শিক্ষাব্রতী ডেভিড হেয়ার

কিভাবে একজন ঘড়ি ব্যবসায়ী থেকে ডেভিড হেয়ার এদেশের একজন মহান শিক্ষাব্রতী হয়ে উঠলেন, সেই ইতিহাসই আমরা "ইতিহাসের পাতা থেকে" নতুন করে আরও একবার জানবো। 

শিক্ষাব্রতী ডেভিড হেয়ার
শিক্ষাব্রতী ডেভিড হেয়ার 


ভারতে ইংরেজদের কর্তৃত্ব প্রতিষ্ঠার পর ভারতীয়দের জীবনধারার অনেকগুলি ক্ষেত্রে গুরুত্বপূর্ণ পরিবর্তন ঘটেছিল। এর মধ্যে একটি হলো "কাজের সময়" সম্পর্কে সচেতনতাবোধ এবং ঘড়ির ব্যবহার

ইংরেজদের ভারতে পদার্পণের আগে কৃষি আর কুটির শিল্পই ছিলো সিংহভাগ মানুষের প্রধান কাজ। সেখানে কাজের নির্দিষ্ট সময় সম্পর্কে কোন ধারনা ছিলো না। কিন্তু এদেশে ধীরে ধীরে ঔপনিবেশিক প্রশাসন গড়ে উঠতে আরম্ভ করলে নানা অফিস, আদালত, কারখানা, স্কুল, কলেজ ইত্যাদি গড়ে উঠতে আরম্ভ করে। এখানে ১০ টা - ৫টা কাজের সময়সূচি গড়ে ওঠে।খুব স্বাভাবিক ভাবেই এই সময়সূচিকে সঠিক ভাবে পালন করবার জন্য প্রয়োজন পড়লো ঘড়ির।

কলকাতা তখন কোম্পানি প্রশাসনের মূল ঘাঁটি। অভিজাত বনেদি পরিবার থেকে সাধারন মানুষ, অনেকেই তখন ঘড়ি কিনতে আরম্ভ করেছেন। ধীরে ধীরে কোম্পানির শাসনের প্রথম দিকে ঘড়ি বিক্রি এবং মেরামতি একটি লাভজনক ব্যবসা হয়ে দাড়ালো। প্রতিদ্বন্দ্বিতা তেমন ছিলো না, সুতরাং যে কয়জন এই ব্যবসায় পা রাখছিলেন, তারা সবাই অল্প দিনের মধ্যেই লাভবান হয়ে উঠছিলেন।


ডেভিড হেয়ার
ডেভিড হেয়ার


ডেভিড হেয়ারের কলকাতা পদার্পণ 

ভারতে ঘড়ির লাভজনক ব্যবসার কথা শুনে ১৮০০ খ্রিঃ কলকাতায় পদার্পণ করেন পঁচিশ বছরের এক স্কটিশ যুবক। নাম ডেভিড হেয়ার। সে সময়ে ভাগ্যান্বেষনে অনেকেই ভারতে আসতেন। ডেভিড হেয়ারও সেইরকম ভাবেই কলকাতা এসেছিলেন। উদ্দেশ্য ছিলো ঘড়ির ব্যবসা করা। কিন্তু শেষ পর্যন্ত আর পাঁচ জনের মতো ডেভিড হেয়ার ব্যবসার মধ্যে নিজেকে ডুবিয়ে রাখেন নি। তিনি হয়ে উঠেছিলেন এদেশে শিক্ষা বিস্তারের এক মহান স্থপতি। 

