ফরাসি বিপ্লবের গল্পকথা - দ্বিতীয় পর্ব

ফরাসি বিপ্লবের গল্পকথায় আজকে তোমাদের দ্বিতীয় পর্বের গল্প শোনাবো। আজকের পর্বটিতে আমরা দেখবো কিভাবে ষোড়শ লুইয়ের সিদ্ধান্তহীনতা, ভুল সিদ্ধান্ত এবং দৃঢ়চেতা ব্যক্তত্বের অভাবের জন্য ফ্রান্স ধীরে ধীরে বিপ্লবের অভিমুখে যাত্রা করেছিলো। 

ফ্রান্সের বিপ্লবের সমস্ত সম্ভাবনাকে রাজদরবারের মধ্যেই ষোড়শ লুই আটকে দিতে পারতেন। কিন্তু তার ভীরুতা, অদূরদর্শীতা,ব্যক্তিত্বহীনতা, সিদ্ধান্তহীনতা, ফ্রান্সকে টেনে নিয়ে গিয়েছিলো এক রক্তক্ষয়ী সংগ্রামের দিকে। কিভাবে এসব ঘটেছিলো, সেটাই আজ থেকে আমরা একটু একটু করে দেখবো... 

ফরাসি বিপ্লবের গল্পকথা - দ্বিতীয় পর্ব
ফরাসি বিপ্লবের গল্পকথা 


পঞ্চদশ লুইয়ের মৃত্যুর পর ফ্রান্সের সিংহাসনে বসেছিলেন ষোড়শ লুই। কিন্তু নতুন রাজা হিসেবে সিংহাসনে বসে ফ্রান্সের জন্য তেমন নতুন কিছুই লুই করেন নি। তিনি তার বাপ ঠাকুরদার পথকেই অনুসরন করেছিলেন। 

আমেরিকার স্বাধীনতা যুদ্ধে যোগদান 


ষোড়শ লুই জীবনে অনেক ভুল কাজ করেছিলেন। ভুল সিদ্ধান্ত নিয়েছিলেন। অনেক সময় আবার অনেক দেরি করে  এমন কিছু সিদ্ধান্ত নিয়েছিলেন,যেগুলো তাকে জীবনভর ভুগিয়েছিলো। রাজা হবার পর যে যে ভুল সিদ্ধান্ত গুলো ষোড়শ লুই নিয়েছিলেন, তার মধ্যে সবথেকে বড়ো ছিলো আমেরিকার স্বাধীনতা যুদ্ধে (১৭৭৫ - ১৭৮৩) অকারনে ফ্রান্সকে জড়িয়ে দেওয়া। এটা কখনই তার উচিত কাজ হয়নি।

রাজদরবারের মধ্যে যারা টাকা কড়ির অঙ্কটা একটু ভালো বুঝতেন, তারা আগেভাগেই লুইকে পরামর্শ দিয়েছিলেন, 
অকারনে আমেরিকা যুদ্ধে ইংল্যান্ডের বিরুদ্ধে লড়ে কোন লাভ নেই।ওটা ঘরের খেয়ে বনের মোষ তাড়ানো ছাড়া আর কিছুই নয়। কিন্তু গোবেচারা লুই এইসব শুভবুদ্ধিসম্পন্ন লোকেদের কথা কানেই তোলেন নি।

এই ব্যাপারে তার অভিমত ছিলো বেশ পরিষ্কার। রাজা যদি যুদ্ধ না করে পিছিয়ে আসে, তাহলে সেটা কখনোই গৌরবের হয় না। দেশের লোক আর বিদেশের লোক, কারো কাছেই এই  ব্যাপারটা ভালোও দেখায় না। সুতরাং যুদ্ধ করাটা খারাপ কিছু না। 

