|
ঐতিহাসিক তথ্য ও তার ব্যাখ্যা |
(ক.) ঐতিহাসিক তথ্য কাকে বলে?
(১.) ইতিহাস হলো বিগত অতীতের অনন্ত সময়কালের বিভিন্ন ঘটনার ধারাবাহিক বিবরন বা কাহিনী।
(২.) মানব সভ্যতার উষালগ্ন থেকে আজ পর্যন্ত সারা বিশ্বে ঘটে যাওয়া বিভিন্ন ঘটনার প্রত্যেকটিই হলো ইতিহাসের এক একটি বিষয়বস্তু বা ঐতিহাসিক তথ্য।
(৩.) উদাহরন হিসাবে বলা যায়, আফ্রিকার তাঞ্জানিয়ার ওল্ডুভাই গিরিখাতে প্রাপ্ত এখনও পর্যন্ত মানবদেহের প্রাচীনতম জীবাশ্ম থেকে জানা যায়, আফ্রিকার মাটিতেই প্রথম মানুষের উদ্ভব ঘটেছিলো। আফ্রিকাতে আদিম মানুষের উদ্ভব সংক্রান্ত এই বিষয়টি একদিকে যেমন ঐতিহাসিক ঘটনা, অন্যদিকে তেমনি মানবেতিহাস সম্পর্কিত একটি মূল্যবান তথ্যও। এমনি ভাবে, মৌর্য সম্রাট অশোকের কলিঙ্গ যুদ্ধ, ১৭৫৭ খ্রিঃ পলাশীর যুদ্ধ বা ১৮৫৭ খ্রিঃ সিপাহী বিদ্রোহ, অথবা শশাঙ্ক পরবর্তী কালে বাংলায় মাৎস্যান্যায়ের অবস্থা - এগুলি সবই ইতিহাসের এক একটি তথ্য বা ঘটনা বা বিষয়বস্তু।
(খ.) ঐতিহাসিক তথ্য ও ঐতিহাসিক উপাদানের সম্পর্ক :-
ঐতিহাসিক তথ্যের (ঘটনা/বিষয়বস্তুর) সাথে ঐতিহাসিক উপাদানের (অতীত ঘটনার বস্তুগত সাক্ষ্যের) সম্পর্কটি অত্যন্ত নিবিড় ও গভীর।
(১.) একটির পর একটি ফুল গেঁথে যেমন মালা তৈরি করা হয়, ঠিক তেমনি ঐতিহাসিকও অতীতের একটির পর একটি তথ্য বা ঘটনা সাজিয়ে অতীত ইতিহাসের পুনঃনির্মান করেন।
(২.) কিন্তু অতীতের অনন্ত সময়কালের সব ঘটনার সাক্ষ্য বস্তুগত উপাদানে "তথ্য" হিসাবে সংরক্ষিত থাকে না। বিষয়টি একটি উদাহরণের সাহায্যে বুঝে নেওয়া যাক।
তুমি স্কুলে ক্লাস করছো। মাস্টারমশাইরা বিভিন্ন বিষয় তোমাদের পড়াচ্ছেন। এইসব ক্লাসের কিছু কিছু গুরুত্বপূর্ণ তথ্য বা ব্যাখ্যার কথা, বা গুরুত্বপূর্ণ পয়েন্ট (অর্থাৎ ঘটনা) তুমি বস্তুগত উপাদানে অর্থাৎ খাতায় লিখে রেখেছো। এখন, ক্লাসে মাস্টারমশাইরা পড়াতে গিয়ে তোমাকে যা যা বলেছেন, তার পুরোটাই কি তুমি লিখে রেখেছো? তা তো নয়। ইতিহাসের ঘটনার ক্ষেত্রেও বিষয়টি তেমনই। অতীতের অনন্ত সময়কালের সব ঘটনার সাক্ষ্য বা তথ্য বস্তুগত উপাদানে সবসময় সংরক্ষিত থাকে না। আজকের দিনের সব ঘটনাই কি কালকের সংবাদপত্রে খবর হয়ে প্রকাশিত হতে পারে? তা তো পারে না। সংবাদপত্রে প্রকাশিত খবরের বাইরে হয়তো আরোও গুরুত্বপূর্ণ কোন ঘটনা ঘটে গেছে, যার তথ্য রিপোর্টার পাননি।
(৩.) ঠিক একই ভাবে ইতিহাসের ক্ষেত্রেও অতীতের সব ঘটনার কথা আমরা জানতে পারি না। কেন জানতে পারি না, তার অনেক কারন আছে। যেমন -
