নারী শিক্ষায় ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগরের ভূমিকা

 "নারী শিক্ষার প্রসারে" ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগরের ভূমিকার বিষয়টি পর্যালোচনা করতে হলে আমাদের ৩ টি মূল দিকের বিশ্লেষন করতে হবে, 

  1. ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগরের নারী শিক্ষা বিস্তারের মূল উদ্দেশ্য কি ছিল?
  2. নারী শিক্ষা প্রসারে পূর্ববর্তী সংস্কারকদের থেকে বিদ্যাসাগর কোন কোন দিক থেকে এগিয়ে ছিলেন? এক্ষেত্রে তাঁর মৌলিকত্ব বা অভিনবত্বের দিকগুলি কি ছিলো? 
  3. নারী শিক্ষা প্রসারের ক্ষেত্রটিকে বিদ্যাসাগর কতদূর এগিয়ে নিয়ে যেতে পেরেছিলেন?

নারী শিক্ষায় ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগরের ভূমিকা
নারী শিক্ষায় ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগরের ভূমিকা 


তবে সবার প্রথমে প্রাক্ ঔপনিবেশিক সমাজে নারীদের অবস্থা কেমন ছিলো, সেটা জানা প্রয়োজন। 

প্রাক্ ঔপনিবেশিক সমাজে নারীদের অবস্থা :-


আশ্চর্যজনক ভাবে ভারতের শিক্ষার দেবী একজন নারী হলেও, প্রাক্ ঔপনিবেশিক পর্বের বহু আগে থেকেই ভারতে মেয়েদের পড়াশোনার কোন অধিকার ছিলো না। প্রাচীন ভারতে একসময় নারী শিক্ষার প্রচলন থাকলেও, সমাজ যখন থেকে ধীরে ধীরে পুরুষতান্ত্রিক হয়ে উঠতে আরম্ভ করেছিলো, তখন থেকেই নারীকে নিষ্ক্রিয় করে অন্তপুরে ঠেলে দেওয়ার প্রবনতা লক্ষ্য করা যায়।

ঐ সময় থেকেই নারী ধীরে ধীরে শিক্ষার অধিকার হারাতে শুরু করেছিলো। শেষপর্যন্ত নারী অশিক্ষিত হয়ে পড়লে যে কোন বিষয়ে সহজেই তার কাছ থেকে আনুগত্য আদায় করা সহজ হয়ে যায়। পুরুষতন্ত্র প্রতিষ্ঠার কাজটি একই সঙ্গে সহজতর হয়ে ওঠে। এর ফলে নারী সমাজে নানা কুসংস্কার ও অন্ধবিশ্বাসের শিকার হয়ে পড়ে। যেমন কৌলিন্যপ্রথা, বাল্যবিবাহ, পুরুষের বহু বিবাহ, সতীদাহপ্রথা ইত্যাদি।

মনে রাখতে হবে, প্রচলিত সমাজের এই সমস্ত কুপ্রথা গুলি নারীদের শিক্ষার অভাবের জন্যই সমাজে বদ্ধমূল হয়ে টিকে থাকতে পেরেছিল। এইজন্য বিদ্যাসাগর নারী শিক্ষার প্রসারকে সমাজ সংস্কারের একটি অন্যতম হাতিয়ার হিসাবে গ্রহন করেছিলেন।

বিদ্যাসাগরের নারী শিক্ষা বিস্তারের উদ্দেশ্য:-

অর্থাৎ বিদ্যাসাগরের নারী শিক্ষা বিস্তারের মূল উদ্দেশ্যটি ছিলো,
  1. নারী সমাজের দীর্ঘদিনের সামাজিক কুপ্রথা গুলি দূর করা। শিক্ষার মধ্য দিয়ে নারীদের সচেতন করে তোলা।
  2. বিদ্যাসাগরের নারী শিক্ষা প্রসারের পিছনে আরোও একটি বিশেষ দিকের কথা আমরা বলতে পারি। তা হল, বিদ্যাসাগরের মানবতাবাদী দর্শন। নিপীড়িত জনের প্রতি বিদ্যাসাগরের গভীর মমত্ববোধ, সহানুভূতি, সমদর্শী দৃষ্টিভঙ্গিই তাকে নারী শিক্ষা সংস্কারে উৎসাহী করে তুলেছিল, এই বিষয়ে কোন সন্দেহ নেই। নারীদের শিক্ষিত করে বিদ্যাসাগর নারী সমাজের দীর্ঘ বঞ্চনা ও দুঃখ, দুর্দশার দিকগুলিকে দূর করতে চেয়েছিলেন

