ইবন বতুতার ভ্রমন বৃত্তান্ত

মধ্যযুগে ভারতে আগত বিদেশী পর্যটকদের মধ্যে অন্যতম ছিলেন ইবন বতুতা। চতুর্দশ শতকে আফ্রিকার মরক্কোর অধিবাসী ইবন বতুতা নানা দেশ ঘুরে ১৩৩৩ খ্রিঃ ভারতে আসেন। পরে ভারত থেকে চিন সফর করে তিনি মরক্কোতে ফিরে যান এবং নিজ বিদেশ ভ্রমণের অভিজ্ঞতাকে অবলম্বন করে রচনা করেন "কিতাব - উল - রিহলা" গ্রন্থ।

ইবন বতুতার ভ্রমন বৃত্তান্ত
ইবন বতুতার ভ্রমন বৃত্তান্ত 


(১.) ইবন বতুতার ভ্রমনকালে ভারতবর্ষের রাজনৈতিক অবস্থা :- 

ভারতে আগত আলবেরুনী এবং মার্কো পোলোর পরবর্তীকালে উল্লেখযোগ্য কোন পর্যটকের কথা স্মরন করলে অবধারিত ভাবেই ইবন বতুতার নাম উঠে আসে। আলবেরুনীর প্রায় ৩০০ বছর পর চতুর্দশ শতকে ইবন বতুতা ভারতে আসেন। 

ইবন বতুতা যখন ভারতে আসেন তখন দিল্লিতে তুঘলক বংশের শাসন চলেছিলো। খ্রিষ্ট্রীয় চতুর্দশ শতকের প্রথম ২০ বছর ভারতকে খলজি সুলতানরা শাসন করেছিলেন (১২৯০ - ১৩২০)। এরপর তুঘলক বংশ ক্ষমতায় এসেছিলো (১৩২০ - ১৪১৩)। তুঘলক বংশের প্রতিষ্ঠাতা ছিলেন গিয়াসউদ্দিন তুঘলক। গিয়াসউদ্দিন তুঘলকের পর দিল্লি শাসন করেন তুঘলক বংশের শ্রেষ্ঠ সুলতান মহম্মদ বিন তুঘলক (১৩২৫ - ১৩৫১)। মহম্মদ বিন তুঘলকের আমলেই ইবন বতুতা ভারত ভ্রমনে এসেছিলেন। 

মহম্মদ বিন তুঘলক যেবছর দিল্লির সিংহাসনে বসেন সেই বছরটিতেই অর্থাৎ ১৩২৫ খ্রিঃ ইবন বতুতা বিশ্বভ্রমনে বের হন। আফ্রিকা ও মধ্য এশিয়ার নানা দেশ ঘুরে অবশেষে ১৩৩৩ খ্রিঃ ইবন বতুতা ভারতে আসেন এবং ১৩৩৩ খ্রিঃ থেকে ১৩৪৭ খ্রিঃ পর্যন্ত প্রায় ১৪ বছর ভারতে অবস্থান করেন। 

ইবন বতুতার ভারতে আগমন ও অবস্থানকাল থেকে একথা নির্দ্ধিদায় বলা যায় আলবেরুনী বা মার্কো পোলোর থেকে অনেক বেশি দিন ইবন বতুতা ভারতে অবস্থান করেন। বস্তুতপক্ষে সমুদ্র পার করে দূর দেশ থেকে এসে এতদীর্ঘ দিন ভারতে থাকার সাহস ইবন বতুতা ছাড়া, মধ্যযুগের আর কোন পর্যটকই দেখান নি। আলবেরুনী এদেশে পাঞ্জাব ও উত্তর ভারতের মধ্যেই সীমায়িত ছিলেন। মার্কো পোলোর ভ্রমন এদেশে দক্ষিণ ভারতের উপকূল অঞ্চল সমূলের মধ্যেই আবদ্ধ ছিলো। কিন্তু ইবন বতুতার ভারত ভ্রমণ আলবেরুনী বা মার্কো পোলোর ভারত ভ্রমন থেকে অনেক বেশি বিস্তৃত ছিলো। ইবন বতুতা উত্তর ভারত, দক্ষিণ ভারত এমনকি পূর্ব ভারতের বাংলা, আসাম সহ এক বিস্তৃত অঞ্চল ভ্রমন করেছিলেন।

"মধ্য যুগের পর্যটকদের রাজা" নামে খ্যাত মার্কো পোলোর মৃত্যুর পরের বছর ১৩২৫ খ্রিঃ ইবন বতুতা তার বিশ্ব ভ্রমণ শুরু করেন। সমগ্র ভ্রমনকালে ইবন বতুতা এশিয়া আফ্রিকার প্রায় ৪০ টির অধিক দেশ পরিভ্রমন করেন। ৭৫,০০০ মাইল (১,২১,০০০ কিমি) পথ পাড়ি দেন, যা মার্কো পোলোর চেয়ে অনেক বেশি ছিলো। মধ্য যুগে ইবন বতুতাই একমাত্র পর্যটক ছিলেন যিনি তার সময়কালের সমগ্র মুসলিম বিশ্বকে ভ্রমন করেছিলেন। মধ্য যুগে এশিয়া - আফ্রিকার যেসমস্ত দেশগুলিতে ইসলামিক শাসন প্রতিষ্ঠিত হয়েছিলো, সেসব দেশ গুলির প্রায় সবকটিতেই ভ্রমন করেছিলেন ইবন বতুতা। এই বিশেষ কৃতিত্বের জন্যই ইবন বতুতাকে বলা হয় - "The Islamic Marco Polo" বা "The Traveller of Islam."

(২.) ইবন বতুতার সংক্ষিপ্ত পরিচয় ও জীবনী :- 

(i.) জন্ম :- 

১৩০৪ খ্রিঃ আফ্রিকার মরক্কোর তানজিয়ার শহরে ইবন বতুতা জন্মগ্রহন করেন।

(ii.) নাম - পরিচয় :- 

তাঁর পারাবারিক নাম ছিলো - বতুতা। প্রকৃত নাম ছিলো - আবু আবদুল্লাহ মহম্মদ। ভারতে বা দিল্লিতে তিনি মৌলানা বদরউদ্দিন নামে পরিচিত ছিলেন। 

তবে "কিতাব - উল - রিহলা" গ্রন্থে ইবন বতুতা তাঁর সুদীর্ঘ নামটির উল্লেখ করে লিখেছেন - "শামস আল - দিন আবু আবদল্লাহ মহম্মদ ইবন আবদল্লাহ ইবন মহম্মদ ইবন ইব্রাহিম ইবন মহম্মদ ইবন ইউসুফ লাওয়াটি অল - তানজি ইবন বতুতা"।

(iii.) পারিবারিক পরিচয় :- 

ইবন বতুতার পিতার নাম ছিলো আবদুল্লাহ ইবন মহম্মদ। তাঁদের পারিবারিক পেশা ছিলো কাজি বা বিচারবিভাগীয় কাজ এবং দাতব্য সংস্থা পরিচালনা করা। শরিয়ৎ বিশেষজ্ঞ হিসাবে ইবন বতুতার পরিবারের বিশেষ খ্যাতি ছিলো। পারিবারিক ঐতিহ্য অনুযায়ী ইবন বতুতাও খুব অল্প বয়সে সাহিত্য ও ধর্মশাস্ত্রে পান্ডিত্যপূর্ন শিক্ষা লাভ করেছিলেন। 

(iv.) বিদেশভ্রমনের আকাঙ্খা, উদ্দেশ্য ও নীতি :-

ইবন বতুতা বিশ্বাস করতেন, দেশভ্রমনের মাধ্যমে যে শিক্ষা ও অভিজ্ঞতা অর্জন করা যায়, তা কখনই পুস্তক পাঠের দ্বারা লাভ করা সম্ভব হয় না। খুব ছোটবেলা থেকেই ইবন বতুতার মধ্যে একদিকে ছিলো প্রবল ধর্মীয় আবেগ, অন্যদিকে ছিলো নতুন দেশ ভ্রমনের তীব্র বাসনা। 

"নতুন দেশভ্রমন" এবং "ধর্মীয় আবেগ" - এই দুই আকাঙ্খার টানেই ১৩২৫ খ্রিঃ মাত্র ২১ বছর বয়সে ইবন বতুতা বিদেশ ভ্রমণে বের হন। ইবন বতুতা বিদেশ ভ্রমণের ক্ষেত্রে তাঁর ৩ টি লক্ষ্য ও উদ্দেশ্য স্থির করেন। এগুলি হলো - 

  • (ক.) ইসলামের পবিত্র তীর্থস্থান গুলি পরিদর্শন করা। 
  • (খ.) বিভিন্ন দেশের ইসলামিক সাধু, সন্ত ও দরবেশদের সঙ্গ লাভ করা।
  • (গ.) বিশ্বের যেসব দেশে ইসলাম প্রতিষ্ঠিত হয়েছে, সেইসব দেশ গুলিতে পরিভ্রমন করা।
ইবন বতুতা দেশ ভ্রমনের ক্ষেত্রে কতকগুলি নীতি নিয়েছিলেন। তিনি জানতেন, এই পৃথিবী লেনদেনের ভিত্তিতে চলে। বতুতা যখনই কোন নতুন দেশে যেতেন, তখনই সেই দেশের সুলতানের সঙ্গে সাক্ষাৎ করে নানা উপহার দিতেন। বিনিময়ে উক্ত দেশের সুলতানও বতুতাকে উপহার প্রদান করতেন। এইভাবে দেশ ভ্রমণের সূত্রে ইবন বতুতা প্রভূত সম্পদ লাভ করেছিলেন। 