- অতীতের সব ঘটনার সাক্ষ্য বা প্রমান সবসময় উপাদানে সংরক্ষিত থাকে না।
- এমন বহু ঐতিহাসিক উপাদান আছে, যেখানে হয়তো মানব ইতিহাসের গুরুত্বপূর্ণ কোন ঘটনা বা তথ্য লিপিবদ্ধ আছে, কিন্তু সেই মূল্যবান ঐতিহাসিক উপাদান এখনও খুঁজে পাওয়া যায় নি।
(৪.) কয়েকটি এলোমেলো ভাঙ্গা কাঁচকে জুড়ে যেমন দর্পন বা আয়না তৈরি করে রূপদর্শনের প্রয়াস করা হয়, ঠিক তেমনই ঐতিহাসিক অতীতের সাক্ষ্য রেখে যাওয়া উপাদান গুলি জুড়ে অতীতকে বা অতীতের ঘটনাবলীকে পুনঃনির্মান করার চেষ্টা করেন। এজন্য প্রখ্যাত ঐতিহাসিক জন বাগনেল বিউরি বলেছেন, "ইতিহাস হলো কিছু ভাঙ্গা টুকরো দিয়ে জোড়া এক বিশাল ধাঁধা, যার অনেক টুকরো হারিয়ে গেছে"।
(৫.) অতীতের ঘটনাবলীর সাক্ষ্য সবসময় উপাদানে সংরক্ষিত থাকে না বলে বা সঠিক উপাদান সবসময় পাওয়া যায় না বলে ঐতিহাসিক অনেক ঘটনা বা তথ্যের কথা ইতিহাসে জানা যায় না। যেমন -
- আর্য অনার্য সংঘাতের পর ভারতে অনার্যরা কোথায় হারিয়ে গেলো, সেসম্পর্কে ইতিহাসে কোন তথ্য পাওয়া যায় না।
- বিমান দুর্ঘটনার পর নেতাজি সুভাষচন্দ্র বসু সত্যিই কি মারা গিয়েছিলেন, এ সম্পর্কে সঠিক ঐতিহাসিক তথ্য আজোও পাওয়া যায় নি।
(৯.) এজন্য ঐতিহাসিককে ইতিহাস রচনার জন্য সঠিক ও নির্ভুল উপাদান নির্বাচন করতে হবে। কারন সঠিক ঐতিহাসিক উপাদানের সাহায্যেই একজন ঐতিহাসিক সঠিক ও সত্য ঘটনা এবং নির্ভুল ঐতিহাসিক তথ্য জানাতে পারেন।
(১০.) কোনটি ইতিহাসের উপাদান আর কোনটি ইতিহাসের উপাদান নয়, কোন উপাদানটি গ্রহনীয় আর কোনটি বর্জনীয়, তা সম্পূর্ণই ঐতিহাসিকের পেশাগত জ্ঞান, দক্ষতা ও দৃষ্টিভঙ্গির ওপর নির্ভর করে।
(গ.) তথ্যের উপস্থাপন ও ব্যাখ্যা সম্পর্কিত বিতর্ক :-
উনিশ শতকে একজন ঐতিহাসিকের কর্মপদ্ধতি কি হওয়া উচিত, তথ্যের উপস্থাপন বা তথ্যের বিচার বিশ্লেষণ - তা নিয়ে ঐতিহাসিক মহলে তীব্র বিতর্ক দেখা যায়।
(১.) ইতিহাস পুনর্গঠন বা পুনঃনির্মানের ক্ষেত্রে উনিশ শতক পর্যন্ত ধারনা ছিলো ঐতিহাসিকের কাজ হলো সৎ ও নিরপেক্ষ দৃষ্টিভঙ্গিতে অতীতের ঘটনা বা ঐতিহাসিক তথ্যকে তুলে ধরা। অর্থাৎ অতীতের প্রকৃত ঘটনাটিকে শুধুমাত্র তুলে ধরা।
(২.) কিন্তু বিশ শতকে একদল ঐতিহাসিকের আর্বিভাব ঘটে, যারা বলেন, ঐতিহাসিকের দায়িত্ব শুধুমাত্র প্রকৃত ঘটনা বা ঐতিহাসিক তথ্য তুলে ধরা নয়। ঘটনার ব্যাখ্যা, বিচার বিশ্লেষণ ও মূল্যায়ন করাও একজন ঐতিহাসিকের প্রকৃত কাজ।
