ইতিহাস বইয়ে ফরাসি বিপ্লবের গল্পটা ১৭৮৯ খ্রিঃ থেকে শুরু হলেও, আমরা এখানে আরেকটু পিছিয়ে গিয়েই গল্পটা শুরু করবো।
এ প্রসঙ্গে বলে রাখি,ফরাসি বিপ্লবের পুরো গল্পটা আমরা একদিনে শোনাব না। কারন গল্প যদি খুব বড়ো হয়ে যায়, তাহলে শোনার আগ্রহ হারিয়ে যেতে পারে। তাই আমরা ঠিক করেছি, ছোট ছোট পর্বে ভাগ করেই তোমাদের ফরাসি দেশের গল্প শোনাবো। আশা করছি, এই গল্পগুলো তোমাদের ইতিহাস বইয়ের পড়াগুলোকে বুঝতে অনেকটাই সাহায্য করবে।
আজকে আমাদের গল্পের প্রধান বিষয়বস্তু হল - "বিপ্লব পূর্ব ফ্রান্স"। ১৭৮৯ খ্রিঃ ফরাসি বিপ্লব ঘটবার আগে পর্যন্ত ফ্রান্সের পরিস্থিতি কেমন ছিলো সেটাই আজকে আমাদের গল্পের মূল বিষয়বস্তু। তাহলে চলো.. শুরু করা যাক,
ফরাসি বিপ্লবের গল্পকথা |
বুঁরবো রাজবংশের প্রতিষ্ঠা :-
প্রাচীনকালে পশ্চিম ইউরোপে গল নামে একটি দেশ ছিলো। এই গলদেশেরই পরে নাম হয়েছিলো ফ্রান্স। অনেকেই বলে থাকেন, ওখানকার বিখ্যাত ফ্রাঙ্ক রাজবংশের নাম থেকেই নাকি দেশটার নাম অমন হয়েছিলো।
১৭৮৯ সালের প্রায় দুশো বছর আগে ১৫৮৯ খ্রিঃ ফ্রান্সে এক ঐতিহাসিক ঘটনা ঘটলো। চতুর্থ হেনরী নামে একজন ক্ষমতাশালী লোক ভ্যালোয়া বংশের অবসান ঘটিয়ে নতুন একটি রাজবংশের প্রতিষ্ঠা করলেন। যে রাজবংশ বুঁরবো রাজবংশ নামে পরিচিতি লাভ করেছিলো।
স্টেটস জেনারেলের কথা:-
চতুর্থ হেনরীর সময়ে ফ্রান্সের জনগনের একটি প্রতিনিধি সভা ছিলো। এর নাম ছিলো স্টেটস জেনারেল। স্টেটস জেনারেলের অস্তিত্ব চতুর্থ হেনরীর আগে থেকেই ফ্রান্সে ছিলো। যদিও হেনরী এই প্রতিনিধি সভাকে খুব একটা পছন্দ করতেন না।তিনি এটাকে সামন্তপ্রভুদের প্রতিষ্ঠান বলেই ভাবতেন। তার সময়ে মাত্র চার বার স্টেটস জেনারেলের অধিবেশন বসেছিল।১৬১০ খ্রিঃ তার মৃত্যুর পর তার নাবালক পুত্র ত্রয়োদশ লুইয়ের আমলে ১৬১০ খ্রিঃ শেষবারের মতো স্টেটস জেনারেলের অধিবেশন বসেছিলো। তারপর আর কখনই এই সভার অধিবেশন বসে নি।
ফ্রান্সের জনসাধারনকে তিনটি শ্রেনীতে ভাগ করা হয়েছিলো। চার্চের যাজকরা ছিলেন প্রথম শ্রেনী। অভিজাতরা ছিলেন দ্বিতীয় শ্রেনী এবং এই দুটো শ্রেনী বাদ দিয়ে বাদবাকি পেশার সব লোকেরা তৃতীয় শ্রেণীর অন্তর্ভুক্ত ছিলো।
প্রত্যেক শ্রেনী থেকে এই স্টেটস জেনারেলে ভোট দিয়ে লোকেদের পাঠানো হতো। এইসব লোকেরা তাদের এলাকার নানা অভাব অভিযোগ এবং নিজেদের শ্রেনীর দাবিদাওয়া গুলি রাজার কাছে তুলে ধরতো। রাজার সঙ্গে জনগনের সেতুবন্ধনের কাজ করতো এই স্টেটস জেনারেল।
