ইতিহাসের তথ্য বিশ্লেষণের বিভিন্ন দৃষ্টিভঙ্গি

ইতিহাসের তথ্য বিশ্লেষণের বিভিন্ন দৃষ্টিভঙ্গি
ইতিহাসের তথ্য বিশ্লেষণের বিভিন্ন দৃষ্টিভঙ্গি 

(অ.) ইতিহাস চর্চায় তথ্য ও দৃষ্টিভঙ্গির প্রতিফলন :- 

(১.) অতীতের অনন্ত সময়কালে ঘটে যাওয়া প্রত্যেকটি ঘটনাই হলো ইতিহাসের এক একটি তথ্য। এই তথ্য বা ঘটনাকে ঐতিহাসিকরা বিভিন্ন দৃষ্টিভঙ্গিতে দেখেন এবং বিশ্লেষন করে থাকেন।

(২.) দৃষ্টিভঙ্গি বা দেখার ধরন যেমন ব্যক্তিভেদে আলাদা হয়, তেমনই যুগ, দেশ ও কাল অনুসারেও আলাদা হয়ে থাকে। একটি উদাহরণের সাহায্যে বিষয়টি বুঝে নেওয়া যাক।

ধরা যাক, তোমার ক্লাসে রাহুল নামে একটি ছেলে পড়ে। এখন তোমাদের প্রত্যেককে পৃথক পৃথক করে একটি আলাদা ঘরে ডেকে জানতে চাওয়া হলো, রাহুল ছেলেটি কেমন? এখানে সকলের উত্তর কি একই হবে? তা তো হবে না। সকলের দেখার দৃষ্টিভঙ্গি আলাদা। সুতরাং রাহুল কেমন ছেলে সকলেই তা নিজস্ব দৃষ্টিভঙ্গি অনুযায়ী ব্যাখ্যা - বিশ্লেষন করবে। 

আরোও একটি উদাহরণ নেওয়া যাক। একদিন ক্লাস করতে করতে হঠাৎতি তোমাদের ক্লাসের মাস্টারমশাই সকলকে বললেন তোমরা এখন একটু বাইরে থেকে ঘুরে এসো। কিছুক্ষণ পর ঐ ক্লাসের মাস্টারমশাই প্রত্যেককে আলাদা করে ডেকে জানতে চাইলেন, তুমি বাইরে কি দেখলে? এর উত্তরে সকল ছাত্রই কি একই কথা বলবে? তা তো বলবে না। কেউ হয়তো বলবে, আমি একটি গাছে কয়েকটি পাখি দেখলাম। আবার কেউ দূরে রাস্তায় হয়তো কোনো অচেনা ব্যক্তির হেঁটে যাওয়ার কথা বলবে। 

এইভাবে ব্যক্তি ভেদে দেখার দৃষ্টিভঙ্গির বদল ঘটে। বদলে যাওয়া এই দৃষ্টিভঙ্গিতে অতীতকে দেখার ভঙ্গিমারও বদল ঘটে যায়। এই কারনে একই ইতিহাস ভিন্ন ভিন্ন লেখকদের ব্যাখ্যা ও বিশ্লেষনে বৈচিত্র্যময় হয়ে উঠে। এক একজন লেখক এক এক দৃষ্টিভঙ্গিতে ঐতিহাসিক তথ্য বা ঘটনা গুলির বিশ্লেষন করেন বলেই লেখক ভেদে আমাদের ইতিহাস বই গুলো আলাদা হয়ে যায়। 

ব্যক্তিভেদে যেমন দৃষ্টিভঙ্গির বদল ঘটে। তেমনি যুগ বা সময়কাল অনুসারেও আমাদের দৃষ্টিভঙ্গির বদল ঘটে যায়। যেমন মধ্য যুগে আমাদের সমাজের মেয়েদের আমরা যে দৃষ্টিভঙ্গিতে দেখতাম, এখন কি সেই দৃষ্টিভঙ্গিতে তাদের দেখে থাকি? তা তো দেখি না। 