যেমন - মৌর্য সম্রাট অশোক ২৬১ খ্রিঃ পূর্বাব্দে কলিঙ্গ যুদ্ধে লিপ্ত হয়েছিলেন। - এটি হলো একটি ঐতিহাসিক ঘটনা বা তথ্য। উনিশ শতকে ইতিহাস চর্চার উদ্দেশ্য বা ধারা অনুযায়ী এখানে ঐতিহাসিক শুধুমাত্র মূল ঘটনা বা তথ্যেরই উপস্থাপন করবেন। তার কোন ব্যাখ্যা বিশ্লেষণ করবেন না।
কিন্তু বিশ শতকের ঐতিহাসিকরা তথ্যের বিচার বিশ্লেষণের কথা বললেন, অর্থাৎ তিনি শুধু কলিঙ্গ যুদ্ধের তথ্যটির উপস্থাপন বা বর্ননাই দেবেন না। মৌর্য সম্রাট অশোক কেন কলিঙ্গ যুদ্ধে লিপ্ত হয়েছিলেন? এই যুদ্ধ অশোক বা মৌর্য সাম্রাজ্যের ওপর কিরূপ প্রভাব ফেলেছিলো, তার বিচার বিশ্লেষণের কথাও বলবেন। অর্থাৎ তথ্যের বিচার বিশ্লেষণ ও মূল্যায়ন করবেন।
(ঘ.) তথ্যের বিচার ও ব্যাখ্যার পক্ষে - বিপক্ষে মত :-
তথ্য বিশ্লেষণের পক্ষে মত :-
ঐতিহাসিক তথ্যের বিচার বিশ্লেষণের স্বপক্ষে মত দিয়েছেন, যে সমস্ত ঐতিহাসিক, তাদের মধ্যে আছেন - লর্ড অ্যাকটন, বেনেদিত্তো ক্রোচে, মাইকেল ওকশট, হেনরি টমাস বাকলে।
(১.) লর্ড অ্যাকটনের মত :- লর্ড অ্যাকটনের মতে, ইতিহাসের তথ্য গুলি হলো খুবই নীরস শুষ্ক কাষ্ঠ। এই তথ্য গুলি ঐতিহাসিকের বিচার বিশ্লেষণের মধ্য দিয়ে প্রানবন্ত ও আকর্ষনীয় হয়ে ওঠে। তার মতে, ইতিহাস শুধুমাত্র ঐতিহাসিক তথ্য বা ঘটনা গুলির কথাই উপস্থাপন করবে না। ঘটনার আসল সত্যকেও তুলে ধরবে। এজন্য ঐতিহাসিককে সর্বদা তথ্যের বিচার বিশ্লেষণও করতে হবে।
অর্থাৎ তাঁর মতে একজন ঐতিহাসিক মৌর্য সম্রাট অশোকের শুধু "ধম্মনীতির প্রচারের" তথ্য তুলে ধরবেন না। অশোকের ধম্মনীতি প্রচারের কারন ও উদ্দেশ্য গুলিকেও তুলে ধরবেন। একমাত্র তথ্য বিশ্লেষণ করেই ঐতিহাসিক অশোকের ধম্মনীতির আসল সত্য ও উদ্দেশ্যকে তুলে ধরতে পারবেন। একই ভাবে তিনি শুধু কলিঙ্গ যুদ্ধের বর্ননাই করবেন না। এই যুদ্ধের কারন ও ফলাফলকেও ব্যাখ্যা - বিশ্লেষন করবেন।
(২.) বেনেদিত্তো ক্রোচের মত :- ইতালীয় ঐতিহাসিক বেনেদিত্তো ক্রোচের মতে, "শুধুমাত্র তথ্যের উপস্থাপন ঐতিহাসিককের দায়িত্ব নয়, ঐতিহাসিকের কাজ হলো তথ্যের সঠিক মূল্যায়ন ও বিচার বিশ্লেষন করা।"
তাঁর মতে, ঐতিহাসিক কেবলমাত্র নিরপেক্ষ ভাবে ঐতিহাসিক ঘটনা বা তথ্যকে তুলে ধরবেন না। তিনি অতীতকে বিচারও করবেন। বর্তমানের চোখ দিয়ে ঐতিহাসিক অতীতকে দেখবেন ও বিচার বিশ্লেষণ করবেন।
যেমন - বর্তমানের মতো অতীতে খেলাধুলার ক্ষেত্রটি বিভিন্ন সময়ে কেমন ছিলো, সাধারণ মানুষের খাদ্যাভ্যাস কেমন ছিলো, শাসন ব্যবস্থার ধরন ও প্রকৃতি কেমন ছিলো, ইত্যাদি নানা বিষয় বর্তমানের আলোকে ঐতিহাসিক অতীতে খুঁজবেন বা মিলিয়ে দেখবেন। এইজন্য ঐতিহাসিক ক্রোচে বলেছেন - "All history is contemporary history" অর্থাৎ সকল ইতিহাসই সমসাময়িক ইতিহাস।