ভারতের সঙ্গে একাত্মতাবোধ 

ডেভিড হেয়ার ১৮০০ থেকে ১৮৪২ পর্যন্ত এদেশে ছিলেন। এই দীর্ঘ সময়কালে হেয়ার এদেশের বিভিন্ন সামাজিক আন্দোলন গুলির সঙ্গে, বিশেষত শিক্ষা বিস্তারের সঙ্গে নিজেকে একাত্ম করে ফেলেছিলেন। এর ফলে তিনি আর ঘড়ির ব্যবসাতে মন দিতে পারলেন না। ঠিক করলেন, ঘড়ির ব্যবসা বিক্রি করে দেবেন। সেই মতো ১৮২০ খ্রিঃ তিনি নিজের ঘড়ির ব্যবসা তারই সহকারী মিঃ গ্রে র কাছে বিক্রি করে এদেশে শিক্ষার প্রসারে নিজেকে সম্পূর্ণ ভাবে উজার করে দেন। 

কলকাতায় আসবার অল্প কিছুদিনের মধ্যেই হেয়ারের সঙ্গে বহু নামী অনামী মানুষদের পরিচয় হয়। অন্তরঙ্গ ভাবে তাদের সাথে মিশে এদেশের নানা কুসংস্কার, কুপ্রথা, অশিক্ষা আর জনগনের দুর্দশা দেখে হেয়ার অত্যন্ত ব্যথিত ও বিচলিত হন। অন্তরাত্মার ডাকে সাড়া দিয়ে তাই তিনি সিদ্ধান্ত নেন, কিছু একটা করতেই হবে এই পোড়া দেশের অসহায় মানুষ গুলোর জন্য। তিনি অনুভব করেন, একমাত্র শিক্ষাই পারে এদেশের জনসাধারণের নানা কুসংস্কার এবং দুর্দশার অবসান ঘটাতে। এই জন্যই বোধ হয় এদেশে শিক্ষা বিস্তারের কাজে হেয়ার তার সমস্ত শক্তি এবং সম্পদ নিয়োজিত করেছিলেন। 

