উত্তর আধুনিক যুগ ও উত্তর আধুনিকতাবাদ

 ইতিহাসে যুগ বিভাজনে একটি গুরুত্বপূর্ণ মত হলো "উত্তর আধুনিক যুগ বা উত্তর আধুনিকতাবাদ"। এটি আসলে কি, তাই খুব সহজ ভাষায় এখানে আমরা আলোচনা করবো। 

একদল ঐতিহাসিকদের মতে, ১৯৪৫ খ্রিঃ দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর পৃথিবীতে আধুনিক যুগ শেষ হয়ে গেছে। এর পর বিশ্বে শুরু হয়েছে "উত্তর আধুনিক যুগ" বা "post modern age"। 

উত্তর আধুনিক যুগ কাকে বলে বা উত্তর আধুনিকতা বলতে ঠিক কি বোঝায়, তা একটি জটিল এবং গোলমেলে বিষয়। সহজ করে বলা যায়, উত্তর আধুনিকতা হচ্ছে "আধুনিকতা" বিরোধী একটি দর্শন বা মতাদর্শ। ফ্রান্সের মিশেল ফুকো, জ্যাঁক ডেরিডা প্রমুখ ছিলেন এর প্রবক্তা

উত্তর আধুনিক যুগ ও উত্তর আধুনিকতাবাদ
উত্তর আধুনিক যুগ ও উত্তর আধুনিকতাবাদ 


 উত্তর আধুনিকতাবাদের অর্থ ও ধারনা :-  

(ক.) আধুনিক যুগের ধারনা :- 

"উত্তর আধুনিকতা" সম্পর্কে বুঝতে হলে আগে "আধুনিকতা কাকে বলে"? - তা জানা দরকার। 

মাথায় রাখতে হবে, আধুনিকতা কোন মতবাদ নয়, দর্শন নয়, এমনকি কোন স্থায়ী লক্ষনও নয়। ঊনবিংশ ও বিংশ শতাব্দীর পৃথিবীর সভ্যতার একটি "রূপ" বা "Structure" ছিলো আধুনিকতা। 

(খ.) প্রাক আধুনিক কালের সঙ্গে আধুনিক কালের মৌলিক পার্থক্য :-

উত্তর আধুনিকতাবাদের বিষয়টি ভালো করে বোঝবার জন্য আগে প্রাক আধুনিক কালের সঙ্গে আধুনিক কালের কি মৌলিক পার্থক্য ছিলো সেটি বুঝে নেওয়া দরকার। 

আধুনিক যুগের আগের সময়কালকে বলা হয় প্রাক্ আধুনিক কাল বা যুগ এবং আধুনিক যুগের পরবর্তী সময়কালকে বলা হয় উত্তর আধুনিক কাল বা যুগ। 
 

(গ.) প্রাক আধুনিক যুগের চিন্তা ভাবনা, বৈশিষ্ট্য ও লক্ষন :- 

"প্রাক্ আধুনিক যুগ" বলতে একদিকে যেমন আধুনিক যুগ প্রারম্ভের নিকটবর্তী লক্ষনযুক্ত সময়কালকে বোঝায়, তেমনি বৃহত্তর অর্থে আধুনিক যুগ শুরু হওয়ার পূর্ববর্তী সমগ্র সময়কালকে অর্থাৎ সমগ্র প্রাচীন এবং মধ্য যুগকেই বোঝায়। 

প্রাক্ আধুনিক যুগে অর্থাৎ প্রাচীন যুগ এবং মধ্য যুগে মানুষ ছিলো অসহায়। সেই সময় ধর্ম এবং ঈশ্বরীয় চেতনা সমগ্র মানব সত্তাকে আচ্ছন্ন করে রেখেছিলো। মনে করা হতো, এই বিশ্ব ব্রহ্মান্ড এবং সমগ্র ভূ লোকের মালিক হলেন ঈশ্বর। ঈশ্বর এই ভূলোক শাসনের জন্য রাজাকে নিযুক্ত করেছেন। রাজা তাই নিজেকে ঈশ্বরের প্রতিনিধি বলে প্রচার করতেন। স্বয়ং ঈশ্বরের কাছ থেকে তিনি রাজ্য শাসনের দায়িত্ব লাভ করেছেন বলে দাবি করতেন। 