(৩.) মাইকেল ওকশটের মত :- মাইকেল ওকশটের মতে, "History is the Historian's experience..." অর্থাৎ ইতিহাস হলো ঐতিহাসিকের ব্যক্তিগত অভিজ্ঞতার ফসল। ঐতিহাসিক তথ্যের বিচার ও ব্যাখ্যা বিশ্লেষন করে ঐতিহাসিক অতীতের যে ঘটনা ও ঘটনার পিছনে আসল তথ্য ও সত্যকে উপস্থাপন করেন তাই হলো ইতিহাস। অর্থাৎ মাইকেলের মতে, ইতিহাস প্রকৃতপক্ষে কেমন হবে, তা ঐতিহাসিকের ওপরেই নির্ভর করে। ব্যক্তিগত অভিজ্ঞতার পার্থক্যের কারনেই ইতিহাস সব সময় এক হয় না। এক একজন লেখক এক একরকম ভাবে ইতিহাস লেখেন বা ঐতিহাসিক ঘটনাকে উপস্থাপন করেন। ফলে ইতিহাস চর্চায় একটি বৈচিত্র্য দেখা যায়।
হেনরি টমাস বাকলের মত :- ব্রিটিশ ঐতিহাসিক হেনরি টমাস বাকলে তথ্যের বিচার বিশ্লেষণের স্বপক্ষে বলতে গিয়ে যুক্তি দিয়ে বলেছেন, ইতিহাসে শুধুমাত্র তথ্য বা ঘটনা সংগ্রহ বা তার উপস্থাপন হলো কাঁচি দিয়ে কেটে তাকে আঠা দিয়ে জোড়া লাগানোর মতো ব্যাপার।
তথ্য বিশ্লেষণের স্বপক্ষে যুক্তি :-
ইতিহাসে তথ্য বিশ্লেষণের স্বপক্ষে বেশ কিছু যুক্তি দেওয়া হয়। যেমন -
(১.) কার্য - কারন সমন্ধ খুঁজে বের করা :-
ইতিহাসের কোন তথ্য বা ঘটনার বিশ্লেষণ করলে তার কারনটি সম্পর্কে জানতে পারা যায়। কোন যুদ্ধ, বিদ্রোহ বা ঘটনার বিবরন পেশ করেই ঐতিহাসিকের দায়িত্ব শেষ হয়ে যায় না। এর নেপথ্যে আসল কারটিকেও তুলে ধরতে হয়। তথ্য বা ঘটনা বিশ্লেষনের মাধ্যমে এটি করা যায়।
তথ্য বিশ্লেষণের মাধ্যমে ইতিহাসে কোন বিদ্রোহ, যুদ্ধ বা রাজার অথবা সাম্রাজ্যের পতনের কারন সম্পর্কে জানতে পারা যায়।
(২.) ইতিহাসকে আকর্ষনীয় করে তোলা :-
শুধুমাত্র তথ্য বা অতীতের ঘটনার বিবরন দিয়ে গেলে সাধারন পাঠকের কাছে ইতিহাস নিরস বলে মনে হবে। তথ্য বা ঘটনার বিচার বিশ্লেষন, অর্থাৎ কারন বা ফলাফলের নির্দেশ ইতিহাসকে অনেক আকর্ষনীয় করে তোলে।
(৩.) নতুন ব্যাখ্যা ও সত্যের সন্ধান :-
ইতিহাসে তথ্য বিশ্লেষণ করে নতুন ব্যাখ্যা ও সত্যেরও সন্ধান পাওয়া যায়। যেমন সাধারণ ভাবে আমরা জানি মৌর্য সম্রাট অশোক বৌদ্ধ ধর্মের প্রভাবেই অহিংসা নীতি গ্রহণ করেছিলেন। কিন্তু ঐতিহাসিক রোমিলা থাপার ঐতিহাসিক তথ্যের ব্যাখ্যা বিশ্লেষণ করে দেখিয়েছেন, শুধু বৌদ্ধ ধর্ম নয়, অশোকের সময়ে অর্থনৈতিক অগ্রগতির ফলে মৌর্য সমাজে নতুন নতুন বর্ন পেশা ও জাতির উদ্ভব ঘটে। পুরাতন চতুঃবর্ন কাঠামো ভেঙ্গে পড়ে। সামাজিক মর্যাদা লাভের জন্য শ্রেনী সংঘাত দেখা যায়। এই শ্রেনী সংঘাত এড়াবার উদ্দেশ্যেই অশোক অহিংসা নীতির প্রচার করেন।