আসলে সময়ের হাত ধরে আমাদের শিক্ষা, চেতনা ও সামাজিক মূল্যবোধে নানা বদল আসে। এই পরিবর্তনের হাত ধরে আমাদের দৃষ্টিভঙ্গিরও বদল ঘটে। নতুন দৃষ্টিভঙ্গিতে নতুন ভঙ্গীমায় আমরা যেকোন কিছুকেই মূল্যায়ন করতে, বা ব্যাখ্যা বিশ্লেষন করতে চাই। 

ইতিহাস চর্চায় "ঐতিহাসিক তথ্য বা ঘটনা" বিশ্লেষনে এইকারনেই বিভিন্ন যুগের ঐতিহাসিকদের মধ্যে বিভিন্ন দৃষ্টিভঙ্গি পরিলক্ষিত হয়। দৃষ্টিভঙ্গির তারতম্যের জন্যই ঐতিহাসিক তথ্য বা ঘটনা সম্পর্কে যুগে যুগে আমাদের ধারনার পরিবর্তন ঘটে চলে। 

যেমন পরাধীন ভারতে ব্রিটিশ ঐতিহাসিকদের সাম্রাজ্যবাদী দৃষ্টিভঙ্গিতে ঔরঙ্গজেবকে যতটা সাম্প্রদায়িক দেখানো হয়, অথবা ভারতবর্ষের প্রাচীন ও মধ্য যুগকে যতটা অন্ধকারাচ্ছন্ন দেখানো হয়, বর্তমানে জাতীয়তাবাদী ইতিহাস চর্চায় ততটা মনে হয় না। এককথায়, দৃষ্টিভঙ্গির পরিবর্তনের সাথে সাথে ইতিহাস সম্পর্কে আমাদের ধারনারও বদল ঘটে।

(আ.) ইতিহাস চর্চার বিভিন্ন দৃষ্টিভঙ্গির পরিচয় :-

ঐতিহাসিক তথ্য বা ঘটনা বিশ্লেষনে ইতিহাস চর্চার সূচনালগ্ন থেকে আজ পর্যন্ত (ক.) বিভিন্ন দৃষ্টিভঙ্গি, (খ.) ইতিহাস চর্চার আঙ্গিক ও (গ.) ঐতিহাসিক গোষ্ঠী গড়ে উঠেছে। এগুলির সংক্ষিপ্ত পরিচয় নীচে তুলে ধরা হলো।

ঐতিহাসিক তথ্য বিশ্লেষণের বিভিন্ন দৃষ্টিভঙ্গি
ঐতিহাসিক তথ্য বিশ্লেষণের বিভিন্ন দৃষ্টিভঙ্গি 


(১.) ধর্মীয় দৃষ্টিভঙ্গি :-

প্রাচীন যুগ ও মধ্য যুগের ঐতিহাসিকগন ধর্মীয় দৃষ্টিভঙ্গিতে ইতিহাস চর্চা করতেন। এই সময় ধর্মীয় দৃষ্টিভঙ্গির মাধ্যমেই ঐতিহাসিক তথ্য বা ঘটনার ব্যাখ্যা করা হতো ।

পৃথিবীর সব দেশেই প্রাচীন ও মধ্য যুগে ধর্মের ব্যাপক প্রভাব ছিলো। এই সময় মনে করা হতো জাগতিক সমস্ত ঘটনাই ঈশ্বরের নিয়ন্ত্রনে ঘটে থাকে। শুধু জাগতিক ঘটনা নয়, মানুষের আপন ভাগ্যও ঈশ্বর দ্বারা নিয়ন্ত্রিত ও পরিচালিত হয় বলে মনে করা হতো। এই কারনে প্রখ্যাত ঐতিহাসিক লিয়োপোল্ড ভন র্যাঙ্কে বলেছিলেন, "ঈশ্বরের অবস্থান ইতিহাসের মধ্যেই"। 

(ক.) ইতিহাস চর্চার আঙ্গিক :-

ধর্মীয় দৃষ্টিভঙ্গি দ্বারা যে ইতিহাস চর্চা করা হয়, সেখানে অতীতের ঘটনাবলী বা গুরুত্বপূর্ণ পরিবর্তন গুলি ঈশ্বরের নির্দেশে পরিচালিত বলে ব্যাখ্যা করা হতো। এমনকি রাজা কতটা ধর্মীয় অনুশাসন মেনে রাজ্য শাসন করছেন, তা দেখেই সেই সময় একজন রাজা কতখানি ভালো ও যোগ্য তার মূল্যায়নও করা হতো ।