হেয়ারের শিক্ষা সংস্কারের আদর্শ ও অভিনবত্ব

উনিশ শতকে এদেশে শিক্ষা বিস্তারে অনেকেই এগিয়ে এসেছিলেন। কিন্তু এদের কেউই ডেভিড হেয়ারের মতো শিক্ষার জন্য অকাতরে টাকা খরচ করেন নি। এইসব সংস্কারকদের সঙ্গে হেয়ারের আদর্শগত পার্থক্যও ছিল। 
  • ডেভিড হেয়ারের সময় যারা শিক্ষা বিস্তারে এগিয়ে এসেছিলেন, তাদের মধ্যে কেউ ধর্মের ধ্বজাবাহক তৈরি করতে চেয়েছিলেন, কেউবা আবার ইংরেজদের অন্ধ তল্পিবাহক গড়তে চেয়েছিলেন। ডেভিড হেয়ার কিন্তু এই দুটোর কোনটাই চান নি। তিনি চেয়েছিলেন, ছাত্ররা প্রকৃত আধুনিক জ্ঞান বিজ্ঞানের শিক্ষায় আলোকিত হয়ে উঠুক। 
  • শিক্ষা সংস্কারে হেয়ারের আরেকটি বিশেষ দিক ছিলো যে, তিনি কখনোই শিক্ষাকে ধর্মীয় বিষয়ের সঙ্গে গুলিয়ে ফেলতে রাজি ছিলেন না। নিজে ব্যক্তিগত ভাবে খ্রিষ্টধর্মাবলম্বী হলেও, শিক্ষার ভিতর দিয়ে খ্রিষ্ট ধর্মের প্রচারের তিনি ঘোর বিরোধী ছিলেন। তার সময়ে একদল দেশীয় সংস্করক বেদান্ত শিক্ষার প্রসারে সোচ্চার হলেও তিনি তাকে সমর্থন করেন নি। একবার শিক্ষা সংক্রান্ত এক আলোচনা সভায় রামমোহন রায় ডেভিড হেয়ারের কাছে বেদান্ত বিদ্যালয় স্থাপনের প্রস্তাব দিলে হেয়ার তার বিরোধিতা করেন। 
  • শিক্ষা বিস্তারে রামমোহনের দৃষ্টিভঙ্গি যেখানে হিন্দু শিক্ষার্থীদের মধ্যেই আবদ্ধ ছিলো। সেখানে ডেভিড হেয়ার জাতি, ধর্ম, বর্ণ নির্বিশেষে সকল সম্প্রদায়ের জন্য আধুনিক শিক্ষার স্বপ্ন দেখতে পেরেছিলেন। আসলে ডেভিড হেয়ার শিক্ষার মধ্য দিয়ে কোন একটি জাতি বা সম্প্রদায়ের শিক্ষার কথা ভাবেন নি। শিক্ষার মধ্য দিয়ে তিনি সমগ্র মানবসমাজের মনুষ্যত্ববোধের জাগরন ঘটাতে চেয়েছিলেন। 
  • তার সময়ে অনেকেই পাশ্চাত্য শিক্ষাকে কেরানি সৃষ্টির দৃষ্টিভঙ্গি তে দেখেছিলেন এবং মেপেছিলেন। হেয়ার কিন্তু কখনই শিক্ষাকে এত সংকীর্ণ গোন্ডির মধ্যে বাঁধতে চান নি, অথবা দেখতেও চান নি। শিক্ষা সংস্কারে তার আদর্শ ছিলো সবার জন্য চাই প্রকৃত শিক্ষা যে শিক্ষার ভিত হবে ধর্মনিরপেক্ষ। তার উদ্দেশ্য হবে মনুষ্যত্ববোধের জাগরন ঘটানো।
আসলে এদেশে পাশ্চাত্য তথা আধুনিক শিক্ষার প্রসারে অন্যান্য শিক্ষা সংস্কারকদের মতো ডেভিড হেয়ারের অবদান কখনোই গুটিকতক শিক্ষা প্রতিষ্ঠান প্রতিষ্ঠার কৃতিত্বের মধ্যেই সীমাবদ্ধ ছিল না। উনিশ শতকে শিক্ষা সংস্কারে ডেভিড হেয়ার বিভিন্ন শিক্ষা প্রতিষ্ঠান প্রতিষ্ঠার সাথে সাথে যে স্বচ্ছ, উদার, মুক্ত, ধর্ম নিরপেক্ষ আধুনিক মননের বিজ বপন করে যেতে সক্ষম হয়েছিলেন, তা তার সমকালীন কোন সংস্কারকরাই করতে পারেন নি। 

আর ঠিক এই কারনেই সমকালীন শিক্ষা সংস্কারকদের থেকে হেয়ার শুধু যে সফলভাবে কয়েকযোজন এগিয়ে থাকতে পেরেছিলেন, তাই নয়, তিনি পরবর্তীকালে প্রগতিশীল শিক্ষা চিন্তকদের কাছেও পথপ্রদর্শক হয়ে উঠেছিলেন। 

হিন্দু কলেজ প্রতিষ্ঠার উদ্যোগ

ঘড়ির ব্যবসার সূত্র ধরে হেয়ারের সঙ্গে সমকালীন সময়ের অনেক প্রখ্যাত ব্যক্তিরই সাক্ষাৎ ঘটে। যাদের মধ্যে অন্যতম ছিলেন রাজা রামমোহন রায়, প্রিন্স দ্বারকানাথ ঠাকুর, রাজা রাধাকান্ত দেব, বৈদনাথ মুখোপাধ্যায় প্রমুখ। এই সমস্ত ব্যক্তিদের সাথে বিভিন্ন বিষয় নিয়ে প্রায়ই হেয়ারের নানা গভীর আলোচনা হতো। এই আলোচনা গুলি থেকে এদেশের কল্যানের জন্য একটি উন্নত আধুনিক শিক্ষা প্রতিষ্ঠান প্রতিষ্ঠার উপলব্ধির কথা উঠে আসে। বলা বাহুল্য, ১৮১৭ খ্রিঃ হিন্দু কলেজের প্রতিষ্ঠা এই উপলব্ধিরই ফলশ্রুতি ছিলো। 

