ভারতের স্বাধীনতা আন্দোলনের দুটি ধারা ছিলো। একটি ছিলো - (১.) অহিংস গন আন্দোলনের ধারা। অপর ধারাটি ছিলো - (২.) সহিংস সশস্ত্র বিপ্লবী সংগ্রামের ধারা। বিংশ শতাব্দীর সূচনা থেকেই পরস্পর বিরোধী এই দুই ধারায় ভারতের স্বাধীনতা আন্দোলন দুর্বার হয়ে উঠেছিলো।
শুরুর দিক থেকেই ভারতের সশস্ত্র বিপ্লবী আন্দোলনের সঙ্গে ছাত্রসমাজ ওতোপ্রতো ভাবে জড়িত ছিলো। মনে রাখতে হবে, ভারতের সশস্ত্র বিপ্লবী আন্দোলনের ধারাটি পরিচালিত হয়েছিলো দেশের তরুন যুবশক্তির উদ্যোগে। এই যুবশক্তির একটা বড়ো অংশই উঠে এসেছিলো ছাত্র সমাজ থেকে। তাই ভারতের সশস্ত্র বিপ্লবী আন্দোলনের সঙ্গে ছাত্রসমাজের যোগ ছিলো গভীর, ব্যাপক ও নিবিড়।
সশস্ত্র বিপ্লবী আন্দোলনে ছাত্রদের ভূমিকা |
(অ.) সশস্ত্র বিপ্লবী আন্দোলনের গতিপ্রকৃতি ও বৈশিষ্ট্য :-
ভারতে সশস্ত্র বিপ্লবী আন্দোলনের গতিপ্রকৃতির মধ্যে বেশ কিছু বৈশিষ্ট্য লক্ষ্য করা যায়। যেমন -
(১.) ভারতে সশস্ত্র বিপ্লবী আন্দোলন সারা দেশে প্রসারিত হলেও, বাংলা, মহারাষ্ট্র ও পাঞ্জাবেই এর তীব্রতা ছিলো সবচেয়ে বেশি।
(২.) হিন্দু ধর্মের আদর্শ ও ভাবধারার সঙ্গে সশস্ত্র বিপ্লবী আন্দোলনের এক গভীর সংযোগ ছিলো। এই কারনে ইংরেজ ঐতিহাসিক ভ্যালেন্টাইন চিরোল তার "ইন্ডিয়ান আনরেস্ট" (Indian Unrest) গ্রন্থে ভারতের বৈপ্লবিক আন্দোলনকে "হিন্দু বিদ্রোহ" বলে অভিহিত করেছিলেন।
(৩.) হিন্দু ভাবধারা দ্বারা পরিচালিত হলেও, বিপ্লবী আন্দোলনকারীদের মধ্যে কোন ধর্মীয় সংকীর্ণতা ছিলো না। প্রকৃতিগত দিক থেকে এই আন্দোলন ছিলো সহিংস ও ধর্মনিরপেক্ষ।
(৪.) শিক্ষিত, মধ্যবিত্ত, অর্থনৈতিক দিক থেকে স্বচ্ছল পরিবারের যুবকরাই সশস্ত্র বিপ্লবী আন্দোলনের মূল চালিকা শক্তি ছিলেন।
(৫.) প্রথম বিশ্বযুদ্ধের পূর্ব পর্যন্ত সময়কালে ভারতের সশস্ত্র বিপ্লবী আন্দোলনের মূল চরিত্র ও লক্ষ্য ছিলো গুপ্ত হত্যা ও সন্ত্রাসের মাধ্যমে ভারতে ব্রিটিশ শাসনকে অচল ও অকার্যকর করে দেওয়া।
(৬.) প্রথম বিশ্বযুদ্ধ চলাকালীন সময়ে বিপ্লবীরা গুপ্ত হত্যার পথ থেকে সরে এসে সশস্ত্র অভ্যুত্থান ঘটানোর পরিকল্পনা করে।
(৭.) গুপ্তহত্যা, রাজনৈতিক ডাকাতি, অস্ত্র লুন্ঠন, বিদেশী শক্তির সহায়তায় সশস্ত্র অভ্যুত্থানের মাধ্যমে স্থানীয় প্রশাসনকে দখল করা, ইত্যাদি ভারতের সশস্ত্র বিপ্লবী আন্দোলনের কয়েকটি উল্লেখযোগ্য বৈশিষ্ট্য ছিলো।
(৮.) ভারতের সশস্ত্র বিপ্লবী আন্দোলনের আরেকটি বৈশিষ্ট্যের দিক ছিলো, বিপ্লবীরা ইংরেজদের বিরুদ্ধে নানা নাশকতামূলক কাজ করলেও, তারা তাদের কার্যক্রমের মধ্য দিয়ে কখনই দেশের সাধারণ মানুষকে ক্ষতিগ্রস্ত করেন নি।
(৯.) সবশেষে বলা যায়, ভারতের সশস্ত্র বিপ্লবী আন্দোলন একটানা চলে নি। এই আন্দোলন ৩ টি ধারা বা পর্বের মধ্য দিয়ে চলেছিলো। যথা - ঊনবিংশ শতাব্দীর শেষদিকে থেকে ১৯১৩ খ্রিঃ পর্যন্ত অর্থাৎ প্রথম বিশ্বযুদ্ধের পূর্ব পর্যন্ত ছিলো সশস্ত্র বিপ্লবী আন্দোলনের "প্রথম পর্ব"। ১৯১৪ খ্রিঃ থেকে ১৯২০ খ্রিঃ পর্যন্ত ছিলো সশস্ত্র বিপ্লবী আন্দোলনের "দ্বিতীয় পর্ব", এবং ১৯২২ খ্রিঃ থেকে ১৯৩৪ খ্রিঃ পর্যন্ত ছিলো সশস্ত্র বিপ্লবী আন্দোলনের "শেষ ও অন্তিম পর্ব"।
(আ.) সশস্ত্র সংগ্রামে ছাত্রদের অংশগ্রহণের ধরন ও চরিত্র :-
সশস্ত্র বিপ্লবী আন্দোলনে ছাত্রদের অংশগ্রহণের ধরন ও চরিত্র বিশ্লেষণ করলে দেখা যায় -
(১.) ব্রিটিশ বিরোধী আন্দোলনের শুরু থেকেই ভারতের ছাত্র সমাজ সশস্ত্র সংগ্রামে অংশ নিয়েছিলো।
(২.) সশস্ত্র সংগ্রামে অংশগ্রহণকারী যুবকদের প্রত্যেকেরই বয়স ১৪ থেকে ২৭ মধ্যে ছিলো। এদের প্রায় প্রত্যেকেই ছিলেন হয় ছাত্র, না হয় সদ্য পাশ করা প্রাক্তন ছাত্র। এরা প্রত্যেকেই এসেছিলেন মধ্যবিত্ত স্বচ্ছল পরিবারগুলি থেকে।
(৩.) সশস্ত্র সংগ্রামে অংশ গ্রহণ করা ছাত্রদের মধ্যে স্কুল কলেজের ছাত্রদের সংখ্যাই ছিলো সবচেয়ে বেশি।
(৪.) তবে বিংশ শতাব্দীর তিরিশের দশক থেকে ছাত্রদের পাশাপাশি ছাত্রীরাও সশস্ত্র বিপ্লবী আন্দোলনে উল্লেখযোগ্য ভাবে অংশগ্রহণ করতে শুরু করেন এবং সক্রিয় ভাবে বিপ্লবী অভ্যুত্থানে অংশ নেন। এদের মধ্যে অন্যতম ছিলেন শান্তি ঘোষ, সুনীতি চৌধুরী, কল্পনা দত্ত, প্রীতিলতা ওয়াদেদ্দার, উজ্জ্বলা মজুমদার প্রমুখ।
(৫.) ধর্মনিরপেক্ষ ও অসাম্প্রদায়িক মানসিকতা নিয়েই ছাত্রসমাজ সশস্ত্র বিপ্লবী আন্দোলনে সামিল হয়েছিলো।
(৬.) সশস্ত্র বিপ্লবী আন্দোলনের নেতৃত্ব দান, সংগঠন পরিচালনা, গুপ্ত হত্যা অথবা সশস্ত্র অভ্যুত্থান ঘটানো, প্রতিটি ক্ষেত্রেই ছাত্ররা প্রথম সারিতে থেকে অগ্রনী ভূমিকা নিয়েছিলো।
(৭.) অহিংসাবাদী মূল স্রোতের জাতীয়তাবাদী আন্দোলন থেকে সশস্ত্র বিপ্লবী আন্দোলনে স্বাধীনতার ধারনা ও চেতনা ছিলো অত্যন্ত সুস্পষ্ট। বিংশ শতাব্দীর বিশের দশক থেকে কমিউনিস্ট মতাদর্শ, সমাজতান্ত্রিক চিন্তাধারা ও সাম্রাজ্যবাদ বিরোধী চেতনা ভারতের ছাত্রসমাজের মনকে গভীর ভাবে প্রভাবিত করে। এর ফলে বিংশ শতাব্দীর তিরিশের দশকে সশস্ত্র বিপ্লবী আন্দোলনে ছাত্র সমাজ ব্যাপক ভাবে অংশগ্রহণ করতে এগিয়ে আসে।
(৮.) সশস্ত্র সংগ্রামে ছাত্রদের অংশগ্রহণের আরেকটি লক্ষ্যনীয় দিক হলো, বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই পরিবারকে না জানিয়ে অত্যন্ত গোপনে ছাত্রসমাজ সশস্ত্র বিপ্লবী আন্দোলনে অংশগ্রহণ করেছিলো।
(৯.) ভারতীয় ছাত্রদের অনেকেই ইংল্যান্ড, ফ্রান্স, আমেরিকা ও জার্মানিতে পড়তে যেতেন। ছাত্ররা অনেকাংশেই সন্দেহের উর্ধ্বে ছিলেন। এই অনুকূল অবস্থানের সদ্ব্যবহার করে ছাত্ররা ভারতে সশস্ত্র বিপ্লবের পক্ষে আন্তর্জাতিক স্তরে বিদেশী রাষ্ট্রের সমর্থন ও নানা সামরিক ও আর্থিক সাহায্য নিয়ে আসেন।
(১০.) ছাত্রদের উদ্যোগেই বর্হিবিশ্বে ভারতের সশস্ত্র বিপ্লবী আন্দোলন সংগঠিত ও পরিচালিত হয়। লন্ডন, প্যারিস, বার্লিন, আমেরিকাতে প্রবাসী ভারতীয় ছাত্ররা নানা বিপ্লবী কেন্দ্র গড়ে তুলে ভারতীয় বিপ্লবীদের প্রয়োজনীয় রসদ সরবরাহ করেন।
সুতরাং একথা নির্দ্ধিধায় বলা যায়, ভারতের সশস্ত্র বিপ্লবী আন্দোলনে ছাত্রদের অবদান ও ভূমিকা ছিলো এককথায় অসামান্য।
(ই.) সশস্ত্র সংগ্রামে ছাত্রদের ভূমিকার বহুবিধ দিক :-
সশস্ত্র বিপ্লবী আন্দোলনের ধারা :-
ভারতে সশস্ত্র বিপ্লবী আন্দোলনের ৩ টি ধারা বা পর্ব লক্ষ্য করা যায় -
(ক.) প্রথম পর্ব :- ঊনবিংশ শতাব্দীর শেষদিকে থেকে ১৯১৩ খ্রিঃ পর্যন্ত অর্থাৎ প্রথম বিশ্বযুদ্ধের পূর্ব পর্যন্ত ছিলো সশস্ত্র বিপ্লবী আন্দোলনের "প্রথম পর্ব"। এই পর্বে সশস্ত্র আন্দোলন ছিলো বেশ কিছুটা ইতস্তত ও বিক্ষিপ্ত। এই পর্বের সশস্ত্র আন্দোলনের অন্যতম বৈশিষ্ট্য ছিলো - দেশের বিভিন্ন প্রান্তে ছোট ছোট প্রাদেশিক বা স্থানীয় বিপ্লবী সমিতি বা সংগঠনের উদ্ভব, অস্ত্র ও বোমা তৈরির কৌশল সম্পর্কে শিক্ষা লাভ করা, গুপ্ত হত্যা ও সন্ত্রাসের মধ্য দিয়ে ভারতে ব্রিটিশ শাসনকে অচল করে দেওয়া।
(খ.) দ্বিতীয় পর্ব :- ১৯১৪ খ্রিঃ থেকে ১৯২০ খ্রিঃ পর্যন্ত ছিলো সশস্ত্র বিপ্লবী আন্দোলনের "দ্বিতীয় পর্ব"। প্রথম বিশ্বযুদ্ধের সুযোগ নিয়ে এই পর্বে ভারতীয় বিপ্লবীদের কর্মতৎপরতা অনেক বেশি বেড়ে যায়। এই পর্বের বিপ্লবী আন্দোলন প্রথম পর্ব অপেক্ষা অনেক বেশি সংগঠিত ছিলো। ভারতের বিভিন্ন প্রদেশের বিপ্লবীদের মধ্যে এই সময় যোগাযোগ গড়ে ওঠে। বিদেশী শক্তির সহায়তায় এই পর্বে সশস্ত্র অভ্যুত্থান ঘটানোর একাধিক চেষ্টা করা হয়। তবে সবকটি অভ্যুত্থানই ব্যর্থতায় পর্যবসিত হয়।