ইবন বতুতার ভ্রমনকালের আরেকটি বিশেষত্বের দিক হলো, যখনই তিনি কোন নতুন দেশে যেতেন তখনই একটি করে বিবাহ করতেন। কিছুদিন অতিবাহিত করার পর বিবাহিত স্ত্রীদের নিজ দেশে পরিত্যাগ করেই বা বিবাহ বিচ্ছেদ করে তিনি নতুন দেশভ্রমনে বেরিয়ে পড়তেন। মালদ্বীপে ইবন বতুতা একসঙ্গে চারজন নারীকে বিবাহ করেছিলেন। পঞ্চাশোর্দ্ধ বয়সেও তিনি একাধিকবার বিবাহ করেন।

ইবন বতুতা প্রতিজ্ঞা করেছিলেন, যে পথে তিনি একবার পরিভ্রমন করবেন, সেই পথে তিনি দ্বিতীয়বার আর পরিভ্রমন করবেন না। যদিও ভারতে আসার পর ইবন বতুতা তাঁর এই নিয়মকে অক্ষরে অক্ষরে মেনে চলতে পারেননি। ভারত থেকে চিন যাওয়ার পথে তিনি পথ ভুলে দুইবার কালিকট এবং দুইবার মালদ্বীপে গিয়েছিলেন।

(v.) বিদেশ ভ্রমনের সংক্ষিপ্ত পরিচয় :- 

ইবন বতুতা ১৩২৫ খ্রিঃ ২১ বছর বয়সে সর্বপ্রথম হজ করার জন্য মক্কায় যান। মক্কাতে তিন বছর থাকার পর তিনি সিরিয়া, ইরাক, পারস্য, ইয়েমেন, ওমান ও পূর্ব আফ্রিকার কিছু উপকূলীয় বানিজ্যিক বন্দরের ভ্রমন করেন। এরপর ইবন বতুতা ১৩৩৩ খ্রিঃ মধ্য এশিয়া হয়ে স্থলপথে ভারতে প্রবেশ করেন।

ইবন বতুতার ভ্রমন পথ
ইবন বতুতার ভ্রমন পথ



(vi.) ইবন বতুতার ভারতে প্রবেশ :- 

১৩৩৩ খ্রিঃ ইবন বতুতা খোরাসান তৃনভূমি পার করে আফগানিস্তানের হিন্দুকুশ পর্বত অতিক্রম করে পৌঁছান পানজ্ আব, যাকে বর্তমানে সিন্ধুনদ বলা হয়ে থাকে। সিন্ধু নদীর তীরেই ছিলো সিন্ধুপ্রদেশ, যাকে "সিন্দ" নামে ডাকা হতো। এর রাজধানী ছিলো মূলতান। সিন্ধ অঞ্চল থেকেই শুরু হয়েছিলো দিল্লির সুলতান মহম্মদ বিন তুঘলকের রাজ্যসীমা। 

ইবন বতুতা সিন্ধ অঞ্চলে প্রবেশ করলে সুলতানের সীমান্তরক্ষীরা ইবন বতুতাকে আটক করে তার নাম, পরিচয় এবং ভারতে আসার কারন জানতে চান। পরে ইবন বতুতার নামে একটি রিপোর্ট তৈরি করে তারা মহম্মদ বিন তুঘলকের কাছে পাঠিয়ে দেন। এইসময় ভারতীয় ডাক ব্যবস্থার দিকটি প্রত্যক্ষ করে ইবন বতুতা অভিভূত হয়ে যান। সিন্ধ অঞ্চল থেকে ইবন বতুতার দিল্লি আগমনের সংবাদ ডাকযোগে পৌঁছে দেওয়া হয়। কিছুদিন পর সুলতানের অনুমতি মেলায় ইবন বতুতাকে ভারত সীমান্তে প্রবেশের ছাড়পত্র দেওয়া হয়।

ইবন বতুতা সিন্ধু উপত্যকার অরন্য অতিক্রম করার সময় গন্ডার প্রত্যক্ষ করেন। তিনি তাঁর ভ্রমন বৃত্তান্তে সিন্ধ অঞ্চলকে বিশ্বের অন্যতম শ্রেষ্ঠ নদী অববাহিকা অঞ্চল বলে অভিহিত করেন। সিন্ধু নদী অতিক্রম করে ইবন বতুতা ভারতে দেখা প্রথম শহর জনানী - তে আসেন। সেখান থেকে শিবিস্তান, লাহোরি, বুক্কর - প্রভৃতি শহর গুলি হয়ে সিন্ধুর উচ শহরে পৌঁছান। উচ থেকে সিন্ধুর রাজধানী মূলতান এবং মূলতান থেকে পাঞ্জাবের ফিরোজপুর আবোহর শহরে আসেন। সেখান থেকে অযোধান, সরসুতি, হানসি শহর হয়ে দিল্লির উপকন্ঠ মাসুদাবাদ শহরে পৌঁছান। অবশেষে সেখান থেকে দিল্লিতে প্রবেশ করেন। 

ইবন বতুতার বর্ননা অনুযায়ী সেইসময় সিন্ধু থেকে দিল্লি যেতে ৫০ দিন সময় লাগতো। অন্যদিকে মূলতান থেকে দিল্লি যেতে ৪০ দিন সময় লাগতো। সেই সময় পথ ঘাটের অবস্থা খুব ভালো ছিলো না। এর ওপর ছিলো ডাকাতদের ভয়। ইবন বতুতা সব সময় একটি যাত্রীদলের সঙ্গে ভ্রমন করতে পছন্দ করতেন। মূলতান থেকে দিল্লি যাওয়ার সময় তাঁর যাত্রীদল ডাকাতদের দ্বারা আক্রান্ত হয়। পাঞ্জাবের আবোহর শহর পার করে ইবন বতুতার যাত্রীদল এক পার্বত্য অঞ্চলে এসে পড়লে হিন্দু ডাকাতরা তাদের ওপর আক্রমণ করে। এতে সহযাত্রীদের অনেকেই প্রান হারান এবং ইবন বতুতা সহ যারা বেঁচে যান তারা গুরুতরভাবে আহত হন। 

(vii.) দিল্লিতে ইবন বতুতা কার্যক্রম :- 

দিল্লিতে প্রবেশ করার পর ইবন বতুতা সুলতান মহম্মদ বিন তুঘলকের সঙ্গে দেখা করেন। এইসময় ইবন বতুতা মহম্মদ বিন তুঘলককে ৩০ টি ঘোড়া, কিছু উট ও নানা অত্যাশ্চর্য উপঢৌকন দিয়ে মন জয় করার চেষ্টা করেন। মহম্মদ বিন তুঘলক এইসময় ইবন বতুতার ধর্মীয় জ্ঞান ও পান্ডিত্যে অভিভূত হয়ে তাকে রাজধানী দিল্লির কাজি বা বিচারক ও খানকাহ্ সম্মুহের অধ্যক্ষ পদে নিযুক্ত করেন। বার্ষিক বারো হাজার দিনার আয় হয় এমন সাড়ে চারখানি গ্রামের রাজস্বের বরাত তাকে দেওয়া হয়। তখন ৫ দিনারেই একটি সাধারণ পরিবারের মাসিক খরচা চলে যেতো। সেখানে ইবন বতুতার জন্য বার্ষিক বারো হাজার দিনারের চাকুরি নিঃসন্দেহে শুধু ঈর্ষনীয় ছিলো না, এটি তার জ্ঞান ও যোগ্যতার পৃষ্ঠপোষকেরও পরিচায়ক ছিলো।

ইবন বতুতা দীর্ঘ আট বছর কাজি বা বিচারকের পদে ছিলেন। ১৩৩৩ খ্রিঃ থেকে ১৩৪৭ খ্রিঃ পর্যন্ত ভারতে থাকাকালে ইবন বতুতা বহু সন্ত ও দরবেশের সান্নিধ্যে আসেন। দিল্লির সে যুগের বিখ্যাত দরবেশ শেখ শিহাবুদ্দিনের সান্নিধ্যে আসেন ইবন বতুতা। ক্রমে দুজনের মধ্যে অন্তরঙ্গ সম্পর্ক গড়ে ওঠে। কিন্তু এইসময় শেখ শিহাবুদ্দিনের সঙ্গে দিল্লির সুলতান মহম্মদ বিন তুঘলকের সম্পর্ক অত্যন্ত তিক্ততায় পৌঁছায়। মহম্মদ বিন তুঘলক দিল্লি থেকে রাজধানী দৌলতাবাদে স্থানান্তরের সময় দিল্লির সকল অধিবাসীকে বলপূর্বক দৌলতাবাদে যেতে বাধ্য করেন। সুলতানের এই কার্যকলাপের জন্য শেখ শিহাবুদ্দিন মহম্মদ বিন তুঘলককে স্বৈরাচারী ও নির্মম শাসক বলে অভিহিত করেন। 