আসলে কখনও কখনও আভ্যন্তরীণ শাসনের শূন্যতাকে উগ্র বিদেশনীতি দিয়ে ঢাকিয়ে দেওয়ার চেষ্টা করা হয়। ষোড়শ লুই সেই রকমই কিছু একটা করতে চেয়েছিলেন। তার বাপ ঠাকুরদাও এইরকমই কিছু কিছু কাজ করে উতরে গিয়েছিলো ঠিকই, কিন্তু আগের আমলের থেকে লুয়ের আমলে ফ্রান্সের ছবিটা অনেকটাই বদলে গিয়েছিলো। ষোড়শ লুইয়ের আমলে ফ্রান্সের কোষাগারের যা হাল হয়েছিলো,তাতে যুদ্ধ করা আর নিজের পায়ে কুড়ুল মারা একই ব্যাপার ছিলো। ষোড়শ লুই অবশ্য সেটাই করেছিলো। 

তীব্র আর্থিক সংকট


লুইয়ের যুদ্ধ নীতির এক গুঁয়েমির ফলে যা হওয়ার তাই হলো। যুদ্ধ করতে গিয়ে লাভ তো কিছু হলোই না। উল্টে কাড়ি কাড়ি টাকা খরচ হয়ে গেলো। শেষটাই রাজকোষের হাল এমন দাড়ালো যে, নুন আনতে পান্তা ফুরানোর মতো অবস্থায় দাড়ালো। ধারের পর ধার করতে হলো। বৈদেশিক ঋনের পরিমান কয়কশ গুন বেড়ে গেলো

ষোড়শ লুই যখন সিংহাসনে বসেছিলেন,তখন তার বয়স ছিলো মাত্র ২০ বছর। এমনিতেই তিনি যথেষ্ট অনভিজ্ঞ এবং দূর্বলচিত্তের ছিলেন। এর ওপর দেশের আর্থিক অবস্থা যখন ক্রমেই খারাপ হয়ে যেতে থাকলো তখন রাজদরবারের হোমড়াচোমড়া অভিজাতরা তাকে নানা দিক থেকে চেপে ধরলে লুইয়ের অবস্থা "ছেড়ে দে মা কেঁদে বাঁচির" মতো হয়ে গেলো। বেচারা লুই এতে আরও ঘাবড়ে গিয়ে, প্রায় দিশাহীন হয়ে পড়লেন।

তুর্গোর আর্থিক সংস্কারের প্রস্তাব এবং তার প্রতিক্রিয়া 


এইসময় সংকট থেকে উদ্ধার পাবার জন্য ষোড়শ লুই তুর্গো নামে একজন লোককে অর্থমন্ত্রী হিসাবে নিয়োগ করেছিলেন। তুর্গো ফিজিওক্র্যাট মতবাদে বিশ্বাসী ছিলেন,যে মতবাদ রাষ্ট্র নিয়ন্ত্রিত অর্থনীতির বদলে অবাধ বানিজ্য নীতির কথা বলেছিলো।

 তুর্গো তৃতীয় সম্প্রদায় থেকে এসেছিলেন বলে এমনিতেই রাজদরবারের অভিজাতরা ওকে একদমই পছন্দ করতো না। মাঝে মধ্যেই তারা ফিস ফিস করে বলতো, রাজা একটা অপদার্থ, আর এই লোকটা নিশ্চয়ই কোন বদ মতলবে এসেছে। শেষপর্যন্ত অবশ্য তাদের আশঙ্কাটাই সত্যি হয়ে গিয়েছিলো।

রাজাকে বাঁচাতে গিয়ে তুর্গো অর্থনীতির এমন  কিছু তেতো পরামর্শ দিয়েছিলো,যেগুলো শুনেই অভিজাতরা তেলেবেগুনে জ্বলে গিয়েছিলো। রানীর রাগটা হয়েছিলো আরও বেশি। রাজপরিবারের ব্যায় সংকোচের কথা বলতে গিয়ে তুর্গো বলেছিলো, রানীর দাসদাসীর সংখ্যাটা এবার একটু কমিয়ে দিতে হবে। রানীকে সেবা করাবার জন্য ৫০০ টা লোককে পুষে রাখা যথেষ্ট বাড়াবাড়ি ছাড়া আর কিছুই নয়! 