(গ.) তৃতীয় পর্ব :- ১৯২২ খ্রিঃ থেকে ১৯৩৪ খ্রিঃ পর্যন্ত ছিলো সশস্ত্র বিপ্লবী আন্দোলনের "শেষ ও অন্তিম পর্ব"। এই পর্বে বিপ্লবী আন্দোলনের ব্যপকতা ও প্রসার দ্রুত বৃদ্ধি পায় এবং বিপ্লবী আন্দোলন সবথেকে বেশি তীব্র হয়ে ওঠে। বৈপ্লবিক নাশকতামূলক হত্যাকান্ড ও সশস্ত্র বিপ্লবী অভ্যুত্থান দুটিই একসঙ্গে এই পর্বে লক্ষ্য করা যায়।
(১.) প্রথম পর্বে সশস্ত্র বিপ্লবী আন্দোলনের ধারা
ঊনবিংশ শতাব্দীর শেষভাগ থেকেই ভারতে সশস্ত্র বিপ্লবী আন্দোলনের পদধ্বনি শোনা যায়। প্রথম পর্বে ভারতে সশস্ত্র বিপ্লবী আন্দোলনের মূল কেন্দ্র ছিলো মহারাষ্ট্র, পাঞ্জাব ও বাংলা।
(ক.) মহারাষ্ট্রে সশস্ত্র আন্দোলন ও ছাত্রসমাজ
ভারতে সশস্ত্র বিপ্লবী আন্দোলনের প্রথম সূত্রপাত ঘটে মহারাষ্ট্রে। সেখানে বাসুদেও বলবন্ত ফাড়কে মূলত ছাত্র ও যুব সমাজকে নিয়ে প্রশাসনযন্ত্র অচল করার কাজে তৎপর হন।
বলবন্ত ফাড়কে
১৮৭৬ - ৭৭ খ্রিঃ বোম্বাই প্রেসিডেন্সিতে ভয়াবহ দুর্ভিক্ষের সময় সরকার জনসাধারণের কোনরকম সাহায্য না করে নির্লিপ্ত ও উদাসীন থাকে। এই অবস্থায় ফাড়কে নির্দয় ব্রিটিশ শাসনকে উচ্ছেদ করার জন্য সশস্ত্র বিপ্লবী সংগ্রাম শুরু করেন। তিনি উপজাতি যুবক ও ছাত্রদের নিয়ে শিবাজীর আদর্শে একটি সেনাদল গঠন করেন। এছাড়া তিনি একটি গুপ্ত সমিতিও গঠন করেন।
ফাড়কের বিপ্লবী অভ্যুত্থানের প্রধান পরিকল্পনা গুলি ছিলো - (১.) সরকারি কোষাগার লুন্ঠন,
(২.) "সাউকার" নামে মহাজনদের ধনসম্পত্তি লুন্ঠনের জন্য ডাকাতি,
(৩.) রেল, ডাক ও যোগাযোগ ব্যবস্থা বিচ্ছিন্ন করে দেওয়া,
(৪.) কারাগার থেকে বন্দীদের মুক্ত করা। কিন্তু ফাড়কের পরিকল্পনা গুলি শেষপর্যন্ত পুলিশ জানতে পারে এবং ১৮৭৯ খ্রিঃ সরকার তাকে এডেন দুর্গে বন্দী রেখে যাবজ্জীবন কারাদণ্ড দেয়।
ফাড়কের পরিকল্পনা ব্যর্থ হলেও, অস্ত্রশস্ত্র সংগ্রহ করে ছাত্র যুবদের সামরিক শিক্ষাদানের যে পরিকল্পনা তিনি করেছিলেন, তা পরবর্তীকালে ভারতের বিপ্লবী সমিতি গুলি গ্রহন করেছিলো। তার সশস্ত্র বিপ্লবী পরিকল্পনা গুলি অনুকরন করেই পরবর্তীকালের বিপ্লবীরা সশস্ত্র অভ্যুত্থান ঘটনার চেষ্টা করেছিলেন। এই কারনে ঐতিহাসিক রমেশচন্দ্র মজুমদার বাসুদেও বলবন্ত ফাড়কে কে "ভারতের বিপ্লবী আন্দোলনের জনক" বলে অভিহিত করেছিলেন।
বাল গঙ্গাধর তিল
ফাড়কের মৃত্যুর পর মহারাষ্ট্রে সশস্ত্র আন্দোলন অল্প কিছুকাল স্তব্ধ থাকে। কিন্তু ঊনবিংশ শতাব্দীর শেষের দিকে বাল গঙ্গাধর তিলকের নেতৃত্বে পুনরায় বিপ্লবী আন্দোলন শুরু হয়।
তিলক মারাঠী ও কেশরী নামে দুই পত্রিকা এবং গনপতি উৎসব (১৮৯৪) ও শিবাজী উৎসবের (১৮৯৫) মাধ্যমে ছাত্র যুবদের জাতীয়তাবাদী ভাবধারায় উজ্জিবিত করেন। তিলকের অনুপ্রেরণায় মহারাষ্ট্রে "ইয়ং ইতালির" ধাঁচে একদল ছাত্র "বালসমাজ" নামে এক গুপ্ত সমিতি গঠন করে। বাল সমাজের কার্যকলাপ ওয়ার্ধা, নাগপুর এবং অমরাবতী শহরে বিস্তৃত হয়। ছাত্রদের মধ্যে ব্রিটিশ বিরোধী মনোভাব সঞ্চারে বালসমাজ বিশেষ উদ্যোগী হয়।
মহারাষ্ট্রের আরেক দেশপ্রেমিক ও ছাত্র পান্ডুরং খানখোজে ওয়ার্ধায়" আর্যবান্ধব সমাজ" নামে একটি বিপ্লবী সমিতি গঠন করেন। এর শাখা পাঞ্জাব ও লাহোরে প্রতিষ্ঠিত হয়। বলা বাহুল্য, আর্যবান্ধব সমাজের সদস্যদের বেশিরভাগই ছিলেন ছাত্র। এরা গোপনে গেরিলা ও সামরিক যুদ্ধের শিক্ষা গ্রহণ করতো। তিলকের সহায়তায় আর্যবান্ধব সমাজের প্রতিষ্ঠাতা ছাত্র পান্ডুরং খানখোজে সামরিক শিক্ষার জন্য জাপানে যান। আর্যবান্ধব সমাজ ব্রিটিশ সেনা বাহিনীর ভারতীয় সিপাহীদের মধ্যে বৈপ্লবিক আদর্শ প্রচারের চেষ্টা করে।
বিনায়ক দামোদর সাভারকর
পুনার ফার্গুশন কলেজের বি এ র ছাত্র ছিলেন বিনায়ক দামোদর সাভারকর। ১৮৯৯ খ্রিঃ মহারাষ্ট্রের নাসিক শহরে তিনি "মিত্রমেলা" নামে একটি সমিতি স্থাপন করেন। এর উদ্দেশ্য ছিলো সশস্ত্র সংগ্রামের মাধ্যমে ভারতের স্বাধীনতা অর্জন করা। ১৯০৪ খ্রিঃ মিত্রমেলার নাম বদল করে রাখা হয় "অভিনব ভারত"।
মিত্রমেলা বা অভিনব ভারতের সংখ্যাগরিষ্ঠ সদস্যই ছিলো স্কুল কলেজের ছাত্র। মহারাষ্ট্রের সর্বত্র অভিনব ভারতের শাখা প্রতিষ্ঠিত হয় পুনা এবং বোম্বাইয়ের প্রায় প্রতিটি কলেজে অভিনব ভারতের কেন্দ্র স্থাপিত হয়। বিদেশী শাসন থেকে দেশকে মুক্ত করার উদ্দেশ্যে এই সমিতি জাতীয়তাবোধক পুস্তক, পত্রিকা ও সঙ্গীত প্রচার করতে থাকে।
বাংলাদেশের বিপ্লবীদের সঙ্গে অভিনব ভারতের ছাত্র বিপ্লবীরা যোগাযোগ স্থাপন করেন। ১৯০৬ খ্রিঃ সাভারকর লন্ডনে যান এবং সেখান থেকে পিস্তল সংগ্রহ করে তা তাঁর শিষ্যদের সাহায্যে ভারতে পাঠিয়ে দেন। সাভারকরের দলের পি এন ব্যাপাত ও মির্জা আব্বাস বাংলার (মেদিনীপুরের) বিপ্লবী ছাত্র হেমচন্দ্র কানুনগোর সঙ্গে একত্রে বোমা প্রস্তুতির কৌশল শিক্ষার জন্য প্যারিসে সমবেত হন।
অন্যান্য গুপ্ত সমিতি, গুপ্তহত্যা ও মামলা :-
অভিনব ভারত ছাড়া ১৯০৭ খ্রিঃ মধ্যে বোম্বাই, পুনা, নাসিক, কোলাপুর, সাতারা, গোয়ালিয়র, বরোদা, নাগপুরে অনেক গুলি গুপ্ত সমিতি গড়ে উঠেছিলো। এই গুপ্ত সমিতি গুলি ব্যাপক হারে বোমা তৈরি করতে থাকে। বলা বাহুল্য, বোমা বাঁধার মতো ঝুঁকিপূর্ন ও দুঃসাহসী কাজগুলি তরুন ছাত্র যুবরাই করেছিলো। কিন্তু দুর্ভাগ্যক্রমে কোলাপুরে এক গুপ্ত সমিতির এক বোমা বিস্ফোরণে সমগ্র ব্যাপারটি প্রকাশিত হয়ে পড়ে।
এই ঘটনায় পুলিশ বহু ছাত্র যুব বিপ্লবীকে গ্রেফতার করে কোলাপুর বোমার মামলা দায়ের করে। এই মামলায় বহু বিপ্লবীর দীর্ঘ মেয়াদী কারাদন্ড হয়। তবে এই মামলার পরে মহারাষ্ট্রে বিপ্লবী আন্দোলন একেবারেই স্তব্ধ হয়ে যায় নি।
বিনায়ক সাভারকরের বড়ো ভাই গনেশ সাভারকর ইংরেজ বিরোধী কবিতা লিখলে নাসিকের (ম্যাজিস্ট্রেট) জেলাশাসক তাকে দীপান্তরে পাঠিয়ে শাস্তি দেন। এই ঘটনার প্রতিশোধ নেওয়ার জন্য ১৯০৯ খ্রিঃ অভিনব ভারতের তরুন সদস্য ও ছাত্র অনন্ত লক্ষন কানহেরি নাসিকের ম্যাজিস্ট্রেট জ্যাকসনকে গুলি করে হত্যা করেন। এই ঘটনায় পুলিশ অভিনব ভারত সহ বহু তরুন বিপ্লবীকে গ্রেফতার করে "নাসিক ষড়যন্ত্র মামলা" দায়ের করে।
এই ঘটনার পর মহারাষ্ট্রে বিপ্লবী কার্যকলাপ ধীরে ধীরে স্তিমিত হয়ে পড়তে শুরু করে। তুলনামূলক ভাবে বাংলার তুলনায় মহারাষ্ট্রের প্রথম পর্বের সশস্ত্র বিপ্লবী আন্দোলনের তীব্রতা ও জোর ছিলো কম।
(খ.) পাঞ্জাবে সশস্ত্র সংগ্রাম ও ছাত্রসমাজ
বাংলার বৈপ্লবিক আন্দোলনের প্রেরনায় এবং বাংলার বিপ্লবীদের সহায়তায় পাঞ্জাবে সশস্ত্র বিপ্লবী আন্দোলনের সূত্রপাত ঘটে।
জে এম চট্টোপাধ্যায়
১৯০৪ খ্রিঃ শাহারানপুরে প্রবাসী বাঙালি জে এম চট্টোপাধ্যায়ের উদ্যোগে কয়েকজন ছাত্র সর্বপ্রথম পাঞ্জাবে একটি গুপ্ত সমিতি প্রতিষ্ঠা করে। এই গুপ্ত সমিতির প্রধান কর্মকেন্দ্র পরে রুরকি ইঞ্জিনিয়ারিং কলেজে স্থানান্তরিত হয়। লালা হরদয়াল, সুফী অম্বাপ্রসাদ, অজিত সিং প্রমুখ তরুন ছাত্ররা এই বিপ্লবী দলের সদস্য ছিলেন।
অস্ত্র সংগ্রহ, বোমা তৈরি, গুপ্ত হত্যা এবং রাজনৈতিক ডাকাতি, বিপ্লবী পত্র পত্রিকা প্রকাশ করা ছিলো শাহারানপুর গুপ্ত সমিতির প্রধান কাজ। এই গুপ্ত সমিতির সঙ্গে বাংলার বিপ্লবীদের গোপন যোগাযোগ গড়ে উঠেছিলো। রুরকি ইঞ্জিনিয়ারিং কলেজের ছাত্ররাই বিপ্লবী কার্যকলাপে সামনের সারিতে থাকতেন।
অজিত সিং
অজিত সিং ছিলেন পাঞ্জাবের বিপ্লবী আন্দোলনের প্রানপুরুষ। তিনি পাঞ্জাবে বিপ্লবী আদর্শ প্রচারের জন্য "আঞ্জুমান - ই - মাহিফান - ই - ওয়ান" নামে একটি বিপ্লবী সমিতি প্রতিষ্ঠা করেন। মহাবিদ্রোহের সুবর্নজয়ন্তি উপলক্ষে ১৯০৭ খ্রিঃ তিনি পাঞ্জাবের বিভিন্ন স্থানে ব্রিটিশ বিরোধী জ্বালাময়ী বক্তৃতা দেন। তার "ভারত মাতা" এবং সুফী অম্বাপ্রসাদের "ঝঙ্গের শিয়ার" পত্রিকা দুটি পাঞ্জাবে সশস্ত্র বিপ্লবের পক্ষে জনমত গঠনে সক্রিয় ভূমিকা পালন করেছিলো।