এই ঘটনায় মহম্মদ বিন তুঘলক অত্যন্ত রুষ্ট হন এবং শেখ শিহাবুদ্দিনকে নির্মম ভাবে মৃত্যুদন্ডের আদেশ দেন। পরদিন শেখ শিহাবুদ্দিনের ঘনিষ্ট বা অনুগামী ব্যক্তিদেরও ধরে ধরে হত্যা করা হয়। শেখ শিহাবুদ্দিনের অনুগামীদের মধ্যে অন্যতম ছিলেন ইবন বতুতা। সুলতানের এই আচরনে কিছুটা ভীত এবং কিছুটা ক্ষুব্ধ হয়ে ইবন বতুতা সরকারি চাকরি (দিল্লিতে কাজি বা বিচারকের পদ) ছেড়ে দিয়ে সন্ন্যাস গ্রহন করে ফকির হয়ে যান। 

সুলতান মহম্মদ বিন তুঘলকের অনুরোধ সত্ত্বেও তিনি আর কোন সরকারি পদ গ্রহণ করেন নি। এর একবছর পর ইবন বতুতা দিল্লি দরবারে এসে "সুলতানের চোখে অপরাধী" শেখ শিহাবুদ্দিনের সান্নিধ্য লাভের প্রায়শ্চিত্য স্বরূপ মক্কায় হজ যাত্রার অনুমতি প্রার্থনা করলে মহম্মদ বিন তুঘলক তাকে সুলতানের দূত হিসাবে চিনে যাওয়ার নির্দেশ দিলে ইবন বতুতা রাজী হয়ে যান। 

(viii.) ইবন বতুতার চিন যাত্রার কাহিনী :-  

১৩৪২ খ্রিঃ ইবন বতুতা সুলতানের প্রচুর উপঢৌকন নিয়ে চিনের পথে বেরিয়ে পড়েন। কিন্তু তিনি ১৩৪৭ খ্রিঃ আগে চিনে পৌঁছাতে পারেন নি। সুলতান মহম্মদ বিন তুঘলক কেন চিনে দূত পাঠাতে চেয়েছিলেন, সেই কারনটির উল্লেখ ইবন বতুতা নিজেই তাঁর ভ্রমন বৃত্তান্তে উল্লেখ করেছেন। 

তাঁর লেখা থেকে জানা যায়, ১৩৩৭ - ৩৮ খ্রিঃ হিমালয় অঞ্চলের একটি রাজ্য কারাজল জয় করার জন্য সুলতান সামরিক অভিযান চালান। এইসময় সুলতানের সেনাদল "সমহল" (বর্তমান রোহিলখন্ডের "সম্ভল") নামক স্থানে একটি মন্দির ধ্বংস করেন, যেখানে বহু চিনা তীর্থদর্শনে আসতো। চিনা সম্রাট এই মন্দিরটি সংস্কার করার জন্য বহু উপঢৌকন সহ একদল দূত প্রেরন করেছিলেন। চিনা দূতের পাল্টা মহম্মদ বিন তুঘলক ইবন বতুতাকে দূত হিসাবে চিনে প্রেরন করেন। এইসময় ইবন বতুতার হাতে একটি পত্র দিয়ে মহম্মদ বিন তুঘলক জানান ইসলামীয় আইন অনুযায়ী যারা জিজিয়া কর প্রদান করে শুধু তাদেরই মন্দির তৈরির অনুমতি দেওয়া হয়। চিনা সম্রাট যদি এই প্রস্তাবে রাজি হন তবে মন্দির তৈরির অনুমতি দেওয়া হবে। 

দিল্লি থেকে খুব সহজেই ইবন বতুতা চিন পৌঁছাতে পারেন নি। (১.) তিনি প্রথমে দিল্লি থেকে আলিগড়ে পৌঁছান এবং সেখানে পথ হারিয়ে ফেলেন। (২.) আলিগড় থেকে কনৌজ, গোয়ালিয়র, উজ্জয়িনী হয়ে দৌলতাবাদে আসেন। (৩.) পরে দৌলতাবাদ থেকে গুজরাটের ক্যাম্বে উপসাগর থেকে জাহাজে করে পৌঁছান সন্দাবুর দ্বীপে, যার বর্তমান নাম ছিলো গোয়া(৪.) সেখান থেকে মালাবার উপকূলে পৌঁছান। মালাবারে কালিকট দ্বীপ থেকে জাহাজে মালদ্বীপে আসেন।(৫.) মালদ্বীপ থেকে যান শ্রীলঙ্কা, শ্রীলঙ্কা থেকে ফের ফিরে আসেন কালিকটে(৬.) এরপর কালিকট থেকে দ্বিতীয়বার মালদ্বীপ ঘুরে ইবন বতুতা বাংলার চট্টগ্রাম বন্দরে আসেন। (৭.) বাংলায় কিছু সময় কাটিয়ে অবশেষে ১৩৪৬ খ্রিঃ একটি জাহাজে করে তিনি সুমাত্রা - জাভা হয়ে চিনের জাইটুন বন্দরে (বর্তমান কোয়াংঝাউ) পৌঁছান।

ইবন বতুতা ভারত, শ্রীলঙ্কা এবং মালদ্বীপে প্রায় ১৪ হাজার মাইল পথ অতিক্রম করেন। চিন যাওয়ার পথে তিনি রাস্তা হারিয়ে ফেলেন। বেশ কয়েকবার ডাকতদলের সম্মুখীন হন। এমনকি তাঁর যাত্রী সঙ্গীদের জাহাজ ডুবি পর্যন্ত হয়। বহু প্রতিকূলতা অতিক্রম করে ইবন বতুতা চিনে পৌঁছাতে পারলেও, চিনা সম্রাটের উদ্দেশ্যে সুলতানের দেওয়া উপঢৌকনের আর কোন কিছুই তার কাছে অবশিষ্ট ছিলো না। চিনে তখন মোঙ্গল শাসকরাই শাসন করতেন । সুলতানের পত্র চিনা সম্রাটের কাছে দিয়ে ইবন বতুতা আনুমানিক ১৩৫৪ খ্রিঃ নিজ দেশ তানজানিয়ায় ফিরে যান। 

(ix.) ইবন বতুতার মৃত্যু :- 

পঞ্চাশ বছর বয়সে পদার্পণের আগেই ইবন বতুতা তাঁর দুঃসাহসিক অভিযাত্রী জীবনের ইতি টেনে নিজ দেশে ফিরেছিলেন। ১৩৭৭ খ্রিঃ (মতান্তরে ১৩৬৮/৬৯ খ্রিঃ) ফেজ নামক শহরে তিনি শেষনিশ্বাস ত্যাগ করেন।

(৩.) ইবন বতুতার ভ্রমন বৃত্তান্তের পরিচয় :- 

(I.) ভ্রমন বৃত্তান্তের কথক ও লেখক :- 

১৩২৫ খ্রিঃ মাত্র একুশ বছর বয়সে বাড়ি থেকে যাত্রা শুরু করে আনুমানিক ২৪ বছর পর ইবন বতুতা ১৩৪৯ খ্রিঃ তাঁর নিজ জন্মস্থান মরক্কোতে ফিরে আসেন। তিনি যখন নিজ দেশে ফিরে আসেন তখন সেখানকার স্থানীয় শাসক তাঁর ভ্রমন কাহিনী লিপিবদ্ধ করার নির্দেশ দেন। ইবন জুয়াই - কে ইবন বতুতার ভ্রমন বৃত্তান্ত লিপিবদ্ধ করার জন্য নিযুক্ত করা হয়েছিলো।

(II.) ভ্রমন বৃত্তান্তের নাম :- 

ইবন বতুতার ভ্রমন বৃত্তান্তের নাম ছিলো - "কিতাব - উল - রেহলা" বা Rihla। ১৩৫৪ খ্রিঃ ইবন বতুতা আরবি ভাষায় তাঁর এই ভ্রমন বৃত্তান্তটি রচনা করেন। আমরা আগেই বলেছি, ইবন বতুতার এই গ্রন্থটি লিপিবদ্ধ করেছিলেন ইবন জুয়াই নামে এক পন্ডিত ব্যক্তি। এই গ্রন্থটি প্রথমে পরিচিত ছিলো - "A Masterpiece to Those Who Contemplate the Wonders of cities and the Marvels of Travelling" নামে।

(III.) ভ্রমন বৃত্তান্তের বিষয়বস্তু :- 

ইবন বতুতা তাঁর ২৪ বছরের ভ্রমনকালে এশিয়া - আফ্রিকার যেসব দেশ ঘুরেছিলেন, সেইসব দেশের ভ্রমনের অভিজ্ঞতার কথাই ছিলো "কিতাব - উল - রেহলা" গ্রন্থের মূল আলোচ্য বিষয়বস্তু। এই গ্রন্থটি ৮০ টি অধ্যায়ে বিভক্ত ছিলো

চতুর্দশ শতাব্দীর ভারত সহ এশিয়া - আফ্রিকার যে সমস্ত দেশ গুলিতে ইবন বতুতা গিয়েছিলেন, সেইসব দেশ গুলির আর্থ - সামাজিক ও রাজনৈতিক পরিবেশ,সুলতানদের পরিচয়, বিভিন্ন অঞ্চলের যোগাযোগ ব্যবস্থা, বিভিন্ন নগর, শহর ও বন্দরের পরিচয়, আবহাওয়া ও জলবায়ু, উৎপন্ন বিভিন্ন দ্রব্যাদি ইত্যাদি বহুবিধ বিষয়ে এই গ্রন্থটিতে ইবন বতুতা আলোকপাত করেছিলেন।