তুর্গোর কথাটা শুনে রানী রেগে গিয়ে কত দিন যে সাপের মতো ফোঁস ফোঁস করেছিলো সেটা একমাত্র ষোড়শ লুই ই বলতে পারবে। মোটকথা, রানীর রাগ দেখে একটা কথা বোঝা গিয়েছিলো, তুর্গোর রানীর ঘরে উঁকি মারাটা এমদমই উচিত কাজ হয় নি। যেমন করেই হোক, এর শোধ নিতেই হবে, মনে মনে প্রতিজ্ঞা করেছিলেন মেরী এ্যান্টোয়ানেন্ট। 

তুর্গো দেশের অর্থনীতির হাল ফেরাতে বেশ কিছু পরামর্শ দিয়েছিলেন। এই সব পরামর্শ গুলোর মধ্যে ছিল - (১.) অন্তশুল্ক তুলে দিয়ে অবাধ বানিজ্য নীতির প্রচলন, (২.)রাজপরিবার ও সরকারের ব্যায় সংকোচন করা, (৩.)আমেরিকার স্বাধীনতা যুদ্ধ থেকে সরে আসা এবং (৪.) যাজক অভিজাত দের ওপর ভূমিকর আরোপ করা। এর ওপর তুর্গো খাদ্য শস্যের রপ্তানি এবং অবাধ বিক্রির ওপরেও নিষেধাজ্ঞা তুলে দিলেন। 

রুটির দাঙ্গা 

দুর্ভাগ্যক্রমে এইসময় একটা খারাপ ঘটনা ঘটে গেলো। ১৭৭৪ খ্রিঃ অজন্মার ফলে খাদ্য শস্যের দাম মারাত্মক ভাবে বেড়ে গেলো। খাবারের ঘাটতিও দেখা গেলো। সাঁকুলেৎ নামে ভবঘুরেরা এইসময় চারদিকে দাঙ্গা হাঙ্গামা শুরু করে দিলো। দেশের সর্বত্র তারা "রুটির দাঙ্গা" ঘটাতে লাগলো। এই সময়টাতে তুর্গো কঠোর হাতে সাঁকুলেৎ দের দাঙ্গা মোকাবিলা করলেন। কিন্তু এই সময় নির্মম দমন নীতি প্রয়োগের জন্য চারদিকে তুর্গোর নিন্দা আর সমালোচনা হতে থাকলো। শেষটায় বেচারা তুর্গোর জনপ্রিয়তার এক কানাকড়িও অবশিষ্ট থাকলো না। 

রাজদরবারের অভিজাতরা আর রানী যেন এই দিনটার জন্যই অপেক্ষা করছিলেন। এমনিতেই অভিজাতদের ওপর কর বসানোর ঘোষনাটা করবার পর থেকেই অভিজাতরা তুর্গোর ওপর রেগে লাল হয়ে ছিলেন। তুর্গোর ওপর রানীর রাগটা ছিলো তো আরো আগের থেকেই। কদিন ধরেই বার বার অভিজাতরা রানীর কাছে গিয়ে কানভারি করে আসছিলো, রাজাকে কু পরামর্শ দেওয়া এই খিটখিটে লোকটাকে এবার বিদায় দেওয়া হোক।রানীও লোকটাকে সরানোর একটা ছুঁতো খুঁজছিলেন। 

শেষটায় রাজাকে একথা ওকথা বলে রানী বুঝাতে সক্ষম হলেন যে, তুর্গোটাকে সরিয়ে অন্য কোন ভালো লোককে বসানো হোক। নিশ্চয়ই সে তুর্গোর থেকে ভালো কিছু পরামর্শ দেবে। 

