
- এর ফলে উনিশ শতকে নানা ধর্মে বিভক্ত ও বিভ্রান্ত ভারতীয় সমাজ প্রকৃত পথের দিশা খুঁজে পায়।
- হিন্দু ধর্মের অর্ন্তবিরোধ হ্রাস পায়, এবং হিন্দু ধর্ম নবচেতনায় বলীয়ান হয়ে ওঠে।
- হিন্দু ধর্মের সর্বধর্ম সমন্বয়ের উদার আদর্শবাদে আকৃষ্ট হয়ে বহু ধর্মান্তরিত মানুষ হিন্দু ধর্মে ফিরে আসেন।
- সর্বধর্ম সমন্বয়ের নীতি ধর্মীয় বিভেদ ও সাম্প্রদায়িকতাকে দূর করে জাতীয়তাবাদকে সুদৃঢ় করে তুলতে সাহায্য করে।
- সর্বধর্ম সমন্বয়ের মানবতাবাদী ভাবধারায় উজ্জিবিত হয়েই লোকশিক্ষা ও লোক কল্যানের জন্য স্বামী বিবেকানন্দ ১৮৯৭ খ্রিঃ রামকৃষ্ণ মঠ ও মিশন প্রতিষ্ঠা করেন।
অসাধারণ। আবারও মুগ্ধ করলেন।
ReplyDeleteঅসাধারণ। আবারও মুগ্ধ করলেন।
ReplyDelete