(খ.) ঐতিহাসিক গোষ্ঠী :- 

ধর্মীয় দৃষ্টিভঙ্গির ইতিহাস চর্চার সমর্থকদের মধ্যে অন্যতম হলেন -

  • আধুনিক ঐতিহাসিক লিয়োপোল্ড ভন র্যাঙ্কে
  • জার্মান ঐতিহাসিক টয়েনবি। 
ধর্মীয় দৃষ্টিভঙ্গির ঐতিহাসিকদের মধ্যে মধ্য যুগের সকল ঐতিহাসিকরাই পড়েন। যেমন - জিয়াউদ্দিন বরনী, আমির খসরু এবং আরো অনেকে।

(২.) যুক্তিবাদী দৃষ্টিভঙ্গি :-


পঞ্চদশ শতকে ইওরোপে নবজাগরনের পর যুক্তিবাদী চিন্তা চেতনার জন্ম হয়। নবজাগরন প্রসূত "যুক্তিবাদ" ও "মানবতাবাদী দর্শন" ঈশ্বরের সর্বব্যাপী নিয়ন্ত্রনের চিন্তা ভাবনার মূলে কুঠারাঘাত করে। এর ফলে ইতিহাস চর্চায় ধর্মীয় দৃষ্টিভঙ্গির বদল ঘটে।

যুক্তিবাদী দৃষ্টিভঙ্গি বলতে বোঝায় কোন কিছু অন্ধবিশ্বাসে বিশ্বাস না করে তাকে যুক্তিতর্ক দিয়ে বিচার বিশ্লেষণের মাধ্যমে কোন সিদ্ধান্ত গ্রহণ করা।

(ক.) ইতিহাস চর্চার আঙ্গিক :- 

যুক্তিবাদী দৃষ্টিভঙ্গিতে যুক্তি ও বিজ্ঞানের ভিত্তিতে প্রাচীন ঘটনা সমূহকে বিচার বিশ্লেষণ করা হয়। 

যেমন - কোন রাজবংশের, রাজার অথবা সাম্রাজ্যের পতনকে ঈশ্বরের ইচ্ছা অথবা ঐগুলির পতন অন্যায়, অধর্ম ও পাপের বৃদ্ধির কারনেই হয়েছে বলে আর মনে করা হতো না। যুক্তিবাদী দৃষ্টিভঙ্গিতে কোন রাজা, রাজবংশ,সাম্রাজ্য অথবা যুদ্ধের জয় পরাজয় বা পতনের কারন গুলিকে যুক্তি ও বিজ্ঞান দিয়ে বিচার বিশ্লেষণ করে খোঁজা হয়। 

(খ.) ঐতিহাসিক গোষ্ঠী :- 

যুক্তি ও বিজ্ঞান সম্মত ইতিহাস চর্চার যারা অনুসারী ছিলেন, তাদের মধ্যে উল্লেখযোগ্য ছিলেন -
  • ভলতেয়ার
  • বার্কলে
  • কোঁৎ
  • ডারউইন। 
যুক্তিবাদী দৃষ্টিভঙ্গিতে প্রথম ইতিহাস লেখার চেষ্টা করেন ইতালির মানবতাবাদী ঐতিহাসিকগন। এদের মধ্যে উল্লেখযোগ্য ছিলেন -
  • পগ্গিও
  • এসকোলির ইনোক।

(৩.) সাম্রাজ্যবাদী দৃষ্টিভঙ্গি :-


যখন কোন শক্তিশালী দেশ অপর কোন দুর্বল দেশের ওপর বলপূর্বক প্রভাব ও নিয়ন্ত্রণ স্থাপন করে ঐ দেশের সম্পদকে শোষন করে অথবা নিজ স্বার্থে ব্যবহার করে, তাকেই সাধারণত "সাম্রাজ্যবাদ" বলা হয়।

ইওরোপে নবজাগরনের পর ভৌগলিক আবিষ্কারের মধ্য দিয়ে পশ্চিমী দেশগুলি এশিয়া আফ্রিকার অনুন্নত দেশ গুলিতে পৌঁছে গিয়ে সাম্রাজ্য বিস্তার করেছিলো। ইওরোপে শিল্প বিপ্লবের পর ঊনবিংশ শতাব্দীতে এই সাম্রাজ্যবাদ তীব্র আকার ধারন করেছিলো। 