আবার সিন্ধু নদীর তীরে অবস্থিত হওয়ার কারনে একসময় সিন্ধু সভ্যতাকে ঐতিহাসিকরা সিন্ধু সভ্যতা বলেই চিহ্নিত করেছিলেন। কিন্তু সাম্প্রতিক কালে তথ্য বিশ্লেষণ করে জানা গেছে, সিন্ধু সভ্যতার মূল কেন্দ্র বা সেন্টার ছিলো হরপ্পা নগরী।হরপ্পা নগরীর ছাঁচ, মাপ ও বৈশিষ্ট্য গুলি সিন্ধু সভ্যতার অন্যান্য নগরীতেও হুবহু অনুকরন বা অনুসরন করা হয়েছিলো। সবচেয়ে প্রাচীনতম উপস্থিতির নিদর্শন হরপ্পাতেই পাওয়া গেছে। তাই তথ্য বিশ্লেষণের ভিত্তিতে ঐতিহাসিকরা সিন্ধু সভ্যতাকে আর সিন্ধু সভ্যতা না বলে তাকে হরপ্পা সভ্যতা বলে অভিহিত করছেন।
(৪.) বিজ্ঞান সম্মত ইতিহাস চর্চা করা :-
উনিশ শতকে বেশ কিছু ঐতিহাসিক ইতিহাসকে বিজ্ঞানের সমতুল্য বলে ব্যাখ্যা করেন। বিজ্ঞানের মতোই ইতিহাসের কাজ হলো অনুসন্ধান বা গবেষণা করা, তথ্যের পর্যবেক্ষণ ও ব্যাখ্যা বিশ্লেষন করে মূল সত্যকে জানা। একমাত্র তথ্যের বিচার বিশ্লেষণের মধ্য দিয়েই প্রকৃত ঘটনার কার্য কারন সমন্ধকে খুঁজে পাওয়া সম্ভব এবং বিজ্ঞান সম্মত ইতিহাস চর্চা করা সম্ভব।
(৫.) মূল সত্য কখনো নসাৎ হয় না :-
ঐতিহাসিক তথ্য বা ঐতিহাসিক কোন ঘটনাকে ভিন্ন ভিন্ন দৃষ্টিভঙ্গিতে বিচার বিশ্লেষণ করলে অনেক নতুন তথ্য বা ঘটনাবলীর কথা জানা গেলেও, তথ্যের মূল সত্যটি কখনোই নসাৎ হয়ে যায় না।
যেমন - ১৮৫৭ খ্রিঃ সিপাহী বিদ্রোহের প্রকৃতি বিশ্লেষন করে আমরা এই বিদ্রোহে বিভিন্ন শ্রেণীর ভূমিকা সম্পর্কে নতুন তথ্যের হদিস পাই। এর ভিত্তিতে কেউ এই বিদ্রোহকে জাতীয় বিদ্রোহ, কেউ সামন্ত বিদ্রোহ, আবার কেউ শুধুই সিপাহী বিদ্রোহ বলেছেন। এখন ১৮৫৭ খ্রিঃ বিদ্রোহের চরিত্র নিয়ে কোন সার্বজনীন ঐক্যমত বা চূড়ান্ত সত্য জানা না গেলেও ১৮৫৭ খ্রিঃ যে সিপাহীদের বিদ্রোহ হয়েছিলো সেই মূল সত্যটিকে কি উপেক্ষা করা হয়? তা তো কখনোই হয় না। একই ভাবে অশোকের অহিংসা নীতি গ্রহণের পিছুনে নানা আর্থ - সামাজিক বা রাজনৈতিক যুক্তি দেওয়া হলেও, অহিংসা নীতির পিছনে বৌদ্ধ ধর্মের প্রভাবকেও তো কখনোই উপেক্ষা করা হয় না।
এইভাবে ইতিহাসে তথ্যের বিচার বিশ্লেষণ ঐতিহাসিক ও পাঠককে সত্যের গভীরতায় নিয়ে যায় কিন্তু মূল সত্য থেকে কখনোই বিচ্যুত করে না।
|
তথ্য বিশ্লেষণের পক্ষে - বিপক্ষে যুক্তি |
তথ্য বিশ্লেষণের বিপক্ষে মত :-