সুতরাং রাজার স্বৈরাচারী শাসনের বিরুদ্ধে কোন প্রশ্ন তোলার অধিকার মানুষের ছিলো না। ধর্মভীতি ও স্বৈরশাসনের নাগপাশে তখন মানবাধিকার জর্জরিত ছিলো। মুক্ত মনন, চিন্তার স্বাধীনতা, স্বাধীন ভাবে মত প্রকাশের অধিকার তখনও মানুষ অর্জন করে নি। "ধর্ম ও ঈশ্বর" মানুষের অন্তর্নিহিত সকল শক্তি ও অপার সম্ভবনার পথ গুলিকে রুদ্ধ করে রেখেছিলো। 

রাজার পরে ছিলেন পোপ,পুরোহিত,উলেমা বা ইমাম প্রভৃতি ধর্মীয় ব্যক্তি। এরা প্রধানত ধর্মগুরু ছিলেন। এইসব ধর্মীয় পদাধিকারী ব্যক্তিরা দাবি করতেন, পৃথিবীর ওপর প্রথম অধিকার তাদেরই। কারন এই পৃথিবীর ভার ঈশ্বর তাদের উপরেই অর্পন করেছেন। ঐ সমস্ত ধর্মীয় পদাধিকারী ব্যক্তিরা তাই আধ্যাত্মিক জগতে নেতৃত্ব দেওয়ার পাশাপাশি রাজ ক্ষমতাকেও নিয়ন্ত্রন করতেন। "পুরোহিত" নামক ধর্মীয় পদাধিকারী ব্যক্তিকে চটিয়ে প্রাক্ আধুনিক যুগে কোন শাসকের পক্ষেই ক্ষমতায় টিকে থাকা সম্ভব ছিলো না। ধর্ম ও ঈশ্বরীয় নিয়ন্ত্রনের নাগপাশে শুধু রাজা বা শাসক নয়, সাধারন মানুষও জর্জরিত ছিলেন। 

এককথায়, ধর্ম ও ঈশ্বরীয় চিন্তা ভাবনা প্রাক্ আধুনিক যুগে রাষ্ট্র, সমাজ, রাজনীতি এবং মানুষের ব্যক্তিত্বকে নিয়ন্ত্রন করতো। এইজন্য প্রাক্ আধুনিক যুগে ঈশ্বরকে কেন্দ্র করেই সাহিত্য, সংগীত ও দর্শন রচিত হয়েছিলো। মানুষের চিন্তা ভাবনাকে আচ্ছন্ন করে রেখেছিলো ঈশ্বর এবং নানা ঈশ্বরীয় বিধি বিধান ও সংস্কার। মানুষ সব কিছুই ঈশ্বর নির্দিষ্ট বলে মনে করতো। এমনকি নিজের ভাগ্যকেও তারা ঈশ্বর দ্বারা নিয়ন্ত্রিত বলে ভাবতো। 

শামুক যেমন তার শক্ত খোলের মধ্যে কুঁকড়ে থাকে, ঠিক তেমনি প্রাক্ আধুনিক যুগে ঈশ্বরের ভয়ে বা তার নিয়ন্ত্রনে মানুষ কুঁকড়ে ছিলো। এই সময়ে সর্বব্যাপী ঈশ্বরীয় ধ্যান ধারনার দরুন মানুষের মুক্ত মন ও স্বাধীন চিন্তা ধারার জন্ম হয় নি। মানবিকতা বোধ মানবাধিকার, ব্যক্তিসত্ত্বা, ব্যক্তিস্বাতন্ত্রবাদ ইত্যাদি মানবীয় গুনগুলিরও বিকাশ ঘটে নি। মনে করা হতো পৃথিবীতে সব কিছুই ঈশ্বর তৈরি করেছেন। সব কিছুর মালিকও তিনি। মানুষ নিমিত্ত মাত্র। রাজা তার হয়ে শাসন করছেন। পোপ বা পুরোহিতও তাই। রাজা বা পুরোহিত কে উপেক্ষা বা অস্বীকার করার কোন ক্ষমতা সাধারন মানুষের ছিলো না। রাজা বা পুরোহিত ঈশ্বরের ভয়ে যতটা অসহায় ছিলেন, রাজা বা পুরোহিতের স্বৈরতান্ত্রিক শাসনের কাছে সাধারন মানুষ আরো অনেক বেশি অসহায় ছিলেন। 