(৪.) ইবন বতুতার ভ্রমন বৃত্তান্তে বর্নীত ভারত :- 

ইবন বতুতা বর্তমান আফগানিস্তান, পাকিস্তান সীমান্ত দিয়ে সিন্ধু - পাঞ্জাব হয়ে স্থলপথে ১৩৩৩ খ্রিঃ ভারতে প্রবেশ করেন১৩৩৩ খ্রিঃ থেকে ১৩৪৭ খ্রিঃ পর্যন্ত প্রায় ১৪ বছর তিনি ভারতে ছিলেন। এই সুদীর্ঘ সময়ে তিনি ভারতের নানা প্রান্তে পরিভ্রমন করেছিলেন। এছাড়া, দিল্লিতে সুদীর্ঘ ৮ বছর কাজি বা বিচারকের চাকুরি করার সুবাদে দিল্লি নগরী, মহম্মদ বিন তুঘলকের দরবার ও সুলতানি ইতিহাস ও ঐতিহ্য সম্পর্কে বহু গুরুত্বপূর্ণ বক্তব্য ও তথ্য তিনি লিপিবদ্ধ করেন।

ভারত সম্পর্কে ইবন বতুতা তাঁর ভ্রমন বৃত্তান্তে যেসব বক্তব্য লিপিবদ্ধ করেছিলেন, তা খুব সংক্ষেপে আমরা নিন্মলিখিত ভাবে তুলে ধরতে পারি :- 

(ক.) যোগাযোগ ব্যবস্থার পরিচয় :- চতুর্দশ শতকে ভারতে পথঘাট ও যোগাযোগ ব্যবস্থা সম্পর্কে বহু তথ্য ইবন বতুতার ভ্রমন বৃত্তান্ত থেকে পাওয়া যায়। সেই সময়ে যোগাযোগ ও পথঘাট বর্তমান কালের মতো ছিলো না। দূর দেশে গমন তখন বেশ ঝুঁকিপূর্ণ ছিলো। পায়ে হেঁটে অথবা ঘোড়ায় করে দূর দেশে যাওয়াই ছিলো তখনকার রীতি। পথে ডাকাতদের উপদ্রোপ ছিলো বলে অভিযাত্রীরা সর্বদাই দল বেঁধে একত্রে অভিযান বা যাতায়াত করতেন

ইবন বতুতার বর্ননা অনুযায়ী সেই সময়ে মূলতান থেকে দিল্লি আসতে ৪০ দিন, সিন্ধু থেকে দিল্লি আসতে ৫০ দিন, দৌলতাবাদ থেকে দিল্লি আসতে ৪০ দিন, এবং গোয়ালিয়র থেকে দিল্লি আসতে ১০ দিন সময় লাগতো। ভারতীয় পথঘাট অত্যন্ত বিপদসঙ্কুল ও ডাকাত দ্বারা পরিপূর্ন বলে ইবন বতুতা উল্লেখ করেছেন। মূলতান থেকে দিল্লি আসার সময় এবং ভারত থেকে চিন যাওয়ার সময় তিনি ডাকাত দলের সম্মুখীন হয়েছিলেন বলে জানিয়েছিলেন।

(খ.) ভারতীয় নগরের পরিচয় :- ইবন বতুতা ভারতের অনেক নগর দেখেছিলেন। ভারতে দেখা তার প্রথম শহর ছিলো জনানি। জনানি থেকে তিনি আসেন শিবিস্তান শহরে। তাঁর মতে এই শহরটি ছিলো খুবই উর্বর প্রকৃতির। ইবন বতুতা জলপথে বর্তমানে পাকিস্তানের অন্তর্গত তৎকালীন ভারতের লাহোরেও যান। ইবন বতুতার মতে, এই বন্দর শহরটি ছিলো একটি "মন ভোলানো শহর।" 

ইবন বতুতার মতে, ভারতের প্রত্যেকটি শহর ছিলো অত্যন্ত ঘনবসতিপূর্ন ও সমৃদ্ধ। শহর গুলি ছিলো ব্যবসা বাণিজ্য, সামাজিক ও সাংস্কৃতিক ক্রিয়াকলাপের কেন্দ্র। শহরের রাস্তাঘাট ও বাজার গুলি জমজমাট ও লোকজনে পরিপূর্ন।

(গ.) দিল্লি ও দৌলতাবাদ নগরীর বর্ননা :- ইবন বতুতার মতে,"বিরাট পাঁচিল দিয়ে ঘেরা" দিল্লি শহরটি ছিলো ইসলামি প্রাচ্যের সবচেয়ে সুন্দর ও সবচেয়ে বড়ো শহর। তিনি ইসলামি প্রাচ্যের কায়রো, বাগদাদ, মক্কা, মদিনা প্রভৃতি শহর দেখেছিলেন। কিন্তু তাঁর মতে, দিল্লি সবার সেরা। 

ইবন বতুতার বর্ননা অনুযায়ী, দিল্লি ছিলো চারটি শহরের সমষ্টি। এগুলি হলো যথাক্রমে - হিন্দুদের তৈরি পুরোনো দিল্লি বা ইন্দ্রপ্রস্থ, আলাউদ্দিন খলজির সিরি, গিয়াসউদ্দিন তুঘলক প্রতিষ্ঠিত তুঘলকাবাদ এবং সুলতান মহম্মদ বিন তুঘলকের তৈরি জাহানপনাহ। ইবন বতুতার মতে, দিল্লি শহরে প্রবেশের জন্য ছিলো ২৮ টি দরওয়াজা। এছাড়া ছিলো কুতুবমিনার, পুষ্করনী এবং অনেক মসজিদ। 

ইবন বতুতার মতে, দিল্লির পরেই স্থান ছিলো দৌলতাবাদের। মহম্মদ বিন তুঘলক তাঁর রাজধানী দিল্লি থেকে দৌলতাবাদে সরিয়ে নিয়ে গেলে শহর হিসাবে দিল্লির গুরুত্ব কিছুটা ম্লান হয়ে পড়েছিলো। ইবন বতুতার মতে, দৌলতাবাদ আকারের দিক থেকে দিল্লির তুলনায় কোন অংশে কম ছিলো না। ইবন বতুতা যখন দিল্লিতে আসেন তার সাত বছর আগে মহম্মদ বিন তুঘলক রাজধানী দিল্লি থেকে দৌলতাবাদে স্থানান্তর করেন। ইবন বতুতার বর্ননা অনুযায়ী তিন বছর পর ১৩৪১ খ্রিঃ দিল্লিকে আবার রাজধানীর মর্যাদায় ফিরিয়ে আনা হয়েছিলো। 

ইবন বতুতা দিল্লি থেকে চিন যাওয়ার পথে দৌলতাবাদে গিয়েছিলেন। ইবন বতুতার মতে, দৌলতাবাদের স্থানীয় লোকজন নিরামিশাষী ছিলেন। তারা ন্যায় নিষ্ঠ ও ধার্মিক অতিথিদের আপ্যায়ন করতেন। এখানকার মারাঠা নারীদের সৌন্দর্যের তিনি প্রভূত প্রশংসা করেছিলেন।

(ঘ.) সুলতানি যুগের ইতিহাসের বর্ননা :- ইবন বতুতার "রেহেলায়" দিল্লি সুলতানির ইতিহাস পাওয়া যায়। ইবন বতুতা দিল্লির প্রধান কাজি কামালউদ্দিনের কাছ থেকে মহম্মদ বিন তুঘলকের আগেকার সুলতানদের ইতিহাস সম্পর্কে জেনেছিলেন। এর ভিত্তিতে তিনি দিল্লির সুলতানির প্রতিষ্ঠা থেকে মহম্মদ বিন তুঘলকের রাজত্বকালের বিস্তারিত ইতিহাস তাঁর গ্রন্থে লিপিবদ্ধ করেছিলেন। ইবন বতুতা দিল্লি সুলতানির অন্যতম শাসক ইলতুৎমিস, গিয়াসউদ্দিন বলবন, আলাউদ্দিন খলজি এবং গিয়াসউদ্দিন তুঘলকের শাসন নীতির প্রভূত প্রশংসা করেন।

ইবন বতুতার মতে, সুলতান আলাউদ্দিন খলজি ছিলেন দিল্লির অন্যতম শ্রেষ্ঠ সুলতান। অন্যদিকে মহম্মদ বিন তুঘলক তাঁর পিতাকে ষড়যন্ত্রের মাধ্যমে হত্যা করে ১৩২৫ খ্রিঃ দিল্লির সিংহাসনে বসেন।

(ঙ.) মহম্মদ বিন তুঘলকের শাসন পদ্ধতি ও চরিত্র বিশ্লেষণ :- সুলতান মহম্মদ বিন তুঘলকের সময়কালের একজন প্রত্যক্ষদর্শী ছিলেন ইবন বতুতা। সুলতান মহম্মদ বিন তুঘলকের রাজত্বকালের ইতিহাস (১৩৩৩ - ১৩৪২) ইবন বতুতা তাঁর নিজস্ব অভিজ্ঞতার ওপর ভিত্তি করেই লেখেন। মহম্মদ বিন তুঘলকের আমলে প্রশাসনিক ও আর্থ - সামাজিক বহু তথ্য ইবন বতুতা তাঁর গ্রন্থে লিপিবদ্ধ করেন।

