ইতিহাস চর্চার ধারনা ও বিকাশের সঙ্গে "পেশাদারি ইতিহাস" এবং "অপেশাদারি ইতিহাস" শব্দ দুটি ওতপ্রোত ভাবে জড়িত।
পেশাদারি এবং অপেশাদারি ইতিহাস |
বলে রাখা ভালো, অপেশাদার ইতিহাস চর্চার মধ্য দিয়েই পৃথিবীর যে কোন দেশের ইতিহাস চর্চার প্রথম সূত্রপাত ঘটেছিলো। অপেশাদারি ইতিহাস চর্চার পরের ধাপে এসেছিলো পেশাদারি ইতিহাস, যেখানে ইতিহাসকে পেশা বা বৃত্তি হিসাবে গ্রহন করে, যথেষ্ট প্রশিক্ষণ এবং পেশাদারি দক্ষতাকে অবলম্বন করে ইতিহাস লেখার চেষ্টা করা হয়েছিলো।
অপেশাদারি ইতিহাস মূলত ব্যক্তিগত উদ্যোগে, অলাভজনক দৃষ্টিভঙ্গিতে লেখা হয়ে থাকে। কিন্তু পেশাদারি ইতিহাস ইতিহাস রচনার যথেষ্ট প্রশিক্ষণ নিয়ে এবং পেশাদারি দক্ষতার সঙ্গে, নিরপেক্ষ দৃষ্টিভঙ্গিতে লেখার চেষ্টা করা হয়। পেশাদারি ইতিহাস চর্চার সঙ্গে অর্থ লাভের বিষয়টাও জড়িয়ে থাকে। অপেশাদারি ইতিহাসের পরবর্তীকালে পেশাদারি ইতিহাসের সূত্রপাত হলেও, বর্তমানে যে কোন দেশের ইতিহাস চর্চার ঘরানার মধ্যেই এই দুটি ধারা আজও সক্রিয় আছে।
এখন ইতিহাস চর্চার এই দুটি ধারার সংজ্ঞা, বৈশিষ্ট্য এবং অন্যান্য দিক গুলো সম্পর্কে বিস্তারিত আলোচনা করলেই ইতিহাস চর্চার এই দুটি ধারা সম্পর্কে একটা স্বচ্ছ এবং পরিষ্কার ধারণা তৈরি হয়ে যাবে।
অপেশাদারি ইতিহাস
ইতিহাস রচনার কোনরকম প্রশিক্ষণ ছাড়াই, অতীতের প্রতি ভালোবাসার টানে কোন ব্যক্তি যখন অতীতের ঘটনাবলীকে লিপিবদ্ধ করে তাকে একটা ইতিহাসের রূপ দেওয়ার চেষ্টা করেন, তখন তাকেই সাধারণত অপেশাদারি ইতিহাস বলা হয়ে থাকে।
এখানে মনে রাখতে হবে, পেশাদারি ইতিহাস রচনার আগে পর্যন্ত অপেশাদারি ইতিহাসই ছিলো, ইতিহাস রচনার প্রচলিত রীতি। "ইতিহাসের জনক" বলে খ্যাত হেরোডোটাস থেকে থুকিডিডিস, প্রথম দিকের প্রায় সব লেখকরাই অপেশাদারি ঢঙেই ইতিহাস লিখেছিলেন। আমাদের দেশের "প্রথম ইতিহাস গ্রন্থ" কলহনের রাজতরঙ্গিনীও অপেশাদারি ঢঙেই লেখা হয়েছিলো।
অপেশাদারি ইতিহাসের সঙ্গে যুক্ত ঐতিহাসিক
- অপেশাদারি ঐতিহাসিকদের বেশির ভাগই ছিলেন, সাধারন শ্রেনীর মানুষ। অতীতের প্রতি ভালোবাসার টানেই এদের কেউ কেউ ব্যক্তিগত ভাবে ইতিহাস রচনায় উৎসাহিত হয়েছিলেন। বর্তমানেও স্থানীয় স্তরে, অতীতের কোন স্মরণীয় ঘটনাকে তুলে ধরার জন্য কেউ কেউ ব্যক্তিগত ভাবে ইতিহাস চর্চা করে থাকেন। এরাই হলেন মূলত অপেশাদারি ঐতিহাসিক।
- প্রাচীনকালের ইতিহাসকারদের অনেকেই ছিলেন মূলত শখের ঐতিহাসিক। অর্থাৎ সেইসব লেখকদের কাছে ইতিহাস চর্চা ছিলো একটি শখের বিষয়।