লালা হরদয়াল
১৯০৯ খ্রিঃ লালা হরদয়ালের প্রচেষ্টায় পাঞ্জাবে বৈপ্লবিক আন্দোলনের প্রভূত বিস্তার হয়। হরদয়াল ছিলেন বিশ্ববিদ্যালয়ের একজন কৃতি ছাত্র। তিনি ১৯০৩ খ্রিঃ এম এ পরীক্ষায় ইংরেজিতে প্রথম স্থান অধিকার করেন। পরে অক্সফোর্ড বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়তে গিয়ে ইংল্যান্ডে প্রখ্যাত বিপ্লবী শ্যামজী কৃষ্ণবর্মার সঙ্গে তার দেখা হয়।
শ্যামজীর সাথে দেখা হবার পর হরদয়াল বিপ্লবী দলে যোগ দেন। ১৯০৮ খ্রিঃ হরদয়াল দেশে ফিরে আসেন এবং পাঞ্জাবের বিপ্লবীদের সংগঠিত করে লাহোরে একটি বিপ্লবী সমিতি প্রতিষ্ঠা করেন। বাংলার চন্দননগরের খ্যাতনামা বিপ্লবী রাসবিহারী বসু এই বিপ্লবী সমিতির সঙ্গে যুক্ত হন।
১৯১০ খ্রিঃ হরদয়াল ভারত ত্যাগ করে আমেরিকায় যান এবং আমেরিকার সানফ্রানসিসকো শহরে প্রবাসী ভারতীয় ছাত্রদের নিয়ে ১৯১৩ খ্রিঃ গদর পার্টি নামে একটি বিপ্লবী দল প্রতিষ্ঠা করেন। গদর শব্দের অর্থ ছিলো বিপ্লব। ১৯১৩ খ্রিঃ পাঞ্জাবের গদরপন্থীদের সঙ্গে রাসবিহারী বসু যোগাযোগ স্থাপন করেন। গদর বিপ্লবীদের সহায়তায় তিনি সেনা অভ্যুত্থানের পরিকল্পনা করেন।
(গ.) বাংলায় সশস্ত্র সংগ্রাম ও ছাত্রসমাজ
ঊনবিংশ শতাব্দীর দ্বিতীয়ার্ধে নবগোপাল মিত্র প্রতিষ্ঠিত হিন্দুমেলা (১৮৬৭ খ্রিঃ) থেকেই বাংলায় বিপ্লববাদের অস্পষ্ট পদধ্বনি শোনা যেতে থাকে। ঔপনিবেশিক আমলে ইংরেজরা প্রায়ই ভারতীয়দের ভীতু, দুর্বল, কাপুরুষ বলে সম্বোধন করতো। এর যোগ্য প্রত্যুত্তর দেবার জন্য "হিন্দুমেলা" শারীরিক নানা কসরৎ ও ব্যায়াম অনুশীলনে গুরুত্ব আরোপ করে। ক্রমে বাংলার নানা স্থানে শরীর চর্চার নানা আখড়া গড়ে উঠতে শুরু করে। বাংলার তরুন ছাত্র যুবকরা ঐ সমস্ত আখড়া গুলিতে সমবেত হয়। এই আখড়া গুলিই পরবর্তীকালে বঙ্গীয় বিপ্লববাদের আতুরঘরে পরিনত হয়।
অনুশীলন সমিতি :-
বাংলার আখড়া সংস্কৃতিকে সবচেয়ে সংগঠিত রূপ দেন কলকাতার ছাত্র সতীশচন্দ্র বসু। ১৯০২ খ্রিঃ ২৪ মার্চ কলকাতার ১২ নং মদনমিত্র লেনে তিনি "অনুশীলন সমিতি" প্রতিষ্ঠা করেন। বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়ের আনন্দমঠ উপন্যাসে উল্লেখিত সন্তানদলের অনুশীলন সমিতির নাম থেকেই বাংলার এই বিখ্যাত গুপ্ত সমিতির নামকরন করা হয় অনুশীলন সমিতি।
কলকাতার ছাত্র যুবরা অনুশীলন সমিতিতে যোগ দিয়ে স্বামীজির আদর্শে ব্যায়াম, লাঠি চালনা, সাঁতার কাটা, মুষ্টিযুদ্ধ, অসিচালনা ইত্যাদির শিক্ষা গ্রহণ করতেন। অনুশীলন সমিতির সভাপতি ছিলেন ব্যারিস্টার প্রমথনাথ মিত্র। সহ সভাপতি ছিলেন চিত্তরঞ্জন দাস এবং কোষাধ্যক্ষ ছিলেন অরবিন্দ ঘোষ।
অরবিন্দ ঘোষ
বাংলার সশস্ত্র বিপ্লবী আন্দোলনকে প্রজ্বলিত করার ক্ষেত্রে অরবিন্দ ঘোষ বিশেষ ভূমিকা নেন। বরোদা কলেজে অধ্যাপনা করার সময়ে তিনি বোম্বাইয়ের বিপ্লবী ঠাকুর সাহেবের সঙ্গে পরিচিত হন। বিলাতে থাকার সময়ে তিনি আইরিশ বিপ্লবীদের গুপ্ত সমিতির সঙ্গে পরিচিত হয়েছিলেন। এর দ্বারা প্রভাবিত হয়ে বাংলায় অনুরূপ গুপ্ত সমিতি গড়ে তোলার জন্য তিনি যতীন্দ্রনাথ মুখোপাধ্যায়কে কলকাতায় পাঠান।
যতীন্দ্রনাথ মুখোপাধ্যায় বরোদার সামরিক বাহিনীতে কাজ করতেন। যতীন্দ্রনাথ কলকাতায় এসে অনুশীলন সমিতির সঙ্গে যুক্ত হন। অরবিন্দ ঘোষের অনুপ্রেরণায় তার ভাই বারীন্দ্রকুমার ঘোষও বিপ্লবী সংগঠনে এগিয়ে আসেন এবং অনুশীলন সমিতিতে যুক্ত হন।
স্বদেশী আন্দোলন ও বিপ্লববাদ
১৯০৫ খ্রিঃ লর্ড কার্জন বঙ্গভঙ্গ করলে বাংলায় স্বদেশী আন্দোলন শুরু হয়। এই সময় অরবিন্দ ঘোষ কলকাতায় আসেন এবং গুপ্ত সমিতি পরিচালনায় অংশগ্রহণ করেন। তিনি অনুশীলন সমিতিতে যুক্ত হন।
স্বদেশী আন্দোলনের কর্মসূচিকে ছড়িয়ে দেবার জন্য এই সময় বাংলার বিভিন্ন জেলায় বহু সমিতি গড়ে উঠতে থাকে। যেমন - ঢাকায় পুলিন বিহারী দাসের নেতৃত্বাধীন অনুশীলন সমিতি, হেমচন্দ্র ঘোষের মুক্তি সংঘ, বারীন্দ্রকুমার ঘোষের যুগান্তর গোষ্ঠী, ফরিদপুরের ব্রতী সমিতি, ময়মনসিংহের সাধনা সমিতি ও সুহৃদ সমিতি ইত্যাদি। বহু ছাত্র যুব এই সমিতি গুলির ছত্রছায়ায় সংঘবদ্ধ হয়।
স্বদেশী আন্দোলনের সময় স্বদেশী ও বয়কট কর্মসূচিকে প্রসারিত করতে এই সমিতি গুলি গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা নেয়। কিন্তু সরকার বলপূর্বক ভাবে স্বদেশী আন্দোলনকে দমন করতে শুরু করলে এই সমস্ত সমিতি গুলি ধীরে ধীরে বিপ্লবী আন্দোলনের দিকে ঝুঁকে পড়তে শুরু করে।
বারীন্দ্রকুমার ঘোষ ও যুগান্তর দল
স্বদেশী আন্দোলনের সময় অনুশীলন সমিতির ছেলেদের মধ্যে বিতর্ক সৃষ্টি হয়। একদল যুবক শুধু শারীরিক অনুশীলন ও শারীরিক শক্তি অর্জনের মধ্যে নিজেদের সীমাবদ্ধ রাখতে রাজী হলেন না। তারা বাস্তবে শক্তি প্রয়োগ করতে চাইলেন। এই নিয়ে দলের সদস্যদের মধ্যে বিরোধ উপস্থিত হলে অরবিন্দ ঘোষের ভাই বারীন্দ্রকুমার ঘোষের নেতৃত্বে একদল যুবক ও ছাত্র অনুশীলন সমিতি থেকে বেরিয়ে এসে ১৯০৬ খ্রিঃ যুগান্তর দল গঠন করে। ঐ একই বছর তারা "যুগান্তর" নামে একটি সাপ্তাহিক পত্রিকাও (মুখপত্র) প্রকাশ করে। এর সম্পাদক ছিলেন ভূপেন্দ্রনাথ দত্ত।
যুগান্তর দল শুধুমাত্র কাগজ কলমে বিপ্লব প্রচারে ক্ষান্ত হয় নি। সশস্ত্র বিপ্লবকে বাস্তবে রূপ দিতে দুজন ছাত্রকে বোমা তৈরির কৌশল শিক্ষার জন্য ফ্রান্সে পাঠায়। হেমচন্দ্র কানুনগো ফ্রান্স থেকে বোমা তৈরির কৌশল শিখে দেশে ফিরে আসেন। এরপর বারীন্দ্রকুমার ঘোষ ও তার সহযোগীরা কলকাতার মুরারিপুকুরে বোমা তৈরির একটি গোপন কেন্দ্র তৈরি করেন।
এই সময় নিখিলেশ্বর রায় মল্লিক ও ইন্দ্রনাথ নন্দী "ছাত্র ভান্ডার" প্রতিষ্ঠা করে তার সদস্য ছাত্রদের দ্বারা যুগান্তর দলের বিপ্লবীদের কাছে অস্ত্রশস্ত্র পৌঁছে দেওয়ার ব্যবস্থা গ্রহণ করে।
যুগান্তর দলের বিপ্লবী অভ্যুত্থান
স্বদেশী আন্দোলনের সময় সরকার বলপূর্বক আন্দোলন দমন করতে উদ্যোগী হলে বাংলায় বিপ্লবী সম্প্রদায়, বিশেষকরে যুগান্তর দলের ছাত্র যুবরা সন্ত্রাসবাদের দিকে ঝুঁকে পড়ে।
(১.) এইসময় পূর্ববঙ্গের ছোটলাট বামফিল্ড ফুলার স্বদেশী আন্দোলন দমনের জন্য নির্যাতন শুরু করলে বিপ্লবীরা ফুলারকে হত্যা করার চেষ্টা করে। কিন্তু দু বার চেষ্টা করেও তারা ব্যর্থ হয়।
(২.) ১৯০৭ খ্রিঃ বাংলার ছোটলাট অ্যানড্রু ফ্রেজারকে বিপ্লবীরা দু বার হত্যা করার চেষ্টা করেও বিপ্লবীরা সফল হয় নি।
(৩.) তবে ঐ বছরই ২৩ ডিসেম্বর, ঢাকার ভূতপূর্ব ম্যাজিস্ট্রেট অ্যালেনকে এক ছাত্র বিপ্লবী গুলি করেন।
(৪.) চন্দননগরের মেয়র এক স্বদেশী সভার আয়োজন বন্ধ করে দিলে ১৯০৮ খ্রিঃ ১২ এপ্রিল এক ছাত্র চন্দননগরের মেয়রের ঘরে বোমা বিস্ফোরণ করেন।
(৫.) কলকাতায় প্রেসিডেন্সি ম্যাজিস্ট্রেট কিংসফোর্ড স্বদেশী স্বেচ্ছাসেবকদের ওপর প্রভূত নির্যাতন চালালে যুগান্তর দল কিংসফোর্ডকে হত্যার পরিকল্পনা করে।
(৬.) কিংসফোর্ড হত্যার দায়িত্ব দেওয়া হয় দুজন ছাত্র কিশোর ক্ষুদিরাম বসু এবং প্রফুল্ল চাকরির হাতে। ১৯০৮ খ্রিঃ ৩০ এপ্রিল, তারা বদলি হয়ে যাওয়া অত্যাচারী ম্যাজিস্ট্রেটকে হত্যার জন্য বিহারের মজঃফরপুর যান এবং কিংসফোর্ডের গাড়ি ভেবে ভুল ক্রমে জনৈক মিসেস কেনেডি ও তার কন্যার গাড়িতে বোমা নিক্ষেপ করেন। এই ঘটনায় পুলিশের হাতে ধরা পড়ার আশঙ্কায় প্রফুল্ল চাকি গুলি করে আত্মহত্যা করেন। ক্ষুদিরাম ধরা পড়ে যান।
(৮.) কিংসফোর্ড হত্যাকাণ্ডের সূত্র ধরে পুলিশ মুরারিপুকুরে থেকে অরবিন্দ, বারীন্দ্রকুমার, হেমচন্দ্র কানুনগো সহ ৩৭ জন বিপ্লবীকে গ্রেফতার করে ১৯০৮ খ্রিঃ আলিপুর আদালতে "আলিপুর বোমা মামলা" দায়ের করে।