তাঁর মতে, মহম্মদ বিন তুঘলক ন্যায় বিচার ও সুশাসন প্রতিষ্ঠা করেছিলেন। তাঁর রাজত্বকালে দুর্ভিক্ষ দেখা দিলে সুহতান ছয় মাস ধরে দিল্লির বাসিন্দাদের খাদ্যশস্য সরবরাহ করেন। ব্যবসা বাণিজ্যের উন্নতির জন্য বহু শুল্ক রদ করেন। কৃষির উন্নতির জন্য সজসেচ ও কৃষিঋনের ব্যবস্থা করেন। প্রতি সোম ও বৃহস্পতিবার সুলতান ফৌজদারি আদালত বসিয়ে নিজেই বিচার করতেন। বিচারের ক্ষেত্রে ইসলামি শরিয়ৎ আইন অনুসরন করা হতো।

ইবন বতুতা সুলতানের সঙ্গে ব্যক্তিগত ভাবে মেলামেশার ফলে সুলতানের চরিত্র ও কৃতিত্ব সম্পর্কে অনেক কথাই জানতে পারেন। তাঁর মতে সুলতান ছিলেন মাতৃভক্ত ও ধর্মভীরু। তিনি নিয়মিত নামাজ পড়তেন ও রোজা রাখতেন। ইবন বতুতার মতে, সুলতানের চরিত্রে ভালো এবং মন্দ দুই ধরনের স্বভাবেরই সংমিশ্রণ দেখা গিয়েছিলো। 

মহম্মদ বিন তুঘলকের চরিত্র বিশ্লেষণ করতে গিয়ে ইবন বতুতা বলেছিলেন সুলতান একাধারে ছিলেন উদার, দয়ালু ও ন্যায় পরায়ন শাসক। অন্যদিকে ছিলেন ভয়ঙ্কর রকম নিষ্ঠুর। তিনি মহম্মদ বিন তুঘলককে নির্দ্ধিধায় রক্তপিপাসু বলে অভিহিত করেছিলেন। সুলতানের নিষ্ঠুরতার বহু প্রমান ইবন বতুতা তাঁর গ্রন্থে লিপিবদ্ধ করেন। 

তাঁর মতে প্রতিদিন সুলতানের প্রাসাদের দুই ধারে মুন্ডুকাটা মানুষের মৃতদেহ পড়ে থাকতো। মৃত্যুদন্ড কার্যকর করার পর জনমনে ত্রাস সঞ্চারের জন্য তা তিনদিন ফেলে রাখা হতো। মহম্মদ বিন তুঘলক কখনই তার সমালোচক বা বিরোধীদের সহ্য করতে পারতেন না। দিল্লির প্রখ্যাত দরবেশ শেখ শিহাবুদ্দিন সুলতানের অধীনে চাকুরি করতে অসম্মত হলে মহম্মদ বিন তুঘলক শেখের দাড়ি টেনে ছিঁড়ে দেওয়ার নির্দেশ দেন। সুলতান দিল্লি থেকে দৌলতাবাদে রাজধানী স্থানান্তরের সময় একজন অন্ধ ব্যক্তি দৌলতাবাদ যেতে রাজি না হওয়ায়, সুলতানের নির্দেশে ঐ অন্ধ ব্যক্তিকে দড়ি বেঁধে টানতে টানতে নিয়ে যাওয়া হয়। পথে ঐ ব্যক্তির অঙ্গ প্রত্যঙ্গ ছিন্ন ভিন্ন হয়ে শুধুমাত্র দড়ি বাঁধা একটি পা দৌলতাবাদে পৌঁছেছিলো।

ইবন বতুতা তাঁর রেহলা গ্রন্থে দিল্লি থেকে দৌলতাবাদে রাজধানী স্থানান্তরের কারন হিসাবে লোকমুখে শোনা নানা কারনের উল্লেখ করেছেন। এর মধ্যে একটি হলো, দিল্লির স্থানীয় লোকেদের আচার আচরনে অসন্তুষ্ট হয়ে সুলতান তাদের শাস্তি দানের জন্যই রাজধানী স্থানান্তর করেন।

(চ.) সুলতানের দরবারের পরিচয় :- ইবন বতুতার লেখায় মহম্মদ বিন তুঘলকের রাজসভার বিস্তারিত বিবরন পাওয়া যায়। ইবন বতুতার মতে, সুলতানের একটি বিশাল দরবার কক্ষ ছিলো, যাকে বলা হতো হাজার উস্তুন (হাজার সুতুন), যার মানে হাজার স্তম্ভ। স্তম্ভ গুলি ছিলো কাঠের এবং ছাদও কাঠের। এই দরবার কক্ষে বসে সুলতান দরবার চালাতেন।

দরবার সাধারনত বিকেলে বসলেও, মাঝে মধ্যে সকালেও বসতো। উঁচু জায়গায় সাদা কার্পেটে মোড়া সিংহাসনে পা মুড়ে সুলতান বসতেন। এই দরবার কক্ষেই সুলতান নানা রকম দান করতেন। এছাড়া, বন্দি অপরাধীদের হত্যা বা অঙ্গছেদের নির্দেশ দিতেন।

(ছ.) ডাক ব্যবস্থার পরিচয় :- ইবন বতুতার ভ্রমন বৃত্তান্ত থেকে সুলতানি যুগের ডাক ব্যবস্থার কথা জানা জানা যায়। ইবন বতুতার মতে তৎকালীন সময়ে ভারতে দুই ধরনের ডাক ব্যবস্থা প্রচলিত ছিলো। 
  • (১.) ঘোড়ার পিঠে চেপে চিঠিপত্র দ্রুত নিয়ে যাওয়ার ব্যবস্থাকে বলা হতো "উলাক"। 
  • (২.) অন্যদিকে পায়ে হেঁটে একজায়গা থেকে অন্য জায়গায় চিঠিপত্র পৌঁছানোর ব্যবস্থাকে বলা হতো "দাওয়া" । এই ব্যবস্থায় পত্রবাহকের হাতে থাকতো দুহাত লম্বা লাঠি আর লাঠির মাথায় তামার ঘন্টা লাগানো থাকতো।
উলাকের ক্ষেত্রে প্রতি চার মাইল অন্তর এবং দাওয়ার ক্ষেত্রে প্রতি মাইলের মধ্যে তিনটি করে ডাকস্টেশন থাকতো। নির্দিষ্ট স্টেশন অন্তর এক ব্যক্তির হাত থেকে অপর ব্যক্তি পত্র গ্রহন করে সামনের দিকে এগিয়ে চলতো, যতক্ষন না পত্রটি নির্দিষ্ট গন্তব্যে না পৌঁছায়। পত্র পাঠানোর ক্ষেত্রে উলাকের চাইতে দাওয়া অনেক দ্রুত পদ্ধতি ছিলো। 

(জ.) সমাজ ব্যবস্থার পরিচয় :- ইবন বতুতা তাঁর "কিতাব - উল - রেহলা" গ্রন্থে লিখেছেন, ভারতবর্ষে দুটি সম্প্রদায় ছিলো - বিজয়ী মুসলমান ও বিজিত হিন্দু। দুটি সম্প্রদায়ের মধ্যে কোন সদ্ভাব ছিলো না। একটি সম্প্রদায় অপর সম্প্রদায়কে ঘৃনা করতো। 

হিন্দুরা মুসলিমদের অপরিচ্ছন্ন, অপবিত্র ও ম্লেচ্ছ মনে করতো। যেকোন হিন্দুই মুসলমানের ছোঁয়া থেকে দূরে থাকতো। মুসলমানদের সঙ্গে একাসনে খাবার বা তাদের ছোঁয়া জল হিন্দুরা গ্রহন করতো না। বিপরীতদিকে মুসলমানরা বিধর্মী হিসাবে হিন্দুদের শুধু ঘৃনাই করতো না, রীতিমতো তাদের ওপর অত্যাচারও করতো। ইবন বতুতার বিবরনী থেকে জানা যায়, রাজধানী দিল্লির "কোয়াত - উল - ইসলাম" মসজিদের পূর্বদিকের প্রবেশ পথের দুটি তাম্রনির্মিত দেবমূর্তিকে ঘৃনার চোখে দেখা হতো। 

ইসলামে বিধর্মীদের যে দৃষ্টিভঙ্গিতে দেখা হয়, প্রতিষ্ঠিত ইসলামীয় শাসনতন্ত্রে সেটাই বাস্তবায়িত হয়। একজন মুসলমান হয়েও সুলতানি শাসনে হিন্দুদের অত্যাচারের এক নিরপেক্ষ বিবরন ইবন বতুতা লিখে গিয়েছিলেন। হিন্দুদের বলপূর্বক ধর্মান্তরিত করা, ক্রীতদাসে পরিনত করা, জিম্মি হিসাবে তাদের সামাজিক মর্যাদা হরন, হিন্দু নারীদের প্রতি নানা অমর্যাকর আচরনের বহু প্রমান ইবন বতুতা তাঁর গ্রন্থে তুলে ধরেছিলেন।

ইবন বতুতা হিন্দু রমনীদের লাঞ্ছিত হওয়ার কথা বলতে গিয়ে লেখেন - (১.) "দিল্লিতে ঈদ উৎসবের সময় দশজন বন্দিনী বিধর্মীকে সুলতানের উজির ইবনকে উপহার হিসাবে দেন। (২.) মহম্মদ বিন তুঘলক চিনের সম্রাটকে যেসব উপহার পাঠিয়ে ছিলেন তার মধ্যে একটি অমুসলিম ক্রীতদাস এবং নাচে গানে পারদর্শী একশো বিধর্মী ক্রীতদাসী ছিলো।