১৮১৬  খ্রিঃ ২১ মে, ডেভিড হেয়ার কলকাতায় একটি সভা আহ্বান করেন। এই সভাতেই আধুনিক শিক্ষা বিস্তারের জন্য কলকাতায় হিন্দু কলেজ স্থাপনের সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়। হেয়ারের প্রচেষ্টায় এই উদ্যোগে রাধাকান্ত দেব, রামমোহন রায়, দেওয়ান বৈদনাথ মুখোপাধ্যায়, বিচারপতি স্যার এডোয়াড হাইড সামিল হন। সকলের উদ্যোগে ও সম্মতিতে যখন হিন্দু কলেজ প্রতিষ্ঠার সিদ্ধান্ত প্রায় পাকা, সেই অবস্থায় এই উদ্যোগে রামমোহনের যুক্ত থাকার বিষয়টিতে একদল রক্ষণশীল বেঁকে বসলেন। ফলে সমস্ত পরিকল্পনা বানচাল হয়ে যাওয়ার উপক্রম হলো। 

এই অবস্থায় ত্রাতার ভূমিকায় অবতীর্ণ হলেন স্বয়ং হেয়ার। রামমোহন কে সসস্মানে এই উদ্যোগে সম্পর্কছেদে তিনি রাজী করালেন। অবশেষে ১৮১৭ খ্রিঃ ২০ জানুয়ারি, গরানহাটার গোরাচাঁদ বসাকের বাড়িতে হিন্দু কলেজের উদ্বোধন হয়। পরবর্তীকালে কলেজটি চিৎপুরে রূপচরন রায়ের বাড়িতে স্থানান্তরিত হয়। 

কলেজের জন্য জমি দান

ডেভিড হেয়ার কলেজ স্কোয়ারের উত্তরদিকে তার যে জমিটি ছিলো, সেটা হিন্দু এবং সংস্কৃত কলেজের জন্য দান করেন। ১৮২৪ খ্রিঃ ২৫ ফেব্রুয়ারি, এই জমিতেই কলেজ ভবনের ভিত্তি প্রস্তর স্থাপিত হয়। হিন্দু কলেজের পরিচালন সমিতিতে হেয়ারকে করা হয় অন্যতম সদস্য। 

কলকাতা স্কুল সোসাইটি প্রতিষ্ঠা

হিন্দু কলেজ প্রতিষ্ঠার পর কলেজ কে এগিয়ে নিয়ে যাওয়ার জন্য কলেজের উপযোগী ছাত্রের প্রয়োজন দেখা দিলো। এই অবস্থায় উপযুক্ত ছাত্র তৈরির জন্য হেয়ারের উদ্যোগে ১৮১৮ খ্রিঃ সেপ্টেম্বর মাসে প্রতিষ্ঠিত হয় "কলকাতা স্কুল সোসাইটি"। 

কলকাতা স্কুল সোসাইটির অন্যতম উদ্দেশ্য ছিল - 
  • কলকাতার পাঠশালা গুলির মান উন্নয়ন করা। 
  • শিক্ষার প্রসার ঘটানো। 
  • নতুন নতুন স্কুল প্রতিষ্ঠা করা। 
  • কলকাতার ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা পাঠশালা গুলিকে নিয়ন্ত্রনে নিয়ে আসা। 
এদেশে প্রাথমিক শিক্ষার বিকাশে স্কুল সোসাইটি গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা নিয়েছিলো। দরিদ্র মেধাবী ছাত্ররা সোসাইটির ব্যয়ে হিন্দু কলেজে পড়াশোনা করবার সুযোগ পেতো। হেয়ার সকাল থেকে সন্ধ্যা পর্যন্ত সোসাইটির অধীন বিভিন্ন স্কুল গুলি পরিদর্শন করতেন। তিনি ছাত্রদের মায়ের মতোই স্নেহ করতেন। তাদের অভাব অভিযোগ ও অসুবিধার দিক গুলি জেনে তৎক্ষণাৎ তা সমাধান করার চেষ্টা করতেন। 