বিপ্লবী আন্দোলনের তীব্রতা বৃদ্ধি
আলিপুর বোমা মামলা দায়ের হলেও বাংলায় বিপ্লবী কার্যকলাপ বন্ধ হয় নি। বরং তার মাত্রা আরোও বৃদ্ধি পায়। ১৯০৭ থেকে ১৯১৭ খ্রিঃ মধ্যে ৬৪ জন সরকারি কর্মচারী, পুলিশের কর্তা, পুলিশের গুপ্তচর, সরকারি উকিল, পুলিশ পক্ষের সাক্ষী ও দলত্যাগী বিপ্লবী নিহত হয়। এই সময়ের মধ্যে ১১২ টি ডাকাতি করে বিপ্লবীরা প্রায় ৭ লক্ষ টাকা সংগ্রহ করে।
১৯১০ - ১৯১৪ খ্রিঃ মধ্যে বাংলাদেশে বিপ্লবী কার্যকলাপ আরোও ব্যাপক ও তীব্র হয়ে ওঠে। বিপ্লবীদের দমন করার জন্য ঢাকা ষড়যন্ত্র মামলা (১৯১০) হাওড়া ষড়যন্ত্র মামলা (১৯১০),বরিশাল ষড়যন্ত্র মামলা (১৯১২ - ১৩) দায়ের হয়। এই সব মামলায় বহু ছাত্র অভিযুক্ত হয় এবং বিচারে অনেকের ফাঁসি ও দীপান্তর হয়।
(ঘ.) প্রথম পর্বে বহির্ভারতে বিপ্লবী প্রচেষ্টা ও ছাত্রসমাজ
প্রথম পর্বে ভারতে সশস্ত্র বিপ্লবী আন্দোলনের প্রচেষ্টা শুধুমাত্র ভারতের অভ্যন্তরেই সীমাবদ্ধ থাকে নি। তা ভারতের বাইরেও প্রসারিত হয়েছিলো। এক্ষেত্রেও ছাত্রদের ভূমিকা ও অবদান ছিলো সবথেকে গুরুত্বপূর্ণ। ছাত্ররা পড়াশোনার জন্য বিদেশে যেতেন। সেই সময় বেশ কয়েকজন বিপ্লবী নেতা বিদেশে ছাত্রদের সংগঠিত করে তাদের মাধ্যমে ভারতে বিপ্লববাদ ছড়িয়ে দেওয়ার উদ্যোগ গ্রহণ করেন।
লন্ডন ও প্যারিস কেন্দ্র
সশস্ত্র বিপ্লবী আন্দোলনের প্রথম পর্বে ইওরোপে বিপ্লবীদের প্রধান কেন্দ্র ছিলো দুটি - একটি লন্ডন। অপরটি প্যারিস। দুটি কেন্দ্রই পরিচালনা করতেন শ্যামজী কৃষ্ণবর্মা, সর্দার সিংরানা এবং মাদাম ভিকাজী রুস্তম কামাল, যাকে ভারতের বিপ্লববাদের জননী বলে আখ্যায়িত করা হয়।
শ্যামজী কৃষ্ণবর্মা পশ্চিম ভারতের জুনাগড় রাজ্যের দেওয়ান ছিলেন। ১৮৯৭ খ্রিঃ তিনি দেওয়ান পদ ত্যাগ করে লন্ডনে বসবাস করতে থাকেন। এর এক বছর পরে ১৮৯৮ খ্রিঃ কাথিয়াবাড়ের এক ছাত্র সর্দার সিংরানা ব্যারিস্টারি পড়ার জন্য ইংল্যান্ডে যান। ইংল্যান্ডের থাকাকালীন অবস্থায় দুজনের পরিচয় ঘটে এবং এই এইসময় শ্যামজি ও সিংরানার সঙ্গে আইরিশ বিপ্লবীদের পরিচয় হয়। শ্যামজি আইরিশ বিপ্লবের ধাঁচে ভারতেও বিপ্লবী আন্দোলন সংগঠিত করার পরিকল্পনা করেন। এক্ষেত্রে তাকে নানা ভাবে সাহায্য করেন মাদাম কামা।
ইন্ডিয়া হাউস
এই সময় বহু ভারতীয় ছাত্র পড়াশোনার জন্য লন্ডনে যেতেন। তাদের সংগঠিত করে স্বাধীনতা সংগ্রামে নিয়োজিত করার জন্য শ্যামজী একটি পরিকল্পনা করেন। ১৯০৫ খ্রিঃ মে মাসে তিনি লন্ডনের হাইগেট অঞ্চলে ভারতীয় ছাত্রদের থাকার জন্য একটি বোডিং হাউস খোলেন। এর নাম দেওয়া হয় "ইন্ডিয়া হাউস"। কিছুদিনের মধ্যেই ইন্ডিয়া হাউস বিপ্লবী ছাত্রদের প্রধান কর্মকেন্দ্র হয়ে উঠে।
১৯০৩ খ্রিঃ শ্রীমতি সরোজনী নাইডুর ভাই বীরেন্দ্রনাথ চট্টোপাধ্যায় আই সি এস পরীক্ষা দেওয়ার জন্য লন্ডনে যান। কিন্তু আই সি এস না হয়ে তিনি শ্যামজীর দলে যোগ দেন। বীরেন্দ্রনাথ অসি চালনা, বন্দুক চালনা ইত্যাদি বেশ ভালো করে জানতেন। তিনি ইন্ডিয়া হাউসে ছাত্রদের এইসব শিক্ষা দেওয়ার ভার গ্রহণ করেন।
ইতিমধ্যে ভারতীয় ছাত্ররা যাতে ইওরোপে এসে বিপ্লবী কাজকর্ম শেখার সুযোগ পায় সেইজন্য শ্যামজী ও সর্দার সিং রানা "শিবাজী", "রানা প্রতাপ" প্রমুখ বিখ্যাত দেশপ্রেমিকদের নামে কয়েকটি বৃত্তি দানের ব্যবস্থা করেন। এরকম একটি বৃত্তি নিয়ে বিনায়ক দামোদর সাভারকর ১৯০৬ খ্রিঃ জুন মাসে লন্ডন যান। সাভারকর পুনা থেকে বি এ পাশ করে লন্ডনে ব্যারিস্টারি পড়া শুরু করেন। এই সময় শ্যামজী তাকে ইন্ডিয়া হাউসের অধ্যক্ষ নিযুক্ত করেন। সাভারকর ইন্ডিয়া হাউসে নাসিকের অভিনব ভারতের শাখা স্থাপন করে বৈপ্লবিক কাজকর্ম শুরু করেন।
ভারতের বিভিন্ন স্থান থেকে আগত ছাত্ররা ইন্ডিয়া হাউসে সমবেত হতেন। প্রতি সপ্তাহে ছাত্রদের নিয়ে বৈপ্লবিক সংগ্রাম বিষয়ে আলোচনা সভা বসতো। এইজন্য ইন্ডিয়া হাউসে ফ্রি ইন্ডিয়া সোসাইটি গঠন করা হয়। মাদাম কামা এই সোসাইটির অন্যতম পরামর্শদাত্রী ছিলেন।
প্যারিস কেন্দ্র
শ্যামজী কৃষ্ণবর্মা, মাদাম কামা ও সিংরানার কার্যকলাপ ব্রিটিশ পুলিশের দৃষ্টি আকর্ষন করলে, গ্রেপ্তার এড়াবার জন্য তারা প্যারিসে চলে আসেন। প্যারিসে এসে তারা একটি কর্মকেন্দ্র খোলেন। ১৯০৬ খ্রিঃ মেদিনীপুরের বিপ্লবী হেমচন্দ্র কানুনগো বোমা প্রস্তুতি শিখবার জন্য প্যারিসে এলে মাদাম কামা ও সিংরানা তাকে সাহায্য করেন।
প্যারিস কেন্দ্র থেকে লন্ডনের ইন্ডিয়া হাউসের বিপ্লবী ছাত্রদের সঙ্গে নিয়মিত যোগাযোগ রাখা হতো। ১৯০৯ খ্রিঃ সর্দার সিংরানা প্যারিস থেকে লন্ডনে ইন্ডিয়া হাউসে সাভারকরের কাছে ২০ টি পিস্তল ও কার্তুজ পাঠান। ব্যারিস্টারি ছাত্র সাভারকর ঐ পিস্তল ও কার্তুজ গুলি ইন্ডিয়া হাউসের পাচক ছত্রভুজ আমিনের হাত দিয়ে বোম্বাইয়ে অভিনব ভারতের ছাত্র বিপ্লবীদের কাছে পাঠিয়ে দেন। এই পিস্তল গুলির সাহায্যেই ১৯০৯ খ্রিঃ ২১ ডিসেম্বর, নাসিক জেলার ম্যাজিস্ট্রেট জ্যাকসনকে হত্যা করা হয়।
ইংল্যান্ডে ওয়াইলি হত্যাকান্ড
অমৃতসর নিবাসী মদনলাল ধিংড়া দিল্লি বিশ্ববিদ্যালয় থেকে গ্র্যাজুয়েট হয়ে ইঞ্জিনিয়ারিং পড়ার জন্য ইংল্যান্ডে আসেন। ইংল্যান্ডে এসে তিনি ইন্ডিয়া হাউসের বিপ্লবীদের দলে যোগ দেন। ১৯০৯ খ্রিঃ ১ লা জুলাই মদনলাল "লন্ডন ন্যাশনাল ইন্ডিয়া অ্যাসোসিয়েশনের" বার্ষিক সভায় ভারত সচিবের সহকারী লর্ড কার্জন ওয়াইলিকে গুলি করে হত্যা করেন।
এই ঘটনায় মদনলাল ধরা পড়েন। বিচারে তার ফাঁসি হয়। জ্যাকসন হত্যা এবং ওয়াইলি হত্যাকান্ডের সঙ্গে সাভারকর জড়িত থাকায় ব্রিটিশ পুলিশ তাকে গ্রেফতার করে ভারতে পাঠাবার ব্যবস্থা করে। অন্যদিকে ভারতীয় বিপ্লববাদে মদত দেওয়ার অপরাধে ব্রিটিশ সরকারের অনুরোধে ফরাসি সরকার মাদাম কামাকে বন্দী করে এক প্রাচীন দুর্গে আটক করে রাখে। অন্যদিকে সর্দার সিংরানা ও তার স্ত্রী পুত্রকে ফরাসি সরকার মার্টিনিক দ্বীপে বন্দী করে রাখে। শ্যামজী কৃষ্ণবর্মা প্যারিস ত্যাগ করে এই সময় জার্মানিতে চলে যান।
এইভাবে ভারতে সশস্ত্র বিপ্লবী আন্দোলনের প্রথম পর্বের আপাত পরিসমাপ্তি ঘটে।
(২.) দ্বিতীয় পর্বের সশস্ত্র বিপ্লবী আন্দোলনের ধারা
১৯১৪ খ্রিঃ প্রথম বিশ্বযুদ্ধ শুরু হলে ভারতে সশস্ত্র বিপ্লবী আন্দোলনের দ্বিতীয় পর্ব শুরু হয়। এই সময় আন্তর্জাতিক ক্ষেত্রে যুদ্ধের অনুকূল পরিবেশকে কাজে লাগিয়ে বিপ্লবীরা ভারতে সশস্ত্র অভ্যুত্থানের পরিকল্পনা করেন। এই পর্বেও বিপ্লবী আন্দোলনের সামনের সারিতে ছিলেন ছাত্ররা।
(ক.) দ্বিতীয় পর্বে বাংলায় সশস্ত্র সংগ্রাম
প্রথম পর্বের বাংলার সশস্ত্র বিপ্লবী আন্দোলনের সঙ্গে দ্বিতীয় পর্বে সশস্ত্র বিপ্লবী আন্দোলনের মধ্যে একটি চরিত্রগত প্রভেদ লক্ষ্য করা যায়।
প্রথম পর্বে বাংলার সশস্ত্র সংগ্রাম গুপ্ত হত্যা, রাজনৈতিক ডাকাতি, অস্ত্র লুন্ঠন ইত্যাদির মধ্যেই সীমাবদ্ধ ছিলো। কিন্তু দ্বিতীয় পর্বে বাংলার বিপ্লবীরা গুপ্ত হত্যার বদলে সশস্ত্র অভ্যুত্থানের পরিকল্পনা করে।
আরেকটি পার্থক্যের জায়গা হলো ১৯০৪ থেকে ১৯১৩ খ্রিঃ পর্যন্ত বাংলার বিপ্লবীরা তাদের কাজকর্ম গোপনে পরিচালনা করতেন। পুলিশ গ্রেপ্তার করতে এলে তারা বাধা দিতেন না। শান্ত ভাবে ধরা দিতেন। কিন্তু ১৯১৪ সাল থেকে বিপ্লবীদের কর্মধারা পরিবর্তিত হয়। তারা প্রত্যক্ষ সংঘর্ষের জন্য প্রস্তুত হন এবং পুলিশ তাদের গ্রেফতার করতে এলে গুলি বিনিময় করে সশস্ত্র প্রতিরোধ গড়ে তুলতে সচেষ্ট হন।
(a.) যতীন্দ্রনাথ মুখোপাধ্যায় :-