এই সময় অর্থাৎ ঊনবিংশ শতাব্দীতে পশ্চিমী সাম্রাজ্যবাদী দেশ গুলি উপনিবেশ গুলিতে তাদের সাম্রাজ্যবাদী শাসনকে বৈধতা দানের জন্য যে ইতিহাস শুরু করেছিলো, তাকেই সাম্রাজ্যবাদী দৃষ্টিভঙ্গির ইতিহাস চর্চা বলা হয়।

১৮ শতকের শেষদিক থেকে ভারতে সাম্রাজ্যবাদী ইতিহাস চর্চার সূত্রপাত হয়।

(ক.) ইতিহাস চর্চার আঙ্গিক :-

সাম্রাজ্যবাদী দৃষ্টিভঙ্গির ইতিহাস চর্চায় এমন ভাবে অতীতের ঘটনা গুলিকে ব্যাখ্যা বিশ্লেষন করা হয়, যাতে বৌদ্ধিক ভাবে পাঠক সাম্রাজ্যবাদের বা বিদেশী শাসনের সমর্থক হয়ে উঠেন।

ঔপনিবেশিক আমলে সাম্রাজ্যবাদী ঐতিহাসিকদের হাত ধরেই ভারতে সর্বপ্রথম ইতিহাস চর্চার সূত্রপাত ঘটে। 
সাম্রাজ্যবাদী ইতিহাস চর্চায় দেখানো হয়, ভারতে বৈদিক আর্যদের হাত ধরে যে হিন্দু সভ্যতা ও সংস্কৃতির জন্ম হয়েছিলো, সেই বৈদিক আর্যরাই ভারতের বাইরে বিদেশ থেকে আগত ছিলেন। অসংখ্য বার বিদেশী আক্রমণে জর্জরিত ভারত বিদেশীদের দানেই বিভিন্ন ভাবে সমৃদ্ধ ও সভ্য হয়ে উঠেছিলো। প্রাচীন ভারতের খ্যাতিমান সকল রাজারা সাম্রাজ্যবাদী কার্যকলাপের জন্য জগৎবিখ্যাত। এদের মধ্যে অন্যতম ছিলেন - চন্দ্রগুপ্ত মৌর্য, অশোক, সমুদ্রগুপ্ত, হর্ষবর্ধনের, আলাউদ্দিন খলজি, আকবর প্রমুখ। 

জেমস মিল ১৮০৬ - ১৮১৮ খ্রিঃ মধ্যে ৬ খন্ডে ভারতের ইতিহাস লেখেন। এখানে তিনি সাম্রাজ্যবাদী দৃষ্টিভঙ্গিতে ভারতের ইতিহাসকে ৩ ভাগে ভাগ করেন। প্রাচীন যুগকে "হিন্দু যুগ", মধ্য যুগকে "মুসলিম যুগ" এবং আধুনিক যুগকে "ব্রিটিশ যুগ" নামে বিভক্ত করেন। তার এই যুগ বিভাজনের উদ্দেশ্য ছিলো ভারতে হিন্দু - মুসলিম সম্প্রদায়ের মধ্যে বিভাজন ও বিরোধ সৃষ্টি করে ব্রিটিশ শাসনকে শক্ত বৌদ্ধিক সমর্থনের ভিতের ওপর প্রতিষ্ঠিত করা। 

মিল তার ইতিহাসে হিন্দু যুগকে অবক্ষয়ের যুগ হিসাবে তুলে ধরেন। তিনি হিন্দুদের সমস্ত প্রতিষ্ঠান, ধ্যান ধারনা ও কাজকর্মের বিরোধিতা করেন। এমনকি তিনি ভারতবর্ষের অবক্ষয়ের পিছুনে হিন্দুদেরই দায়ী করেন। মিলের লেখা History of India গ্রন্থটি ইংল্যান্ডের Harley Burn স্কুলে প্রায় ৫০ বছর ধরে পাঠ্য পুস্তক হিসাবে পড়ানো হয়েছিলো। 