হেয়ার স্কুল প্রতিষ্ঠা 

দরিদ্র ছাত্রদের ব্যাপারে হেয়ারের উদ্যোগ ছিলো লক্ষ্য করবার মতো। অর্থ যাতে শিক্ষার পথে অন্তরায় হয়ে না দাঁড়ায় সেই জন্য দরিদ্র ছাত্রদের জন্য তিনি প্রতিষ্ঠা করেন সিমলা পাঠশালা, পটলডাঙ্গা স্কুল এবং আরপুলি পাঠশালা। 

স্কুল সোসাইটির অর্থের জোগান দিতো "ম্যাকিনটোস অ্যান্ড কোং"। কিন্তু এই কোম্পানি বন্ধ হয়ে গেলে স্কুল গুলির ব্যায়ভার চালানো মুশকিল হয়ে ওঠে। এই অবস্থায় অনেকগুলি স্কুলকে একসঙ্গে মিশিয়ে দেওয়ার উদ্যোগ নেওয়া ছাড়া আর কোন বিকল্প পথ খোলা ছিলো না। এরই ফলে ডেভিড হেয়ারের উদ্যোগে ১৮১৮ খ্রিঃ আরপুলি স্কুল এবং পটলডাঙ্গা স্কুলকে একত্রিত করে দেওয়া হয়। জন্ম হয় হেয়ার স্কুলের। 

কলকাতা স্কুল বুক সোসাইটি প্রতিষ্ঠা 

শিক্ষা বিস্তারে হেয়ারের আরেকটি অসামান্য উদ্যোগ ছিলো কলকাতা স্কুল বুকের প্রতিষ্ঠা। স্কুল সোসাইটির একবছর আগেই অবশ্য ১৮১৭ খ্রিঃ কলকাতা স্কুল বুক সোসাইটির প্রতিষ্ঠা হয়। 

স্কুল বুক সোসাইটির প্রধান উদ্দেশ্য ছিলো - ছাত্রদের পাঠের উপযোগী ইংরেজি ও দেশীয় ভাষায় পাঠ্যপুস্তক রচনা, মুদ্রন এবং তার বিতরন করা। 

সমকালীন সময়ে শিক্ষার প্রসারে এটি এক গভীর ও সুদূরপ্রসারী প্রভাব ফেলেছিল। মনে রাখতে হবে, আমাদের আলোচ্য সময়ে প্রাথমিক বা শিশু পাঠের উপযোগী কোন বই সেই অর্থে ছিলো না। এক্ষেত্রে সোসাইটি এক গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা নিয়েছিলো। 

মেডিক্যাল কলেজ প্রতিষ্ঠায় সাহায্য 

১৮৩৫ খ্রিঃ জুন মাসে কলকাতা মেডিক্যাল কলেজের প্রতিষ্ঠা হয়। এই কলেজকে সমকালীন রক্ষনশীল প্রতিকূল পরিবেশ থেকে বিকশিত করবার ক্ষেত্রেও হেয়ার গুরুত্বপূর্ণ অবদান রাখেন। 

মেডিক্যাল কলেজ প্রতিষ্ঠিত হওয়ার পর হেয়ার তার ছাত্র জোগাড় করে দিয়েছিলেন। মেডিক্যাল কলেজের প্রথম অধ্যক্ষ ছিলেন এম. জে. ব্রামলি। ১৮৩৭ খ্রিঃ তার মৃত্যুর পর কলেজ পরিচালনার জন্য অধ্যাপকদের নিয়ে একটি কাউন্সিল গঠিত হয়েছিলো। ডেভিড হেয়ার এই কাউন্সিলের সেক্রেটারি মনোনীত হন। এরপর হেয়ারের হাত ধরে কলকাতা মেডিক্যাল কলেজের পরিকাঠামোতে অভূতপূর্ব বিকাশ ঘটতে থাকে। 

