স্থানীয় ইতিহাস

সামাজিক ইতিহাস চর্চার একটি অন্যতম দিক হলো স্থানীয় ইতিহাস বা আঞ্চলিক ইতিহাস বা Local History। জাতীয় ইতিহাস এবং স্থানীয় ইতিহাস এক উলম্ব সরল রেখায় পরস্পর বিপরীত বিন্দুতে অবস্থান করে। অর্থাৎ জাতীয় ইতিহাস চর্চায় যেখানে ওপর থেকে ইতিহাস নেমে আসে, সেখানে স্থানীয় ইতিহাস চর্চায় ইতিহাস নীচ থেকে উপরের দিকে ওঠে। 


স্থানীয় ইতিহাস
স্থানীয় ইতিহাসের ধরন


জাতীয় ইতিহাসকে মূল ধারার ইতিহাস হিসাবে দেখা হলেও, বর্তমানে সামাজিক ইতিহাস চর্চায় স্থানীয় ইতিহাস চর্চার গুরুত্ব বৃদ্ধি পেয়েছে। বহু লেখক, ঐতিহাসিক তাদের নিজস্ব এলাকার ঐতিহ্য এবং ঐতিহাসিক স্মারক গুলো নিয়ে ইতিহাস লিখে যাচ্ছেন। 

এখন দেখে নেওয়া যাক স্থানীয় ইতিহাস বলতে ঐতিহাসিকরা ঠিক কোন ইতিহাসকে বুঝিয়েছেন। 

 স্থানীয় ইতিহাসের সংজ্ঞা :-

কোন একটি স্থান বা অঞ্চলের জনসমাজের নিজস্ব ইতিহাসকেই সাধারন ভাবে স্থানীয় ইতিহাস বলা হয়ে থাকে। অর্থাৎ কোন মানুষ বা জনগোষ্ঠী যে অঞ্চল বা এলাকায় বসবাস করে, সেই অঞ্চল বা এলাকার ইতিহাসকেই স্থানীয় বা আঞ্চলিক ইতিহাস বলা হয়।

উদাহরন :-

আঞ্চলিক বা স্থানীয় ইতিহাসের উদাহরন বিভিন্ন রকম হতে পারে। যেমন - 

(ক) নিজ গ্রামের ইতিহাস (খ) নিজ গ্রামের কোন প্রাচীন মন্দির, মসজিদ, চার্চ, স্কুল, বিশেষ জনগোষ্ঠী বা প্রাচীন ঘটনাবহুল কোন বাড়ির ইতিহাস, আবার (গ) কোন রাজ্য বা প্রদেশের নিজস্ব ইতিহাসও স্থানীয় ইতিহাসের মধ্যে পড়ে। 

নিজ ঐতিহ্য এবং সংস্কৃতির অমোঘ টানেই মূলত স্থানীয় ঐতিহাসিকরা অথবা ইতিহাস প্রেমী পন্ডিতেরা স্থানীয় ইতিহাস নিয়ে চর্চা করে থাকেন। স্থানীয় ইতিহাস চর্চার পিছনে তাদের প্রধান উদ্দেশ্য গুলি ছিলো - 

স্থানীয় ইতিহাস চর্চার উদ্দেশ্য :-

  1. নিজ অঞ্চলের সামাজিক ও সাংস্কৃতিক ঐতিহ্যকে তুলে ধরা।
  2. নিজ এলাকার প্রাচীন বা অতীত ইতিহাসকে মেলে ধরা।এবং
  3. জাতীয় ইতিহাস ও ঐতিহ্যের ধারার সঙ্গে নিজের সংযোগ অনুসন্ধান করা

