আজকের সংবাদপত্র হলো "বিগত দিনটির একটি জীবন্ত ইতিহাস"। খুব স্বাভাবিক ভাবেই ইতিহাস চর্চায় সংবাদপত্রকে একটি গুরুত্বপূর্ণ উপাদান বলে ঐতিহাসিকরা মনে করে থাকেন।
সংবাদপত্রে সমকালীন সময়ের গুরুত্বপূর্ণ খবর গুলিই শুধু প্রকাশিত হয় না, সমাজের পরিবর্তিত নানা ভাবনা, সংস্কার, সমাজ বদলের নানা খুঁটিনাটি দিকগুলো প্রকাশিত হয়। এককথায়, সংবাদপত্র সমাজ বিশ্লেষনের সুযোগ করে দেয়। যেকোন সময়ের সমাজকে বোঝবার জন্য তাই সংবাদপত্র অত্যন্ত উপযোগী একটি ঐতিহাসিক মাধ্যম বলে বিবেচিত হয়।
|
উনিশ শতকের সাময়িকপত্র ও সংবাদপত্র |
বোল্টসের সংবাদপত্র প্রকাশের চেষ্টা :-
আমাদের দেশে সংবাদপত্রের যাত্রাটি শুরু হয়েছিলো ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির শাসনের প্রথম দিকে, ১৭৮০ খ্রিঃ। তবে তাঁর অনেক আগে ১৭৬৬ খ্রিঃ কলকাতায় ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির এক ওলন্দাজ কর্মচারী উইলিয়াম বোল্টস কলকাতা থেকে প্রথম ভারতীয় সংবাদপত্র প্রকাশের ইচ্ছা প্রকাশ করেন। কিন্তু তার ইচ্ছার অঙ্কুরেই বিনাষ ঘটে।
সংবাদপত্র প্রকাশের বিজ্ঞপ্তি শোনা মাত্রই তৎকালীন গর্ভনর ভাস্ট তৎক্ষণাৎ বোল্টসকে ভারত ছেড়ে চলে যাবার নির্দেশ দেন।
সংবাদপত্র প্রকাশে কোম্পানির অনীহা :-
আসলে কোম্পানি প্রথম দিকে ভারতে কোনোমতেই সংবাদপত্র প্রকাশ করতে রাজি ছিলো না।
(১.) শুরুর দিকে ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির কর্মচারীদের মধ্যে দুর্নীতি, অর্ন্তদ্বন্দ্ব, ষড়যন্ত্র প্রায়ই লেগে থাকতো। কোম্পানি কখনই চায় নি, তাদের সেই দুর্বলতার জায়গাগুলি ভারতীয়রা অথবা অন্যান্য প্রতিদ্বন্দ্বী বিদেশী শক্তিগুলি জেনে যাক। ভারতে সংবাদপত্র প্রকাশ করতে না দেওয়ার এটা একটা বড়ো কারন ছিলো
(২.) সংবাদপত্রের মধ্যে এমন কোন সংবাদ বের হতে পারে, যা ভারতীয়দের প্রবলভাবে অসন্তুষ্ট করতে পারে। এই আশঙ্কাতেও কোম্পানি সংবাদপত্র প্রকাশ করতে দিতে চাই নি।
(৩.) আবার কোম্পানি এমন আশঙ্কাও করেছিলো, ইংল্যান্ড বা ইওরোপের মতো মুক্ত চিন্তা এবং উদার নৈতিক চিন্তা ভারতে সংবাদপত্রের মাধ্যমে ছড়িয়ে পড়তে পারে।
সংবাদপত্র প্রকাশের অনুকূল পরিবেশ :-
তবে মনে রাখতে হবে, কোম্পানি কিন্তু সংবাদপত্র প্রকাশের সম্ভবনাকে বেশিদিন আটকে রাখতে পারে নি। পলাশীর যুদ্ধ এবং দেওয়ানী লাভের পর কোম্পানির ভিত একটু একটু করে শক্ত হচ্ছিলো।