ডেভিড হেয়ারের উদ্যোগে ১৮৩৮ খ্রিঃ ২০ টি এবং ১৮৩৯ খ্রিঃ আরো ৬০ টি অর্থাৎ মোট ৮০ শয্যার একটি হাসপাতাল ভবন তৈরি করা হয় এবং সেই হাসপাতালেই ছাত্রদের চিকিৎসা বিদ্যা শিক্ষার ব্যবস্থা করা হয়। ১৮৪১ খ্রিঃ ডেভিড হেয়ার মেডিক্যাল কলেজের সেক্রেটারি পদ থেকে পদত্যাগ করলেও, মেডিক্যাল কলেজে তার অসামান্য অবদানের জন্য সরকার হেয়ারকে মেডিক্যাল কলেজের "অনারারী মেম্বার" নিযুক্ত করেন। 

প্রথম শবব্যবচ্ছেদ এবং হেয়ারের ভূমিকা 

মেডিক্যাল কলেজ প্রতিষ্ঠার পর যখন প্রথম শবব্যবচ্ছেদের সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়, তখন রক্ষনশীল হিন্দুরা রে রে করে ওঠে।
 তারা সমবেত হয়ে মেডিক্যাল কলেজ ভবনে বিক্ষোভ দেখায়। 
হিন্দু ধর্মে মৃতদেহ স্পর্শ বা শবব্যবচ্ছেদ সম্পূর্নই ধর্মবিরুদ্ধ বলে রক্ষনশীলরা মনে করতেন। শবব্যবচ্ছেদের প্রশ্নে যখন কলকাতা দিশেহারা, তখনও ত্রাতার ভূমিকায় এগিয়ে আসেন হেয়ার। তিনি চিকিৎসা বিজ্ঞানে শবব্যবচ্ছেদের প্রয়োজনীয়তা এবং যৌক্তিকতার দিকটি তৎকালীন সমাজের নেতৃস্থানীয় ব্যক্তিদের বোঝান। তাঁর এই উদ্যোগের ফলে রক্ষনশীল সমাজের প্রধান নেতা রাধাকান্ত দেবের মতো অনেকে শুধু যে শবব্যবচ্ছেদকে সমর্থন করলেন তাই নয়, চিকিৎসা শিক্ষা এবং উচ্চ শিক্ষার জন্য ছাত্রদের সমুদ্রপার বা বিদেশযাত্রাকেও সমর্থন করলেন। 

হেয়ারের শেষ জীবন

মেডিক্যাল কলেজের সেক্রেটারি থাকাকালীন হেয়ার প্রত্যেকদিন অফিসের কাজ ছাড়াও, নিয়মিত প্রতিটি রোগীর খবর নিতেন। তাদের ওষুধপত্রের ব্যবস্থা করতেন। বাড়িতে খবর পাঠানোর ব্যবস্থা করতেন। এছাড়াও কলেজে পাঠরত ছাত্রদের নানা সুবিধা অসুবিধা গুলিও তিনি নিজে দেখতেন এবং তার সমাধানের চেষ্টা করতেন। 

মনে রাখতে হবে, মেডিক্যাল কলেজের এই সমস্ত গুরুদায়িত্বের পাশাপাশি হেয়ার নিয়মিত স্কুল সোসাইটির বিদ্যালয় গুলি পরিদর্শন করতেন। হিন্দু কলেজের নানা কাজকর্মে সামিল হতেন। এমনকি, বিভিন্ন সভা সমিতিতে অংশ নিতেন। হেয়ারের এই প্রাত্যহিক কর্মসূচি থেকে বোঝা যায় তিনি কতটা পরিশ্রমী ছিলেন, সর্বোপরি এদেশের কল্যানে কতটা নিজেকে উজাড় করে দিয়েছিলেন। 