ফলে প্রাক্ আধুনিক যুগের চিন্তা চেতনায় প্রাধান্য পেয়েছিলেন ঈশ্বর, মানুষ নয়। শিল্প, সাহিত্য, সংস্কৃতি সব কিছুতেই মানুষ উপেক্ষিত ছিলেন। ঈশ্বরকে কেন্দ্র করেই মানুষের যাবতীয় চিন্তা ভাবনা ও দর্শন গড়ে উঠেছিলো। ঈশ্বরীয় চিন্তার প্রাবল্যে মানুষের বুদ্ধিমত্তা, স্বাধীন মনন ও মানবীয় সত্ত্বা গুলি শামুখের খোলের মধ্যেই আবদ্ধ থেকে গিয়েছিলো। পরিপূর্ণ মুক্ত ভাবে বিকশিত হবার সুযোগ পায় নি। 

(ঘ.) ইওরোপে আধুনিক যুগের আগমন, চিন্তা ভাবনা, বৈশিষ্ট্য ও লক্ষনসমূহ :-  

ইওরোপে ১৪৫৩ খ্রিঃ অটোমান তুর্কিদের দ্বারা কনস্ট্যানটিনোপেলের পতনের পর সেখানকার বুদ্ধিজীবী পন্ডিতরা তাদের প্রাচীন পুঁথিপত্র গুলি নিয়ে ইতালির শহর গুলোতে চলে আসেন। এই সময় প্রাচীন গ্রিক ও রোমান সাহিত্যের পুঁথিপত্র গুলো তারা নতুন করে পড়তে ও বুঝতে শুরু করলেন। তারা দেখলেন, ধ্রুপদি গ্রিক ও ল্যাটিন সাহিত্য গুলিতে ঈশ্বর নয়, কেন্দ্রীয় চরিত্র ছিলো মানুষ। মানুষের সুখ, দুঃখ, আনন্দ, ভালোবাসা, বিচ্ছেদ, বিরহ প্রভৃতি বিষয়কে নিয়ে এই সময়কার সাহিত্য গুলো লেখা হয়েছিলো। 

ধ্রুপদি সাহিত্য চর্চা ও তার বৌদ্ধিক অনুশীলন থেকে পঞ্চদশ শতকে ইওরোপে শুরু হয় রেনেসাঁ বা নবজাগরন। এই নবজাগরন থেকে জন্মলাভ করে যুক্তিবাদ, মানবতাবাদব্যক্তিস্বাতন্ত্রবাদযুক্তিবাদের ফলে মানুষ যুক্তি বা লজিক দিয়ে সব কিছুকে বিচার বিশ্লেষণ করতে শুরু করে। এর ফলে ঈশ্বরীয় বিশ্বাস ও নিয়ন্ত্রণের জায়গাটি অনেকটা শিথিল হয়ে পড়ে। মানুষের মনে পোপের নিরঙ্কুশ কর্তৃত্ব ও আচরন নিয়ে প্রশ্ন দেখা দেয়। এর ফলে শুরু হয় ধর্ম সংস্কার আন্দোলন। মানুষ পোপের ও ঈশ্বরের অখন্ড রাষ্ট্রতত্ত্বের নাগপাশ থেকে মুক্তি লাভ করতে শুরু করে। দেশে দেশে রাজাদের নেতৃত্বে জাতীয় রাষ্ট্র গড়ে উঠতে শুরু করলো। রাজারা ঈশ্বর ও পোপের নিয়ন্ত্রন থেকে মুক্তি লাভ করে আরোও শক্তিশালী হয়ে ওঠার চেষ্টা করতে লাগলেন। 

ক্রমে রাজার অসীম ঈশ্বর প্রদত্ত ক্ষমতা নিয়েও মানুষ প্রশ্ন তুলতে শুরু করলো। রাজ ক্ষমতাকে নিয়ন্ত্রন করার জন্য শুরু হয় পার্লামেন্টারি শাসন। ধীরে ধীরে রাজনৈতিক চিন্তা চেতনায় জন্ম নেয় গনতন্ত্র, প্রজাতন্ত্র, উদারনীতিবাদ প্রভৃতি মতাদর্শ। 

