বাংলায় ছাপাখানার বিকাশ - বিস্তার পর্ব (১৮১৭ - ১৮৩৪)

 বাংলায় ছাপাখানার বিকাশকে আমরা ৪ টি পর্বে ভাগ করে আলোচনা করছি। ইতিমধ্যেই বাংলা ছাপাখানার সূচনা পর্ব (১৭৭৮ - ১৭৯৯), এবং বিকাশ পর্ব (১৮০০ - ১৮১৬) নিয়ে আমরা আলোচনা করেছি। আজ তৃতীয় পর্বে আমরা ছাপাখানার বিস্তার পর্ব (১৮১৭- ১৮৩৪) নিয়ে আলোচনা করবো।

বাংলায় ছাপাখানার বিকাশ - বিস্তার পর্ব (১৮১৭ - ১৮৩৪)
বাংলায় ছাপাখানার বিকাশ - তৃতীয় পর্ব 


বাংলা ছাপাখানার বিস্তার পর্ব (১৮১৭ - ১৮৩৪)

১৮১৭ খ্রিঃ থেকে ১৮৩৪ খ্রিঃ পর্যন্ত বাংলা ছাপাখানার বিকাশকে আমরা "ছাপাখানার বিস্তার পর্বের" অন্তর্ভুক্ত করতে পারি। কারন এই পর্বে বাংলা মুদ্রনের বহুমুখী বিস্তার ঘটেছিলো।

বেশ কিছু উল্লেখযোগ্য ঘটনা এই পর্বে বাংলা ছাপাখানার বিস্তারে সাহায্য করেছিলো। যেমন -
  • ১৮১৭ খ্রিঃ স্কুল বুক সোসাইটির প্রতিষ্ঠা,
  • ১৮১৮ খ্রিঃ থেকে পর ধারাবাহিক ভাবে বাংলা সাময়িকপত্র ও সংবাদপত্রের আবির্ভাব,
  • আর্ল অব ময়রা কর্তৃক ১৮১৮ খ্রিঃ সংবাদপত্র নিয়ন্ত্রন আইনের কঠোরতা হ্রাস, ইত্যাদি।
এই পর্বেই কলকাতা এবং তার আশে পাশের ছোটো বড়ো অসংখ্য দেশীয় মালিকানার ছাপাখানাকে আশ্রয় করে বাংলা মুদ্রন - প্রকাশন শিল্প ব্যবসায়িক ভিত্তিতে বিস্তৃত হতে থাকে।

স্কুল বুক সোসাইটি ও ছাপাখানা

প্রতিষ্ঠা 

ডেভিড হেয়ারের উদ্যোগে ১৮১৭ খ্রিঃ কলকাতায় "স্কুল বুক সোসাইটি" গড়ে উঠলে বাংলা মুদ্রন এবং পাঠ্যপুস্তক প্রকাশনাতে অভূতপূর্ব জোয়ার আসে।

ছাপাখানা স্থাপন ও বই প্রকাশ 

মূলত কলকাতা ও কলকাতা সংলগ্ন স্কুল গুলির পাঠ্যপুস্তক রচনা, পাঠ্যপুস্তক ছাপানো এবং বিতরনের উদ্দেশ্যেই স্কুল বুক সোসাইটির প্রতিষ্ঠা করা হয়েছিলো। ১৮১৭ থেকে টানা ১৯১২ খ্রিঃ পর্যন্ত, সোসাইটি পাঠ্যপুস্তক প্রকাশ ও পরিবেশনের সঙ্গে যুক্ত থাকে। 

বই ছাপানোর ক্ষেত্রে সোসাইটির যেমন নিজস্ব ছাপাখানা ছিলো, তেমনই সোসাইটির অনেক বই শ্রীরামপুর মিশন প্রেস থেকেও ছাপিয়ে নিয়ে আসা হতো। প্রথম চার বছরে শুধু বাংলা ভাষাতেই ১৯ টি বইয়ের ৭৯,৭৫০ টি কপি সোসাইটি মুদ্রিত করেছিলো। এই সমস্ত বই গুলি সোসাইটির নিজস্ব প্রেস থেকেই ছাপা হয়েছিলো।

পুস্তক বিপননের আধুনিক রীতি

বাংলা ছাপাখানা এবং মুদ্রনের ক্ষেত্রে স্কুল বুক সোসাইটির আরেকটি বিশেষ কৃতিত্বের দিক ছিল, বই বিপননের ব্যবস্থা করা। কলকাতা এবং জেলার বিভিন্ন স্থানে বইয়ের বিতরন কেন্দ্র স্থাপন, বিক্রেতাদের কমিশন প্রদান ইত্যাদির মধ্য দিয়ে সোসাইটি আধুনিক রীতিতে বইয়ের ব্যবসা আরম্ভ করেছিলো।