ব্যবস্থাটা ভালোই ছিলো। কিন্তু হেনরীর জীবনের বেশিরভাগটাই বড়োই অশান্তিতে কেটেছিলো। স্টেটস জেনেরেলের মতো একটি সভাকে ডেকে তিনি আর অশান্তি বাড়াতে চান নি।
ত্রয়োদশ লুই ও রিশলু :-
হেনরী হঠাৎ করেই মারা গিয়েছিলেন। মৃত্যু যদিও কারো কাছে বলে কয়ে আসে না। কিন্তু অসময়ে মরে যাওয়াটাকে হঠাৎ করে মরে যাওয়াই বলে। হেনরী মরবার পর তার নাবালক পুত্র ত্রয়োদশ লুইকে ফ্রান্সের সিংহাসনে বসিয়ে দেওয়া হয়েছিলো। এই সময় কার্ডিন্যাল রিশলু নামে একটা লোক প্রধানমন্ত্রী হয়ে গিয়ে সব ক্ষমতা আত্মসাৎ করে নিয়েছিলো।
রিশলু দেশপ্রেমিক ছিলেন ঠিকই, কিন্তু স্টেটস জেনারেলের সভাকে তিনিও খুব একটা পাত্তা দিতেন না। কোনদিন এর অধিবেশনই ডাকেন নি। নিজের মতো করে দেশ চালিয়ে গিয়েছিলেন। রাজতন্ত্র এবং দেশকে শক্তিশালী করবার জন্য যা করার, এবং যতটুকু করার, তার থেকে একটু বেশিই তিনি করে গিয়েছিলেন। তিনি যে বছর মারা যান, তার ঠিক পরের বছরেই মৃত্যু হয় ত্রয়োদশ লুইয়ের। সালগুলো ছিলো যথাক্রমে ১৮৪২ এবং ১৮৪৩।
রিশলুর মতো একজন দক্ষ প্রশাসক মরে যাওয়ার পর স্বাভাবিক ভাবেই দেশে বিরাট শূন্যতা দেখা দিলো। ত্রয়োদশ লুইয়ের মৃত্যুর পর তার বউ অ্যান নাবালক পুত্র চতুর্দশ লুইয়ের হয়ে রাজকার্য চালাতে থাকলেন।
গুইলো ম্যাজারিন:-
এই সময়ে ইতালি থেকে আসা গুইলো ম্যাজারিন নামে একটা লোক রানীর কাছে খুবই আস্থাভাজন হয়ে ওঠে। ফ্রান্সের সাধারণ লোকজন কিন্তু রানী অ্যানের সঙ্গে ম্যাজারিনের সম্পর্কটাকে ভালো নজরে দেখতো না।
ম্যাজারিন বেশ ধান্দাবাজ ছিলেন। রিশলু যে বছর মরলো, সেই বছরই রানী ত্রয়োদশ লুইকে বলে কইয়ে ম্যাজারিনকে প্রধানমন্ত্রী করে দিলেন। এর একবছরের মাথায় ত্রয়োদশ লুইয়ের মৃত্যু হলে ম্যাজারিনের ভাগ্য যেন খুলে গেলো। নাবালক চতুর্দশ লুইয়ের বকলমে তিনিই হয়ে উঠলেন ফ্রান্সের প্রকৃত শাসক।
ম্যাজারিনকে ফ্রান্সের লোকজন একদমই পছন্দ করতেন না। তাতে অবশ্য ম্যাজারিনের কিছু আসে যায় নি। রাজতন্ত্রকে শক্তিশালী করবার চেষ্টা তিনি করে গিয়েছিলেন। ফ্রান্সের লোকজন তার ওপর রেগে লাল হয়ে থাকতো। সেই জন্যই বোধ হয় ম্যাজারিনও স্টেটস জেনারেলের অধিবেশন আর ডাকেন নি।