অন্যদিকে মানবতাবাদী দর্শন চর্চা থেকে মানুষ সিদ্ধান্তে পৌঁছায় ঈশ্বর নয়, মানুষই সর্বশ্রেষ্ঠ। নবজাগরন প্রসূত যুক্তিবাদ বা লজিকের দ্বারা মানুষ প্রকৃতির কার্য কারন সমন্ধ গুলিকে নতুন করে অনুসন্ধান করতে শুরু করে। এর ফলে ইওরোপে শুরু হয় বিজ্ঞান বিপ্লব। একের পর এক বৈজ্ঞানিক আবিষ্কার শুরু হয়ে যায়। 

বিজ্ঞান চর্চার ফলে এতদিনকার পুরানো ধর্মীয় ধ্যান ধারনাকে অস্বীকার করে মানুষ সিদ্ধান্তে উপনীত হয়, পৃথিবী চ্যাপ্টা নয়,গোলাকার। সূর্য নয়, পৃথিবীই সূর্যকে প্রদক্ষিণ করছে। আর পৃথিবী যেহুতু গোলাকার সেহুতু হারিয়ে যাওয়ার ভয় নেই। ঘুরতে ঘুরতে ঠিক আগের জায়গায় ফিরে আসা যাবে - এই যুক্তিবাদী চিন্তা ভাবনায় ভর করে ইওরোপের মানুষ দুঃসাহসিক ভৌগলিক অভিযানে বেরিয়ে পড়ে এবং এশিয়া, আফ্রিকা ও আমেরিকাতে একের পর এক নতুনদেশ আবিষ্কার করে সেখানে উপনিবেশবাদ স্থাপন করে। 

মোটকথা, পঞ্চদশ ও ষোড়শ শতকে নবজাগরনের ফলে মানুষ ঈশ্বর ভাবনার জায়গা থেকে সরে আসে। তার মধ্যে মুক্ত ও স্বাধীন চিন্তার বিকাশ ঘটে। এই মুক্ত চিন্তা  ও স্বাধীন দৃষ্টিভঙ্গিতে সে নতুন করে প্রকৃতি, জগৎ ও সমাজকে দেখতে আরম্ভ করলো। ঈশ্বরীয় কাল্পনিক জগৎ থেকে বেরিয়ে এসে মানুষ বাস্তবমুখী হয়। সে তার সমাজ ও রাষ্ট্রকে নতুন মানবিক দৃষ্টিভঙ্গিতে দেখতে শুরু করলো। এর ফলে জন্ম নিলো সামাজিক - উদারনীতিবাদ। মনে করা হলো এই সামাজিক উদারনীতিবাদের ফলেই সমাজে মানুষের প্রকৃত মুক্তি এবং কল্যান সাধন সম্ভব হবে। আগে মানুষ রাষ্ট্র ও সমাজকে একটি ঐশ্বরিক প্রতিষ্ঠান বলে মনে করতো। কিন্তু এখন তা না ভেবে সে রাষ্ট্র ও সমাজকে "মানবীয় প্রতিষ্ঠান" বলে দেখতে শুরু করলো। ক্রমে মানুষ রাষ্ট্রকেও ঈশ্বর ও ধর্মের নিয়ন্ত্রন থেকে মুক্ত করতে প্রয়াসী হলো। এর ফলে গড়ে উঠলো ধর্মনিরপেক্ষ রাষ্ট্র ব্যবস্থা। 

এই ধর্মনিরপেক্ষ রাষ্ট্র ব্যবস্থাকে পূর্ববর্তী ধর্মীয় রাষ্ট্র ব্যবস্থা থেকে অনেক বেশি যুগোপযুগী ও আধুনিক বলে মনে করা হলো। গনতান্ত্রিক, পার্লামেন্টারি বা প্রতিনিধিত্ব মূলক শাসনকে প্রাক্ আধুনিক যুগের শাসন গুলি থেকে অনেক বেশি উন্নত ও আধুনিক বলে মনে করা হলো। রেনেসাঁ যুগে মানুষ শিক্ষাকেও ধর্মের নিয়ন্ত্রন থেকে মুক্ত করে। এর ফলে ধর্মনিরপেক্ষ শিক্ষা ব্যবস্থার বুনিয়াদ গড়ে ওঠে। এই ধর্ম নিরপেক্ষ শিক্ষা ব্যবস্থাকে প্রাক্ আধুনিক যুগের ধর্মীয় শিক্ষা ব্যবস্থার চেয়ে অনেক বেশি উন্নত, আধুনিক ও যুগোপযুগী বলে মনে করা হয়।