বাংলা মুদ্রনে সোসাইটির অবদান

বাংলা মুদ্রনের সংস্কার এবং উন্নতির জন্য সোসাইটি একাধিক উদ্যোগ গ্রহণ করেছিলো। যেমন -
  • ইংরেজি ভাষার মতো বাংলাতেও কমা, সেমিকোলোন এবং যতিচিহ্নের ব্যবহার, 
  • বাংলা হরফের মাত্রা গুলিকে যতটা সম্ভব সোজা করা, অর্থাৎ সোজা মাত্রার প্রচলন করা, 
  • কাঠের বদলে তামা বা অন্য ধাতুফলকের ওপর খোদাই করা. ব্লকের প্রবর্তন,
  • বাংলা বইয়ে ছবি, নকশা, মানচিত্র ও আদর্শ বাংলা লিপির মুদ্রন,
বলা বাহুল্য, চিত্রসম্ভারে সজ্জিত সোসাইটির বইগুলি ছাত্র শিক্ষক মহলে তুমুল আলোড়ন সৃষ্টি করে। পাঠ্যপুস্তকে নানা ছবি ও মানচিত্র শুধু বইকেই আকর্ষনীয় করে তোলে না। শিক্ষা গ্রহনকেও করে তোলে আরোও সহজ ও আনন্দদায়ক।

দেশ বিদেশের ইতিহাস, মানচিত্র সহ ভূগোল, জ্যোর্তিবিদ্যা, পশুপাখীর ইতিহাস, দেশবিদেশের নীতি কথা, শরীরতত্ত্ব ব্যাকরন ইত্যাদি নানা স্বাদের পাঠ্যপুস্তক রচনা করে সোসাইটি বাঙালি শিক্ষক ও ছাত্র মহলে পাশ্চাত্যের জ্ঞান বিজ্ঞানের দরজা উন্মুক্ত করে দেয়।

বাংলা সাময়িকপত্র ও ছাপাখানা

বিস্তার পর্বে বাংলা ছাপাখানার অভূতপূর্ব বিস্তারের আরেকটি বড়ো কারন ছিলো ১৮০০ খ্রিঃ থেকে পর পর ধারাবাহিক ভাবে বাংলা সাময়িকপত্র ও সংবাদপত্রের উদ্ভব। এই সময় এক একটি পত্রিকাকে কেন্দ্র করে নতুন নতুন ছাপাখানা গড়ে উঠেছিলো। যেমন -
  • বাঙ্গাল গেজেটি প্রেস (চোরবাগান),
  • চন্দ্রিকা যন্ত্র (কলুটোলা),
  • সংবাদ প্রভাকর প্রেস (সিমলা),
  • সম্বাদ সুধাকরের প্রেস (জোড়া বাগান),
  • রত্নাবলী প্রেস (বাঁশতলা গলি) ইত্যাদি।
এই সমস্ত প্রেস গুলি ছাড়াও, ছিলো বেশ কিছু মিশনারি প্রেস। শ্রীরামপুর মিশন প্রেস তো ছিলই, এর পাশাপাশি ছিলো চার্চ মিশনারি প্রেস, শিবপুরের বিশপস কলেজ প্রেস ইত্যাদি।

 মিশনারি ও সংবাদপত্র ভিত্তিক প্রেস ছাড়াও এই সময় ব্যক্তিগত ভাবে অনেকে ছাপাখানা খুলেছিলেন। এর মধ্যে অন্যতম ছিলো -
  • আড়পুলি লেনে হরচন্দ্র রায়ের ছাপাখানা,
  • শোভাবাজারে বিশ্বনাথ দেবের ছাপাখানা, 
  • লালবাজারে হিন্দুস্থানী ছাপাখানা,
  • বাঙালি প্রেস, ইত্যাদি।

ছাপাখানার বিস্তার পর্বের বৈশিষ্ট্য 

বিস্তার পর্বে বাংলা মুদ্রন ব্যবস্থার বেশ কিছু উল্লেখযোগ্য বৈশিষ্ট্য লক্ষ্য করা যায় -
  • এই সময়ে কলকাতা শহরকে কেন্দ্র করেই প্রধানত ছাপাখানা গুলি গড়ে উঠতে আরম্ভ করেছিলো।
  • ছাপার মুদ্রনশৈলীর উৎকর্ষ সাধনের চেষ্টা এই পর্বে চলেছিলো।
  • এই পর্বেই ছাপাখানা গুলির মধ্যে একটি প্রতিযোগীতার পরিমন্ডল লক্ষ্য করা যায়। কে কত ভালো অথচ অল্পমূল্যে পুস্তক ছাপতে এবং বিতরন করতে পারে,এই নিয়ে মূলত প্রতিযোগীতা চলেছিলো।
  • জ্ঞান চর্চার বিভিন্ন স্বাদের বৈচিত্র্যময় পুস্তকের প্রকাশনা এই পর্বের অন্যতম একটি বৈশিষ্ট্য ছিলো। 
  • এই পর্বেই লিথোগ্রাফিক ছাপার প্রবর্তন হয়েছিলো। 
Post a Comment (0)
Previous Post Next Post