চতুর্দশ লুই:-
যাইহোক, ১৬৬১ খ্রিঃ ম্যাজারিনের মৃত্যুর পর ফ্রান্সের লোকজন যেন একটু বেশিই খুশি হলো। আপদটা মরে যেন ভালোই হলো। চতুর্দশ লুই অভিভাবকত্বের নাগপাশ থেকে মুক্ত হলেন এবং ১৬৬১ খ্রিঃ দেশের প্রকৃত শাসন ক্ষমতা নিজের হাতে নিয়ে নিলেন।
ফ্রান্সের লোকেরা যেন এই দিনটার জন্যই অপেক্ষা করছিলেন। এতদিনে তারা তাদের স্বপ্নের রাজাকে ফ্রান্সের মাটিতে আবির্ভূত হতে দেখলেন।
চতুর্দশ লুই খুব ভালো কথা বলতে পারতেন। খুব সুন্দর বক্তিতা দিতে পারতেন। তার আমলে রাজকীয় আড়ম্বরে ফ্রান্সের লোকজন একেবারে মোহিত হয়ে পড়েছিলো।
চতুর্দশ লুই খুব কড়া স্বভাবের মানুষ ছিলেন। তার সময়ের বেশিরভাগটা রোমের পোপের সঙ্গে ঝগড়া করেই কেটেছিলো। ফ্রান্সের সব গির্জা গুলো রোমের পোপের অধীন ছিলো। ফ্রান্স থেকে নানা ধর্মীয় কর এবং দানসামগ্রী ফরাসি গির্জাগুলো রোমে চালান করে দিতো। এই ব্যাপারটা একেবারেই চতুর্দশ লুইয়ের নাপসন্দ ছিলো।
তিনি চাইছিলেন, দেশের চার্চ দেশের রাজার অধীনেই থাকুক। দেশ থেকে বছর বছর যে বিপুল পরিমান টাকা রোমের গির্জা নিয়ে চলে যাচ্ছে, ওটা দেশে থাকলে দেশের ক্ষমতা অনেক বৃদ্ধি পাবে। চতুর্দশ লুইকে ফ্রান্সের সামন্তপ্রভু আর বেশিরভাগ অভিজাত পছন্দ করতো না ঠিকই, কিন্তু ভয়ে কিছু বলতেও পারতো না। চতুর্দশ লুই রাষ্ট্র আর রাজতন্ত্রকে ক্ষমতাশালী করতে গিয়ে প্রায়ই একটা কথা বলে বেড়াতেন - I am tha state. আমিই হলাম রাষ্ট্র।
পঞ্চদশ লুই :-
১৬৬১ - ১৬১৫ পর্যন্ত বেশ দাপটের সঙ্গেই চতুর্দশ লুই ফ্রান্স শাসন করেছিলেন। ১৬১৫ খ্রিঃ তার মৃত্যুর পর ফ্রান্সের সিংহাসনে বসেন পঞ্চদশ লুই। এই লোকটা একেবারে ১৬৭৪ খ্রিঃ পর্যন্ত ফ্রান্সের সুখভোগ করে গিয়েছিলো। ইনি ছিলেন অত্যন্ত বিলাসি, রমনীরঞ্জনে আসক্ত, এবং পরিশ্রম বিমুখ। সারাদিন বউদের নিয়েই পড়ে থাকতেন। এইজন্য ফ্রান্সের লোকেরা মজা করে তার একটা নাম দিয়েছিলো - প্রজাপতি রাজা। উপপত্নী মাদাম দ্য পম্পাদ্যুরের কথায় ওঠবোস করাই যেন ছিলো তার প্রধান কাজ।
ক্ষুধার্ত নেকড়েদের হানা :-
রাজা দূর্বল আর পরিশ্রম বিমুখ হলে সরকারেও ঘুন লেগে যায়। সেসব কথা অবশ্য আমরা পরে বলবো। আপাতত, এইটুকুই জেনে রাখা ভালো, বুঁরবো রাজতন্ত্রের অবক্ষয়টা পঞ্চদশ লুইয়ের আমল থেকেই শুরু হয়।