সাম্রাজ্যবাদী ঐতিহাসিকরা মনে করেন, ভারতীয়দের মধ্যে কোন সৃষ্টিশীলতা বা পরিবর্তনশীলতা নেই। তাই ভারতের সমস্ত প্রতিষ্ঠান, প্রথা, শিল্প, ও কারিগরি কৌশল গুলি অর্থাৎ সমস্ত ভালো বিষয় গুলি বাইরে থেকে অর্থাৎ বিদেশীদের দ্বারাই ভারতে প্রবেশ করেছিলো। 

(খ.) ঐতিহাসিক গোষ্ঠী :-

ভারতে সাম্রাজ্যবাদী দৃষ্টিভঙ্গির ঐতিহাসিকদের মধ্যে অন্যতম ছিলেন -
  • জেমস মিল
  • উইলিয়াম হান্টার
  • ব্যাবিংটন মেকলে
  • জন স্টুয়ার্ট মিল
  • অ্যাডাম স্মিথ
  • ভিনসেন্ট স্মিথ।

(৪.) জাতীয়তাবাদী দৃষ্টিভঙ্গি :-


সাম্রাজ্যবাদী দৃষ্টিভঙ্গিকে চ্যালেঞ্জ জানিয়ে ঊনবিংশ শতাব্দীতেই জাতীয়তাবাদী দৃষ্টিভঙ্গির জন্ম হয়।

জাতীয়তাবাদ সম্পূর্নই একটি "জাতি" কেন্দ্রীক ভাবগত রাজনৈতিক আদর্শ বা স্বাতন্ত্র্যবোধের ধারনা। কোন জনসমস্টি যখন নিজেদের দেশ, ভাষা, ধর্ম, সাহিত্য, সংস্কৃতি বা ঐতিহ্য নিয়ে গভীর একাত্মবোধ অনুভব করে, তখনই তাদের মধ্যে জাতীয়তাবাদের জন্ম হয়। জাতীয়তাবাদের একটি অপরিহার্য বৈশিষ্ট্য হলো "দেশপ্রেম"

উনিশ শতকে ভারতে সাম্রাজ্যবাদী ইতিহাস চর্চাকে চ্যালেঞ্জ জানিয়ে একদল ভারতীয় ঐতিহাসিক ইতিহাসে জাতীয়স্বার্থ সুরক্ষিত রাখতে এবং ইতিহাসের মাধ্যমে দেশপ্রেম ও দেশের গৌরমময় ঐতিহ্যকে তুলে ধরতে যে ইতিহাস চর্চা শুরু করেন, তাকেই "জাতীয়তাবাদী দৃষ্টিভঙ্গির ইতিহাস চর্চা" বলা হয়।

(ক.) ইতিহাস চর্চার আঙ্গিক :-

জাতীয়তাবাদী দৃষ্টিভঙ্গির ইতিহাস চর্চায় সাম্রাজ্যবাদী দৃষ্টিভঙ্গির সমালোচনা করা হয়। এখানে মিলের যুগ বিভাজনকে সমালোচনা করে দেখানো হয়, প্রাচীন যুগের সকল রাজারাই ধর্মীয় দিকে হিন্দু ছিলেন না। সুতরাং প্রাচীন যুগকে হিন্দু যুগ হিসাবে চিহ্নিত করা ঠিক নয়। আবার ভারতে মধ্য যুগে শাসনব্যবস্থার ওপরতলায় মুসলিম শাসকরা থাকলেও, প্রশাসনের নীচের স্তর গুলিতে শাসন ক্ষমতায় হিন্দুরা থেকে গিয়েছিলেন। সুতরাং মধ্য যুগকে মুসলিম যুগ হিসাবে চিহ্নিত করাও অবৈজ্ঞানিক। 

এই ভাবে জাতীয়তাবাদী ইতিহাস চর্চায় ইতিহাসে হিন্দু - মুসলিম সাম্প্রদায়িক সম্প্রতির তথ্য তুলে ধরে একদিকে সাম্রাজ্যবাদী দৃষ্টিভঙ্গির ভেদ নীতির যেমন সমালোচনা করা হয়, তেমনই অন্যদিকে জাতীয় ঐক্যের স্বপক্ষে ঐতিহাসিক তথ্যের উপস্থাপন করে ইতিহাসে জাতীয়স্বার্থঐক্য রক্ষারও চেষ্টা করা হয়। 