সাম্প্রদায়িক মুসলমানদের শাসনে হিন্দুদের কি ভয়াবহ অবস্থা হয় তার বর্ননা দিতে গিয়ে ইবন বতুতা লেখেন - (১.) সুলতানি শাসনে হিন্দুদের "জিম্মি" বা আশ্রিত জাতি হিসাবে ফসলের অর্ধেক রাজস্ব ও অন্যান্য অনেক দায়িত্ব পালন করতে হতো। (২.) হিন্দু অধ্যুষিত ছোট্ট শহর আলাপুরে স্থানীয় এক মুসলিম সেনাপতি, যিনি মুসলমানদের কাছে একজন আদর্শ ধার্মিক ব্যক্তি বলে পরিচিত ছিলেন, তাঁর ভয়াবহ অত্যাচারে হিন্দুরা সর্বদাই ভয়ে ভয়ে থাকতো (৩.) ইবন বতুতা যখন গোয়ালিয়র ভ্রমন করতে যান, তখন সেখানে দেখেন স্থানীয় দুর্গের এক অধ্যক্ষ এক হিন্দুকে দ্বিখন্ডিত করার প্রস্তুতি নিচ্ছিলেন। শেষপর্যন্ত ইবন বতুতার হস্তক্ষেপে হতভাগ্য হিন্দুটি প্রানে বেঁচে যায়। (৪.) ইবন বতুতা লেখেন, মাদুরার সুলতান গিয়াসউদ্দিন মহম্মদ শাহ দামাঘানি নারী - পুরুষ - শিশু নির্বিশেষে বহু বিদ্রোহী হিন্দু প্রজাদের হত্যা করেছিলেন। (৫.) চারদিক হিন্দু পরিবৃত ছোট্ট পারওয়ান শহরে চার হাজার মালাবারি মুসলিমের বসবাস ছিলো। নগরীর হিন্দু - মুসলমানরা প্রায়ই সংঘাতে লিপ্ত হতো। (৬.) হিমওয়াড়ের মুসলিমরা গোয়ার হিন্দু রাজার রাজপ্রাসাদটি দখল করে সেখানকার ১০,০০০ হিন্দুকে বিতাড়িত করে দেয়।

মুসলমান শাসনে হিন্দুদের মধ্যে যে ক্ষোভের জন্ম হয়েছিলো, তা থেকে দুই সম্প্রদায়ের মধ্যে ঘৃনা আরোও বৃদ্ধি পেয়েছিলো। ইবন বতুতা নিজেও হিন্দু - মুসলিম বৈষম্যের শিকার হয়েছিলেন। একবার ক্ষুধা তৃষ্ণায় তিনি এক হিন্দু অধ্যুষিত গ্রামে এসে খাদ্যদ্রব্য চাইলে কোন খাবারই তিনি পান নি। উল্টে স্থানীয় এক অধিবাসী তাকে হত্যা করতে গিয়েছিলো। - এ থেকেই বোঝা যায়, হিন্দুদের মনে মুসলমানদের প্রতিও কতখানি ক্ষোভ ও রাগ ছিলো। ইবন বতুতা তাঁর গ্রন্থের অন্য এক স্থানে লেখেন - "রাতে রাজপথে হিন্দুদের সঙ্গে দেখা হলে আমাদের রাস্তা অতিক্রম না করা পর্যন্ত তারা পথ ছেড়ে দিয়ে দাঁড়িয়ে থাকতো।" 

বস্তুত পক্ষে আলবেরুনীর ৩০০ বছর পর ইবন বতুতা ভারতে এসে যে বিবরন লিপিবদ্ধ করেছিলেন, তা থেকে মনে হয় ভারতে হিন্দু - মুসলিম দুই সম্প্রদায়ের সম্পর্কের কোন উন্নতি হয় নি। হিন্দু - মুসলিম সংঘাত ছাড়া ইবন বতুতা ভারতীয় সমাজে বেশ কিছু কুপ্রথা দেখেছিলেন। যার মধ্যে অন্যতম ছিলো সতীদাহ প্রথা, দাসপ্রথা, জাদুটোনা ইত্যাদি। তাঁর মতে, গঙ্গা নদীকে পবিত্র মনে করে অনেকে গঙ্গায় প্রান বিসর্জন দিতো।

(ঝ.) ব্যবসা বাণিজ্যের পরিচয় :- ইবন বতুতা তাঁর ভ্রমন বৃত্তান্তে তৎকালীন ভারতের ব্যবসা বাণিজ্যের বিষয়েও বহু তথ্য লিপিবদ্ধ করেন। ইবন বতুতার মতে, ভারতে মালাবারের অন্যতম শ্রেষ্ঠ ও ব্যস্ততম বন্দর ছিলো কুইলন, কালিকট, ম্যাঙ্গালোর, সিন্দাবুর (গোয়া)। সিন্দাবুর থেকে কুইলন পর্যন্ত ভারতের সমুদ্র উপকূল মালাবার নামে পরিচিত। মালাবারের বন্দর গুলিতে আরব দেশের বহু জাহাজ বানিজ্যের জন্য আসতো। এ যুগে বৈদেশিক ব্যবসা বাণিজ্য অনেকখানি বৃদ্ধি পেয়েছিলো।

পশ্চিম এশিয়া ও দক্ষিন পূর্ব এশিয়াতে ভারতের জিনিস পত্রের বিপুল চাহিদা ছিলো। বিশেষত, দেশীয় ও বৈদেশিক বাজারে ভারতীয় সুতিবস্ত্র, সূক্ষ্ম মসলিন ও রেশম বস্ত্রের ব্যপক চাহিদা ছিলো। ইবন বতুতা লিখেছেন, সুলতান মহম্মদ বিন তুঘলক দেশে ব্যবসা বাণিজ্যের উন্নতির জন্য অনেক শুল্ক তুলে দেন। এছাড়া বানিজ্যিক রাস্তার ধারে সরাইখানাবিশ্রামাগারের সুব্যবস্থা করেন।

ইবন বতুতার মতে, মালাবারের কালিকট বন্দর ছিলো পৃথিবীর বৃহত্তম বন্দরের একটি। এখানকার  হিন্দু রাজা জনগনের কাছে "সামুরি" (জামোরিন) নামে পরিচিত ছিলেন। ইবন বতুতার লেখায় সর্বপ্রথম কালিকটের রাজার সামুরি বা জামোরিন উপাধিটির কথা জানতে পারা যায়আরব সহ চিন, সুমাত্রা, শ্রীলঙ্কা, মালদ্বীপের বানিজ্যিক জাহাজ গুলি কালিকটে আসতো। ইবন বতুতার মতে, গুজরাটের ক্যাম্বে বন্দর ছিলো পৃথিবীর অন্যতম সুন্দর ও সুসজ্জিত বন্দর।

(ঞ.) কৃষি ব্যবস্থা ও উৎপন্ন দ্রব্যের পরিচয় :- ইবন বতুতা ভারতে কৃষিজ ফসল ও উৎপাদিত দ্রব্যের এক মনোজ্ঞ বর্ননা দিয়েছেন। তাঁর মতে, ভারতীয়রা বছরে দুবার ফসল ফলাতো। তবে ধানের চাষ হতো তিনবার। ধান ছাড়া গম ও জোয়ারের চাষও করা হতো।

ইবন বতুতা ভারতে এসে অনেক নতুন জিনিস দেখেছিলেন। তার মধ্যে অন্যতম ছিলো পান ও নারকেল। এই দুটি দেখে তিনি এতটাই বিস্মিত ও অভিভূত হয়ে যান যে, তিনি তাঁর ভ্রমন বৃত্তান্তে পান ও নারকেল নিয়ে সবিস্তারে বর্ননা লিপিবদ্ধ করেন। তিনি নারকেলকে মানুষের মাথার সঙ্গে তুলনা করেন। তাঁর মতে পান এমন একটি গাছ যার ফল নয়, পাতার জন্যই চাষ করা হয়।

পান ও নারকেল ছাড়াও ইবন বতুতা ভারতে আম, কাঠাল, জাম, আঙুর, ডালিম, শশা, নারকেল, তরমুজ, কলা, সুপারি চাষের কথা লিখেছেন। তাঁর মতে, তখন কনৌজের আঁখ, মালবের পান, গম, নারকেল ও সুপারির খুব সুনাম ছিলো। এছাড়া, মালাবারের দারুচিনি, লবঙ্গ, এলাচ, গোলমোরিচ, আদা, লঙ্কা জগৎ বিখ্যাত ছিলো। 

তিনি আরও লেখেন, গোয়ালিয়রের মার অঞ্চলের মতো উৎকৃষ্ট গম একমাত্র চিনে উৎপন্ন হতো। ভারতের মতো উৎকৃষ্ট কমলা লেবু পৃথিবীর কোথাও চাষ হতো না। আজ থেকে কয়েকশ বছর আগে ইবন বতুতা ভারতের প্রতিটি পরিবারের বাড়ির সংলগ্ন জমিতে ফুল, ফল ও সবজির বাগান দেখেছিলেন। এসব দেখে ইবন বতুতা অকপটে লিখেছিলেন ভারতে জিনিসপত্রের যে প্রাচুর্য তিনি দেখেছিলেন, তা পৃথিবীর অন্য কোথাও কখনো দেখেন নি। 