রাজা অলস এবং দূর্বল। সুতরাং তার কর্মচারীরা কি কর্মঠ হবে? কখনোই হবে না। শেষপর্যন্ত দেখা গেল দুর্নীতিপরায়ন, ফাঁকিবাজ, ঘুষখেকো লোকেরা আস্তে আস্তে প্রশাসনকে গ্রাস করতে আরম্ভ করলো। প্রদেশে রাজস্ব আদায় করতো ইনটেনডেন্ট নামে কর্মচারীরা। তারা বড়োই দুর্নীতিপরায়ন এবং ঘুষখোর হয়ে গেলো এই সময় থেকে। ফ্রান্সের লোকজন আড়ালে লুকিয়ে চুরিয়ে এদেরকে "ক্ষুধার্ত নেকড়ে" বলে ডাকতো। টাকা ছাড়া ইনটেনডেন্টরা যেন কিছুই বুঝতো না।
আরেকদিকে দেখা গেলো ফ্রান্সের আদালত গুলোও খুবই দুর্নীতিগ্রস্থ হয়ে পড়ছে। যাদের টাকা আছে, তারা টাকা দিয়ে বিচারকের পদ এবং রায় দুটোকেই কিনে নিতে পারছে। একটাই দেশ, কিন্তু সেই দেশে ভিন্ন ভিন্ন আইন।
" লত্রে দ্য গ্রাস" এবং "লত্রে দ্য কেসে" :-
এই সময় দুটো আইনের অপপ্রয়োগে ফ্রান্সের লোকজন রাগে ফুঁসতো। কিন্তু তাদের কিছুই করার ছিলো না। একটার নাম ছিলো "লত্রে দ্য গ্রাস" আরেকটা ছিলো "লত্রে দ্য কেসে"। লত্রে দ্য গ্রাসের প্রয়োগ করে রাজা আদালত প্রদত্ত শাস্তি মুকুব করে দিতে পারতেন। এটা একটু বাড়াবাড়িই ছিলো। রাজা যে অসীম ক্ষমতার অধিকারী এটা বোঝাতে ফরাসি রাজারা মাঝে মধ্যেই লত্রে দ্য গ্রাসের প্রয়োগ করে বেড়াতেন। কখনো সখনো বুক ফুলিয়ে বক্তিতা দিয়ে বলতেন তারা হলেন ঈশ্বরের প্রতিনিধি। ভগবানই তাদের কে শাসন করবার দায়িত্ব দিয়েই পৃথিবীতে পাঠিয়েছেন।
অসন্তোষ আইনের আরেকটা ছিলো "লত্রে দ্য কেসে" । এটি আরো মারাত্মক ছিলো। এই আইনের প্রয়োগে রাজা যেকোন ব্যক্তিকে বিনা বিচারে অনির্দিষ্টকাল জেলে পুরে রাখতে পারতেন। সরকারি কর্মচারীরা প্রায়ই লত্রে দ্য কেসের অপব্যবহার করতেন।
এই দুটো আইন কারো উপকার করুক না কারণ, ফরাসি রাজাদের ধীরে ধীরে স্বৈরাচারী হয়ে উঠতে সাহায্য করেছিলো।
পঞ্চদশ লুইয়ের বিদেশনীতি :-
পঞ্চদশ লুই অনেকদিন ফ্রান্সের সুখভোগ করলেও তার সময়কালের ১৫ টা বছর যুদ্ধ করেই কেটেছিলো। অষ্ট্রিয়ার উত্তরাধিকার যুদ্ধ (১৭৪০ - ৪৮) এবং সপ্তবর্ষব্যাপী যুদ্ধে (১৭৫৬ - ১৭৬৩) তিনি ফ্রান্সকে জড়িয়ে ফেলেছিলেন।
এই যুদ্ধ করা নিয়ে এমনিতেই দেশের মধ্যবিত্ত শ্রেণী ক্ষেপে ছিলো।কারন এই দুটো যুদ্ধের সঙ্গে দেশের কোন স্বার্থ জড়িত ছিলো না। তার পর দুটো যুদ্ধে পঞ্চদশ লুই যখন হেরে ভূত হয়ে গেলো তখন ফরাসি বনিক আর মধ্যবিত্ত শ্রেণীর রাগের সীমা পরিসীমা রইলো না। কারন আসল ক্ষতিটা তাদেরই হলো। যুদ্ধ দুটোতে হেরে যাওয়ার ফলে ফরাসি বনিক আর মধ্যবিত্ত শ্রেণীরা বানিজ্য এবং উপনিবেশ গুলো হেলায় হারালেন।