প্রাচীন ভারত জ্ঞান বিজ্ঞান ও দর্শন চর্চায় ইওরোপের থেকেও যে কয়েকগুন এগিয়ে ছিলো, জাতীয়তাবাদী ঐতিহাসিকরা তা তথ্য প্রমান দিয়ে দেখান। এই ইতিহাস চর্চায় দেশের গৌরবময় দিক গুলিকে তুলে ধরা হয়। যেমন - গুপ্ত যুগ সুবর্নযুগ, শাহজাহানের রাজত্বকাল শিল্প স্থাপত্যের ইতিহাসে সুবর্নযুগ, প্রাচীন ভারতে শূন্যের আবিষ্কার ইত্যাদি।

এর পাশাপাশি এই ইতিহাস চর্চায় ভারতে ব্রিটিশ শাসনের কুফল, শোষন ও অত্যাচারের কথাও ঐতিহাসিকরা তুলে ধরেন। পৃথিবীর সব দেশের ইতিহাস চর্চায় জাতীয়তাবাদী দৃষ্টিভঙ্গির প্রতিফলন দেখা যায়। 


(খ.) ঐতিহাসিক গোষ্ঠী :-

ভারতে জাতীয়তাবাদী দৃষ্টিভঙ্গির ঐতিহাসিকরা হলেন - 
  • তারাচাঁদ 
  • ড. রমেশচন্দ্র মজুমদার 
  • আচার্য যদুনাথ সরকার
  • ড. রোমিলা থাপার
  • ড. ইরফান হাবিব। 

(৫.) মার্কসবাদী দৃষ্টিভঙ্গি :-


বিশ শতাব্দীর পঞ্চাশের দশক থেকে মার্কসবাদী দৃষ্টিভঙ্গির ইতিহাস চর্চার সূত্রপাত ঘটে। ইতিহাসের এই মার্কসবাদী ব্যাখ্যার প্রবর্তক ছিলেন বিশিষ্ট জার্মান দার্শনিক কার্ল মার্ক্স। 
  

(ক.) ইতিহাস চর্চার আঙ্গিক:-

মার্কসবাদী দৃষ্টিভঙ্গিতে শ্রেনী সংগ্রামের আলোকে ঐতিহাসিক তথ্য বা ঘটনা গুলির ব্যাখ্যা - বিশ্লেষন করা হয়। মার্ক্সের মতে, প্রত্যেক সমাজেই দুটি শ্রেণির অস্তিত্ব থাকে। একটি সম্পত্তিবান ধনী শ্রেনী, আরেকটি সর্বহারা শ্রেনী। এই দুটি শ্রেণির মধ্যে দ্বন্দ্ব বা সংঘাতেই ইতিহাসে নতুন ঘটনা ও সমাজের জন্ম হয়

ভারতের ইতিহাসে মোপলা বিদ্রোহ, তিতুমিরের বারাসাত বিদ্রোহ অথবা পূর্ববঙ্গে দাঙ্গার ইতিহাসকে মার্কসবাদী ঐতিহাসিকরা সাম্প্রদায়িক মনোভাবের বদলে সম্পূর্ণ অন্য দৃষ্টিভঙ্গি, অর্থাৎ শ্রেণি সংগ্রামের আলোকে ব্যাখ্যা ও বিশ্লেষন করেন। মার্ক্সবাদী দৃষ্টিভঙ্গিতে ইতিহাসের সমস্ত ঘটনা বা কারনের পিছুনে অর্থনৈতিক কারন বা উদ্দেশ্যের ব্যাখ্যা দেওয়া হয়।

(খ.) ঐতিহাসিক গোষ্ঠী :-

ভারতে মার্ক্সবাদী দৃষ্টিভঙ্গির ঐতিহাসিকরা হলেন -
  • সুশোভন সরকার
  • ডি ডি কোশাম্বী
  • সুপ্রকাশ রায়
  • সুমিত সরকার
  • বিপানচন্দ্র
  • রোমিলা থাপার
  • ইরফান হাবিব
  • রামশরন শর্মা
  • ডি এন ঝা
  • রজনীপাম দত্ত 
  • এরিখ হবসবম। 