প্রাক্ বিদ্যাসাগর পর্বে নারী শিক্ষা ও  তৎকালীন সমাজের দৃষ্টিভঙ্গি:-

বিদ্যাসাগরের আগে ভারতে খ্রিষ্টান মিশনারিরাই প্রথম নারী শিক্ষার উদ্যোগ গ্রহণ করেছিলেন। শ্রীরামপুরের মিশনারিরাই এক্ষেত্রে প্রথম উদ্যোগ নিয়েছিলেন।

শ্রীরামপুর ব্যাপটিস্ট মিশনারিরা ছাড়াও, লন্ডন মিশনারি সোসাইটির উদ্যোগের বলেও একাধিক নারী শিক্ষা প্রতিষ্ঠান গড়ে উঠেছিলো। এই সমস্ত বিদ্যালয়ে অল্প সংখ্যক নারী শিক্ষা লাভের সুযোগ পেয়েছিল ঠিকই, কিন্তু মনে রাখতে হবে, এইসব মিশনারিদের মূল লক্ষ্যটি ছিলো শিক্ষার অন্তরালে খ্রিষ্টধর্মের প্রচার করা। সমকালীন সময়ে অনেকেই ভাবতেন, ঐ সমস্ত বিদ্যালয়ে (মিশনারি ইস্কুলে) পড়তে গেলে মিশনারিরা খ্রিষ্টান করে দেবে।

এই সমস্ত ধর্মভীতি ছাড়াও নারী শিক্ষা সম্পর্কে কিছু কুসংস্কারও সমাজে প্রচলিত ছিলো। মেয়েরা ইস্কুলে গেলে অল্পবয়সে বিধবা হবে, এরকম ভ্রান্ত ধারনা সমাজে প্রচলিত ছিলো।

নারী শিক্ষা প্রসারে বিদ্যাসাগরের অভিনবত্ব ও মৌলিকত্বের দিক :-

নারী শিক্ষা প্রসারে বিদ্যাসাগরের অভিনবত্বের মূল দিক গুলি ছিলো এখানেই যে -

(১.) তিনিই প্রথম সমস্ত রকমের ধর্মভীতি থেকে নারী শিক্ষাকে মুক্ত করতে সক্ষম হয়েছিলেন।

ধর্মের সঙ্গে বা শাস্ত্রের সঙ্গে নারী শিক্ষার যে কোন বিরোধ নেই, সেটি বোঝাতে তিনি বেথুন স্কুলে ছাত্রীদের পালকি গাড়ি গুলিতে মহানির্বানতন্ত্রের একটি শ্লোক লিখে দিয়েছিলেন। যেখানে বলা ছিলো - "কন্যাপ্যেবং পালনীয়া শিক্ষানীয়াতি যত্নতঃ।" অর্থাৎ পুত্রের মতো কন্যাকেও যত্ন করে পালন করতে হবে এবং শিক্ষা দিতে হবে।

আসলে বিদ্যাসাগর জানতেন, এ পোড়া দেশে অজ্ঞ, ধর্ম ভ্রু দেশবাসীর ভুল ভাঙ্গানোর জন্য শাস্ত্রের বিধান ব্যতিত কোন গতি নেই। ফলতঃ, নারী শিক্ষার প্রসারে বিদ্যাসাগর যতটা সফল হতে পেরেছিলেন, যতটা সচেতনতা সৃষ্টি করতে পেরেছিলেন, তাঁর পূর্ববর্তী সংস্কারকরা ততটা সফল হতে পারেন নি।

(২.) বিদ্যাসাগরের নারী শিক্ষা প্রসারের আরোও একটি অভিনবত্বের দিকের কথা আমরা তুলে ধরতে পারি। তা হল, নারী শিক্ষা প্রসারের ক্ষেত্রে বিদ্যাসাগর "গ্রাম" কে অধিক গুরুত্ব দিয়েছিলেন