ইতিহাসের তথ্য বিশ্লেষণের বিপক্ষে যারা মত রেখেছেন, তাদের মধ্যে অন্যতম হলেন - লিওপোল্ড ভন রেঙ্কে, মার্ক ব্লখ ও বিউরি।
(ক.) লিওপোল্ড ভন র্যাঙ্কের মত :- জার্মান ঐতিহাসিক র্যাঙ্কের মতে, ঐতিহাসিক নিরপেক্ষ ও সততার সঙ্গে ঐতিহাসিক ঘটনা বা তথ্য তুলে ধরবেন। তাঁর মতে, ঘটনা বা তথ্যের বিচার বিশ্লেষণের কোন প্রয়োজন নেই। ঐতিহাসিক তথ্যের বিচার বিশ্লেষণ করে তার আবেগ ও সিদ্ধান্তকে কখনোই পাঠকের ওপর চাপিয়ে দেবেন না।
ইতিহাসে ঘটনা গুলি যেভাবে ঘটেছিলো ঐতিহাসিক ঘটনা গুলিকে সেইভাবেই উপস্থাপন করবেন। ইতিহাসে তথ্য বা ঘটনা উপস্থাপনের ক্ষেত্রে জাতীয়তাবাদী প্রভাব বা ব্যাখ্যাকেও Ranke পছন্দ করতেন না। এসব কারনের জন্য Ranke কে "আধুনিক ও বিজ্ঞানসম্মত ইতিহাস চর্চার জনক" বলা হয়।
(খ.) মার্ক ব্লখ এর মত :- ঐতিহাসিক মার্ক ব্লখও ইতিহাসের তথ্য বা ঘটনা বিশ্লেষণের বিরোধী ছিলেন। তাঁর মতে, ঐতিহাসিক তথ্য সংগ্রহ করে তার বিচার বিশ্লেষণ করতে গেলে ঐতিহাসিক তার সীমা অতিক্রম করবেন। কারন "ঐতিহাসিকের কাজ বিচার করা নয়, অতীতকে বোঝা।"
(গ.) জন বিউরির মত :- ব্রিটিশ ঐতিহাসিক জন বিউরির মতে, "History is a science, no less and no more " অর্থাৎ ইতিহাস হলো একটি বিজ্ঞান। এর বেশিও নয়, কমও নয়। তিনি বলেন, ঐতিহাসিক বৈজ্ঞানিক দৃষ্টিভঙ্গিতে ইতিহাস লিখবেন। যা ঘটেছে তার বেশিও নয়, আবার কমও নয়।
তাঁর মতে, ঐতিহাসিক তথ্যের বিচার বিশ্লেষণ করলে ইতিহাস হয়ে পড়বে জটিল ও বিভ্রান্তিকর। যেমন দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের জন্য কে দায়ী - এই প্রশ্নের উত্তরে কোন একজন ঐতিহাসিক জার্মানিকে দায়ী করবেন, কেউ আবার ইংল্যান্ড ও ফ্রান্সকে, কেউবা আবার আমেরিকাকে দায়ী করবেন। মহাবিদ্রোহের প্রকৃতি বিশ্লেষন করতে গিয়েও অনুরূপ মত ও তত্ত্ব উঠে আসবে। ফলে ইতিহাসচর্চা হয়ে উঠবে জটিল ও বিভ্রান্তিকর। সঠিক কোন সিদ্ধান্তে আসা যাবে না।
তথ্য বিশ্লেষণের বিপক্ষে যুক্তি :-
ইতিহাসে তথ্য বিশ্লেষণের বিপক্ষে ঐতিহাসিকরা বেশ কিছু জোরালো যুক্তি দিয়েছেন। যেমন -
(১.) ইতিহাস জটিল ও বিভ্রান্তিকর হয়ে উঠবে :-
তথ্য বিশ্লেষণের ফলে ইতিহাস জটিল ও বিভ্রান্তিকর হয়ে উঠবে। একই ঘটনা, যুদ্ধ বা ফলাফলের ভিন্ন ভিন্ন মত ও পরস্পর বিরোধী ব্যাখ্যা উঠে আসবে। ফলে পাঠকের কাছে ইতিহাস জটিল ও বিভ্রান্তিকর মনে হবে।
(২.) ব্যক্তিগত আবেগ ও দৃষ্টিভঙ্গিগত প্রভাব :-