(৬.) সামাজিক দৃষ্টিভঙ্গি :-


১৯৬০ এর দশকে ফ্রান্সের অ্যানাল পত্রিকা গোষ্ঠীর ঐতিহাসিকদের উদ্যোগে যে নতুন দৃষ্টিভঙ্গির ইতিহাস চর্চা শুরু হয়, তাকে "নতুন সামাজিক ইতিহাস" বলা হয়।

ইতিহাস মানুষের কথা বলে। মানুষ সমাজবদ্ধ জীব। আমাদের আশেপাশে এবং আমাদের জীবনের সঙ্গে যুক্ত সবকিছুকে নিয়েই সমাজ ও সামাজিক বোধের নির্মান হয়। সবযুগে ও সবকালেই এটি সত্য। তাই ইতিহাসে শুধু রাজনৈতিক ঘটনাবলীর বিশ্লেষণ করলেই সম্পূর্ণ অতীতকে জানা যাবে না।সম্পূর্ণ অতীতকে জানতে গেলে এবং ঐতিহাসিক ঘটনা গুলির পরিবর্তনের ধারাকে সঠিক ভাবে উপলব্ধি করতে হলে সমাজের সবকিছুর ইতিহাসকেই আলোচনা করতে হবে। কারন যে কোন যুগেই সময়কালের প্রভাব ও ফলাফল সমাজের প্রত্যেকটি বস্তুকেই প্রভাবিত করে। 

(ক.) ইতিহাস চর্চার আঙ্গিক:-

নতুন সামাজিক ইতিহাসকে "আধুনিক ইতিহাস চর্চার জননী" বলা হয়। এই ইতিহাস চর্চায় সাধারণ মানুষের জীবন সংগ্রাম ও কাহিনীর কথা তুলে ধরা হয়। ইতিহাসের অন্তরালে পড়ে থাকা অবহেলিত শ্রেনী ও সাধারন মানুষের প্রাত্যহিক জীবনের সঙ্গে যুক্ত পোশাক পরিচ্ছদ, খেলাধুলা, যানবাহন, বিনোদন, বিজ্ঞান ও চিকিৎসা বিদ্যা, পরিবেশ ইত্যাদি সবকিছুই আলোচনা করা হয়।

(খ.) ঐতিহাসিক গোষ্ঠী :-

নতুন সামাজিক ইতিহাস প্রসঙ্গে প্রথম আলোকপাত করেন ইতালির চিন্তাবিদ জি ভিকোইংল্যান্ডে সামাজিক ইতিহাস চর্চার জনক ছিলেন - জি এম ট্রেভেলিয়ান। এছাড়া, এই ঘরানার অন্যান্য ঐতিহাসিকদের মধ্যে ছিলেন - 
  • ফার্নান্দ ব্রদেল
  • মার্ক ব্লখ
  • লুসিয়েন ফেভর

(৭.) নিন্মবর্গের ইতিহাস চর্চার দৃষ্টিভঙ্গি :-

১৯৬০ - ৭০ এর দশকে ইতিহাস চর্চায় এক নতুন ধারা যুক্ত হয়। একে বলা হয় "নিন্মবর্গের ইতিহাস চর্চার দৃষ্টিভঙ্গি"। ঐতিহাসিক ব্যারিংটন, লাদুরি, এরিখ হবসবম, জর্জ দুদে প্রমুখ ঐতিহাসিকরা ছিলেন এই ইতিহাস চর্চার পথপ্রদর্শক১৯৬৬ খ্রিঃ ই পি থমসন তাঁর "History from Below" প্রবন্ধে সর্বপ্রথম নিন্মবর্গের দৃষ্টিভঙ্গির অবতারনা করেন। 

ভারতে নিন্মবর্গের ইতিহাস চর্চার জনক ছিলেন ড. রনজিৎ গুহ১৯৮২ খ্রিঃ "Subaltern Studies" গ্রন্থ প্রকাশ করে ঐতিহাসিক রনজিৎ গুহ ভারতে নিন্মবর্গের ইতিহাস চর্চা শুরু করেন।