স্থানীয় ইতিহাস চর্চার সূচনা :-

তবে মনে রাখতে হবে,স্থানীয় ইতিহাস চর্চা নতুন কোন বিষয় নয়। আমাদের দেশে স্থানীয় ইতিহাসের ওপর ভিত্তি করেই প্রথম ইতিহাস গ্রন্থ লিখেছিলেন কলহন। তিনি কাশ্মীরের ইতিহাসকে নিয়ে রচনা করেন "রাজতরঙ্গিনী"। পরবর্তীকালে ইতিহাস পিপাসু অনেক ব্যক্তি তাদের স্থানীয় এলাকার ইতিহাসকে নিয়ে এই ইতিহাস চর্চা করে গেলেও, বিংশ শতাব্দীর আগে পর্যন্ত স্থানীয় ইতিহাসকে সেভাবে গুরুত্ব বা স্বীকৃতি কোনটাই দেওয়া হয় নি। 

কিন্তু বিংশ শতাব্দীর মাঝামাঝি সময় থেকে সামাজিক ইতিহাস চর্চার সূত্র ধরে স্থানীয় ইতিহাসকে গুরুত্ব দেওয়া হতে থাকে। এই সময়ের পর থেকেই স্থানীয় ইতিহাসকে ইতিহাস চর্চারই একটি শাখা হিসাবে স্বীকৃতি দেওয়া হয়। বর্তমানে এর জনপ্রিয়তা এবং প্রাসঙ্গিকতা দুটোই বৃদ্ধি পেয়েছে।

সাম্প্রতিক কালে কেমব্রিজ গোষ্ঠীর ঐতিহাসিকরা এবং নিন্মবর্গের ঐতিহাসিকরা স্থানীয় ইতিহাস চর্চায় অত্যন্ত গুরুত্ব আরোপ করছেন। তাদের মতে, জাতীয় ইতিহাসের ভিত্তি এবং গতিপথকে সঠিক ভাবে উপলব্ধি করতে গেলে স্থানীয় ইতিহাসকে গুরুত্ব দিতেই হবে। 

স্থানীয় ইতিহাসের উল্লেখযোগ্য গ্রন্থ :-

স্থানীয় ইতিহাসকে অবলম্বন করে অসংখ্য আঞ্চলিক ইতিহাস রচিত হয়েছে এবং এখনো হয়ে চলেছে। এইসব গ্রন্থ গুলির মধ্যে উল্লেখযোগ্য হল -
  • রাখালদাস বন্দ্যোপাধ্যায়ে - বাংলার ইতিহাস
  • নীহাররঞ্জন রায়ের - বাঙালির ইতিহাস (আদিপর্ব)
  • কুমুদনাথ মল্লিকের - নদীয়া কাহিনী
  • মনোরঞ্জন চন্দ্রের - মল্লভূম বিষ্ণুপুরের ইতিহাস
  • শ্রীরথীন্দ্রনাথ চৌধুরীর - বাঁকুড়াজনের ইতিহাস ও সংস্কৃতি
  • সুধীরকুমার মিত্রের - হুগলি জেলার ইতিহাস
  • সতীশচন্দ্র মিত্রের - যশোহর খুলনার ইতিহাস
  • ভবানীচরন বন্দোপাধ্যায়ের - কোচবিহারের ইতিহাস
  • দীনেশচন্দ্র সেনের - বৃহৎ বঙ্গ
  • রমেশচন্দ্র মজুমদারের - বাংলাদেশের ইতিহাস
  • রাধারমন সাহার - পাবনা জেলার ইতিহাস
  • নিখিলনাথ রায়ের - মুর্শিদাবাদ কাহিনী
এবার দেখে নেওয়া যাক, স্থানীয় ইতিহাস চর্চার প্রধান বৈশিষ্ট্যের ধারা গুলো কেমন - 