বাস্তব জীবনের অভিজ্ঞতা থেকে বিদ্যাসাগর বুঝতে পেরেছিলেন, গ্রামীন সমাজের মেয়েরা সবচেয়ে বেশি সামাজিক শোষন ও নির্যাতনের শিকার হয়। একমাত্র শিক্ষাই পারে, তাদের এই কন্টকময় জীবন থেকে মুক্ত করতে। নারী শিক্ষা প্রসারের ক্ষেত্রে তাই একের পর এক বিদ্যালয় গুলি বিদ্যাসাগর গ্রামেই প্রতিষ্ঠিত করেছিলেন

আসলে বিদ্যাসাগর একেবারে বাস্তবের মাটি থেকে তাঁর সংস্কার আন্দোলন শুরু করেছিলেন। যার জন্য তিনি হতে পেরেছিলেন - অনেকখানি সফল ও সার্থক।

মোটকথা, "নারী শিক্ষা" বিষয়টিকে বিদ্যাসাগর সমাজে যেভাবে -
  1. গ্রহনযোগ্য করে তুলতে পেরেছিলেন,
  2. যেভাবে বিষয়টিতে জনসচেতনতা সৃষ্টি করতে সক্ষম হয়েছিলেন, 
  3. যেভাবে নারী শিক্ষার প্রচেষ্টাটিকে সারা বাংলাব্যাপী ছড়িয়ে একটি আন্দোলনের পর্যায়ে নিয়ে যেতে পেরেছিলেন, তা তাঁর আগে কোন সংস্কারকই করতে পারেন নি।
এইখানেই ছিলো নারী শিক্ষা প্রসারে বিদ্যাসাগরের মূল অভিনবত্ব এবং মৌলিকত্ব।

নারী শিক্ষায় বিদ্যাসাগরের উদ্যোগ:-

নারী জাতিকে শিক্ষিত করে তুলতে বিদ্যাসাগর শুধু অক্লান্ত পরিশ্রমই করেন নি, তার সর্বস্ব পনও করেছিলেন।

বেথুন সাহেব যখন স্ত্রী শিক্ষা প্রসারের জন্য বিভিন্ন উদ্যোগ গ্রহণ করছিলেন, তখন কুসংস্কারাচ্ছন্ন দেশবাসী তাকে নানা দিক থেকে বাধা দিচ্ছিল।

ঠিক এই সময় ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর এবং তাঁর অন্তরঙ্গ বন্ধু মদনমোহন তর্কালঙ্কার বেথুন সাহেবের পাশে এসে দাঁড়ান।

১৮৪৯ খ্রিঃ ৭ ই মে, বেথুন সাহেবের প্রচেষ্টায় ভারতবর্ষের যে প্রথম মহিলা বিদ্যালয় "বেথুন স্কুল" তৈরি হয়, তাকে সমকালীন প্রতিকূল পরিবেশের মধ্যেও এগিয়ে নিয়ে যেতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা নেন বিদ্যাসাগর।

বেথুন সাহেবের অনুরোধে বিদ্যাসাগর বেথুন স্কুলের অবৈতনিক সম্পাদকের দায়িত্ব গ্রহণ করেন। বিদ্যালয় শুরুর প্রথম দিনেই বিদ্যাসাগরের অনুরোধে মদনমোহন তর্কালঙ্কার তার দুই কন্যা ভুবনমালা এবং কন্দনমালাকে বেথুন স্কুলে ভর্তি করান। এইজন্য মদনমোহনকে গ্রামচ্যুত হতে হয়েছিলো।

তবে এই কঠিন পরিস্থিতির মধ্যেও বিদ্যাসাগর ভেঙে পড়েন নি। নারী শিক্ষা যে শাস্ত্র বা ধর্ম বিরুদ্ধ নয়, তা বোঝাতে তিনি অতঃপর বেথুন স্কুলের প্রতিটি পালকী গাড়িতে মহানির্বানতন্ত্রের একটি শ্লোক লিখে দিয়েছিলেন। যেখানে বলা ছিল -

"পুত্রের ন্যায় কন্যা সন্তানকেও পালন করতে ও শিক্ষা দিতে হবে"