বংশের শেষ প্রদীপ - ষোড়শ লুই :-
দেশের মানুষের মনে একরাশ ক্ষোভ আর রাজতন্ত্রের প্রতি রাগের জন্ম দিয়ে পঞ্চদশ লুই দুনিয়া ছেড়ে বিদায় নিলেন। তার মৃত্যুর পর ১৭৭৪ খ্রিঃ ফ্রান্সের সিংহাসনে বসলেন ষোড়শ লুই। তিনিই ছিলেন বুঁরবো বংশের শেষ রাজা। ১৭৭৪ থেকে ১৭৯৩ খ্রিঃ পর্যন্ত ষোড়শ লুই মোটামুটি রাজা থেকে যেতে পেরেছিলেন। যদিও, ১৭৮৯ থেকেই তার জীবনে শনির প্রবেশ ঘটেছিলো। তার মতো এত অশান্তি, ঝামেলা আর কাউকেই পোয়াতে হয় নি। লুইয়ের বাপ, ঠাকুরদার প্রতি ফ্রান্সের লোকের যতো রাগ আর ক্ষোভ ছিলো সব যেন এক লহমায় লুইয়ের ওপর কালবৈশাখির ঝড়ের মতো এসে পড়েছিলো।
মাঝে মধ্যেই ষোড়শ লুই রানীকে বলতেন, কি কুক্ষনেই যে আমি ফ্রান্সের সিংহাসনে বসেছিলাম! রানী লুইকে বুঝিয়ে সুজিয়ে বলতেন, তুমি বাপু রাজা। রাজার মতো থাকো। এত ভালোমানুষি সাজা তোমায় ভালো দেখায় না। রানী মেরী এ্যান্টোনেটের কথা শুনে ষোড়শ লুই আপ্রান চেষ্টা করতেন রাজা হয়ে উঠতে। কিন্তু অল্প স্বল্প চেষ্টা করেই তিনি ধপাস করে করে পড়ে যেতেন। বড়োই নরম মনের মানুষ ছিলেন।
অত্যন্ত ভদ্র এবং ভালো মনের মানুষ ছিলেন ষোড়শ লুই। নিজে অত্যন্ত সৎ ছিলেন। কিন্তু রাজা হওয়ার মতো কোন ব্যক্তিত্বই তার ছিলো না। রাজাকে প্রয়োজনে কঠোর ও কঠিন হতে হয়। কিন্তু সেসব ষোড়শ লুইয়ের ধাতে ছিলো না। তিনি একরকম রানীর হাতের পুতুল হয়েই থেকে গিয়েছিলেন।
আলগা রাশের বেপরোয়া ঘোড়া :-
কথায় বলে, নরম মাটিতেই শক্ত পায়ের ছাপ পড়ে বেশি। ষোড়শ লুইয়ের ক্ষেত্রে তাই হয়েছিলো। ফ্রান্সের রাজকর্মচারীরা মোটেই তাকে ভয় করতো না। অভিজাতরা তো একবার রাজাকে মৃত্যুদন্ড দিয়ে দেবো বলে বেশ করে শাসিয়েও দিয়েছিলো। সেসব গল্প পরে বলবো। মোটকথা, ষোড়শ লুইয়ের ভালোমানুষির সুযোগ নিয়ে ক্ষমতার অলিন্দে থাকা লোকগুলো যেন বেপরোয়া হয়ে গেলো।
ইনটেনডেন্টরা আরো বেশি করে দুর্নীতিবাজ আর ঘুষখোর হয়ে গেলো। আদালত গুলো বিচার ঘরের নামে প্রহসন ঘরে পরিনত হলো। লত্রে দ্য কেসের অপব্যবহার হতে থাকলো। সব দিক থেকে এসবের কুফল ভোগ করতে থাকলো ফ্রান্সের সাধারন জনগন। তাদের দুর্দশার আর শেষ ছিলো না।
তিনটি শ্রেনী :-