এই পর্বে বাংলার সশস্ত্র বিপ্লবী আন্দোলনের নেতৃত্ব দেন যতীন্দ্রনাথ মুখোপাধ্যায়। একসময় হাতাহাতি লড়াই করে একটি বাঘ মেরেছিলেন বলে তিনি "বাঘা যতীন" নামে পরিচিত হয়েছিলেন। তার বিপ্লবী দলে এইসময় যুক্ত হন বাংলার অনেক ছাত্র, তরুন।
(b.) রডা কোম্পানির অস্ত্র লুন্ঠন :-
প্রথম বিশ্বযুদ্ধের সময় আত্মোন্নতি সমিতির প্রতিষ্ঠাতা বিপিন বিহারী গাঙ্গুলীর অনুপ্রেরণায় এবং যতীন্দ্রনাথ মুখোপাধ্যায়ের নেতৃত্বে একদল বিপ্লবী ১৯১৪ খ্রিঃ ২৬ আগস্ট কলকাতার ধর্মতলার "রডা অ্যান্ড কোম্পানির" দোকান থেকে ৫০ টি মাউজার পিস্তল ও ৪৬,০০০ কার্তুজ লুঠ করেন। অস্ত্র লুঠের এই দলে অনেক ছাত্র প্রত্যক্ষ ভাবে অংশ নিয়েছিলেন।
যাইহোক, অস্ত্র লুন্ঠন করার পর সেগুলি বিভিন্ন বিপ্লবী দলের মধ্যে বিতরন করা হয়।
(c.) বিদেশী সাহায্যে বাংলার বিপ্লবীদের অভ্যুত্থানের পরিকল্পনা :-
১৯১৪ খ্রিঃ প্রথম বিশ্বযুদ্ধ শুরু হলে আন্তর্জাতিক রাজনীতি এবং সম্পর্কের পট পরিবর্তন হয়। প্রথম বিশ্বযুদ্ধে ফ্রান্স ইংল্যান্ডের পক্ষে যুদ্ধে যোগ দিলে প্রবাসী ভারতীয় বিপ্লবী ও ছাত্ররা অনুধাবন করতে পারেন, ফ্রান্স থেকে বিপ্লবকর্মে আর কোন সহযোগীতা পাওয়া যাবে না। প্রথম বিশ্বযুদ্ধের শুরুতে বিভিন্ন রনাঙ্গনে জার্মানির কাছে ইংল্যান্ড বাহিনীর বিপর্যয় ঘটতে শুরু করেছিলো।
বিপ্লবীরা উপলব্ধি করেন জার্মানির সাহায্য নিয়ে এই অনুকূল পরিবেশকে কাজে লাগাতে পারলে তা অচিরেই ভারতকে স্বাধীন করার সুযোগ এনে দেবে। ইতিমধ্যেই শ্যামজী কৃষ্ণবর্মা জার্মানিতে গিয়ে বিপ্লবীদের একটি নতুন কেন্দ্র খুলেছিলেন।
বহু ভারতীয় ছাত্র পড়াশোনার জন্য বিদেশ যেতেন। সেই সমস্ত প্রবাসী ভারতীয় ছাত্ররাই এই সময় আবার সক্রিয় হয়ে উঠেন। একে একে ইওরোপে পাঠরত ছাত্র ও বিপ্লবীরা বার্লিনে সমবেত হতে থাকেন।
১৯১৫ - ১৬ খ্রিঃ এই সমস্ত বিপ্লবীরা ভারত বন্ধু জার্মান সমিতি গঠন করেন। পরে এই সমিতির নাম হয় বার্লিন কমিটি। এই কমিটির প্রথম সম্পাদক হন বীরেন্দ্রনাথ চট্টোপাধ্যায়। পরে সম্পাদক হয়েছিলেন স্বামী বিবেকানন্দের ভাই ডাঃ ভূপেন্দ্রনাথ দত্ত।
বার্লিন কমিটি জার্মান পররাষ্ট্র দপ্তরের সঙ্গে যোগাযোগ করে ভারতে সশস্ত্র অভ্যুত্থানের পক্ষে সাহায্য প্রার্থনা করলে জার্মানি রাজি হয়ে যায়। ঠিক হয় -
(১.) ভারতে সশস্ত্র অভ্যুত্থানে জার্মানি প্রয়োজনীয় অর্থ ও অস্ত্র দিয়ে সাহায্য করবে।
(২.) অস্ত্রশস্ত্র জার্মানি ভারতের উপকূলে পৌঁছে দেবে।
(৩.) সেখান থেকে অস্ত্র গুলি ভারতীয় বিপ্লবীরা সংগ্রহ করে অভ্যুত্থান ঘটাবেন।
(৪.) বিপ্লব সফল হলে ভারতে সাম্যবাদী প্রজাতান্ত্রিক সরকার গঠন করা হবে।
স্থির হয়, প্রশান্ত মহাসাগরের পথে ভারতে অস্ত্রশস্ত্র গুলি পাঠিনো হবে। জার্মানির নেতৃত্বে একটি ফৌজ ব্রহ্মদেশ আক্রমণ করবে। ঐ আক্রমণের সঙ্গে সঙ্গেই ভারতে বিপ্লব শুরু হয়ে যাবে। ৩ টি জার্মান জাহাজ অস্ত্রশস্ত্র নিয়ে তাদের সাহায্য করতে রওনা দেবে। একটি জাহাজ কলকাতা যাবে। অপর দুটি জাহাজ যাবে যথাক্রমে সুন্দরবন অঞ্চল ও ওড়িশা উপকূলে।
মূল পরিকল্পনা রচনা করার পর বার্লিন কমিটির পক্ষ থেকে দুজন প্রতিনিধিকে (শ্রী মারাঠে ও ধীরেন সরকার) পাঠানো হয় আমেরিকায় গদর দলের সঙ্গে যোগাযোগ স্থাপন করার জন্য। অপর দুজন প্রতিনিধি শ্রীরামপুরের জিতেন্দ্রনাথ লাহিড়ি ও কেদারনাথ গুহকে যতীন্দ্রনাথ মুখোপাধ্যায়ের কাছে পাঠানো হয় মূল পরিকল্পনাটি জানানোর জন্য। ইতিমধ্যে জার্মানির সহায়তায় ব্যাঙ্ক, জাভা ও বাটভিয়াতে ভারতীয় বিপ্লবীদের ৩ টি কেন্দ্র স্থাপিত হয়।
(d.) বাঘা যতীনের বিপ্লবী পরিকল্পনা
এদিকে যতীন্দ্রনাথ মুখোপাধ্যায় আমেরিকা থেকে অস্ত্র এনে বাংলায় অভ্যুত্থানের এক গোপন পরিকল্পনা রচনা করেন। ঠিক হয় আমেরিকা থেকে অস্ত্র এনে বিপ্লব শুরু হবে। পরে জার্মানি থেকেও অস্ত্র জাহাজে করে আসবে।
স্থির হয় -
(ক.) এক জাহাজ অস্ত্র নোয়াখালিতে পাঠানো হবে। ঐ অস্ত্র দিয়ে বরিশাল দলের নরেন ঘোষ চৌধুরী, মনোরঞ্জন গুপ্ত প্রমুখ বিপ্লবীরা পূর্ববঙ্গে সশস্ত্র অভ্যুত্থান ঘটাবেন।
(খ.) এক জাহাজ অস্ত্র সুন্দরবন এলাকায় রায় মঙ্গল নদীপথে আসবে। ঐ অস্ত্র গুলি বিপিন বিহারী গাঙ্গুলী, নরেন্দ্রনাথ ভট্টাচার্য, ফনী চক্রবর্তী, ভূপতি মজুমদার, ব্রজেন দত্তরা কলকাতা অধিকার করবেন।
(গ.) আর এক জাহাজ অস্ত্র ওড়িশার উপকূলে বালেশ্বরে আনা হবে। বাঘা যতীন সেখান থেকে ঐ অস্ত্র গুলি সংগ্রহ করবেন।
পরিকল্পনা মতো যতীন্দ্রনাথ মুখোপাধ্যায় অর্থ ও অস্ত্র নিরাপদে সংগ্রহ করার জন্য কলকাতার হ্যারি অ্যান্ড সন্স নামে একটি আমদানি রপ্তানির ভুয়ো অফিস খোলেন। এই প্রতিষ্ঠানের বানিজ্যিক প্রতিনিধি সেজে নরেন্দ্রনাথ ভট্টাচার্য বাটভিয়াতে যান। সেখানে জার্মান বানিজ্য দূতের কাছ থেকে দুই দফায় তেতাল্লিশ হাজার টাকা সংগ্রহ করে কলকাতায় পাঠান। কিন্তু ঐ টাকা পুলিশের হাতে ধরা পড়ে যায়। ফলে আমেরিকা থেকে অস্ত্র আমদানির পরিকল্পনাটি ব্যর্থ হয়ে যায়।
(e.) বিপর্যয় ও বুড়িবালামের যুদ্ধ
ইতিমধ্যে বার্লিন কমিটি থেকে ভূপেন্দ্রনাথ দত্ত জানান ভারতের জন্য অস্ত্র নিয়ে ৩ টি জাহাজ প্রশান্ত মহাসাগর ধরে যাচ্ছে এবং দুটি যাচ্ছে সুয়েজ খালের পথে। এই সংবাদ পেয়ে বাঘা যতীন বেশ কয়েকজন বিপ্লবীদের সঙ্গে নিয়ে ওড়িশা উপকূলে বালেশ্বরে বুড়িবালাম নদীর তীরে অস্ত্র সংগ্রহের জন্য উপস্থিত হন।
কিন্তু দুর্ভাগ্যজনক ভাবে এইসময় জাহাজ বিপর্যয়ে জার্মান পরিকল্পনাটি ভেস্তে যায়। ৫ টি জাহাজের মধ্যে একটি পথ ভুল করে সেলিবিস দ্বীপে পৌঁছালে ওলন্দাজ সরকার সেটিকে আটক করে। লারসেন নামের আরেকটি জার্মান জাহাজকে আমেরিকা ক্যালিফোর্নিয়া উপকূলে আটক করে। একটি জাহাজকে ইংরেজরা আন্দামান দ্বীপের কাছে ডুবিয়ে দেয়। অপর দুটি জাহাজের মধ্যে একটি নিখোঁজ হয়ে যায়, অন্যটিকে ইংরেজরা করাচি বন্দরের কাছে ডুবিয়ে দেয়।
জাহাজ বিপর্যয়ের সংবাদ যতীন্দ্রনাথ মুখোপাধ্যায়ের কাছে পৌঁছায় নি। এমতাবস্থায় বিপ্লবীদের দমন করার জন্য পুলিশের বড়োকর্তা টেগার্ট এক বিশাল বাহিনী নিয়ে ৯ ই সেপ্টেম্বর, ১৯১৫ খ্রিঃ বালেশ্বরে উপস্থিত হন। সেখানে বাঘা যতীন সহ তার চার সঙ্গী চিত্তপ্রিয় রায়চৌধুরী, জ্যোতিষ পাল, নীরেন দাশগুপ্ত ও মনোরঞ্জন সেনগুপ্তের সঙ্গে এক অসম যুদ্ধ চলে।
বুড়িবালাম নদীর তীরে চাষখন্ডের জঙ্গলে এই যুদ্ধ হয়েছিলো বলে এটি "বুড়িবালামের যুদ্ধ" নামে পরিচিত হয়। অসম এই যুদ্ধে যতীন্দ্রনাথ মুখোপাধ্যায় মারা যান। অপর সঙ্গীদের ফাঁসি ও দীপান্তর হয়। বলা বাহুল্য, যতীন্দ্রনাথের সঙ্গে যারা এই অসম যুদ্ধে প্রান বিসর্জন দেন এবং চরম আত্মত্যাগ করেন তারা সকলেই ছিলেন তরুন ও ছাত্র।
বুড়িবালামের যুদ্ধের পর বাংলার বিপ্লব প্রচেষ্টা ক্রমশ ম্লান হয়ে পড়তে শুরু করে। অতঃপর ১৯১৫ খ্রিঃ ভারত শাসন আইন ও ৪ নং ক্রিমিনাল এমেন্ডমেন্ট অ্যাক্ট এবং ১৯১৮ খ্রিঃ তৃতীয় রেগুলেশন পাশ করে ব্যাপক ধরপাকড় করে বিপ্লবী কাজকর্মকে পুরো স্তিমিত করে দেওয়া হয়।
(খ.) দ্বিতীয় পর্বে পাঞ্জাবে সশস্ত্র সংগ্রাম
প্রথম বিশ্বযুদ্ধ শুরু হলে আমেরিকা ও ইওরোপ থেকে গদরপন্থী বিপ্লবীরা পাঞ্জাবে ফিরে এলে পাঞ্জাবে সশস্ত্র বিপ্লবী আন্দোলন আবার দুর্বার হয়ে ওঠে। কোমাগাতামারু ও তোশামারু নামে দুটি জাহাজে করে তারা ভারতে এলে ব্রিটিশ সরকার তাদের অবতরনে বাধা দিলে ও গুলি চালালে বেশ কয়েকজন গদরপন্থী নিহত হন। এই ঘটনা গদরপন্থীদের ব্রিটিশ বিরোধী চেতনাকে আরোও তীব্র করে তোলে। এই সময় কর্তার সিং নামে আমেরিকায় পড়তে যাওয়া এক ইঞ্জিনিয়ারিং ছাত্র ভারতীয় সৈন্যদের মধ্যে সশস্ত্র বিদ্রোহ সৃষ্টির চেষ্টা চালান।