১৮৫৪ খ্রিঃ উডের ডেসপ্যাচে স্ত্রী শিক্ষার ওপর গুরুত্ব দিলে বিদ্যাসাগর বিশেষ আনন্দিত হন। এর পরের বছর, ১৮৫৫ খ্রিঃ বিদ্যাসাগর স্কুল ইন্সপেক্টর নিযুক্ত হয়ে নারী শিক্ষায় জোয়ার আনেন। ১৮৫৭ খ্রিঃ থেকে ১৮৫৮ খ্রিঃ মধ্যে তিনি বর্ধমান, হাওড়া, হুগলি, বীরভূম, ২৪ পরগনা, ও মেদিনীপুরের প্রত্যন্ত গ্রামে ৩৫ টি বালিকা বিদ্যালয় তৈরি করেন। এগুলিতে মোট ১,৩০০ ছাত্রীর জন্য তিনি ব্যক্তিগত ভাবে ৩,৪০০ টাকা খরচ করেন। শুধুমাত্র এই কর্মপ্রয়াসের মধ্যেই উপলব্ধি করা যায়, বিদ্যাসাগর নারী শিক্ষার প্রসারে কতটা আন্তরিক ছিলেন।

পরবর্তীকালে বিদ্যাসাগর সরকারের কাছে ধারাবাহিক তদবির করায় সরকার এই বিদ্যালয় গুলির কিছু আর্থিক ব্যায়ভার বহন করতে রাজি হয়। 

এই বিদ্যালয় গুলি ছাড়াও, গ্রামাঞ্চলে নারীদের মধ্যে শিক্ষার প্রসারের উদ্দেশ্যে বিদ্যাসাগর বাংলার বিভিন্ন জেলায় "স্ত্রী শিক্ষা বিধায়নী সম্মিলনী" প্রতিষ্ঠা করেছিলেন। এমনকি নিজের বীরসিংহ গ্রামে মা ভগবতী দেবীর স্মৃতির উদ্দেশ্যে ১৮৯০ খ্রিঃ গড়ে তোলেন "ভগবতী বিদ্যালয়"। এটি ছিলো নারী শিক্ষায় বিদ্যাসাগরের সর্বশেষ কর্মপ্রয়াস। 

মূল্যায়ন 

নারী শিক্ষায় বিদ্যাসাগরের অক্লান্ত প্রচেষ্টা আর অসীম ইচ্ছা শক্তির ফলে বাংলার নারী শিক্ষা মহীরুহের মতো বিস্তার লাভ করে। 

(১.)বালিকা বিদ্যালয় গুলিতে মহিলা শিক্ষিকা নিযুক্তির জন্য মিস মেরি কার্পেন্টার ১৮৭২ খ্রিঃ তৈরি করেন "নর্মাল স্কুল"
(২.) ১৮৭৮ খ্রিঃ বিদ্যাসাগরের পৃষ্ঠপোষকতায় পুষ্ট বেথুন স্কুল "বেথুন কলেজে" পরিনত হয়। যার প্রথম মহিলা স্নাতক ছিলেন, কাদম্বিনী গাঙ্গুলী এবং চন্দ্রমুখী বসু। 
(৩.) ধীরে ধীরে নারী শিক্ষার প্রসারের ফলে নারীদের বাল্যবিবাহ, সতীদাহপ্রথা, পুরুষের বহু বিবাহ প্রভৃতির বিরুদ্ধেও নারীদের মধ্যে সচেতনতা তৈরি হয়। 

একথা ঠিক, বিদ্যাসাগরের প্রতিষ্ঠিত অনেক বালিকা বিদ্যালয় গুলিতে সরকারী অনুদানের অভাবে পরবর্তীকালে নিয়মিত পঠনপাঠন ব্যহত হয়েছিল। কিছু স্কুল বন্ধও হয়ে গিয়েছিলো। কিন্তু তাই বলে এক্ষেত্রে বিদ্যাসাগরের কৃতিত্বকে খাটো করে দেখবার কোন প্রয়োজন নেই। অন্ধকারে নিমজ্জিত নারী সমাজে শিক্ষার প্রদীপ জ্বেলে বিদ্যাসাগর যে মুক্তির দিশা দেখিয়েছিলেন, তা আজোও নারী মুক্তির এক এবং একমাত্র পথ। 

উনিশ শতকের অবহেলিত নারীজাতি কে "আপন ভাগ্য জয় করিবার" জন্য যে পথের সন্ধান বিদ্যাসাগর দিয়েছিলেন, তা যুগ, কালের সীমা অতিক্রম করে আজও এগিয়ে চলেছে......। 

1 Comments

Post a Comment
Previous Post Next Post