জীবন সায়াহ্নে শিক্ষা এবং জনহিতকর নানা কাজে অর্থ সাহায্য করে হেয়ার একেবারে নিঃস্ব হয়ে পড়লে সরকার তাকে ১৮৪০ খ্রিঃ ছোট আদালতের কমিশনার পদে নিযুক্ত করেন। শিক্ষাব্রতী হেয়ারকে শিক্ষা বিভাগের বাইরের কাজে নিয়োগ করা ছিলো, নিঃসন্দেহে সরকারের এক অমানবিক পদক্ষেপ। 
যতদিন বেঁচে ছিলেন, হেয়ার প্রগতিশীল এবং রক্ষনশীল - দুই শিবিরের ব্যক্তিদের সঙ্গেই ঘনিষ্ঠভাবে মিশতেন। সকলের কাছেই তিনি অত্যন্ত প্রিয় ছিলেন। দুই শিবিরের দ্বন্দ্বে কখনো তিনি নিজেকে জড়িয়ে ফেলেন নি। বাঙালিদের মতোই তিনি ধুতি পাঞ্জাবী পড়তেন। বাঙালিদের সঙ্গে ঘনিষ্ঠ ভাবে মিশে আদব কায়দায় তিনি নিজেকে আদ্যান্ত বাঙালি করে তুলেছিলেন। আর তার এই সমস্ত কাজকর্ম গুলির জন্য তিনি একসময় রক্ষনশীল খ্রিষ্টান মিশনারিদের চক্ষুশূল হয়ে পড়েন। পরিনামে শেষজীবনে খ্রিষ্টানদের কবরস্থানে তাঁর সমাহিত হওয়ার কোন স্থান জুটে নি। 

কথিত আছে, কোনোও এক কলেরা রুগিকে সেবা করতে গিয়ে হেয়ার নিজেই কলেরায় আক্রান্ত হন। ১৮৪২ খ্রিঃ ১জুন,এক দুর্যোগপূর্ন দিনে হেয়ার চিরদিনের মতো এই দেশ ছেড়ে চলে গেলেন অমৃতলোকে। সেদিনের সেই প্রাকৃতিক দুর্যোগপূর্ন দিনে কলকাতায় তার শবদেহ নিয়ে যে শোকযাত্রা বের হয়, তাতে প্রায় পাঁচ হাজার লোক সমবেত হয়। এই বিপুল জনসমাগম থেকে বোঝা যায়, হেয়ার তার কাজের মধ্য দিয়ে এদেশের মানুষের হৃদয়ের কতটা কাছে পৌঁছে যেতে পেরেছিলেন। 


কিন্তু হেয়ারের শিক্ষা ও সমাজ সংস্কার মূলক কাজগুলিকে ইওরোপীয় সমাজ কোনদিনই সমর্থন করে নি। এদেশের লোকেদের সঙ্গে তাঁর ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক এবং আত্মীয়তাকে তারা ভালো নজরে দেখে নি। তাই হেয়ারের মৃত্যুর পর তাঁর মৃতদেহকে তারা তাদের সমাধিভূমিতে সমাহিত করতেও দেয় নি। এবং এইভাবেই তারা হেয়ারের ওপর শেষ পদাঘাতটি হেনেছিলেন। নির্মম, নিষ্ঠুর এক পরিনতির মধ্য দিয়ে শেষ হল এক মহাজীবনের। 

এই ঘটনাকে স্মরণীয় করে রাখতে আহত কবি সত্যেন্দ্রনাথ দত্ত তার "ডেভিড হেয়ার" কবিতায় লিখলেন - 

"কুড়িয়ে পথের রোগী, সংক্রামকে দিলে তুমি প্রান
তবুও নাস্তিক তুমি! ও অস্থি নেবে না গোরস্থান!" 



(গ্রন্থঋন এবং বিশেষ কৃতজ্ঞতা স্বীকার - ডেভিড হেয়ার দ্বিশতবর্ষ স্মারক গ্রন্থ।) 

     




Post a Comment (0)
Previous Post Next Post