এই সুযোগে রাসবিহারী বসু ও শচীন সান্যাল উত্তর ভারতের সেনা ছাউনী গুলিতে বিদ্রোহের পরিকল্পনা করেন। পরিকল্পনা মাফিক স্থির হয় ১৯১৫ খ্রিঃ ২১ ফেব্রুয়ারি দিল্লি, লাহোর, আম্বালা, রাওয়ালপিন্ডি, মীরাট ও ফিরোজপুরে সেনাছাউনি গুলিতে বিদ্রোহ শুরু হবে। ঐ সময় সেনার সাহায্যে কারাবন্দী বিপ্লবীদের মুক্ত করা হবে এবং স্থানীয় প্রশাসন দখল করা হবে।
পরিকল্পনা মতো ব্রিটিশ বাহিনীর ভারতীয় সেনাদের সঙ্গে যোগাযোগ করা হয়। কিন্তু কৃপান সিং নামে এক বিশ্বাসঘাতক সব পরিকল্পনা ফাঁস করে দিলে পুরো পরিকল্পনাটি ভেস্তে যায়। পুলিশ রাসবিহারী সহ বহু বিপ্লবীদের গ্রেফতার করে লাহোর ষড়যন্ত্র মামলা (১৯১৫) দায়ের করে। প্রায় ১৭ জন বিপ্লবীর এই মামলার রায়ে মৃত্যুদন্ড হয়। বাকিদের যাবজ্জীবন দীপান্তর হয়। রাসবিহারী বসু এই সময় পি এন ঠাকুর ছদ্মনামে ভারত ত্যাগ করে জাপানে পালিয়ে যান। পরে জাপানের এক কন্যাকে বিবাহ করে সেখান থেকে বিপ্লব প্রচেষ্টা সংগঠিত করার উদ্যোগ নেন।
তবে গদর দলের পরিকল্পনা ব্যর্থ হবার পর পাঞ্জাবের বিপ্লবী আন্দোলন কিছুকালের জন্য ম্রিয়মান হয়ে পড়ে।
(গ.) দ্বিতীয় পর্বে উত্তরপ্রদেশের বিপ্লবীদের সশস্ত্র সংগ্রাম
প্রথম বিশ্বযুদ্ধের সময় বার্লিন কমিটির পক্ষ থেকে ভারতের পশ্চিম সীমান্তে একটি সামরিক অভিযানের পরিকল্পনা করা হয়েছিলো। এই উদ্দেশ্যে উত্তরপ্রদেশের রাজা মহেন্দ্রপ্রতাপ জার্মান সম্রাটের সঙ্গে সাক্ষাৎ করেন। জার্মান সম্রাট তাকে সাহায্য দানে সম্মত হন।
ঠিক করা হয়, রাজা মহেন্দ্রপ্রতাপের নেতৃত্বে ভারতীয় বিপ্লবীরা আফগানিস্তানে একটি বিপ্লবী কেন্দ্র স্থাপন করবেন। এই কেন্দ্র থেকে তারা ভারতের দিকে সামরিক অভিযান পরিচালনা করবেন। তুরস্ক রনাঙ্গনে যে সব ভারতীয় সেনা জার্মান ও তুরস্কের হাতে বন্দী হবে, তাদের নিয়ে একটি মুক্তিফৌজ গঠন করা হবে।
পরিকল্পনা মাফিক উত্তরপ্রদেশের দেওবন্ধ বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক ও বিপ্লবী মাহমুদ উল হাসান ও তার সহকারী মৌলানা উবাইদুল্লা ১৫ জন বিপ্লবী ছাত্রকে সঙ্গে নিয়ে ১৯১৫ খ্রিঃ চলে যান বালুচিস্তান। উদ্দেশ্য ছিলো স্বাধীন সরকার গঠন করা। কিন্তু সেখানে বিশাল ইংরেজ বাহিনীর চাপ সহ্য করতে না পেরে তারা আফগানিস্তানের রাজধানী কাবুলে আশ্রয় নেন।
সেখানে তারা রাজা মহেন্দ্রপ্রতাপ, বরকততুল্লাহ প্রমুখের সহযোগিতায় এক স্বাধীন সরকার গঠন করেন। রাজা মহেন্দ্রপ্রতাপ এই অস্থায়ী সরকারের রাষ্ট্রপতি পদ গ্রহণ করেন। কাবুল থেকে বিপ্লবীরা রেশমী রুমালে সাংকেতিক লিপি ব্যবহার করে ভারতে সশস্ত্র বিদ্রোহ সৃষ্টির গোপনে প্রচার চালায়। ১৯১৬ খ্রিঃ ইংরেজ গোয়েন্দারা এই প্রচেষ্টা ধরে ফেলে এবং ঐ বছরেই বহু মুসলিম বিপ্লবী ও ছাত্রকে গ্রেফতার করে "রেশমী রুমাল ষড়যন্ত্র মামলা" দায়ের করে।
এই মামলা ও পরবর্তীকালে যুদ্ধে জার্মানির পরাজয়ের কারনে এই সশস্ত্র অভ্যুত্থানের পরিকল্পনাটিও ব্যর্থ হয়ে যায়। যাইহোক,প্রথম বিশ্বযুদ্ধের শেষদিকে যুদ্ধের গতি মিত্র পক্ষের অনুকূলে চলে আসে। এই সময় বিপ্লবীদের ওপর কঠোর দমনমূলন নীতি নেওয়া হয়। ফলে বিপ্লব আন্দোলন আর সেভাবে দানা বাঁধতে পারে নি। ফলে ভারতে দ্বিতীয় পর্বের সশস্ত্র বিপ্লবী আন্দোলনের আপাত পরিসমাপ্তি ঘটে।
(৩.) তৃতীয় পর্বের সশস্ত্র বিপ্লবী আন্দোলনের ধারা
বিপ্লবীদের কারাগার থেকে মুক্তি
প্রথম বিশ্বযুদ্ধ চলাকালীন সময়ে ভারতের বহু বিপ্লবীকে গ্রেফতার করে ব্রিটিশ সরকার কারাগারে বন্দী রেখেছিলো। প্রথম বিশ্বযুদ্ধ শেষ হলে ১৯২০ খ্রিঃ ইংরেজ সরকার বিপ্লবীদের মুক্তি দেয়। ইতিমধ্যে অসহযোগ আন্দোলন শুরু হলে গান্ধীজি ও দেশবন্ধু চিত্তরঞ্জন দাসের ডাকে সাড়া দিয়ে তারা হিংসাত্মক কার্যক্রম বন্ধ রেখে অসহযোগ আন্দোলনে যোগ দেন। কিন্তু গান্ধীজি হঠাৎ করে আন্দোলন প্রত্যাহার করে নিলে বিপ্লবীরা পুনরায় বিপ্লবী কার্যকলাপ শুরু করেন।
(ক.) তৃতীয় পর্বে বাংলায় সশস্ত্র সংগ্রাম
চট্টগ্রাম সম্মলন
অসহযোগ আন্দোলন প্রত্যাহার করার পর ১৯২২ খ্রিঃ থেকেই বাংলার বিপ্লবীরা পুনরায় কর্মতৎপর হয়ে উঠে। ১৯২২ খ্রিঃ এপ্রিল মাসে চট্টগ্রামে কংগ্রেসের বঙ্গীয় প্রাদেশিক সম্মেলন অনুষ্ঠিত হয়। এই সম্মেলনে বিভিন্ন স্থানের ও বিভিন্ন দলের বিপ্লবী কর্মীরা পরস্পরের সঙ্গে সাক্ষাতের সুযোগ লাভ করেন।
বিপ্লবীদের পরিকল্পনা ও ইস্তাহার
১৯২৩ খ্রিঃ জুলাই মাস থেকে বিপ্লবী দলের পুস্তিকা ও প্রচারপত্র প্রকাশিত হতে থাকে। এই সময় "লাল বাংলা" নামে এক ইস্তাহারে অত্যাচারী পুলিশ ও সরকারী কর্মচারীদের হত্যার কথা ঘোষনা করা হয়। পুরাতন ও ভেঙ্গে পড়া অনুশীলন সমিতি ও যুগান্তর দলকে পুনর্গঠন করা হয়। এই সময় জাতীয় কংগ্রেসের নেতা সুভাষচন্দ্র বসুর অভ্যুদয়ে বিপ্লবীরা উৎসাহিত হয়ে উঠেন।
এই সময় মেদিনীপুর কারাগার থেকে মুক্তি লাভের পর বাংলার বিভিন্ন গোষ্ঠীর বিপ্লবীরা স্থির করেন - (১.) তারা এবার থেকে সম্মিলিত ভাবে কাজ করবেন। (২.) পূর্ব অভিজ্ঞতাকে কাজে লাগিয়ে অধিক সতর্কতায় দলের কর্মী ও অস্ত্রশস্ত্র সংগ্রহ করবেন। (৩.) দেশীয় সেনাবাহিনী ও বিদেশী রাষ্ট্রের সাহায্য লাভের জন্য নতুন ভাবে চেষ্টা করবেন এবং পুনরায় সশস্ত্র অভ্যুত্থান ঘটানোর চেষ্টা করবেন।
তবে সারা ভারতব্যাপী বিপ্লবাত্মক অভ্যুত্থান ঘটানোর অনুকূল পরিস্থিতি না আসা পর্যন্ত ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র এলাকায় সশস্ত্র সংগ্রাম চালিয়ে যেতে হবে। এই সময় পূর্ববঙ্গের বিপ্লবীরা চট্টগ্রাম, ময়মনসিংহ ও বরিশালে সরকারি অস্ত্র লুঠ করার পরিকল্পনা করে।
বিপ্লবীদের কর্মতৎপরতা
১৯২৪ থেকে ১৯২৬ খ্রিঃ মধ্যে বাংলায় ৩ টি গুরুত্বপূর্ণ ঘটনা ঘটে। (১.) ১৯২৪ খ্রিঃ তরুন ছাত্র ও বিপ্লবী গোপীনাথ সাহা কলকাতার পুলিশ কমিশনার চার্লস টেগার্ট কে হত্যা করতে গিয়ে ভুল করে এক ইংরেজ অফিসারকে হত্যা করে ফেলে। (২.) এই বছরেই মার্চ মাসে দক্ষিণেশ্বরে একটি বোমার কারখানা ধরা পড়ে। এই ঘটনায় সূর্য সেন, সুভাষচন্দ্র বসু সহ বহু বিপ্লবীদের গ্রেপ্তার করা হয়। (৩.) এই সময় কারাগারের ভিতরেই পুলিশের গুপ্তচর ভূপেন্দ্রনাথ চট্টোপাধ্যায়কে বিপ্লবীরা হত্যা করে। আরেকজন বিপ্লবী এবং ছাত্র প্রমোদ চৌধুরী জেলের ভিতরেই আলিপুর সেন্ট্রাল জেলের সুপারিনটেনডেন্টকে হত্যা করেন।
১৯২৮ দুই বিপ্লবী দলের অভ্যুত্থান
১৯২৮ খ্রিঃ বাংলায় দুটি বিপ্লবী দলের উদ্ভব ঘটে। দুটি দলের ক্ষেত্রেই সশস্ত্র সংগ্রামে ছাত্ররা গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা নিয়েছিলো।
ইন্ডিয়ান রিপাবলিকান আর্মি
১৯১৬ খ্রিঃ বহরমপুর কলেজে বি এ পড়ার সময় থেকেই সূর্য সেন বিপ্লবী আন্দোলনের সঙ্গে যুক্ত হয়েছিলেন। এইজন্য তাকে কারাবরন করতে হয়েছিলো। ১৯২৮ খ্রিঃ কারাগার থেকে মুক্তি লাভ করে তিনি তার কয়েকজন অনুগামী বিপ্লবী ও ছাত্রদের নিয়ে গঠন করেন বিপ্লবী দল ইন্ডিয়ান রিপাবলিকান আর্মি। পেশায় স্কুল মাস্টার ছিলেন বলে বিপ্লবী মহলে সূর্য সেন মাস্টারদা নামেই অধিক পরিচিত ছিলেন।
সূর্যসেন ও ইন্ডিয়ান রিপাবলিকান আর্মির ৬৪ জন বিপ্লবী ১৯৩০ খ্রিঃ ১৮ এপ্রিল চট্টগ্রামের সরকারি অস্ত্রাগার লুন্ঠন করেন ও চট্টগ্রামকে স্বাধীন বলে ঘোষনা করেন। এই বিপ্লবীদের অধিকাংশই ছিলো তরুন ও ছাত্র। এইসময় সূর্যসেনের বিপ্লবীদলের সঙ্গে পুলিশের জালালাবাদ পাহাড়ে এক বীরত্মপূর্ন যুদ্ধ হয়।