রেনেসাঁ, মানবতাবাদের প্রভাবে মানুষ তার চিন্তা ভাবনাকে নতুন করে সাজাতে আরম্ভ করলো। তার মধ্যেকার লুকিয়ে থাকা অসীম শক্তি ও বুদ্ধিমত্তাকে সে খুঁজে পেতে শুরু করলো। এর ফলে মানুষ নিত্য নতুন আবিষ্কার করতে আরম্ভ করলো। তার সাহিত্য, দর্শন ও সাজ পোশাকে একটি বদল এলো। মানবতাবাদ মানুষের মর্যাদা প্রতিষ্ঠার কথা বলেছিলো। মানবতাবাদী দর্শনের আলোকে মানুষের অধিকার ও মর্যাদা প্রতিষ্ঠার জন্য ঊনবিংশ - বিংশ শতাব্দীতে শুরু হয় একের পর এক মানবতাবাদী আন্দোলন। নারী অধিকারের  আন্দোলন তারই একটি ছিলো। 

এইভাবে দেখা যায়, পঞ্চদশ ও ষোড়শ শতকে ইওরোপে রেনেসাঁ বা নবজাগরনের হাত ধরে ঊনবিংশ ও বিংশ শতাব্দীতে ইওরোপে এক নতুন উন্নত সভ্যতার জন্ম হয়। এই সভ্যতার মূল লক্ষ্য, উদ্দেশ্য ও বুনিয়াদ ছিলো মানব মুক্তি ও মানব কল্যান। বলা হয়, ঈশ্বর নয়, এই সভ্যতার মূল কেন্দ্রে বিরাজ করবে "মানুষ এবং মানবিকতা"।

গনতান্ত্রিক শাসন, ধর্মনিরপেক্ষ আদর্শ, শ্রমবিভাজন নীতি, ব্যবহারিক জীবনে বিভিন্ন বৈজ্ঞানিক আবিষ্কার ও তার প্রভাব, শিল্প বিপ্লব, পুঁজিবাদ, সমাজতন্ত্রবাদ, নারী অধিকার প্রতিষ্ঠা, ব্যক্তি স্বাধীনতা ও ব্যক্তি স্বাতন্ত্রবোধের বিকাশ, শিল্প, সাহিত্য, রূপচর্চা ও সাজ পোশাকের নতুন ধারা, উদারনীতিবাদ, উপনিবেশবাদ, নারী পুরুষের সমানাধিকার, ইত্যাদি এই সভ্যতার কয়েকটি উল্লেখযোগ্য বৈশিষ্ট্য বা স্ট্রাকচার ছিলো। এই ইওরোপীয় সভ্যতার বৈশিষ্ট্য গুলিকেই একত্রে বলা হয় "আধুনিকতা" এবং ঊনবিংশ ও বিংশ শতাব্দীতে এই সভ্যতার সময়কালকে বলা হয় "আধুনিক কাল"। মনে করা হয়, আধুনিক যুগের স্ট্রাকচার গুলি পরিপূর্ণ ভাবে মানুষের কল্যান সাধন করবে। 

(ঙ.) ইওরোপের বাইরে অবশিষ্ট বিশ্বে আধুনিকতাবাদের প্রসার ও সুফল  :- 

ঊনবিংশ ও বিংশ শতাব্দীতে উপনিবেশবাদ বা সাম্রাজ্যবাদের প্রসারের সূত্রে সারা বিশ্বে ইওরোপীয় সভ্যতা ও সংস্কৃতির প্রসার ঘটে। এই সূত্রে ইওরোপের বাইরের সমাজ ও রাষ্ট্র ব্যবস্থায় ইওরোপীয় সভ্যতার সুফল ও প্রবনতা গুলি প্রবেশ করে। 