(ট.) ইবন বতুতার দেখা বাংলার পরিচয় :- ভারত থেকে চিন যাওয়ার পথে ইবন বতুতা বাংলার চট্টগ্রাম বন্দরে এসেছিলেন। তাঁর মতে, সুদকাওয়ান (চট্টগ্রাম) তখনকার বিখ্যাত বন্দর শহর ছিলো। চট্টগ্রাম থেকে ইবন বতুতা তাব্রিজ এ (শ্রীহট্টে) দরবেশ শেখ জালালউদ্দিনের সঙ্গে দেখা করতে গিয়েছিলেন। সেখান থেকে আসেন কামরূপ (অসম)। সেই সময় সিলেট কামরূপের অন্তর্গত ছিলো। সিলেট থেকে মেঘনা নদী দিয়ে তিনি সোনারগাঁ তে আসেন। মেঘনা নদীকে ইবন বতুতা "নীল নদী" বলে উল্লেখ করেছিলেন। সোনারগাঁ বন্দর থেকে সুমাদ্রাগামী এক চিনা জাহাজে চেপে চিনের জাইটুন বন্দরে (বর্তমান কোয়াংঝাউ) নামেন।

মনে রাখতে হবে, ইবন বতুতার জন্মভূমি ছিলো পৃথিবীর বৃহত্তম মরুভূমির পাশে। খুব স্বাভাবিক ভাবেই বাংলার নদ নদী পরিবেষ্টিত শস্য শ্যমলা প্রাকৃতিক শোভা তাঁকে মুগ্ধ করেছিলো।বাংলার মতো এতো সস্তা বাজার তিনি পৃথিবীর আর কোথাও দেখেন নি। বাংলার নদীর ধারে তিনি জলচক্র দেখেছিলেন। অগন্য বানিজ্যতরী দেখেছিলেন। এতদসত্ত্বেও বাংলার আদ্র পরিবেশ, বাষাকালে কাদা ভরা পথঘাট, প্লাবন, সাপ ও পোকামাকড়ের উপদ্রোপ ইত্যাদির কারনে তিনি বাংলাকে "দোজখ - ই - পুর - নিয়ামত" বা ভালো জিনিসে পরিপূর্ন একটি নরক এবং "অন্ধকারাচ্ছন্ন দেশ" বলে অভিহিত করেন।

ইবন বতুতার বাংলা আগমনের সময় পূর্ব বাংলার শাসক ছিলেন সুলতান ফকরউদ্দিন

(৫.) ইবন বতুতার ভ্রমন বৃত্তান্তের গুরুত্ব :- 

মধ্য যুগের ইতিহাস চর্চায় ইবন বতুতার ভ্রমন বৃত্তান্তকে ঐতিহাসিকরা বেশ কিছু কারনে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ বলে মনে করেন। 

প্রথমত, ইবন বতুতার আগে আর কোন পর্যটক সমুদ্র উপকূল থেকে দূর দেশের অভ্যন্তরে ঢুকে দীর্ঘদিন বসবাসের সাহস দেখাতে পারেন নি। ইবন বতুতা শুধু একজন ভ্রাম্যমাণ পর্যটকমাত্র ছিলেন না। তিনি ভারতে উচ্চ সরকারি পদে নিযুক্ত ছিলেন। এর ফলে তিনি খুব কাছ থেকে অভিজাতদের জীবনযাত্রা ও দরবারি রাজনীতিকে প্রত্যক্ষ করেছিলেন। সুলতান মহম্মদ বিন তুঘলককেও তিনি খুব কাছ থেকে দেখেছিলেন। এই কারনে একজন প্রত্যক্ষদর্শী হিসাবে ইবন বতুতার বিবরনীকে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ বলে মনে করা হয়। 

দ্বিতীয়ত, ইবন বতুতার ভ্রমন বৃত্তান্ত সুলতানি যুগের দরবারি ঐতিহাসিকদের ত্রুটি থেকেও মুক্ত। ইবন বতুতা ভারতে থেকে তাঁর ভ্রমন বৃত্তান্ত রচনা করেন নি। তিনি দেশে ফিরে যাবার পর নিজের ভ্রমন বৃত্তান্ত লেখেন। ফলে ভারতের সুলতানি শাসন ব্যবস্থা, ধর্ম, সমাজ ব্যবস্থা সম্পর্কে তিনি অকপট ভাবে সত্য কথা গুলি লিপিবদ্ধ করতে পেরেছিলেন, যা এদেশে দরবারি ঐতিহাসিকরা কখনই লিপিবদ্ধ করার সাহস রাখেন নি। 

তৃতীয়ত, ইবন বতুতার ভ্রমন বৃত্তান্তের আরেকটি বিশেষ দিক ছিলো এর নিরপেক্ষতা। ইবন বতুতা একজন বৈদেশিক পর্যটক ছিলেন। সম্পূর্ন নিরপেক্ষ দৃষ্টিভঙ্গিতে তিনি এদেশীয় সমাজ, অর্থনীতি, রাজনৈতিক ব্যবস্থাকে লিপিবদ্ধ করেন। নিজে একজন মুসলিম ধর্মাবলম্বী হওয়া সত্ত্বেও, এবং ভ্রমন পথে হিন্দু ডাকাতদের দ্বারা আক্রান্ত হওয়ার পরেও, অত্যন্ত নিরপেক্ষ দৃষ্টিভঙ্গিতে ইবন বতুতা সুলতানি আমলে হিন্দুদের দুরাবস্থা ও অত্যাচারের বিষয় গুলিকে তুলে ধরেন। সুলতানের অধীনে চাকুরি করা সত্ত্বেও তিনি মহম্মদ বিন তুঘলকের সমালোচনা করেছিলেন। তাঁর প্রশাসনের দুর্নীতিপূর্ন দিক গুলিকেও তুলে ধরেছিলেন। এইসব কারনে ঐতিহাসিক কে এম আসরফ বলেছেন, "সব বিবরনীর মধ্যে ইবন বতুতার বিবরনই সর্বোৎকৃষ্ট ও পূর্নাঙ্গ।

চতুর্থত, সুলতানি শাসনের একজন প্রত্যক্ষদর্শী হিসাবে ইবন বতুতা মহম্মদ বিন তুঘলকের সময়কালকে খুব কাছ থেকে দেখেছিলেন। তিনি সুলতানের অধীনে দীর্ঘদিন কাজি বা বিচারকের দায়িত্ব পালন করেন। প্রশাসনিক বহু নথিপত্র দেখার সুযোগ তাঁর হয়েছিলো। তাই মহম্মদ বিন তুঘলকের রাজত্বকালের ইতিহাস রচনায় তাঁর রেখে যাওয়া বিবরন অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ বলে মনে করা হয়। 

সবশেষে বলা যায়, ইবন বতুতার "কিতাব - উল - রেহলায়" শুধু ভারতের কথা নেই, আছে শ্রীলঙ্কা, মালদ্বীপ, সুমাত্রা ও চিনের কথাওচতুর্দশ শতাব্দীর মধ্য এশিয়া ও আফ্রিকার অনেক দেশ ও পথের কথাও ইবন বতুতার ভ্রমন বৃত্তান্তে উল্লেখ আছে। তাঁর ভ্রমন বৃত্তান্ত পড়েই পরববর্তীকালে বহু অভিযাত্রী সেই সমস্ত দেশ গুলিতে পাড়ি দেন। এখানেই ছিলো ইবন বতুতার ভ্রমন বৃত্তান্তের সবথেকে বড়ো গুরুত্ব।

(৬.) ইবন বতুতার ভ্রমন বৃত্তান্তের সীমাবদ্ধতা :- 

ইবন বতুতার ভ্রমন বৃত্তান্তও সমালোচনার উর্ধ্বে ছিলো না। বস্তুতপক্ষে ইবন বতুতার ভ্রমন বৃত্তান্তের বেশ কিছু ত্রুটি ও সীমাবদ্ধতার কথা ঐতিহাসিকরা তুলে ধরেছেন। যেমন - 

প্রথমত, ইবন বতুতা ফারসি বা হিন্দি ভাষা জানতেন না। এদেশের ভাষা না জানায় তিনি সাধারন মানুষের সঙ্গে খুব বেশি ভাব বিনিময়ের পর্যাপ্ত পরিসর পান নি। তিনি যা দেখেছেন, তা লিখেছেন। অনেক সময় লেখনীর মধ্যে অনেক মনগড়া কথাও তিনি লেখেন, যা সত্য ছিলো না। যেমন তিনি লিখেছিলেন কুতুব মিনারের চূড়া পর্যন্ত যে প্যাঁচানো সিঁড়িপথ আছে, তা ছিলো হাতি চলাচলের মতোই চওড়া। এটি নিঃসন্দেহে ভুল ও অতিরঞ্জিত ছিলো।

দ্বিতীয়ত, তিনি শুনে শুনে সুলতানি যুগের যে ইতিহাস লিপিবদ্ধ করেন, তা সম্পূর্ন নির্ভুলও ছিলো না। তিনি লিখেছেন সুলতান কায়কোবাদ কুতুবমিনার নির্মান করেন। এটি সম্পূর্ন ভুল তথ্য ছিলো। আবার মহম্মদ বিন তুঘলকের রাজধানী স্থানান্তরের কারন হিসাবে তিনি লিখেছিলেন, দিল্লির লোকজন সুলতানের প্রাসাদে রাত্রিতে কুরুচিপূর্ন পত্র লিখে নিক্ষেপ করতো। এতে বিরক্ত হয়ে দিল্লিবাসীদের শাস্তিদানের জন্যই তিনি দৌলতাবাদে রাজধানী স্থানান্তর করেন। আধুনিক ইতিহাস পর্যালোচনায় এই কারনটিকে সম্পূর্ন অনৈতিহাসিক ও ভ্রান্ত বলেই মনে করা হয়। 