স্থানীয় ইতিহাস চর্চার বৈশিষ্ট্য :-

স্থানীয় ইতিহাস চর্চার প্রধান বৈশিষ্ট্য গুলো হল -
  1. স্থানীয় বিষয়বস্তুকে ভিত্তি করে বা অবলম্বন করেই এই ইতিহাস রচনা করা হয়।
  2. অল্প আয়োতন এবং পরিসরেই মূলত এই ইতিহাস লেখা হয়। অর্থাৎ ইতিহাস খুব দীর্ঘ বা বিস্তারিত হয় না। 
  3. অন্য ইতিহাসের তুলনায় কম তথ্যের প্রয়োগে এই ইতিহাস রচিত হয়।
  4. স্মৃতিকথা বা জনশ্রুতি এই ইতিহাস চর্চার গুরুত্বপূর্ণ মাধ্যম হিসাবে ব্যবহৃত হয়। 
  5. অনেক সময় অপেশাদার ঐতিহাসিকরাই স্থানীয় ইতিহাস রচনা করে থাকেন।
  6. অনেক সময় স্থানীয় কোন গোষ্ঠী বা প্রতিষ্ঠান স্থানীয় ইতিহাস রচনা করে থাকে। যেমন - "পশ্চিম রাঢ় ইতিহাস ও সংস্কৃতি চর্চা কেন্দ্রের" উদ্যোগে বাঁকুড়া জেলার ইতিহাস ও চর্চা চলেছে।
সবশেষে দেখে নেওয়া যাক, আধুনিক ইতিহাস চর্চায় কেন ঐতিহাসিকরা স্থানীয় ইতিহাস চর্চা কে এতটা গুরুত্বপূর্ণ বলে  মনে করছেন? এক্ষেত্রে আমরা স্থানীয় ইতিহাস চর্চার ৩ টি প্রধান গুরুত্বের দিক কে তুলে ধরতে পারি - 

স্থানীয় ইতিহাস চর্চার গুরুত্ব:-

(১.) বৃহত্তর পরিসরে ইতিহাস রচনা করতে গিয়ে এমন অনেক বিষয় থাকে, যা ইতিহাসে উপেক্ষিত থেকে যায়। স্থানীয় ইতিহাস চর্চার মধ্য দিয়ে সেই ফাঁক পূর্ন করা সম্ভব। 

(২.) স্থানীয় ইতিহাস চর্চার মধ্য দিয়ে আমরা আঞ্চলিক লোকপরম্পরা, শিল্প স্থাপত্যের বিকাশ, আর্থ সামাজিক ও সাংস্কৃতিক জীবনের একটি রূপরেখা পাই। এছাড়া, 

(৩.) স্থানীয় ইতিহাস জাতীয় ইতিহাসের ধারাকে আরও শক্তিশালী ও বলিষ্ঠ করে তোলে। স্থানীয় ইতিহাসের মূল কথাই হলো - "Start History at your Door" অর্থাৎ তোমার বাড়ির দরজা থেকেই ইতিহাসের শুরু। 

ভারতের স্বাধীনতা আন্দোলনের বিভিন্ন পর্ব গুলিতে আমার গ্রাম বা জেলা কতখানি অংশগ্রহণ করেছিলো, সেই সব আন্দোলন গুলি আমার গ্রাম এবং আমার জেলাকে কতদূর স্পর্শ করতে পেরেছিলো - এমন বহু বিষয় স্থানীয় ইতিহাস চর্চায় উঠে আসে, যা জাতীয় ঘটনাবলীর শিকড় কতদূর বিস্তৃত তা বুঝতে সাহায্য করে। ফলত,স্থানীয় ইতিহাস জাতীয় ইতিহাসের ধারাকে আরও সমৃদ্ধ করে তোলে। 

তাই বলা হয়ে থাকে, স্থানীয় ইতিহাসই হলো জাতীয় ইতিহাসের ভিত্তি। 



1 Comments

  1. The King Casino - Herzaman in the Aztec City
    The King Casino in Aztec City is discount air jordan 11 retro the place 더킹카지노 회원가입 where you can find and 1xbet korean play buy air jordan 6 shoes for real, real money. Enjoy a memorable stay order retro jordans at this one-of-a-kind casino

    ReplyDelete
Post a Comment
Previous Post Next Post