একমাত্র তুর্গো আর আমিই ফ্রান্সকে ভালোবাসি

 
রানী আর অভিজাতদের ষাড়াশি চাপের কাছে দূর্বলচিত্ত রাজার আর কিছুই করার রইলো না। না চাইলেও, তিনি ১৭৭৬খ্রিঃ তুর্গোকে বিদায় দিলেন। অত্যন্ত দুঃখের সঙ্গে তুর্গোকে বিদায় দেবার সময় লুই বলেছিলেন -  "একমাত্র তুর্গো আর আমিই ফ্রান্সকে ভালোবাসি" । 

অত্যন্ত কঠোর আর রুক্ষ স্বভাবের তুর্গো এর প্রত্যুত্তরে রাজাকে সাবধান করে দিয়ে একটি উক্তিরই পুনরাবৃত্তি করেছিলেন - "শুধু মাত্র একটি কামানের গোলাতেই  দেউলিয়া ফরাসি সরকারের পতন আসন্ন"। বিদায়কালে বলে যাওয়া তুর্গোর ভবিষ্যৎ বানী পরে সত্য প্রমানিত হয়েছিলো। 

যাইহোক, তুর্গো চলে যাওয়াতে রানী আর অভিজাতদের খুশির সীমা পরিসীমা রইলো না। অভিজাতরা তো ছোট ছোট দলে গল্প গুজব করবার সময় বলতে থাকলো - খুব বড়ো এক ষড়যন্ত্রের হাত থেকে আমরা সবাই বেঁচে গেলাম। তৃতীয় সম্প্রদায় থেকে আসা লোকটা আমাদের ওপর কর বসিয়ে আমাদেরকে তৃতীয় শ্রেণী করে দেবে বলেছিলো। কিন্তু শেষ পর্যন্ত ভগবান আমাদের বাঁচিয়ে দিলো আর ওকে ওর যোগ্য জায়গাতেই ফিরিয়ে দিলো। 

তিনজন অর্থমন্ত্রীর আনাগোনা

অভিজাতদের এই আনন্দটা অবশ্য সাময়িক ছিলো। তুর্গোকে বিদায় করবার পর ষোড়শ লুই এরপর তিনজন অর্থমন্ত্রী কে পর পর  নিযুক্ত করেছিলেন । ১৭৭৬ খ্রিঃ আনা হয়েছিলো নেকারকে১৭৮৩ খ্রিঃ নেকারকে সরিয়ে ক্যালোনকে নিয়োগ করা হয়েছিলো এবং সবশেষে ব্রিয়াঁ বলে রানীর আস্থাভাজন একজনকে অর্থমন্ত্রী করা হয়েছিলো। নেকার ছাড়া এরা সবাই মোটামুটি এদিক ওদিক অদল বদল করে তুর্গোর প্রস্তাব গুলোই বহাল রেখেছিলেন।

নেকারের ধারদেনার গল্প 

তুষের আগুনকে খড় চাপা দিয়ে ঢেকে রাখবার মতোই নেকার এদিক ওদিক থেকে ধার দেনা করে রাজকোষের কঙ্কাল চেহারাটা ঢেকে দেওয়ার আপ্রান চেষ্টা করলো। কিন্তু কথায় বলে, তুষের আগুন কখনও চাপা থাকে না আর দুর্বল লোকের দুর্বলতা প্রকাশ পেতেও বেশি সময় লাগে না। 

ফ্রান্সের অর্থনীতির হাল ফেরাতে নেকার বিপুল পরিমাণ টাকা ধার করলো। আর তারপর ধার করা টাকার সুদ জোগাড় করতে না পেরে  সামরিক বিভাগের  টাকাকড়ি নিয়ে টানাটানি শুরু করলে নেকারের বেয়াদপি লুই আর সহ্য করলেন না। যে সামরিক শক্তির ওপর ভরসা করে রাজা নিশ্চিন্তে রাজা থেকে যেতে পারেন, সেই সামরিক শক্তির ব্যায় সংকোচের পরামর্শ কোন রাজার পক্ষেই কখনই মেনে নেওয়া সম্ভব নয়। 