ইন্ডিয়ান রিপাবলিকান আর্মির পরিকল্পনা অনুযায়ী আরেক ছাত্রী বিপ্লবী প্রীতিলতা ওয়াদেদ্দার ১৯৩২ খ্রিঃ চট্টগ্রামের পাহাড়তলির ইউরোপীয়ান ক্লাব আক্রমণ করেন। এই ঘটনার অল্প দিন পরেই সূর্যসেন সহ তার অনুগামীরা পুলিশের হাতে ধরা পড়েন।
চট্টগ্রাম বিপ্লবী দলের অন্যতম আরেকজন বিপ্লবী ছিলেন কল্পনা দত্ত। চট্টগ্রামের খাস্তগীর হাইস্কুল থেকে ম্যাট্রিক পাস করার পরেই তিনি ইন্ডিয়ান রিপাবলিকান আর্মিতে যোগদান করেন। সূর্য সেনের পরিকল্পনা মতো ডিনামাইট দিয়ে চট্টগ্রামের জেলখানা উড়িয়ে দেওয়ার দায়িত্ব কল্পনা দত্তকে দেওয়া হয়েছিলো। কিন্তু পুলিশ জানতে পারায় পরিকল্পনাটি আর বাস্তবায়িত করা যায় নি।
বেঙ্গল ভলান্টিয়ার্স
১৯২৮ খ্রিঃ বাংলায় আরেকটি বিপ্লবী দল গড়ে উঠে, যার নাম ছিলো "বেঙ্গল ভলান্টিয়ার্স"। সুভাষচন্দ্র বসুর অনুপ্রেরণায় বিপ্লবী হেমচন্দ্র ঘোষ ১৯২৮ খ্রিঃ শেষের দিকে বেঙ্গল ভলান্টিয়ার্স দল প্রতিষ্ঠা করেন। বাংলার প্রায় প্রতিটি জেলায় বেঙ্গল ভলান্টিয়ার্সের শাখা থাকলেও, কলকাতা, মেদিনীপুর ও ঢাকাতে এদের প্রভাব ছিলো সবচেয়ে বেশি।
বেঙ্গল ভলান্টিয়ার্স দলের প্রায় সব বিপ্লবীরাই ছিলেন ছাত্র। বেঙ্গল ভলান্টিয়ার্স বেছে বেছে নামি কলেজের মেধাবী ছাত্রদের সদস্য করতো। ১৯৩০ দশকে বেঙ্গল ভলান্টিয়ার্সের উদ্যোগে একাধিক হত্যাকান্ডের ঘটনা ঘটে। যার মধ্যে অন্যতম ছিলো -
(১.) ১৯৩০,২৯ আগস্ট, আগস্ট ডাক্তারি ছাত্র বিনয় বসু কর্তৃক ঢাকার মিটফোর্ড হাসপাতালে বাংলা পুলিশের গোয়েন্দা প্রধান লোম্যান হত্যা।
(২.) ১৯৩০ খ্রিঃ ৮ ডিসেম্বর, মেডিক্যাল কলেজের ছাত্র বিনয় বসু, বাদল গুপ্ত, দীনেশ গুপ্ত কর্তৃক কলকাতার রাইটার্স বিল্ডিং আক্রমণ ও কারা বিভাগের অধিকর্তা কর্নেল সিম্পসনকে হত্যা।
(৩.) ১৯৩১ খ্রিঃ ছাত্র বিপ্লবী বিমল দাসগুপ্ত ও জ্যোতিজীবন ঘোষ কর্তৃক মেদিনীপুর কলেজিয়েট স্কুলে জেলাশাসক পেডি হত্যা।
(৪.) চব্বিশ পরগনার জজ কোর্টে গার্লিক হত্যা।
(৫.) গিলেন্ডার হাউসে ভিলিয়ার্সকে হত্যার প্রচেষ্টা।
(৬.) মেদিনীপুর ডিস্ট্রিক্ট ও সেশন কোর্টে রক্সবার্গকে হত্যা।
(৭.) ছাত্র বিপ্লবী প্রদ্যোৎ ভট্টাচার্য কর্তৃক মেদিনীপুরের পরবর্তী জেলাশাসক ডগলাসকে হত্যা।
(৮.) মেদিনীপুরের অপর জেলাশাসক বার্জ হত্যা। ১৯৩৩ খ্রিঃ এই হত্যাকান্ডের সঙ্গে জড়িত ছিলেন ছাত্র অনাথবন্ধু পাঁজা ও মৃগেন দত্ত।
১৯৩০ থেকে ১৯৩৪ খ্রিঃ পর্যন্ত বেঙ্গল ভলান্টিয়ার্স দল টানা বাংলায় নাশকতামূলক কাজকর্ম চালিয়েছিলো। এই সময় বেঙ্গল ভলান্টিয়ার্স ছাড়াও আরোও অনেক বিপ্লবী দল সক্রিয় ভাবে নাশকতামূলক কাজকর্মের সঙ্গে যুক্ত ছিলো। যেমন যুগান্তর দল, অনীল রায়ের শ্রীসংঘ, ইত্যাদি।
ছাত্রীদের ভূমিকা
এই পর্বে কয়েকজন উল্লেখযোগ্য ছাত্রী বিপ্লবী কর্মে সক্রিয় ভাবে অংশগ্রহণ করেন। এদের অভূতপূর্ব কৃতিত্বের কথা পৃথক করে বলতেই হয়।
(১.) এদের মধ্যে সবার প্রথমেই উল্লেখ করতে হয় দুই স্কুল ছাত্রী শান্তি ঘোষ ও সুনীতি চৌধুরী। তারা ১৯৩১ খ্রিঃ কুমিল্লার অত্যাচারী ম্যাজিস্ট্রেট স্টিভেন্সকে হত্যা করেন।
(২.) চট্টগ্রাম অস্ত্রাগার লুন্ঠনের সঙ্গে যুক্ত ছিলেন দুজন ছাত্রী। একজন প্রীতিলতা ওয়াদেদ্দার, অন্যজন কল্পনা দত্ত। এদের কৃতিত্বের কথা আমরা আগেই উল্লেখ করেছি।
(৩.) ১৯৩২ খ্রিঃ আরেক উল্লেখযোগ্য ছাত্রী ছিলেন বীনা দাস। কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ে সমাবর্তন অনুষ্ঠানে তিনি বাংলার গর্ভনর স্ট্যানলি জ্যাকসনকে হত্যার চেষ্টা করেন। বীনা বেথুন কলেজে পড়ার সময় থেকেই বিপ্লবী দলের সঙ্গে যুক্ত ছিলেন।
(৪.) বিপ্লবী আন্দোলনের সঙ্গে যুক্ত আরেকজন ছাত্রী ছিলেন উজ্জ্বলা মজুমদার। ১৯৩৪ খ্রিঃ তিনি দার্জিলিং এ বাংলার গভর্নর জন অ্যান্ডারসনকে হত্যার চেষ্টা করেন।
(খ.) তৃতীয় পর্বে পাঞ্জাব ও উত্তরভারতের সশস্ত্র সংগ্রাম
অসহযোগ আন্দোলন প্রত্যাহার করার পাঞ্জাব ও উত্তর প্রদেশে ধীরে ধীরে বিপ্লবী আন্দোলন দানা বাঁধতে শুরু করে। প্রথম বিশ্বযুদ্ধের পরবর্তীকালে পাঞ্জাবের বিপ্লবী আন্দোলনের একটি অন্যতম বৈশিষ্ট্যেই ছিলো বিপ্লবী ভাবধারায় সমাজতান্ত্রিক আদর্শের অনুপ্রবেশ।
হিন্দুস্থান রিপাবলিকান অ্যাসোসিয়েশন
১৯২৪ খ্রিঃ কানপুরে ভারতীয় বিপ্লবীদের এক গোপন সমাবেশ হয়। ঐ সমাবেশে চন্দ্রশেখর আজাদের উদ্যোগে ১৯২৪ খ্রিঃ গঠিত হয় "হিন্দুস্থান রিপাবলিকান অ্যাসোসিয়েশন"। ধীরে ধীরে এই বিপ্লবী সংস্থার শাখা সংগঠন বিহার, বোম্বাই, মাদ্রাজ ও পাঞ্জাবের মধ্যে ছড়িয়ে পড়ে।
কাকোরী রেল ডাকাতি
১৯২৫ খ্রিঃ রামপ্রসাদ বিসমিলের নেতৃত্বে একদল ছাত্র বিপ্লবী উত্তর প্রদেশের কাকোরি থেকে আলমনগরগামী একটি ট্রেনে অর্থ সংগ্রহের জন্য রাজনৈতিক ডাকাতি করেন। এই ডাকাতিকে কেন্দ্র করে ১৯২৫ খ্রিঃ শুরু হয় "কাকোরী ষড়যন্ত্র মামলা"। এই মামলায় অভিযুক্তদের মধ্যে ছিলেন রামপ্রসাদ বিসমিল, রোওশনলাল, রাজেন্দ্রনাথ লাহিড়ী ও আসফাকুল্লা। এদের সবারই ফাঁসি হয়েছিলো।
ভগৎ সিং
পাঞ্জাবের বিপ্লবী আন্দোলন দুর্বার হয়ে উঠেছিলো ভগৎ সিংহের নেতৃত্বে। ভগৎ সিংহ যখন ছাত্র ছিলেন, তখনই ঘটেছিলো কুখ্যাত জালিয়ানওয়ালাবাগ হত্যাকাণ্ড। সেই ঘটনার তিনি নিজে প্রত্যক্ষদর্শী ছিলেন। ছাত্রবস্থাতেই ভগৎ সিংহ বিপ্লবী আন্দোলনের দিকে ঝুঁকে পড়েছিলেন। তিনি ছিলেন অজিত সিংয়ের ভাইপো। তার কাকা অজিত সিং ছিলেন পাঞ্জাবের একজন বিখ্যাত বিপ্লবী। সুতরাং পারিবারিক পরিমন্ডল থেকেই ভগৎ সিংহ বিপ্লবী আন্দোলনের অনুপ্রেরণা পেয়েছিলেন।
বিপ্লবীদের সংগঠিত করার জন্য তিনি "নওজোয়ান ভারত সভা" গঠন করেন। অনেক পাঞ্জাবী ছাত্র এর সদস্য হয়। ১৯২৮ খ্রিঃ চন্দ্রশেখর আজাদ ভগৎ সিংহ কে "হিন্দুস্থান রিপাবলিকান অ্যাসোসিয়েশনের" দায়িত্ব দিলে, ভগৎ সিংহ ঐ সংস্থার নাম পরিবর্তন করে রাখেন "হিন্দুস্থান সোসালিস্ট রিপাবলিকান অ্যাসোসিয়েশন"।
এই বছরটিতেই সাইমন কমিশন ভারতে পদার্পণ করলে লালা লাজপৎ রায় তার প্রতিবাদ করেন। ঐ সময় পুলিশের লাঠির আঘাতে তিনি গুরুতর জখম হন ও পরে মারা যান।
এই ঘটনার প্রতিশোধ নেবার জন্য ভগৎ সিংহ ১৯২৮ খ্রিঃ ১৭ নভেম্বর, লাহোরের পুলিশ ইন্সপেক্টর মিঃ সান্ডার্সকে গুলি করে হত্যা করেন।
এর পরের বছর ১৯২৯ খ্রিঃ ৮ ই এপ্রিল দিল্লির লেজিসলেটিভ এসেম্বলি হলে "ট্রেড ডিসপিউড বিল" ও "পাবলিক সেফটি বিল" এর প্রতিবাদে, ঐ দুটি বিল নিয়ে আলোচনার সময় ভগৎ সিংহ ও বটুকেশ্বর দত্ত দর্শকের আসন থেকে দুটি শক্তিশালী বোমা নিক্ষেপ করেন।
এই ঘটনার সূত্র ধরে পুলিশ লাহোর ও সাহারানপুরে একটি করে বোমা তৈরির কারখানা আবিষ্কার করে এবং তার সঙ্গে যুক্ত হিন্দুস্থান সোসালিস্ট পার্টির বহু সদস্যকে গ্রেফতার করে ১৯২৯ খ্রিঃ "লাহোর ষড়যন্ত্র মামলা" দায়ের করে।
যতীন দাসের মৃত্যু ও ছাত্র বিক্ষোভ
লাহোর ষড়যন্ত্র মামলায় বিপ্লবী বন্দীরা জেল পুলিশের দুর্ব্যবহারের প্রতিবাদে জেলের মধ্যেই অনশন শুরু করেন। এইসময় বাঙালি বিপ্লবী যতীন দাস ৬৪ দিন অনশন করে প্রানত্যাগ করেন (১৯২৯ খ্রিঃ ১৩ ই সেপ্টেম্বর)।
যতীন দাসের মৃত্যু সংবাদে সারা দেশে ব্যাপক ক্ষোভ ও চাঞ্চল্যের সৃষ্টি হয়। এই সময় সমগ্র ভারত জুড়ে অসংখ্য যুব ও ছাত্র সংগঠন গড়ে উঠে। ১৯২৯ খ্রিঃ ডিসেম্বর মাসে মদনমোহন মালব্যের সভাপতিত্বে লাহোরে এক সর্বভারতীয় ছাত্র সম্মেলন অনুষ্ঠিত হয়।
এই প্রবল ছাত্র বিক্ষোভের মধ্যেই ১৯২৯ খ্রিঃ ডিসেম্বর মাসে চন্দ্রশেখর আজাদের নেতৃত্বে দিল্লীর কাছে বড়লাটের ট্রেনের ওপর বোমা নিক্ষেপ করা হয়। ১৯৩১ খ্রিঃ ২৩ মার্চ ভগৎ সিংহ, বটুকেশ্বর দত্ত, শুকদেব ও রাজগুরুর ফাঁসী হয়।
আনন্দ মন্ডল