ফ্রান্সের সমাজে তিনটি শ্রেনী ছিলো - যাজক, অভিজাত এবং তৃতীয় শ্রেণী। সাধারন মানুষ বলতে ঠিক যাদের বোঝানো হয়, তারা সবাই এই তৃতীয় শ্রেণীর ঘরটার মধ্যেই পড়তেন।
তৃতীয় শ্রেনীর ক্ষোভ :-
তৃতীয় শ্রেণির অবস্থা ফ্রান্সে মোটেই ভালো ছিলো না। ফ্রান্সের ৯৭ % লোকজনই তৃতীয় শ্রেণীর অন্তর্ভুক্ত ছিলেন। শুধুমাত্র বংশকৌলিন্য না থাকার কারনে তারা কোন সরকারী চাকরি পেতেন না। তাদের সেভাবে কোন সম্পত্তি বা জমিও ছিলো না।অভিজাতরা এই তৃতীয় সম্প্রদায়ের লোকেদের নীচু নজরে দেখতো। তাদেরকে ওরা ছোটলোক বলেই মনে করতো। এটার জন্য তৃতীয় শ্রেণীর লোকেদের কারো কারো মনে খুব রাগ জন্মেছিলো। বিপ্লব শুরু হওয়ার কয়েক বছর আগে থেকে এই রাগটা আরো অনেকখানি বেড়ে গিয়েছিলো।
তৃতীয় সম্প্রদায়ের মধ্যে যারা ব্যবসায়ী এবং শিল্পপতি ছিলো, ফরাসি বিপ্লবের আগে তাদের অনেকের পকেটেই মোটা টাকা এসেছিলো। এসব অবশ্য তারা কষ্ট করেই রোজগার করেছিলেন। কথায় বলে, যার যত টাকা থাকে, সে তত টাকাকে আঁকড়ে ধরে থাকতে চায়। যেভাবে ফ্রান্সের একটা শ্রেণীর ওপর সরকার কর বসিয়ে দিনের পর দিন চলছিলো, এটাকে এইসব নব উদীয়মান ব্যবসায়ী, শিল্পপতি আর মধ্যবিত্তরা কিছুতেই মেনে নিতে পারছিলো না। ফরাসি সরকারের একচোখা কর নীতি টাতে তাদের মনে হয়েছিলো, সরকার যেন তাদের টাকাকড়ি গুলো ছিনতাই করে নিচ্ছে।
এর ওপর অভিজাতরা যেভাবে তাদেরকে চোখ রাঙাতো, এটা একেবারেই এইসব শ্রেনী গুলোর কাছে অসহ্য ছিলো। ফ্রান্সের ব্যবসায়ী, শিল্পপতি আর মধ্যবিত্তরা তাই এমন একটা সমাজের স্বপ্ন দেখতে আরম্ভ করেছিলো, যেখানে কোন বৈষম্য থাকবে না। যোগ্যতা অনুযায়ী সবাই যে যার সম্মান ও মর্যাদা পাবে।
দার্শনিকদের কথা আর দিন বদলের স্বপ্ন :-
তাদেরকে এই স্বপ্নটা দেখতে শিখিয়ে ছিলেন রুশো, মনন্তেস্কু, ভলতেয়ারের মতো দার্শনিকরা। ১৭৮৯ খ্রিঃ ফ্রান্সে বিপ্লব শুরু হওয়ার আগেই এরা সবাই মরে গিয়েছিলেন ঠিকই, কিন্তু তাদের আদর্শ ভূত হয়ে বিপ্লবের আগের দিন পর্যন্ত ফ্রান্সের শিক্ষিত মানুষদের মাথার ওপর ভর করে ছিলো। এই শিক্ষিত মানুষদের ডাকেই শেষপর্যন্ত বিপ্লব সম্পন্ন হয়েছিলো।