- এইসব অপেশাদার ঐতিহাসিকদের অনেকেই ছিলেন বিত্তবান মানুষ। তারা আর্থিক দিক থেকে যথেষ্ট ক্ষমতাশালী ছিলেন। মূলত সময় কাটাবার জন্য এবং বিনোদনের জন্য তারা ইতিহাস চর্চা করতেন এবং তাতে আনন্দ পেতেন।
- অপেশাদার ঐতিহাসিকদের মধ্যে আবার এমন এক শ্রেণীর মানুষ ছিলেন, যারা চিত্তবিনোদনের পাশাপাশি সমাজে নিজেদের মান মর্যাদা বৃদ্ধির জন্যও ইতিহাস চর্চা করতেন।
অপেশাদারি ইতিহাসের প্রকৃতি ও বৈশিষ্ট্য
- এরা মূলত কালানুক্রম অনুসারে অতীতের ঘটনা গুলোকে সাজাতেন,
- কিন্তু অতীতের ঘটনাবলীর কোন ব্যাখ্যা তারা দিতেন না। অর্থাৎ তারা কোন একটি যুদ্ধের ঘটনার বিবরন তাদের ইতিহাসে তুলে ধরতেন। কিন্তু সেই যুদ্ধ কেন হল, তার ফলাফল কি হয়েছিলো, যুদ্ধের জয় পরাজয়ের ব্যাখ্যা বা বিশ্লেষন কোনটাই তারা করতেন না।
- তথ্যের বিশ্লেষণও তারা সঠিক ভাবে করতে পারতেন না।অর্থাৎ কোন একটি ঘটনার অনেকগুলি তথ্য সূত্রের মধ্যে কোন তথ্যটি সবথেকে নির্ভরযোগ্য ও বিশ্বাসযোগ্য এই বিষয়ে তাদের কোন জ্ঞান ছিলো না। ফলে তাদের ইতিহাস পুরোপুরি নিরপেক্ষ ও যথার্থ ইতিহাস হয়ে উঠতে পারে নি।
- ইতিহাস রচনার কোন প্রশিক্ষণও এদের ছিলো না। তথ্যকে কিভাবে যাচাই করতে হয়, প্রাথমিক ও নির্ভরযোগ্য তথ্য কোন গুলি, এই বিষয়ে তাদের কোন শিক্ষা ছিলো না। ইতিহাস রচনার আগে তথ্য বিশ্লেষণ খুবই জরুরী। অর্থাৎ যিনি তথ্য লিপিবদ্ধ করছেন, তিনি কতটা নিরপেক্ষ সেটা জানা দরকার। তা না করলে ইতিহাসের বিকৃতি ঘটে যেতে পারে। এই জ্ঞান অপেশাদারি ঐতিহাসিকদের ছিলো না। তারা ইতিহাস রচনায় তথ্য খুঁজেছিলেন, তারপর কিছু তথ্য পাবার পর সেগুলো পরীক্ষা না করেই তারা প্রয়োগ করেছিলেন। তাদের ইতিহাস রচনার এটাই হলো সবচেয়ে দূর্বলতার দিক।
- ইতিহাস রচনার ক্ষেত্রে অপরিহার্য হলো নিরপেক্ষ দৃষ্টিভঙ্গি এবং দর্শনবোধ থাকা। এই দুটোর কোনটাই অপেশাদারি ইতিহাসের মধ্যে ছিলো না। আসলে প্রশিক্ষণ না থাকার ফলে ইতিহাস চর্চায় দৃষ্টিভঙ্গি সম্পর্কে কোন জ্ঞান বা ধারনা অপেশাদারি ঐতিহাসিকদের ছিলো না।
- অপেশাদারি ইতিহাসের আরেকটি বৈশিষ্ট্য হলো, এই ইতিহাস একটি নির্দিষ্ট বিষয়ের মধ্যেই সীমাবদ্ধ থাকে। আলোচনার বৃহৎ পরিসর এবং ব্যাপ্তি, কোনটাই এই ইতিহাসে থাকে না।
- মাথায় রাখতে হবে,ইতিহাস রচনার প্রথম সূত্রপাত অপেশাদারি ইতিহাস থেকেই হয়েছিলো।
- অপেশাদারি ইতিহাস বিভিন্ন দেশের কয়েকশো বছরের ইতিহাস রচনা কে প্রভাবিত করেছিলো।
- আজও আঞ্চলিক স্তরে অনেক সাধারণ মানুষ অপেশাদারি ঢঙে ইতিহাস চর্চা করে যাচ্ছেন।