ভগৎ সিংহের ফাঁসি দেওয়া হলে সারা পাঞ্জাবে প্রবল ছাত্র বিক্ষোভ দেখা যায়। এই সময় খালসা কলেজের ছাত্রদের তৈরি বিপ্লবী সংগঠন এবং অন্য এক বিপ্লবী সংগঠন আনন্দ মন্ডল কিছুটা তৎপরতা দেখলেও, অমৃতসরের খালসা কলেজের ছাত্র হরকিষেনের মৃত্যুদন্ড হলে পাঞ্জাবের বিপ্লবী প্রচেষ্টার আপাত পরিসমাপ্তি ঘটে।
১৯৩০ খ্রিঃ ২৩ ডিসেম্বর, পাঞ্জাবের গভর্নর বিশ্ববিদ্যালয়ের কনভোকেশন উৎসবে যোগদান করার সময়ে হরকিষেন নামে এক ছাত্র গভর্নরকে গুলি করে হত্যা করার চেষ্টা করেছিলেন। ১৯৩০ খ্রিঃ ফেব্রুয়ারি মাসে চন্দ্রশেখর আজাদের মৃত্যুর অল্প দিনের মাথায় হিন্দুস্থান রিপাবলিকান অ্যাসোসিয়েশনও ভেঙ্গে পড়ে।
(গ.) ভারতের অন্যান্য অঞ্চলে বিপ্লবী আন্দোলনে ছাত্র সমাজের ভূমিকা :-
তৃতীয় পর্বের সশস্ত্র বিপ্লবী আন্দোলন শুধুমাত্র বাংলা, পাঞ্জাব বা উত্তর প্রদেশের মধ্যেই সীমাবদ্ধ ছিলো না। কম বেশি ভারতের অন্যান্য প্রদেশ গুলিতেও ছড়িয়ে পড়েছিলো। ঐসমস্ত বিপ্লবী আন্দোলনের ক্ষেত্রেও ছাত্ররাই ছিলেন বিপ্লবের মূল কান্ডারী।
(১.) ১৯৩১ খ্রিঃ ২২ জুলাই বোম্বাই প্রদেশের অস্থায়ী গভর্নর স্যার আর্নেস্ট হটসন পুনার ফার্গুশন কলেজ পরিদর্শন করতে এলে একজন ছাত্র গভর্নরকে গুলি করে হত্যার চেষ্টা করেন।
(২.) এছাড়া, বিহার, আসাম, দিল্লি, মধ্যপ্রদেশ, সিন্ধুপ্রদেশ ও উত্তর পশ্চিম সীমান্ত প্রদেশে এই পর্বে ছোট ছোট রাজনৈতিক ডাকাতি ও হত্যাকাণ্ড সংগঠিত করার চেষ্টা চালায় ছাত্র যুবরা। কিন্তু সেভাবে কার্যকর কোন দৃষ্টান্তমূলক নজির তারা সৃষ্টি করতে পারে নি। ব্রিটিশ সরকার এবং দেশের মানুষের কাছে সেগুলি নাশকতামূলক কাজ হিসাবেই ধরা দেয়।
(ঈ.) বিপ্লববাদের অবসান
১৯৩০ থেকে ১৯৩৪ খ্রিঃ মধ্যে বাংলা ও উত্তর ভারতের প্রায় তিন হাজার বিপ্লবীকে হয় কারাদন্ডে দন্ডিত করা হয় না হয় বিনা বিচারে আটক করা হয়। শুধুমাত্র বাংলাদেশেই ২১৭৭ জনকে বিনা বিচারে আটক করা হয়। এদের বেশিরভাগকেই বহরমপুর, বক্সা, হিজলী, দেউলীর বন্দী শিবিরে আটক রাখা হয়। দীর্ঘ মেয়াদী কারাদন্ডে শাস্তিপ্রাপ্তদের সুদূর আন্দামানে নির্বাসনে পাঠানো হয়।
বিনা বিচারে আটক বন্দীদের প্রায় সকলেই ১৯৩০ - ৩৪ খ্রিঃ থেকে ১৯৩৭ খ্রিঃ পর্যন্ত বিভিন্ন বন্দী শিবিরে আবদ্ধ থাকেন। শেষপর্যন্ত গান্ধীজির হস্তক্ষেপ ও অনুরোধে ১৯৩৭ খ্রিঃ শেষভাগে এবং ১৯৩৮ খ্রিঃ প্রথম ভাগে বাংলাদেশ সহ অন্যান্য অঞ্চলের বিনা বিচারে আটক রাজবন্দীরা মুক্তিলাভ করেন। আরোও কিছুদিন পর অনশন - ধর্মঘটের দ্বারা ভারতের অন্যান্য অঞ্চলের বন্দীদের একটা বড়ো অংশও মুক্তি লাভ করেন।
ইতিপূর্বে জেল ও বন্দীশালায় বসে রাজনৈতিক আলোচনা ও গ্রন্থ পাঠের মধ্য দিয়ে বিপ্লবীরা উপলব্ধি করেন -
মুষ্ঠিমেয় কয়েকজন যুবকদের দ্বারা বিপ্লব হতে পারে না। তারা দেশকেও জাগাতে পারে না। "বিপ্লব" দ্বারা বিদেশী শাসনের উচ্ছেদ করতে হলে অসহিষ্ণুতা নয়। চাই সহিষ্ণুতার সঙ্গে জনগনের মধ্যে সুষ্ঠ সংযোগ স্থাপন করা। জনগনের নিজেদের দাবির "ভিত্তির" ওপর তাদের সংগঠিত করে ছোট ছোট সংঘাতের মধ্য দিয়ে ধাপে ধাপে ক্ষমতা অধিকার করার লক্ষ্যে সর্বশেষ সংগ্রামের পথে এগিয়ে যেতে হবে। এইভাবেই আসবে বিপ্লব। সে বিপ্লব প্রকৃতই হবে "গন বিপ্লব"। জনগনকে বিচ্ছিন্ন রেখে অথবা জনগনের সঙ্গে বিচ্ছিন্ন থেকে কখনই "বিপ্লবকে" সংঘঠিত করা যায় না।
এই গভীর আত্মোপলব্ধীই শেষ পর্যন্ত শত সহস্র বিপ্লবী ছাত্র যুবককে ভারতের গন সমুদ্রের আন্দোলনে ভাসিয়ে নিয়ে যায়। কালের চিরায়ত নিয়মে সকল "শক্তি ও ঐতিহ্যই" ভারতের মহামানবের সাগর তীরে এসে বিলীন হয়েছিলো। সশস্ত্র বিপ্লবী আন্দোলনের সৈনিকদের শক্তিও শেষ অবধি সেই জনসমুদ্রেই বিলীন হয়ে যায় ।
(উ.) বিপ্লবীদের ব্যর্থতার কারন :-
নিঃসন্দেহে, ভারতের সশস্ত্র বিপ্লবী আন্দোলনে শেষপর্যন্ত ব্যর্থ হয়েছিলো। তাদের এই ব্যর্থতার পিছনে অনেক গুলি কারন দায়ী ছিলো।
(১.) জনসমর্থনের অভাব অথবা জনগনের সঙ্গে সম্পর্ক স্থাপন না করা বিপ্লবীদের একটি বিরাট ভুল ছিলো। জনসংযোগ ও জন সমর্থন না থাকাই তাদের বিপ্লবী কার্যক্রম গুলি গন অভ্যুত্থানে পরিনত হতে পারে নি। এর ফলে বিপ্লবীদের এবং তাদের কার্যকলাপকে সরকার ও জনসাধারণের একটা বড়ো অংশ বিচ্ছিন্ন ঘটনা, নাশকতামূলক ঘটনা বা সন্ত্রাসবাদী ঘটনা বলেই দেখেছিলো। গন অভ্যুত্থান ঘটাতে না পারার কারনেই বিপ্লবীদের একাংশকে সন্ত্রাসবাদী আখ্যা দেওয়া হয়।
(২.) রাজনৈতিক সংগঠনের বিস্তার কখনই গুপ্তভাবে করা যায় না। বিপ্লবীরা বিভিন্ন রাজনৈতিক সংগঠন, দল বা গোষ্ঠী গড়ে তুললেও, চূড়ান্ত গোপনীয়তার কারনে তার বিস্তার সেভাবে হতে পারে নি। বিপ্লবী গোষ্ঠী গুলির একটি বড়ো অংশ আঞ্চলিক স্তরেই সীমাবদ্ধ থেকে গিয়েছিলো। স্থানীয় সীমাবদ্ধতার কারনে সরকারের পক্ষে খুব সহজেই তাদের দমন করা সহজ হয়েছিলো।
(৩.) বিপ্লবীদের ব্যর্থতার আরেকটি বড়ো কারন ছিলো তারা জাতীয় কংগ্রেসের মতো কোন সর্বভারতীয় সংগঠন গড়ে তুলতে পারেন নি। এর ফলে তাদের আন্দোলনের ধরন ও প্রকৃতি ছিলো অনেকটাই বিচ্ছিন্ন, ইতস্তত ও আঞ্চলিক এলাকার মধ্যেই সীমাবদ্ধ। সর্বভারতীয় সংগঠনের অভাবে বিপ্লবী আন্দোলনকে একই তালে সারা দেশব্যাপী প্রসারিত করাও যায় নি।
(৪.) বিপ্লবীদের ব্যর্থতা ও সীমাবদ্ধতার আরেকটি দিক ছিলো, তাদের ভুল রনকৌশল। তারা ভেবেছিলো দু একজন ইংরেজ আধিকারিককে হত্যা করলে বা সন্ত্রাসের বাতাবরন সৃষ্টি করলেই ইংরেজ শাসনের অবসান ঘটবে। বাস্তবে কিন্তু তা হওয়ার ছিলো না। ইংরেজ আমলাতন্ত্র ছিলো যথেষ্ট শক্তিশালী। দু একজন রাজ কর্মচারী বা আধিকারিককে হত্যা করে কখনই সে আমলাতন্ত্রে ভাঙ্গন সৃষ্টি করা সম্ভব নয়। পৃথিবীর সব প্রশাসনই টিকে থাকে জনসমর্থন ও সামরিক বাহিনীর নির্বিচার আনুগত্যের ওপর। বিপ্লবীরা সেখানে কোন ফাটল সৃষ্টি করতে পারেন নি।
(৫.) ভারতে জনসমাজের একটা বড়ো অংশ ছিলো আদিবাসী, মুসলিম, কৃষক ও শ্রমিক। সমাজের অন্যান্য অংশ থেকে এরা সামাজিক দিকে অনেক বেশি সংগঠিত ও ঐক্যবদ্ধ থাকে। তাদের শক্তিকে বিপ্লবীরা কাজে লাগান নি। ফলে ঐ সমস্ত জনসমাজ বিপ্লবী আন্দোলন থেকে দূরেই থাকে। অথচ ইতিহাসে ঐ সমস্ত শ্রেনী গুলির সশস্ত্র সংগ্রামের পরিচয় অনেক পাওয়া যায়।
(৬.) এই সমস্ত কারন গুলি ছাড়াও, বিপ্লবীদের গোষ্ঠীদ্বন্দ্ব, বিশ্বাসঘাতকতা এবং ব্রিটিশ সরকারের তীব্র দমন নীতি বিপ্লবীদের পরাজয় ও ব্যর্থতার অন্যতম কারন ছিলো।
(ঊ.) বিপ্লবী আন্দোলনের অবদান
সবশেষে বলা যায়, সশস্ত্র সংগ্রামে ছাত্রযুব দের বিপ্লব যে একেবারেই নিস্ফল হয়েছিলো, তেমনটি কিন্তু নয়। কেননা -
(১.) এই সংগ্রামে তারা যে আত্মত্যাগ ও বীরত্বের নিদর্শন রাখেন, তা দেশবাসীর মনে প্রবল আত্মবিশ্বাস ও গভীর উদ্দীপনার সঞ্চার করেছিলো।
(২.) ব্যক্তিগত সুখ স্বাচ্ছন্দ্য পরিহার করে বিপ্লবীদের কঠোর কৃচ্ছসাধন ও সহাস্য প্রান বিসর্জনে দেশবাসী উপলব্ধি করে, দেশের স্বাধীনতা অর্জনের জন্য চরম আত্মত্যাগ প্রয়োজন।
(৩.) বিপ্লবীদের বীরত্মপূর্ন সংগ্রাম ও আত্মত্যাগ দেশের অগনিত ছাত্র যুবকদের স্বাধীনতা সংগ্রামে এগিয়ে আসার প্রেরণা জোগায়।
(৪.) ব্রিটিশ সরকার ও পুলিশ যে কতখানি নিষ্ঠুর, পৈশাচিক, বর্বর হতে পারে তার কদর্য রূপ বিপ্লবীদের দমন নীতি থেকে দেশবাসী জানতে পারে। ফলে বিপ্লবী আন্দোলন পরোক্ষে দেশবাসীর মনে ব্রিটিশ বিরোধী চেতনার প্রসার করেছিলো।
(৫.) বিপ্লবীরা পূর্ণ স্বাধীনতা অর্জনের জন্য বৈপ্লবিক আপোষহীন ও সমঝোতাহীন সংগ্রামের যে দৃষ্টান্ত রেখে যান তার প্রতিফলনেই পরবর্তীকালে সংগঠিত হয় ১৯৪২ এর "আগস্ট বিপ্লব"।