ক্যালোনের দুষ্টু বুদ্ধি আর ভিমরুলের চাকে ঢিল

অগত্যা নেকারকেও বিদায় দেওয়া হলো। এরপর ক্যালোন নামে আরেকজনকে অর্থমন্ত্রী করে আনা হয়েছিলো। এই লোকটা অবশ্য আগের দুটো লোকের থেকে  অনেক বেশি বিচক্ষন ছিলেন। তুর্গোর প্রস্তাব গুলো মোটামুটি বহাল রেখে দিয়ে, ক্যালোন অভিজাতদের ওপর সামান্য কিছু ভূমি কর আরোপের প্রস্তাব রাখলেন। 

 এর সাথেই চুপি চুপি রাজার কানে একটা দুষ্টু পরামর্শও ক্যালোন দিয়ে দিলেন। রাজা যেন গন্য মান্য অভিজাতদের একটা সভা "Council of Notable"  ডেকে অভিজাতদের ওপর কর বসানোর প্রস্তাবটা পাশ করিয়ে নেন। এই সভার লোকদের রাজাই মনোনীত করবেন। সেইমতো রাজা খোঁজখবর নিয়ে বেছে বেছে কজন অভিজাত, দু একটা যাজক আর বেশ কিছু ইন্টেন্ডেন্টকে মনোনীত করে "council of Notables" গঠন করলেন। তারপর তাদের সামনে দু একবার ঢোক গিলে বীরবলের মতো আসল কথাটা বলেই ফেললেন - দেশের অর্থনীতির অবস্থা মোটেই ভালো নয়। এই অবস্থায় দেশের দুর্দিনে যাজক ও অভিজাতরা  দেশকে সামান্য কিছু কর টর দিলে খুবই ভালো হয়। 

ষোড়শ লুই ভেবেছিলেন, তার মনোনীত লোকগুলো তার প্রস্তাবটিতে সিলমোহর দিয়ে দেবে। সেইমতোই তিনি অনেক খোঁজ খবর নিয়ে তারপর লোকগুলোকে Council of Notables" এ নিয়োগপত্র দিয়েছিলেন। কিন্তু কিছুক্ষণ বাদেই লুইয়ের বুঝতে আর বাকি রইলো না, মনোনয়নে ভারিরকম গলদ থেকে গেছে। চন্দনা আনতে গিয়ে সেই ইলিশ গুলোই জালে উঠে এসেছে। 

আসলে, যাজক আর অভিজাতদের ওপর কর বসানোর ব্যাপারটা ছিলো অনেকটা ভিমরুলের চাকে ঢিল ছুড়ে মারার মতো। রাজার কর বসানোর কথাটা শুনেই অভিজাতদের সভা পাল্টা রাজাকে আক্রমণ করে বসলো। ভিমরুলরা যখন কামড়াতে আসে, সামনে পিছনে কিছুই মানে না। যাকে সামনে পায়, তাকেই আক্রমণ করে। 

অভিজাতরা ষোড়শ লুই আর ক্যালোন কে সামনে পেয়ে তাই করলো। তীব্র আক্রমণ আর বাদানুবাদে রাজা শেষ পর্যন্ত আত্মসমর্পণ করতে একপ্রকার বাধ্যই হলেন। এই ঘটনার দিন দুয়েক পর অভিজাতদের সন্তুষ্ট করতে গিয়ে ষোড়শ লুই ক্যালোনকে অর্থ মন্ত্রীর পদ থেকে সরিয়ে দিলেন। এছাড়া দূর্বল আর দিশাহীন রাজার সামনে অন্য কোন পথ খোলাও ছিলো না। রাজার এই আত্মসমর্পণ এবং দুর্বলতা দেখে অভিজাতরা যারপরনাই খুশিই শুধু হলেন না, তাদের সাহস আর বুকের বল দুটোই অনেক গুন বেড়ে গেলো। 