পেশাদারি ইতিহাস
পেশাদারি ইতিহাসের সূত্রপাত
পেশাদারি ইতিহাসের প্রকৃতি ও বৈশিষ্ট্য
- এই ইতিহাসে যথেষ্ট প্রশিক্ষণ নিয়ে এবং অভিজ্ঞতা সঞ্চয় করে ঐতিহাসিক তথ্যের বিচার বিশ্লেষণ করে থাকেন। একটা কথা মেনে নিতেই হবে, ইতিহাসের গতি প্রকৃতি সম্পূর্ণই তথ্যের ওপর দাঁড়িয়ে থাকে। শশাঙ্কের সঙ্গে হর্ষবর্ধনের বিরোধ ছিলো। এখন হর্ষবর্ধনের সূত্রধররা শশাঙ্ক সম্পর্কে যে তথ্য রেখে যাবেন, সেটা কি নিরপেক্ষ হবে? কখনই হবে না। এখন হর্ষবর্ধনের সূত্রধরদের রেখে যাওয়া তথ্যকে প্রয়োগ করে যদি আমরা শশাঙ্কের ইতিহাস রচনার চেষ্টা করি, তাহলে কি শশাঙ্কের প্রকৃত ইতিহাসকে আমরা তুলে আনতে পারবো? কখনই পারবো না। এইজন্য পেশাদারি ঐতিহাসিকরা ইতিহাস রচনায় সবার প্রথমে যিনি তথ্য লিপিবদ্ধ করছেন তার মানসিকতা যাচাই করেন, দ্বিতীয় ধাপে তথ্যটিকে অন্যান্য উপাদানের তথ্যের সঙ্গে মিলিয়ে দেখেন, তারপর সেই তথ্যকে গ্রহন ও ব্যাখ্যা বিশ্লেষণ করেন। ফলতঃ পেশাদারি ইতিহাস হয়ে থাকে অনেকটাই বিজ্ঞান সম্মত।
- পেশাদারি ইতিহাসে ঐতিহাসিক অতীতের ঘটনা গুলিকে সঠিক প্রেক্ষাপটে যাচাই করেন। অর্থাৎ ইতিহাস চর্চায় কার্যকারন সম্পর্কের প্রয়োগ করেন।সময় হলো ঘটনাপ্রবাহের স্রোত। ইতিহাস সেই ঘটনাপ্রবাহকেই ইতিহাসে তুলে নিয়ে আসে। পেশাদারি ঐতিহাসিকরা সেই ঘটনা গুলির কার্যকারন সম্বন্ধ ইতিহাসে খুঁজে পেতে চান, অর্থাৎ ঘটনাটি কেন ঘটলো, তার কারন গুলি তিনি খুঁজে চলেন।
- পেশাদারি ইতিহাসের আরেকটি বিশেষত্বের দিক হলো, দৃষ্টিভঙ্গির প্রয়োগ। অতীতের ঘটনাকে বর্তমান সময়ের দৃষ্টিভঙ্গিতে না দেখে, ঐতিহাসিক সবসময়ই সেই ঘটনাকে সমকালীন সময়ের প্রেক্ষিতে দেখবার চেষ্টা করেন, এবং সেই সময় কালের মূল্যবোধের ভিত্তিতেই ঘটনাটির মূল্যায়ন করবার চেষ্টা করেন।
- পেশাদারি ইতিহাসের আলোচনার পরিসর অনেক ব্যাপক ও বিস্তৃত। রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক, সামাজিক, সাংস্কৃতিক, রননীতি ও যুদ্ধকৌশল, বিনোদন ও শিল্পচর্চা, সমাজের প্রতিটি বিষয় এই ইতিহাসে স্থান পায়।
- পেশাদারি ইতিহাসের গুরুত্বের কথা বলতে গিয়ে সবার প্রথমে একটি কথা বলতেই হয় যে, পেশাদারি ইতিহাস চর্চার মধ্য থেকেই আধুনিক ইতিহাস চর্চার সূত্রপাত ঘটে।