এইজন্য কেউ কেউ বলে থাকেন ফরাসি বিপ্লবে ফ্রান্সের দার্শনিকদেরও একটা ভূমিকা ছিলো। তারা স্বপ্ন দেখতে শিখিয়ে ছিলেন। যেকোন পরিবর্তনেরই প্রথম এবং প্রধান শর্ত হলো স্বপ্ন দেখতে শেখা। দার্শনিকরা সেটাই দেখিয়ে ছিলেন। সমাজের পঁচে যাওয়া, দুর্গন্ধময় জিনিস গুলোকে তারা চিনিয়ে দিতে পেরেছিলেন। পঁচনশীল পুরাতনতন্ত্রের প্রতি আঘাত করে তারা সমস্ত শ্রদ্ধা ও আনুগত্য নষ্ট করে দেন। দার্শনিকদের এই অবদানের জন্যই শিক্ষিত শ্রেনী ফ্রান্সের পুরাতনতন্ত্রকে ফু দিয়ে উড়িয়ে দিতে পেরেছিলেন। পুরাতন সিস্টেমের প্রতি সমস্ত মোহ তাদের কেটে গিয়েছিলো। এইজন্য কেউ কেউ বলে থাকেন ফরাসি বিপ্লবে দার্শনিকদেরও একটা ভূমিকা ছিলো। সেটা ছিলো পরোক্ষ আর দূরবর্তী।
তৃতীয় শ্রেণীর অর্থনৈতিক ক্ষোভের কথা :-
ফ্রান্সের বৈষম্যমূলক সমাজ নিয়েই শুধু তৃতীয় সম্প্রদায়ের মধ্যে ক্ষোভ ছিলো না। আসল ক্ষোভটা ছিলো দেশের অর্থনীতি নিয়ে। দেশের সমস্ত আর্থিক দায় তাদেরকেই ঠেলতে হতো। কখনো কখনো রাগে তাদের মনে হতো দেশ যেন তাদের একারই। এজন্য তৃতীয় শ্রেণীর লোকেরা রাগে একেবারে ফুঁসে থাকতো।
সাধারন মানুষ আর কৃষকদের ক্ষোভ :-
তাদেরকে প্রত্যক্ষ কর টেইলি (ভূমিকর), ক্যাপিটেশন (উৎপাদন কর), ভ্যাঁতিয়েম (স্থাবর, অস্থাবর সম্পত্তির ওপর কর), গ্যাবেল (লবনকর), টাইথ (ধর্মকর), এডস ( মদ, তামাক ইত্যাদি নেশার জিনিস পত্রের ওপর আরোপিত কর) ইত্যাদি দিতে হতো। এগুলো ছাড়াও সামন্ত প্রভুদের কিছু বাধ্যতামূলক করও ছিলো। গ্রামের সামন্তপ্রভু আর অভিজাতরা করভি (বাধ্যতামূলক বেগার শ্রম), এবং বানালিতে (কলে গম পেষাই করবার ওপর কর) আদায় করতেন।
সবাইকে করটর দিয়ে কৃষকদের হাতে মাত্র পাঁচ ভাগের একভাগ থাকতো। তাই দিয়ে দুবেলা পেটভরে খাওয়াও জুটতো না। ফরাসি বিপ্লবের ঠিক আগে তাই ভবঘুরে বেকার, যাদেরকে সাঁকুলেৎ বলা হয়, তাদের সংখ্যা মারাত্মক ভাবে বেড়ে যেতে আরম্ভ করে।
মধ্যবিত্ত শ্রেণী আর ব্যবসায়ীদের ক্ষোভ :-
ফ্রান্সের সরকারের অর্থনীতি নিয়ে ব্যবসায়ীদের অভিযোগ ছিলো অনেক। তারা চেয়েছিলেন, ফরাসি সরকার ফ্রান্সের ভিতরে অন্তশুল্ক তুলে দিক। পন্য অবাধে চলাচল করুক। কিন্তু এটা মানতে রাজা কোনমতেই রাজী ছিলেন না।
যাজক অভিজাত দের আর্থিক সুবিধা :-
অর্থনীতি নিয়ে তৃতীয় সম্প্রদায়ের রাগের আরেকটা বড়ো কারন ছিলো সমাজে অপর দুই শ্রেনী যাজক এবং অভিজাত দের প্রভূত আর্থিক ছাড় এবং তৃতীয় শ্রেণির ওপর তাদের আর্থিক শোষন।