(ক.) ইতিহাস চর্চার আঙ্গিক:-

 এই ইতিহাস চর্চায় মুটে, মজুরি, কৃষক, দলিত, শ্রমিক, নারী ইত্যাদি সমাজের নীচে বা অন্তরালে পড়ে থাকা শ্রেনী গুলির অবস্থান ও ঐতিহাসিক নানা ঘটনাক্রমে তাদের ভূমিকার দিক গুলিকে তুলে ধরা হয়। 

উদাহরন হিসেবে বলা যায়, এই ইতিহাস চর্চার আলোকে গান্ধী পরিচালিত অসহযোগ, আইন অমান্য ও ভারত ছাড়ো আন্দোলন পর্বে কৃষক, শ্রমিক, ছাত্র, নারী ইত্যাদি অবহেলিত শ্রেনী গুলির অংশগ্রহণ ও ভূমিকার দিক গুলি নিয়ে আলোচনা করা হচ্ছে। ইতিহাসের বিভিন্ন আন্দোলন ও পরিবর্তনের পর্ব গুলিতে নারীদের অবস্থান ও ভূমিকার দিক গুলিকে ইতিহাসে তুলে আনা হচ্ছে। 

"নিন্মবর্গের ইতিহাস" ইতিহাসকে ওপর থেকে না দেখে নীচ থেকে দেখে ও বিচার বিশ্লেষণ করে। ইতিহাসে বড়ো বড়ো ঘটনার বদলে ছোটো ছোটো ঘটনার গুরুত্বকে তুলে ধরে। 

(খ.) ঐতিহাসিক গোষ্ঠী :-

ভারতে নিন্মবর্গের ঐতিহাসিকরা হলেন -
  • রনজিৎ গুহ 
  • গৌতম ভদ্র
  • পার্থ চট্টোপাধ্যায় 
  • জ্ঞান পান্ডে
  • এরিখ হবসবম
  • জর্জ দুদে
  • লাদুরি
  • ই পি থমসন
  • গায়ত্রী চক্রবর্তী

(৮.) অন্যান্য ইতিহাস চর্চার দৃষ্টিভঙ্গি 


(১.) উপরোক্ত দৃষ্টিভঙ্গি ছাড়াও ইতিহাস চর্চার আরোও অনেক দৃষ্টিভঙ্গি আছে। এর মধ্যে অন্যতম হলো কেমব্রিজ ইতিহাস চর্চা, অক্সফোর্ড ইতিহাস চর্চা ইত্যাদি।

(২.) ইংল্যান্ডের কেমব্রিজ বিশ্ববিদ্যালয়ের ঐতিহাসিক, গবেষকদেরই সাধারণভাবে কেমব্রিজ ঐতিহাসিক গোষ্ঠী বলা হয়। কেমব্রিজ গোষ্ঠীর ঐতিহাসিকরা বিভিন্ন দেশের জাতীয়তাবাদকে অস্বীকার বা উপেক্ষা করে ইতিহাস চর্চার নীতিতে বা দৃষ্টিভঙ্গিতে বিশ্বাসী ছিলেন। এই ইতিহাস চর্চার ধারায় সাম্রাজ্যবাদী ইতিহাস চর্চার প্রবনতা লক্ষ্য করা যায়।

(৩.) কেমব্রিজ গোষ্ঠীর ঐতিহাসিকদের মধ্যে অন্যতম ছিলেন -
  • ড. অনিল শীল
  • গর্ডন জনসন
  • ফ্রান্সিস রবিনসন
  • জুডিথ মার্গারেট ব্রাউন
(৪.) আবার নির্দিষ্ট কোন দৃষ্টিভঙ্গি অনুসরন না করে অমলেশ ত্রিপাঠী, তপন রায়চৌধুরী, অশীন দাশগুপ্ত প্রমুখ ঐতিহাসিকরা স্বাধীন দৃষ্টিভঙ্গি নিয়ে ইতিহাস চর্চা করেছেন এবং করছেন। এরা "প্রগতিপন্থী" নামে পরিচিত। 

(৫.) সাম্প্রতিক কালে পোস্টমর্ডান বা উত্তর আধুনিকতাবাদী ইতিহাস চর্চার ধারা বা প্রবনতা লক্ষ্য করা যায়। যদিও এটি এখনো সুপ্রতিষ্ঠিত হতে পারে নি। 
Post a Comment (0)
Previous Post Next Post