ইতিমধ্যেই কলকাতা কোম্পানি শাসনের প্রধান কেন্দ্র হিসাবে স্বীকৃতি লাভ করে। ইওরোপ থেকে প্রতি জাহাজে অনেক ব্যক্তি ব্যবসা বাণিজ্যের জন্য কলকাতায় ভিড় বাড়াচ্ছিলেন। অনেক ইওরোপীয় পাকাপাকি ভাবে কলকাতাতেই বাস করতে আরম্ভ করছিলেন। মোটকথা কলকাতা একটি সমৃদ্ধ শহর হিসাবে ধীরে ধীরে গড়ে উঠতে আরম্ভ করেছিলো।
ইওরোপীয়দের ভিড় বাড়ার ফলে, ইওরোপের মতোই ভারতে সামাজিক যোগাযোগের অন্যতম মাধ্যম হিসাবে সংবাদপত্রের অভাব অনুভূত হতে লাগলো। অবস্থার পরিবর্তন ঘটলো ওয়ারেন হেস্টিংসের আমলে।
ওয়ারেন হেস্টিংস ভারতের গভর্নর জেনারেল হয়ে কলকাতায় আসেন। তিনি অত্যন্ত উদারমনা ছিলেন। তার আমলেই ভারতের প্রথম সংবাদপত্রের আত্মপ্রকাশ ঘটে।
হিকির কলকাতা আগমন ও ছাপাখানা স্থাপন :-
হেস্টিংস যেবছর ভারতের গভর্নর হয়ে এলেন, ঐ বছরটিতেই ইংল্যান্ডের ব্যাকিংহাম থেকে জেমস্ অগাস্টাস হিকি নামে একজন ভাগ্যান্বেষী যুবক কলকাতায় আসেন। সে সময় ভাগ্যান্বেষনে অনেক ব্যক্তিই ভারতে আসতেন।
হিকি কয়েক বছর ব্যবসা বানিজ্য চালিয়ে কোম্পানির কাছে বেশ পরিচিত ব্যক্তি হয়ে উঠেছিলেন। বেশ কিছু টাকা পয়সা জমিয়ে তিনি এরপর একটি জাহাজ কিনেছিলেন।
দুর্ভাগ্যবশত, জাহাজ ডুবির ফলে অল্পদিনের মধ্যেই হিকি সর্বস্বান্ত হয়ে গিয়েছিলেন। জাহাজ কিনতে গিয়ে তার অনেক টাকা দেনা হয়েছিলো। ইতিমধ্যেই পাওনাদারেরা টাকা চাইতে গেলে হিকির সঙ্গে তাদের বিরোধ দেখা দেয়। ফলে পাওনাদারেরা টাকা না পেয়ে হিকির নামে মামলা ঠুকলেন। বিচারে হিকির কয়েকবছর জেল হয়।
শোনা যায়, জেলখানাতে থাকাকালীন অবস্থাতে হিকি ছাপাখানা সম্পর্কে একটি বই পড়েছিলেন। বইটি পড়ে তিনি ছাপাখানার ব্যবসা করবেন বলে ঠিক করেন। ছাপাখানা অল্প পুঁজিতে খুবই লাভজনক ব্যবসা বলে হিকির মনে হয়েছিলো। যাইহোক, জেল থেকে মুক্তিলাভের পর হিকি ইংল্যান্ড থেকে২০০০ টাকা দিয়ে একটি ছাপাখানা কিনে আনেন।
ছাপাখানাতে হিকির ভরাডুবি :-
প্রথমদিকে হিকির প্রেস ভালোই চলছিলো। হিকি সমস্ত সরকারি ছাপার কাজই বরাত পেতে থাকলেন। কিন্তু তার এই সুখ বেশিদিন সইলো না।
ইতিমধ্যে ওয়ারেন হেস্টিংসের পৃষ্ঠপোষকতায় দুজন ইংরেজ সিভিলিয়ান হ্যালহেড এবং উইলকিনস সরকারি ছাপাখানা প্রতিষ্ঠা করেন। উইলকিনস সরকারি প্রেস থেকেই সমস্ত সরকারি কাজের বরাত দেওয়ার কথা বললেন। হেস্টিংস তাকে সমর্থন করলেন। এর ফলে হিকির সরকারি অর্ডার গুলি বিশেষত, আর্মির কাজের বরাতগুলি বাতিল হয়ে যায়।