তথ্য বিশ্লেষণ করলে ব্যক্তিগত আবেগ ও দৃষ্টিভঙ্গি ইতিহাসের বিকৃতি ঘটাবে। দেশ, কাল ও যুগ অনুযায়ী মানুষের আবেগ ও দৃষ্টিভঙ্গি বদলে যায়। বদলে যাওয়া এই দৃষ্টিভঙ্গির কারনে মহঃ আলি জিন্না ভারতের ইতিহাসে যেভাবে খলনায়ক হিসাবে চিত্রিত হন, পাকিস্তান বা বাংলাদেশে সেভাবে চিত্রিত হন না। সে দেশের ইতিহাসে জিন্না জাতীর জনক রূপে খ্যাত হন। একই ভাবে পরাধীন ভারতে বিপ্লবীরা সন্ত্রাসবাদী নামে আখ্যায়িত হলেও, স্বাধীন ভারতের জাতীয়তাবাদী ইতিহাস চর্চায় তারা স্বাধীনতা সংগ্রামী নামে অভিনন্দিত হন।
নিরপেক্ষ ইতিহাস চর্চার জন্য তাই তথ্য বিশ্লেষণের কোন প্রয়োজন নেই। অতীতের মূল ঘটনাকে তার মতোই অবিকৃত ভাবে উপস্থাপিত করতে হবে। নাহলে ইতিহাসের বিকৃতি ঘটবে।
(৩.) পাঠকের ওপর সিদ্ধান্ত চাপিয়ে দেওয়া :-
ঐতিহাসিক "ঘটনা বা তথ্যের" বিশ্লেষণ করলে, তার সিদ্ধান্ত ও আবেগ পাঠকের ওপর চাপিয়ে দেওয়া হয়। তাই একজন ঐতিহাসিকের প্রধান দায়িত্ব হলো দেশ, কাল ও যুগ নিরপেক্ষ থেকে শুধুমাত্র ঐতিহাসিক ঘটনা বা তথ্যকে উপস্থাপন করা।
(৪.) ঐতিহাসিকের ওপর দেশপ্রেমের প্রভাব :-
একজন ঐতিহাসিক যখন ইতিহাসের কোন তথ্য বা ঘটনার আলোচনা বা বিচার বিশ্লেষণ করতে বসবেন তখন কখনোই তিনি তার দেশপ্রেম বা জাতীয়তাবাদী মানসিকতাকে বিসর্জন দিতে পারেন না। ফলে ঐতিহাসিক তথ্য ও ব্যাখ্যার মধ্যে নানা ভুল ভ্রান্তি ও অপব্যাখ্যা দেখা যায়। জাতীয়তাবাদী মানসিকতার জন্য ইতিহাসের অনেক তথ্য বা ঘটনাকে অনেক সময় চেপেও দেওয়া হয়।
যেমন স্বাধীন ভারতের ইতিহাস চর্চায় হিন্দু মুসলিম সাম্প্রদায়িক দাঙ্গার অনেক তথ্য বা ঘটনাকে মূল ইতিহাস থেকে বাদ দেওয়া হয়। দেশের জাতীয় ঐক্যের পরিপন্থী এমন বহু ঘটনা ও তথ্যকে ভারতে ইতিহাস থেকে বাদ দেওয়া হয়েছে। ফলে জাতীয়তাবাদী মানসিকতার জন্য ভারতে নিরপেক্ষ ইতিহাস রচনা সম্ভব হয় নি।
এই সব সমস্যার কারনে ঐতিহাসিক Ranke ও বিউরির মতো ঐতিহাসিকরা ইতিহাসে কেবলমাত্র তথ্যের উপস্থাপনের কথা বলেছেন। সব ধরনের ব্যাখ্যা ও বিশ্লেষনের বিরোধীতা করেছেন। তাদের মতে, একমাত্র সৎ, দেশ, কাল, যুগ নিরপেক্ষ দৃষ্টিভঙ্গিতে শুধুমাত্র ঐতিহাসিক তথ্য উপস্থাপনের মধ্য দিয়েই ইতিহাসের যাবতীয় বিকৃতি ও বিভ্রান্তি দূর করা সম্ভব।
(ঙ.) তথ্যের বিশ্লেষণ সংক্রান্ত পক্ষ - বিপক্ষ মতের সমন্বয় ও ই এইচ কার এর অভিমত :-