- পেশাদারি ঐতিহাসিকরা ইতিহাস চর্চায় কার্যকারন সম্পর্কের প্রয়োগ করে অতীতের ঘটনা গুলির কারন, ফলাফল, তার দূর্বলতার নানা দিক গুলোকে তুলে ধরেন। পেশাদারি ইতিহাস পাঠ করে তাই আমরা অতীতের ঘটনাবলীর অভিজ্ঞতা থেকে যেকোন দুর্যোগ সম্পর্কে সচেতন হয়ে উঠতে পারি। অতীতে কোন দুর্ভিক্ষ হলে, কি কারনে সেটি হয়েছিলো, কিভাবে তাকে মোকাবিলা করা হয়েছিলো, মোকাবিলা করবার ক্ষেত্রে কোথায় ঘাটতি ছিলো, ইত্যাদি নানা দিক গুলি সম্পর্কে আমরা জানতে পারি।
- সকল সময়েই বর্তমান পরিস্থিতি মোকাবিলায় অতীতের জ্ঞানকে ব্যবহার করা হয়। এক্ষেত্রে পেশাদারি ইতিহাস গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে থাকে। শুধু ইতিহাসই নয়, পেশাদারি ঐতিহাসিকও এক্ষেত্রে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা নিয়ে থাকেন। ইংল্যান্ডে এডস রোগের প্রতিরোধে পেশাদারি ঐতিহাসিকদের ভূমিকার কথা এই প্রসঙ্গে বলা যেতে পারে। পেশাদারি ঐতিহাসিকরা সরকারকে এই সময় সতর্ক করে দিয়ে বলেছিলেন, ভিক্টোরিয়া যুগের মতো এডস প্রতিরোধ করতে গিয়ে কখনই যেন জনগনকে নির্যাতন করা না হয়। কারন তাহলে জনসাধারনের সমবেত বিদ্রোহের প্রতিরোধের মুখে সরকারকে পড়তে হতে পারে।
- পেশাদারি ইতিহাস থেকে আমরা অতীতের একটি ধারাবাহিক বিবরন পাই। এই বিবরন থেকে একটি জাতি, একটি দেশ, বা অঞ্চলের আঞ্চলিক বৈশিষ্ট্য ও প্রবনতা গুলিকে আমরা বুঝতে পারি। উদাহরণ হিসেবে বলা যায়, আমাদের দেশের ধারাবাহিক ইতিহাস আলোচনা থেকে দেখা গেছে, যখনই ভারতবর্ষে কোন একটি শক্তিশালী কেন্দ্রীয় শাসনব্যবস্থা গড়ে উঠেছিলো, তখনই আঞ্চলিক প্রতিরোধ ও বিরোধীতা নেমে এসেছিলো।আবার কেন্দ্রীয় শাসনব্যবস্থা ভেঙ্গে পড়বার সাথে সাথেই শুরু হয়েছিলো বৈদেশিক আক্রমণ । অতীতের এই প্রবনতার দিকটি কে লক্ষ্য রেখেই সংবিধানে যুক্তরাষ্ট্রীয় ধাঁচের শাসনতন্ত্র গড়ে তোলা হয়।
- মোটকথা, পেশাদারি ইতিহাস আমাদের অতীতের যেকোন বিষয়ের ভুল, ত্রুটি, ফলাফল, পরিনাম, দূর্বলতার দিকগুলো সম্পর্কে সচেতন করে তোলে। এই জ্ঞান আমাদের ভবিষ্যতের ভুল গুলোকে শুধরে নিতে সাহায্য করে। ভুল সিদ্ধান্ত গুলোকে আগের থেকেই চিনে নিতে সাহায্য করে। পেশাদারি ঐতিহাসিকরা তাই বলে থাকেন, ইতিহাস শুধু অতীতকে জানবার একটা বিষয়মাত্র নয়, বর্তমানকে সঠিকভাবে বোঝবারও একটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয়।
অপেশাদারি ইতিহাসের সঙ্গে পেশাদারি ইতিহাসের পার্থক্য
কিন্তু পেশাদারি ইতিহাসের সূচনা সাম্প্রতিক কালের ঘটনা। অপেশাদারি পর্ব থেকে পেশাদারি পর্বে ইতিহাসের প্রবেশ ঘটেছিলো উনিশ শতকের শেষ দিকে।
(২.) অপেশাদারি ঐতিহাসিকরা ছিলেন শখের ঐতিহাসিক। তারা মূলত অবসর বিনোদনের জন্যই এই ইতিহাস চর্চা করতেন।