(১.) এই সময় অতীতের রাজতন্ত্রিক ও স্বৈরাচারী শাসন ব্যবস্থার চাইতে পার্লামেন্টারি ধাঁচের গনতান্ত্রিক শাসন ব্যবস্থাকে মানুষের মানবীয় সত্ত্বা বিকাশের ও মানব কল্যানের সবচেয়ে উন্নত শাসন পদ্ধতি বলে মনে করা হয়। 

(২.) মানুষ ধর্মীয় রাষ্ট্রের বদলে ধর্মনিরপেক্ষ রাষ্ট্র ব্যবস্থা এবং ধর্মনিরপেক্ষ দর্শনকে মানবীয় সত্ত্বা বিকাশের সবচেয়ে উপযোগী মাধ্যম বলে গন্য করে। 

(৩.) ইওরোপের শিক্ষা, সাজ পোশাক সব কিছুকেই গ্রহন বা অনুকরন করে তাকে আধুনিক বলে এই সময় স্বীকার করে নেওয়া হয়। 

(৪.) মানবতাবাদী দর্শনের প্রভাবে মানুষের অধিকার প্রতিষ্ঠার জন্য শুরু হয় একের পর এক সামাজিক আন্দোলন। শুরু হয় নারীর অধিকার প্রতিষ্ঠার আন্দোলন। নারী শিক্ষা বিস্তারের আন্দোলন। শ্রমিক কল্যানের আন্দোলন। 

(৫.) মানুষের জীবন যাত্রার মানোন্নয়ন ও সুবিধা প্রদানের জন্য একের পর এক বৈজ্ঞানিক আবিষ্কার ও নানাবিধ কর্মসূচি গ্রহণ করা হতে থাকলো। 

(৬.) চিকিৎসা বিদ্যার অগ্রগতি ঘটতে থাকলো। সবই ঘটলো মানুষের জন্য।  - এইভাবে ঊনবিংশ ও বিংশ শতাব্দীর সভ্যতা পূর্ববর্তী ঈশ্বর কেন্দ্রীকতার জায়গা থেকে সরে এসে ধীরে ধীরে মানব কেন্দ্রীক হয়ে উঠলো। 
 
এই সব কারনে খুব স্বাভাবিক ভাবেই, পাশ্চাত্যের বুদ্ধিজীবীরা বাকি বিশ্ব ও সময়কালের তুলনায় ঊনবিংশ ও বিংশ শতাব্দীর পশ্চিমী সভ্যতা, সংস্কৃতি ও চিন্তাধারা কে সর্বশ্রেষ্ঠ বলে উল্লেখ করেন। তারা তাদের "বর্তমান" সময়কালকে অতীত যুগের তুলনায় শ্রেষ্ঠ ও উন্নত বলেও প্রচার করেন। তাদের মতে বর্তমান সময়কাল হলো মানব মুক্তির কাল। তাই বর্তমান সময়কালকে অর্থাৎ ঊনবিংশ ও বিংশ শতাব্দীর কালকে তারা "আধুনিক যুগ" বলে আখ্যায়িত করেন। 

তারা যুক্তি দেন, বিগত অতীতের কাল গুলিতে (প্রাচীন যুগ ও মধ্যযুগ) মানুষের মুক্তি, ও স্বাধীন বুদ্ধিবৃত্তির বিকাশ ঘটেনি। এটা একমাত্র ঘটেছিলো আধুনিক যুগে, ইওরোপীয় সভ্যতায়। এইজন্য যা কিছু অতীত তার থেকে নিজেদের সময়কালের ভিন্নতা বোঝানোর জন্য, পার্থক্য তুলে ধরার জন্য এবং বিগত অতীতকালের সঙ্গে নিজেদের সময়কালের একটি সীমারেখা টানার জন্য ইওরোপীয় বুদ্ধিজীবীরা ঊনবিংশ, বিংশ শতাব্দীর বর্তমান সময়কালকে "আধুনিক যুগ" বলে অভিহিত করেছিলেন।

(চ.) উত্তর আধুনিকতাবাদীদের প্রতিবাদ :- 

উত্তর আধুনিকতাবাদের প্রবক্তারা উপরে উল্লেখিত সকল "আধুনিক" চিন্তা ভাবনারই বিরোধিতা করেছেন। তারা বলেছেন - 