 নতুন অর্থমন্ত্রী ব্রিয়েন

ক্যালোন কে বিদায় করবার পর লমেনি দ্য ব্রিয়েন নামে আর একজন লোককে অর্থমন্ত্রী করে নিয়ে আসা হলো। এই লোকটা ক্যালোনের প্রস্তাব গুলোর সবগুলোই সমর্থন করলো। এর সঙ্গে আবার স্ট্যাম্প করও দাবি করে বসলো। ব্রিয়েনের প্রস্তাব গুলো অনুমোদনের জন্য আর একবার অভিজাতদের সভায় পাঠানো হলো। 

কিন্তু আগের বার যা হয়েছিলো এবারেও তাই হলো। অভিজাতদের সভা রাজার প্রস্তাব তো মানলই না, উল্টে গলা তেড়ে ঝগড়া ঝাঁটি করে জানিয়ে দিলো অভিজাতদের ওপর কর বসানোর কোন এক্তিয়ার রাজার নেই। 

এই ঘটনার পরেই বিরক্ত ও ক্রুদ্ধ লুই অভিজাতদের সভাটিকে ভেঙে ফেললেন। এরপর তিনি চাইলেই বিশেষ ক্ষমতা প্রয়োগ করে অভিজাতদের ওপর কর বসাতে পারতেন, কিন্তু সেরকম কোন কিছুই না করে লুই বাঁকা রাস্তা ধরলেন। কর প্রস্তাব গুলোর সম্মতি আদায় এবং সেগুলোকে রেজিস্টার করবার জন্য তিনি ওগুলো কে প্রাদেশিক পার্লামেন্ট বা বিচার সভা গুলোতে পাঠালেন। 

পার্লামেন্ট আর রাজার দড়ি টানাটানি 

ফ্রান্সে ১২ টি পার্লামেন্ট বা বিচারসভা ছিলো। এর মধ্যে সবথেকে বেশি ক্ষমতাশালী ছিলো প্যারিস পার্লামেন্ট। পার্লামেন্ট বা বিচার সভা গুলোতে একচেটিয়া ভাবে অভিজাতদেরই আধিপত্য ছিলো। রাজা কোন নতুন আইন প্রণয়ন করলে সেটা এই পার্লামেন্ট গুলিতে রেজিস্টার বা নথিভুক্ত করতে হতো। না হলে সেই আইন বাতিল হয়ে যেতো। 

এবার অভিজাতদের কর প্রস্তাব গুলো অনুমোদনের জন্য রাজা যেই ওগুলোকে পার্লামেন্টে পাঠালেন, অমনি পার্লামেন্ট গুলো রাজাকে তীব্র ভাবে আক্রমণ করতে শুরু করে দিলো। প্রস্তাব গুলো তারা বাতিল তো করলোই, এর ওপর রাজার ক্ষমতাকেও পাল্টা আক্রমণ করে জানিয়ে দিলো, যাজক অভিজাতদের ওপর কর বসানোর কোন অধিকার রাজার নেই। কর বসানোর একমাত্র অধিকার রয়েছে স্টেটস জেনারেলের। পার্লামেন্ট গুলো এখানেই থেমে থাকলো না। 

কর বসানোর প্রতিবাদে প্যারিশ পার্লামেন্ট অর্থমন্ত্রী ব্রিয়াকে মৃত্যুদন্ডের হুমকি পর্যন্ত দিয়ে ফেললো। এমনকি রাজা বেশি বাড়াবাড়ি করলে তার সঙ্গেও তেমন কিছু করা হবে বলে বেশ করে শাসিয়েও দেওয়া হলো। 

রাজার "Lit de justice" আর চূড়ান্ত সংঘাত

এই ঘটনা ঘটবার কদিন পরেই রেগে লাল হয়ে থাকা লুই অভিজাতদের সব পার্লামেন্ট গুলো ভেঙ্গে দিয়ে Lit de justice প্রয়োগ করে কর প্রস্তাব গুলো নথিভুক্ত করিয়ে নিলেন। 