অভিজাতরা ফ্রান্সের মোট জনসংখ্যার মাত্র দেড় শতাংশ ছিলেন। দেশের মোট কৃষিজমির তিন ভাগের একভাগ তারা দখল করে ছিলেন। দেশের অধিকাংশ চাকুরি বংশকৌলিন্যের দোহায় দিয়ে তারা ভোগ করতেন। কিন্তু এতকিছু ভোগদখল করা সত্ত্বেও রাষ্ট্রকে তারা একপয়সা পর্যন্ত কর দিতেন না।
গ্রামের অভিজাত আর সামন্তপ্রভু প্রায় সমার্থক ছিলেন। তাদের দ্বারা গ্রামের কৃষকরা নানাভাবে অত্যাচারিত হতেন। সামন্ত অভিজাত দের করভারে গ্রামের মানুষদের অবস্থা খুবই খারাপ হয়ে পড়েছিলো।
অন্যদিকে যাজকরা ছিলেন মোট জনসংখ্যার মাত্র এক শতাংশ। তা সত্ত্বেও কৃষি জমির পাঁচ ভাগের একভাগ তারাই ভোগ করতেন। এর জন্য তারা কোন কর দিতেন না। উপরন্তু লোকজনের কাছে জন্মকর, মৃত্যুকর, বিবাহ কর, ধর্ম কর ইত্যাদি অদ্ভুত অদ্ভুত সব কর আদায় করতেন।
ভ্রান্ত অর্থনীতির জাদুঘর :-
মোটকথা, যাদের হাতে টাকাকড়ি আর সম্পত্তি ছিলো, তাদের ওপর কোন কর বসানো হয় নি। আর যাদের তেমন কিছুই ছিলো না, তাদের ঘাড়ে সব কর বসিয়ে দেওয়া হয়েছিলো। এই অদ্ভুত ব্যাপারটা অনেকটা ম্যাজিকের মতোই মনে হয়েছিলো ঐতিহাসিক অ্যাডাম স্মিথের। তাই তিনি বিপ্লব পূর্ব ফ্রান্সের অর্থনীতিকে "ভ্রান্ত অর্থনীতির জাদুঘর" বলে অভিহিত করেছিলেন।
রাজার ভোগবিলাসের প্রতি অসন্তোষ :-
তৃতীয় সম্প্রদায়ের শ্রেনীগত রাগের পাশাপাশি, রাজার প্রতিও অনেক রাগ জমেছিলো। বুঁরবো রাজপরিবার ছিলো অত্যন্ত বিলাসপ্রিয়। ষোড়শ লুইয়ের রানীর ব্যক্তিগত চাকরানী ছিলো প্রায় ৫০০ জন। রাজা যখন বেড়াতে যেতেন, তখন সঙ্গে করে ২০০০ টা গাড়িকে নিয়ে যেতেন। এছাড়া, খাওয়া দাওয়া, পোশাক আশাক, বিনোদন এসব তো ছিলই।
ভোগী রাজা রানীর কাছে এগুলো প্রয়োজনীয় মনে হলেও, খেতে না পাওয়া, অনাহার, অর্ধাহারে থাকা তৃতীয় শ্রেণির লোকেদের কাছে এগুলো বড়ো বেশি বাড়াবাড়ি মনে হয়েছিলো। এজন্য যাজক, অভিজাত শ্রেনীগুলির পাশাপাশি রাজা রানী আর বুঁরবো রাজবংশের প্রতিও তাদের ক্ষোভ জন্মেছিলো। আর এই ক্ষোভেরই বিষ্ফোরনেই ঘটেছিলো ১৭৮৯ খ্রিঃ ফরাসি বিপ্লব।
চলবে........
আপনার লেখা গুলো যত পড়ছি, তত মুগ্ধ হয়ে যাচ্ছি। ইতিহাসের প্রতি কৌতুহল নতুন করে জেগে উঠছে। এত সুন্দর ভাবে বিষয় গুলো আলোচনা করার জন্য অজস্র ধন্যবাদ আপনাকে।
ReplyDeleteবলছি ত্রয়োদল লুই ও কার্ডিন্যাল রিশলুর মারা যাওয়ার সালটা কি ১৬৪২ ও ১৬৪৩ হবে ?
ReplyDelete