এই প্রসঙ্গে একটা ঘটনার কথা বলতেই হয়। ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির আর্মির প্রধান আয়ারকূটের সঙ্গে হিকির সম্পর্ক যথেষ্ট ভালো ছিলো। এই সুবাদে কূট হিকিকে মিলিটারি ছাপার কাজের তত্ত্বাবধায়ক টমাস জোনসের সঙ্গে পরিচয় করিয়ে দেন। এই সময় জোনস হিকিকে একগাদা ছাপার বরাদ দিয়েছিলেন। কিন্তু ইতিমধ্যেই সরকারি নির্দেশ এসে পৌঁছায় যে, সরকারি সমস্ত ছাপার কাজ সরকারি প্রেস থেকেই হবে।
এর ফলে হিকি মহা বিপদে পড়লেন। কারন ইতিমধ্যেই নতুন বরাতটির প্রায় অর্ধেক কাজ হিকি করে ফেলেছিলেন। এর জন্য হিকির প্রচুর ধার দেনাও হয়। ৩৫ হাজার ৯২ টাকার ছাপার কাজ ইতিমধ্যেই তিনি করে ফেলেছিলেন।
এবার হিকি এই টাকা চাইতে গেলে শুরু হয়ে যায় দায় এড়ানোর পালা। বেশ কিছুদিন ফাইল চালাচালি হতে লাগলো। শেষে জানা গেলো ঐ অর্ডারে বোর্ডের কোন অ্যাপ্রুভালই নেই। মোটকথা, হিকি টাকা পেলেন না। তার দেনার পরিমান বাড়লো।
এমন ঘটনায় হিকি স্বভাবতই কোম্পানির কর্তাদের ওপর চোটে গেলেন। প্রেসের কাজ বন্ধ হয়ে গেলে উপার্জনের তাগিদে হিকি এরপর সংবাদপত্র বের করবার কথা ভাবলেন।
ভারতের প্রথম সংবাদপত্রের আত্মপ্রকাশ :-
ভাবলেন এবং অল্পদিনের মধ্যেই ১৭৮০ খ্রিঃ প্রকাশ করেন তার পত্রিকা "বেঙ্গল গেজেট"। এই পত্রিকাটি ছিলো ভারতের প্রথম সংবাদপত্র।
"বেঙ্গল গেজেট" ইংরেজি ভাষায় প্রকাশিত একটি চার পাতার ট্যাবলয়েট ছিলো। পত্রিকাটি প্রতি শনিবার বের হতো। এতে অর্ধেক খবর আর অর্ধেক বিজ্ঞাপন থাকতো। সমকালীন কোম্পানির কর্তাব্যক্তিদের অনৈতিক জীবন, দুর্নীতি, কেচ্ছা, কেলেঙ্কারির নানা চুটকি খবর এতে প্রকাশ পেতো। হিকি নিজেই সাংবাদিক, নিজেই সম্পাদক এবং প্রকাশক ছিলেন। বেঙ্গল গেজেটে হিকি কাউকেই ছেড়ে কথা বলতেন না। সুপ্রিমকোর্টের প্রধান বিচারপতি এলিজা ইম্পে থেকে গর্ভনর জেনারেল ওয়ারেন হেস্টিংস, হেস্টিংসের বউ কাউকেই হিকি বাদ দেন নি।
ফলে খুব অল্প দিনের মধ্যেই হিকি কোম্পানির রোষানলে পড়ে গেলেন। হেস্টিংস রেগেমেগে হিকির বিরুদ্ধে মানহানির মামলা ঠুকলেন। মামলায় হিকি দোষী সাব্যস্ত হন। তার প্রচুর টাকা জরিমানা হয়। ছাপাখানা বাজেয়াপ্ত করা হয়। জরিমানার টাকা দিতে না পারায় হিকির জেল হয়। অনেক চেষ্টা করেও হিকি শেষ পর্যন্ত বেঙ্গল গেজেটে কে বাঁচিয়ে রাখতে পারেন নি।
হিকি পরবর্তী সংবাদপত্রের মধ্যযুগ(১৭৮০ - ১৮১৭):-