ঐতিহাসিক তথ্যের শুধুই উপস্থাপনা, নাকি বিশ্লেষন - এই দুই মতের মধ্যে সামঞ্জস্য ঘটিয়ে সর্বজনগ্রাহ্য মত দিয়েছেন ঐতিহাসিক ই এইচ কার। তিনি তাঁর "What is History?" গ্রন্থে বলেছেন, ইতিহাসের তথ্যের বা মূল ঘটনাবলীর সঠিক উপস্থাপন ও তার বিশ্লেষন বা মূল্যায়ন দুয়েরই প্রয়োজন রয়েছে। ইতিহাস রচনায় সত্য ঘটনাবলি যথাসম্ভব নিরপেক্ষ ভাবে উপস্থাপন করার পর ঐতিহাসিককে তার নৈর্ব্যক্তিক ব্যাখ্যাও দিতে হবে। ই এইচ কারের মতে," ইতিহাস মূলত বর্তমানের চোখ দিয়ে ও তারই সমস্যার নিরিখে অতীতকে দেখা।"
ইতিহাসে সব উপাদান যেমন গ্রহনীয় নয়, ইতিহাসে উপাদান গ্রহনের আগে যেমন বিচার বিশ্লেষণ করতে হয়। তেমনি অতীতের সব তথ্য বা ঘটনাই ইতিহাস হয় না। কোন তথ্য বা ঘটনাটি ইতিহাসের পাতায় ঠাঁই পাবে তা ঠিক করেন ঐতিহাসিক। ঐতিহাসিক তথ্য বা ঘটনার বিচার বিশ্লেষণের পর তার গুরুত্বকে অনুধাবন করে তবেই ঐতিহাসিক ঐতিহাসিক তথ্যের নথিবদ্ধ করার সিদ্ধান্ত নেন।
ই এইচ কার তাই তাই যথার্থই বলেছেন, ঐতিহাসিকের কাজ শুধু নথিবদ্ধকরন নয়, মূল্যায়নও। একজন ঐতিহাসিক ঐতিহাসিক তথ্যের বা ঘটনার বিচার বিশ্লেষণ করে তারপরেই সিদ্ধান্ত নেন, কোন তথ্যটি বা ঘটনাটি নথিবদ্ধ করার উপযুক্ত।কোনটি নয়। অর্থাৎ তার মতে, ইতিহাসে তথ্যের উপস্থাপনের পাশাপাশি তথ্যের বিশ্লেষণ ও ব্যাখ্যাও জরুরি।
(চ.) উপসংহার ও শেষকথা :-
সবশেষে বলা যায়, তথ্য বিশ্লেষণের পক্ষে, বিপক্ষে দুই পক্ষের বক্তব্য ও নিজ নিজ যুক্তির মধ্যে যে সত্যতা আছে, তাকে কোন ভাবেই উপেক্ষা বা অস্বীকার করা যায় না। শুধুমাত্র তথ্যের বা ঘটনার উপস্থাপন ইতিহাসকে নিরস ও একঘেয়ে করে দেয়। অন্যদিকে তথ্যের বা ঘটনার বিশ্লেষণের ফলে তথ্যের বা ঐতিহাসিক ঘটনার অনেক সময়ই বিকৃতি ঘটে।
মনে রাখতে হবে, দেশ, যুগ ও সময়কালের নিরিখে মানুষের দেখার দৃষ্টিভঙ্গি বদলে যায়। ফলে ঐতিহাসিক তথ্য বা ঐতিহাসিক ঘটনার ব্যাখ্যা বিশ্লেষণও বদলে যায়। বদলে যাওয়া দৃষ্টিভঙ্গিতে ঐতিহাসিক তথ্যেরও বদল ঘটে যায়। এই বদলে যাওয়া দৃষ্টিভঙ্গির কারনেই ভারতের স্বাধীনতা সংগ্রামে মুসলিম বিচ্ছিন্নতাবাদী ধারাকে ভারতের জাতীয়তাবাদের পরিপন্থী ধারা হিসাবে তুলে ধরা হয়। অন্যদিকে পাকিস্তান ও বাংলাদেশী ইতিহাস চর্চায় এই বিচ্ছিন্নতাবাদী ধারাটিকে জাতীয়তাবাদী ধারা হিসাবে উপস্থাপিত হয়।
এজন্য ঐতিহাসিককে যথেষ্ট সতর্ক থাকতে হবে। সত্য ঘটনাকে উপস্থাপন ও বিশ্লেষনের ক্ষেত্রে ঐতিহাসিককে যথেষ্ট দায়বদ্ধ হতে হবে। তাকে দেশ, কাল ও যুগের সীমাবদ্ধতা এবং যাবতীয় আবেগকে উর্দ্ধে রেখে নির্মোহ ও নিরপেক্ষ দৃষ্টি নিয়ে ঐতিহাসিক তথ্য বা ঘটনাকে তুলে ধরতে হবে এবং তার ব্যাখ্যা করতে হবে। একমাত্র তবেই "নিরপেক্ষ ইতিহাস" রচনা করা সম্ভব হবে।