তৃতীয়ত, ইবন বতুতার ভ্রমন বৃত্তান্তের আরেকটি সীমাবদ্ধতার দিক ছিলো ভারতের শিল্প ও সংস্কৃতির প্রকৃত বিবরন তাঁর রচনায় অনুপস্থিত ছিলো। তিনি হিন্দু যোগীদের অলৌকিক ক্ষমতা দেখে বিস্মিত হয়েছিলেন। কিন্তু তাদের ধর্ম ও সমাজ নিয়ে কোন আলোচনা করেন নি। আসলে ইবন বতুতা আলবেরুনীর মতো এদেশের সমাজ, সংস্কৃতি, দর্শন, ধর্ম ইত্যাদি বোঝার চেষ্টা করেন নি। এসব নিয়ে তার কোন আগ্রহও ছিলো না। খোলা চোখে তিনি যা দেখেছেন, তাই অকপটে লিপিবদ্ধ করেছিলেন। তার বিবরনীতে তাই ভারতের সামগ্রীক জীবনের পরিচয় নেই, আছে কিছু খন্ডচিত্র

প্রশ্নোত্তরে সংক্ষিপ্ত তথ্য :- 


1/50
ইবন বতুতা কোন দেশ থেকে ভারতে আসেন?
আফ্রিকার মরক্কো থেকে।
2/50
ইবন বতুতা ভারতে আসেন __________শতাব্দীতে ।
চতুর্দশ শতাব্দীতে।
3/50
ইবন বতুতা ভারতে কি নামে পরিচিত ছিলেন?
মৌলানা বদরুদ্দিন নামে।
4/50
ইবন বতুতার প্রকৃত নাম কি?
আবু আবদুল্লাহ মহম্মদ।
5/50
ইবন বতুতা ভ্রমনের উদ্দেশ্যে বের হন ________বছর বয়সে।
২১
6/50
ইবন বতুতা কত খ্রিঃ ভ্রমনের উদ্দেশ্যে গৃহত্যাগ করেন?
১৩২৫ খ্রিঃ।
7/50
ইবন বতুতা কত খ্রিঃ জন্মগ্রহণ করেন?
১৩০৪ খ্রিঃ মরক্কোর তাঞ্জিয়ার শহরে।
8/50
ইবন বতুতা কত খ্রিঃ ভারতে আসেন?
১৩৩৩ খ্রিঃ।
9/50
ইবন বতুতা কোন পথে ভারতে প্রবেশ করেন?
মধ্য এশিয়া হয়ে স্থলপথে ভারতে প্রবেশ করেন।/কাবুল, মূলতান ও পাঞ্জাব হয়ে ভারতে প্রবেশ করেন।
10/50
ইবন বতুতা কতদিন ভারতে অবস্থান করেন?
১৩৩৩ খ্রিঃ থেকে ১৩৪৭ খ্রিঃ পর্যন্ত ১৪ বছর ভারতে অবস্থান করেন।
11/50
ইবন বতুতার ভারত ভ্রমনকালে দিল্লির সুলতান কে ছিলেন?
মহম্মদ বিন তুঘলক।
12/50
ইবন বতুতার দেখা প্রথম ভারতীয় শহরটির নাম কি ছিলো?
জনানি।
13/50
ইবন বতুতার ভ্রমন বৃত্তান্তের নাম কি?
"কিতাব - উল - রেহলা"।
14/50
"কিতাব - উল - রেহলা" কোন ভাষায় লেখা?
আরবি ভাষায় ।
15/50
ইবন বতুতা কত খ্রিঃ তাঁর ভ্রমন বৃত্তান্তটি রচনা করেন?
১৩৫৪ খ্রিঃ।
16/50
"কিতাব - উল - রেহলা" - গ্রন্থটি কে লিপিবদ্ধ করেন?
ইবন জুজায়ি।
17/50
ইবন বতুতাকে দিল্লির কাজি হিসাবে কে নিযুক্ত করেন?
মহম্মদ বিন তুঘলক।
18/50
ইবন বতুতা কোন শহরকে "একটি মন ভোলানো শহর" বলে অভিহিত করেন?
লাহোর।
19/50
সিন্ধু প্রদেশের রাজধানীর নাম কি ছিলো?
মূলতান।
20/50
ইবন বতুতার মূলতান থেকে দিল্লি পৌঁছাতে কতদিন লেগেছিলো?
৪০ দিন।
21/50
ইবন বতুতার মতে ইসলামি প্রাচ্যের সবচেয়ে সুন্দর ও সবচেয়ে বড়ো শহর ছিলো ________।
দিল্লি।
22/50
ইবন বতুতার মতে দিল্লি কয়টি শহরের সমষ্টি ছিলো?
চারটি।
23/50
ইবন বতুতার মতে সমগ্র দিল্লি শহরে কয়টি ফটক /দরজা ছিলো?
আঠাশটি।
24/50
ভারতে আগত কোন পর্যটক সুলতানি যুগের ইতিহাস লিখেছিলেন?
ইবন বতুতা।
25/50
ঘোড়ার পিঠে বয়ে নিয়ে যাওয়া ডাক ব্যবস্থা পরিচিত ছিলো _______নামে।
উলাক।
26/50
পায়ে হেঁটে মানুষের বয়ে নিয়ে যাওয়া ডাক ব্যবস্থা কি নামে পরিচিত ছিলো?
দাওয়া নামে।
27/50
কোন ডাক ব্যবস্থায় পত্রবাহকের হাতে দুহাত লম্বা লাঠি ও ঘন্টা থাকতো?
দাওয়াতে।
28/50
ইবন বতুতা ভারতের কোন প্রদেশকে অন্ধকারাচ্ছন্ন দেশ বলেছিলেন?
বাংলাদেশকে।
29/50
ইবন বতুতা কাকে "ভালো জিনিসে পরিপূর্ন একটি নরক" বলে অভিহিত করেন?
বাংলাকে।
30/50
ইবন বতুতা বাংলার কোন নদীকে নীল নদী বলে অভিহিত করেন?
মেঘনা নদীকে।
31/50
ইবন বতুতা ভারত থেকে চিনযাত্রা করেন ________পথে।
জলপথে।
32/50
ইবন বতুতা বিদেশ ভ্রমণ শেষ করে কত খ্রিঃ নিজ দেশে ফিরে যান?
১৩৫৪ খ্রিঃ।
33/50
সুদাকাওয়ান এর বর্তমান নাম কি?
চট্টগ্রাম।
34/50
ইবন বতুতার মতে মালাবার অঞ্চলের বৃহত্তম বন্দরের নাম কি ছিলো?
কালিকট।
35/50
সন্দাবুর দ্বীপের বর্তমান নাম কি?
গোয়া।
36/50
ইবন বতুতা ভারতের কোন নদীকে পানজ্ আব বলে উল্লেখ করেন?
সিন্ধু নদীকে।
37/50
দিল্লির কোন সুলতান রাজধানী দিল্লি থেকে দৌলতাবাদে স্থানান্তর করেন?
মহম্মদ বিন তুঘলক।
38/50
কিতাব - উল - রেহলা গ্রন্থটি কয়টি অধ্যায়ে বিভক্ত ছিলো?
৮০ টি অধ্যায়ে।
39/50
ইবন বতুতা দিল্লির কোন সুলতানকে রক্তপিপাসু বলে অভিহিত করেন?
মহম্মদ বিন তুঘলককে।
40/50
ইবন বতুতার মতে সিন্ধু থেকে দিল্লি পৌঁছাতে সময় লাগতো _______দিন।
৫০
41/50
ইবন বতুতার মতে দিল্লি থেকে দৌলতাবাদ পৌঁছাতে সময় লাগতো _______দিন।
৪০
42/50
সিরি নগরী কে নির্মান করেন?
আলাউদ্দিন খলজি।
43/50
তুঘলকাবাদ নগরীর প্রতিষ্ঠাতা ছিলেন ________।
গিয়াসউদ্দিন তুঘলক।
44/50
মহম্মদ বিন তুঘলক কোন নগরী প্রতিষ্ঠা করেন?
জাহানপনাহ।
45/50
মহম্মদ বিন তুঘলকের দরবার কক্ষের নাম ছিলো ______।
হাজার উস্তুন(হাজার সুতুন) ।
46/50
ইবন বতুতা ভারতের কোন ফলকে মানুষের মাথার সঙ্গে তুলনা করেছিলেন?
নারকেল।
47/50
ইবন বতুতার পিতার কি নাম ছিলো?
আবদুল্লাহ ইবন মহম্মদ।
48/50
ইবন বতুতা যখন চিন যান তখন চিন শাসন করতো কোন শাসকরা?
মোঙ্গলরা।
49/50
মহম্মদ বিন তুঘলক কত খ্রিঃ দিল্লি থেকে রাজধানী দৌলতাবাদে স্থানান্তর করেন?
১৩২৬ - ২৭ খ্রিঃ।
50/50
ইবন বতুতার বাংলাদেশ ভ্রমনের সময় বাংলার সুলতান কে ছিলেন?
সুলতান ফকরউদ্দিন।
Post a Comment (0)
Previous Post Next Post