বেঙ্গল গেজেটকে বাঁচিয়ে রাখতে না পারলেও, ভারতীয় সংবাদপত্রের ইতিহাসে হিকি যে প্রদীপ জ্বালিয়ে দিতে পেরেছিলেন, তার ফলে পরবর্তীকালে একের পর এক সংবাদপত্র প্রদীপের শিখার মতো জ্বলে ওঠে। ভারতের তৎকালীন প্রেক্ষাপটে যে সংবাদপত্র প্রকাশ করা সম্ভব। সংবাদপত্র যে লাভজনক ব্যবসার একটি দিক হতে পারে, সেটি হিকি প্রমান করে দিতে পেরেছিলেন।
এর ফলস্বরূপ, ১৭৮০ থেকে ১৮১৭ পর্যন্ত সময়কালে বেশ কয়েকটি সংবাদপত্র একের পর এক বের হতে শুরু করে। মাদ্রাজ ও বোম্বাই প্রেসিডেন্সি থেকেও সংবাদপত্র প্রকাশিত হতে থাকে।
১৭৮০ খ্রিঃ প্রকাশিত হয় "ইন্ডিজ গেজেট"। এটি ছিলো ভারতে প্রকাশিত দ্বিতীয় সংবাদপত্র। হিকির বেঙ্গল গেজেটকে জব্দ করবার জন্য কোম্পানি এই পত্রিকার পৃষ্ঠপোষকতা করেছিলো। এরপর যথাক্রমে - "ক্যালকাটা গেজেট", "বেঙ্গল হরকরা", "বেঙ্গল জার্নাল", "ফ্রেন্ড অব ইন্ডিয়া" প্রভৃতি পত্রিকা গুলি বের হয়।
মনে রাখতে হবে, ১৭৮০ থেকে ১৮১৭ মধ্যে যতগুলি সংবাদপত্র বের হয়, তার সবগুলিই ছিলো ইংরেজি ভাষায় প্রকাশিত সংবাদপত্র। এর মধ্যে দৈনিক পত্রিকা একটিও ছিলো না।
১৮১৮, বাংলা সংবাদপত্রের আত্মপ্রকাশের যুগ :-
১৮১৮ সালটি ছিলো ভারতীয় সংবাদপত্রের ইতিহাসের একটি স্মরণীয় বছর। কারন এই বছরটিতেই (১.) ভারতীয় মালিকানাধীন সংবাদপত্রের, (২.) ভারতীয় ভাষায় প্রকাশিত সংবাদপত্রের, (৩.) বাংলা ও বাঙালি সম্পাদিত সংবাদপত্রের জয়যাত্রা শুরু হয়।
এক্ষেত্রে উল্লেখযোগ্য উদ্যোগ নিয়েছিলো শ্রীরামপুর ব্যাপটিস্ট মিশন। ব্যাপটিস্ট মিশনের উদ্যোগে ১৮১৮ খ্রিঃ বাংলা তথা ভারতীয় ভাষায় প্রথম সংবাদপত্র প্রকাশিত হয় "দিগ্দর্শন"। দিগ্দর্শনের সম্পাদক ছিলেন জন ক্লার্ক মার্শম্যান। এটিই ছিলো বাংলার প্রথম মাসিক বা সাময়িক পত্রিকা। দিগ্দর্শন প্রকাশিত হয় মুখ্যত স্কুলের ছাত্রদের জন্য। এতে ইতিহাস, ভূগোল, জনস্বাস্থ্য, প্রভৃতি বিষয়ে নানা লেখা থাকতো। পরবর্তীকালে পত্রিকাটি বাংলার পাশাপাশি ইংরেজীতে প্রকাশিত হয়।
দিগ্দর্শন পত্রিকা প্রকাশের একমাস পর ব্যাপটিস্ট মিশনের উদ্যোগেই প্রকাশিত হয় "সমাচার দর্পন"। এরও সম্পাদক ছিলেন জন ক্লার্ক মার্শম্যান। এই পত্রিকাটি ছিলো বাংলার প্রথম সাপ্তাহিক পত্রিকা। প্রতি শনিবার এই পত্রিকাটি বের হতো। ১৮২৯ খ্রিঃ পর পত্রিকাটি দ্বিভাষিক হয়ে যায়, অর্থাৎ বাংলার পাশাপাশি ইংরেজিতেও প্রকাশিত হয়।