লুইয়ের এই হটকারী পদক্ষেপে যেন আগুনে ঘি পড়লো। যে কাজটা তার আগুন জ্বলে উঠবার আগেই করা উচিত ছিলো, সেটা তিনি আগুন জ্বলে উঠবার পরে করলেন। এর ফলে যা হবার তাই হলো। দিকে দিকে অভিজাতরা বিদ্রোহ আর দাঙ্গা হাঙ্গামা শুরু করে দিলেন। শেষটায় বিদ্রোহের তীব্রতায় রাজা ভয় পেয়ে ১৭৮৮ খ্রিঃ নাগাদ পার্লামেন্ট গুলোকে পুনরায় প্রতিষ্ঠিত করবার প্রতিশ্রুতি দিলেন। এর সাথেই লুই ঘোষনা করলেন, ১৭৮৯ খ্রিঃ মে মাসের প্রথমদিকে তিনি স্টেটস জেনারেলের অধিবেশন ডাকবেন আর ওখানেই কর প্রস্তাবের বিষয় গুলো নিয়ে আলোচনা করবেন। 

স্টেটস জেনারেলের সভাঘর

রাজার বোধদয় হয়েছে ভেবে অভিজাত শ্রেনী বেশ কিছুটা নিশ্চিন্ত হলো। স্টেটস জেনারেলের সভা ডাকার ঘোষনার পরেই প্যারিস পার্লামেন্ট সাফ জানিয়ে দিলো, স্টেটস জেনারেলের অধিবেশন আগে যেমনি ভাবে চলতো, তেমনি ভাবেই  চালাতে হবে। নিয়ম কানুনের ক্ষেত্রে কোন বদল করা চলবে না। 

স্টেটস জেনারেলে তিনটি শ্রেনী আলাদা তিনটি ঘরে বসবে। তিনটি শ্রেনীর সমান সংখ্যক প্রতিনিধি স্টেটস জেনারেলে থাকবে। যা কিছু সিদ্ধান্ত নেওয়া হবে, সব ভোটের মাধ্যমেই নেওয়া হবে। ভোট আগে যেমন সম্প্রদায় ভিত্তিক ছিলো, তেমনই রাখতে হবে। 

আসলে নিজেদের বাঁচাতে এবং শ্রেনী স্বার্থ অক্ষুন্ন রাখতেই অভিজাতরা স্টেটস জেনারেলের অধিবেশন ডাকার কথা বলেছিলেন। তাদের  আসল উদ্দেশ্য ছিলো, সম্প্রদায় ভিত্তিক ভোটের সুযোগ নিয়ে রাজার সব পরিকল্পনাতে জল ঢেলে দেওয়া। 

স্টেটস জেনারেলে মোট ভোট ছিলো ৩টি। এখন স্টেটস জেনারেলে রাজা যখনই যাজক অভিজাতদের ওপর কর বসানোর প্রস্তাব রাখবেন, তখনই যাজক অভিজাতরা তার বিরুদ্ধে সম্মিলিত ভাবে ভোট দিয়ে প্রস্তাব বানচাল করে দেবেন। এরপরই দেশের স্বার্থে তৃতীয় সম্প্রদায়কে গালভরা উপদেশ দিয়ে আরেকটু বেশি বেশি কর দিতে বললেই অনায়াসে সব দুর্যোগ কেটে যাবে। 

স্টেটস জেনারেলে ঠিক কি কি করা হবে যাজক অভিজাতরা সব একেবারে পাকা করেই ফেলেছিলেন। তারা ভেবেছিলেন,  স্টেটস জেনারেলটা ডাকা করিয়ে তারা এযাত্রা বেঁচেই গেলেন। কিন্তু স্টেটস জেনারেল ডাকা করিয়ে আসলেই তারা তাদের মৃত্যুকে ডেকে আনলেন । সে গল্পটা অবশ্য এর পরের দিন বলবো... ।

চলবে... 


Post a Comment (0)
Previous Post Next Post