অন্যদিকে ১৮১৮ খ্রিষ্টাব্দেই বাঙালি সম্পাদিত এবং বাঙালি মালিকানাধীন প্রথম সংবাদপত্র "বাঙ্গাল গেজেটি" প্রকাশিত হয়। যদিও এই পত্রিকাটির কোন সংখ্যা এখনও পর্যন্ত পাওয়া যায় নি। একটি সংবাদপত্রে এই পত্রিকা প্রকাশের বিজ্ঞপ্তি থেকেই এর নাম জানা যায়। পত্রিকাটি দিগ্দর্শনের আগেই প্রকাশিত হয়েছিলো। পত্রিকার প্রামাণ্য সংখ্যা পাওয়া গেলে এটিই হতো বাংলা ভাষায় এবং ভারতীয় মালিকানাধীন প্রথম সংবাদপত্র।
ভারতীয় সংবাদপত্রের রামমোহন যুগ :-
সংবাদপত্রের ইতিহাসে এরপর যার নামটি উঠে আসে, তিনি হলেন রাজা রামমোহন রায়। রামমোহন সাংবাদিকতাকে উদার ধর্মমত প্রচার এবং সামাজিক সংস্কারের মাধ্যম হিসাবে গ্রহন করেন।
ইতিমধ্যে খ্রিষ্টান মিশনারিরা "সমাচার দর্পন" মারফৎ হিন্দু ধর্ম সম্পর্কে নানা অপব্যাখ্যা করছিলেন। রামমোহন রায় এর যোগ্য প্রত্যুত্তর দেওয়ার জন্য ১৮২১ খ্রিঃ প্রকাশ করেন "সম্বাদ কৌমুদি"পত্রিকা। এই পত্রিকার সম্পাদনার দায়িত্বে ছিলেন ভবানীচরন বন্দোপাধ্যায়। এই একই বছর রামমোহন রায় আরোও একটি পত্রিকা প্রকাশ করেন "ব্রাহ্মণ সেবধি"। ১৮২২ খ্রিঃ প্রকাশ করেন "মীরাতুল আখবার"। এর সম্পাদক ছিলেন স্বয়ং রামমোহন রায় নিজেই।
ইতিমধ্যে রামমোহন রায় সতীদাহ প্রথার বিরোধিতা করলে রক্ষনশীল ভবানীচরন বন্দোপাধ্যায়ের সঙ্গে রামমোহন রায়ের বিরোধ বাঁধে। ফলে ভবানীচরন বন্দোপাধ্যায় সম্বাদ কৌমুদি থেকে বেরিয়ে এসে ১৮২২ খ্রিঃ প্রকাশ করেন" সমাচার চন্দ্রিকা"। এটি অল্পসময়েই রক্ষনশীল হিন্দুদের মুখপত্রে পরিনত হয়েছিলো। সমাচার চন্দ্রিকা সপ্তাহে দুবার প্রকাশিত হতো।
১৮২৮ - ১৮৪০ দশক, সংবাদপত্রের ঝড়ের যুগ :-
১৮২৮, ভারতীয় সংবাদপত্রের ইতিহাসে আরও একটি স্মরণীয় বছর। নব্যবঙ্গীয়দের কর্মকান্ড এবং ব্রাহ্মসমাজের আন্দোলন এই সময়ের পর থেকেই শুরু হয়। ফলতঃ এই দুই শ্রেনির হাত ধরে একের পর এক সংবাদপত্র প্রকাশিত হতে থাকে।
নব্যবঙ্গীয়রা তাদের চিন্তাধারা প্রকাশের জন্য বের করতে থাকলেন একের পর এক পত্রিকা। ১৮৩০ থেকে ১৮৪৩ মধ্যে প্রকাশিত হয় - পার্থেনন, জ্ঞানান্বেষন, হেসপেরাস, এনকোয়ারার, হিন্দু পাইওনিয়ার, বেঙ্গল স্পেকটেটর।
অন্যদিকে ব্রাহ্মসমাজের উদ্যোগে ১৮৪৩ খ্রিঃ প্রকাশিত হয় "তত্ত্ববোধিনী পত্রিকা"। এর সম্পাদক ছিলেন অক্ষয় কুমার দত্ত। পত্রিকাটি ব্রাহ্ম সমাজের তত্ত্ববোধিনী সভার মুখপত্র ছিলো।
১৮৩০ এর দশকে প্রকাশিত হয় আরও একটি উল্লেখযোগ্য পত্রিকা "সংবাদ প্রভাকর"। এটি ১৮৩১ খ্রিঃ প্রকাশিত হয়। সম্পাদক ছিলেন ঈশ্বরচন্দ্র গুপ্ত। পত্রিকাটি প্রথমে সাপ্তাহিক ছিলো। পরবর্তীকালে ১৮৩৯ এর পর এটি দৈনিক পত্রিকা হিসাবে আত্মপ্রকাশ করে। এ প্রসঙ্গে বলে রাখা ভালো, সংবাদ প্রভাকর ই ছিলো বাংলা ভাষায় প্রকাশিত প্রথম দৈনিক সংবাদপত্র।
১৮৫০ এর দশক এবং তার পরবর্তী সময়কাল :-
১৮৫০ এর দশক থেকে বেশ কিছু বিখ্যাত সংবাদপত্র প্রকাশিত হতে থাকে।
(১.) প্রথমেই যার নাম এসে যায় সেটি হলো সর্বশুভকরী পত্রিকা।১৮৫০ খ্রিঃ এটি প্রকাশিত হয়েছিলো।
(২.) ১৮৫৩ খ্রিঃ প্রকাশিত হয় হিন্দু প্যাট্রিয়ট। এটি ছিলো ভারতের প্রথম জাতীয়তাবাদী পত্রিকা।
(৩.) ১৮৫৮ খ্রিঃ প্রকাশিত প্রকাশিত হয়েছিলো আরও একটি বিখ্যাত সংবাদপত্র সোমপ্রকাশ। প্রত্যেক সোমবার এই পত্রিকা প্রকাশিত হতো। সোমপ্রকাশই ছিলো বাংলা ভাষায় প্রকাশিত প্রথম রাজনৈতিক সংবাদপত্র। এর সম্পাদক ছিলেন দ্বারকানাথ বিদ্যাভূষন।
(৪.) ১৮৬০ এর দশকে প্রকাশিত পত্রিকা গুলির মধ্যে সবথেকে উল্লেখযোগ্য ছিলো - বামাবোধিনী পত্রিকা এবং গ্রামবার্তা প্রকাশিকা। দুটি পত্রিকাই ১৮৬৩ খ্রিঃ প্রকাশিত হয়েছিলো। বামাবোধিনী ছিলো মেয়েদের জন্য প্রকাশিত পত্রিকা। ব্রাহ্মসমাজের বামাবোধিনী সভার মুখপত্র ছিলো এটি।এর সম্পাদক ছিলেন উমেশচন্দ্র দত্ত । গ্রামবার্তা প্রকাশিকার সম্পাদক ছিলেন হরিনাথ মজুমদার। এই পত্রিকাটি বাংলার গ্রামসমাজের মুখপত্রে পরিনত হয়েছিলো।
(৫.) ১৮৭০ দশকে প্রকাশিত পত্রিকা গুলির মধ্যে সবথেকে স্মরণীয় ছিলো বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায় সম্পাদিত "বঙ্গদর্শন"।১৮৭২ খ্রিঃ এটি প্রকাশিত হয়েছিলো ।
উনিশ শতকের সংবাদপত্র ও সমাজজীবন :-
উনিশ শতকের সাময়িকপত্র ও সংবাদপত্র গুলি একদিকে যেমন - (১.) নবজাগরন ও সংস্কার আন্দোলনের পক্ষে বিপক্ষে জনমত গঠন করেছিলো, অন্যদিকে তেমনই (২.) উনিশ শতকের সমাজজীবন ও ঔপনিবেশিক শাসনের খুঁটিনাটি দিকগুলিকেও তুলে ধরেছিল। (৩.) আমরা শুরুতেই বলেছিলাম, সমকালীন সময়ে সমাজজীবনকে যে যে ঘটনা গুলি এবং চিন্তা ভাবনা গুলি প্রভাবিত করে এবং আন্দোলিত করে, সেগুলিই সংবাদপত্রে প্রকাশিত হয়। সমাজ বিবর্তনের ধারাভাষ্যটি একমাত্র নিয়মিত সংবাদপত্র পাঠের মাধ্যমেই বোঝা যায়। এককথায়, সংবাদপত্র সমকালীন সময়ের সমাজ জীবনের জীবন্ত দর্পন। তাই উনিশ শতকের সমাজ জীবনকে সঠিকভাবে বুঝতে গেলে সংবাদপত্রের দ্বারস্থ হওয়া ছাড়া আর কোন উপায় নেই।
ধন্যবাদ
ReplyDelete