(১.) আধুনিকতা একটি বিভ্রান্তিমূলক শব্দ ও ধারনা। মনে রাখতে হবে, সব যুগের মানুষরাই তাদের যুগটিকে পূর্ববর্তী যুগ অপেক্ষা আধুনিক বা অগ্রগামী বলেই মনে করতেন। 

(২.) অনেক সময় ইওরোপের ধ্যান ধারনা গুলিকে অনুকরন, অনুসরন বা আত্মস্থ করে নিজেকে আধুনিক দেখানোর চেষ্টা করা হয়। যেমন ঊনবিংশ বিংশ শতাব্দীতে পাশ্চাত্য শিক্ষা ও সংস্কৃতিতে পরিপুষ্ট হয়ে একদল শিক্ষিত বাঙালি ধুতি পাঞ্জাবি বা তারা এলাকার জলবায়ুর উপযোগী পোশাক পরিত্যাগ করে কোর্ট প্যান্ট পরে নিজেদের আধুনিক বলে আখ্যায়িত করার চেষ্টা করেছিলেন। কিন্তু ইওরোপের কোর্ট প্যান্ট যে আধুনিক সেটি আমরা কোন কষ্ঠিপাথরে যাচাই করে বুঝবো? 

(৩.) উত্তর আধুনিকতাবাদের প্রবক্তারা তাই বলেছেন, আধুনিকতা কোন দর্শন নয়। স্থায়ী লক্ষনও নয়ইওরোপীয় সভ্যতার একটি রূপমাত্র। 

(৪.) এই সভ্যতা মানব মুক্তির কথা বলেছিলো। মানব কল্যানের কথা বলেছিলো। ঈশ্বরীয় নিয়ন্ত্রন ও ভীতির নাগপাশ থেকে মানুষকে মুক্ত ও স্বাধীন ভাবে বিকশিত হবার পথ দেখিয়েছিলো। 

(৫.) মানব মুক্তির জন্য এই আধুনিক যুগে নানা প্রগতিশীল চিন্তাধারা ও স্ট্রাকচারের উদ্ভব ঘটে। যেমন - গনতন্ত্র, শিল্পবিপ্লব, সমাজতন্ত্রবাদ, পুঁজিবাদ, উপনিবেশবাদ, উদারনীতিবাদ, নারীবাদ, ধর্মনিরপেক্ষতা, জাতীয়তাবাদ, ব্যক্তি স্বাধীনতা ইত্যাদি। 

(৬.) কিন্তু প্রথম ও দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর আধুনিক (ইওরোপীয়) সভ্যতা সম্পর্কে মানুষের মনে প্রশ্ন উঠতে শুরু করে। আধুনিক ইওরোপীয় সভ্যতার কদর্য রূপ ও অভ্যাস গুলি বিশ্বযুদ্ধে মানুষ পরিলক্ষিত করে। 

(৭.) দেখা গেলো মানব মুক্তির জন্য আধুনিক যুগে যে সব স্ট্রাকচার বা ফর্ম গুলো তৈরি করা হয়েছিলো, সেগুলো মানুষের কোন কল্যান সাধন করতে পারে নি। 

(৮.) অনুন্নত ও অসভ্য মানুষদের সভ্য করে তোলার উদ্দেশ্যে যে উপনিবেশবাদ নামক স্ট্রাকচার বা ফর্ম তৈরি করা হয়েছিলো। দেখা গেলো সেটা মানুষকে মুক্তির বদলে আরোও রুদ্ধ করে দিতে শুরু করেছিলো। 

(৯.) উপনিবেশ স্থাপন নিয়ে দলাদলি ও হিংসা যে ভয়ংকর প্রতিক্রিয়া সৃষ্টি করলো তা মানব মুক্তির বদলে, ধ্বংসের পথ প্রশস্ত করেছিলো। 

(১০.) একই ভাবে মানব কল্যানের জন্য "জাতীয়তাবাদ" নামে যে স্ট্রাকচার বা ফর্ম তৈরি করা হয়েছিলো, সেটাও দেখা গেলো মানুষকে পরিপূর্ণ ভাবে মুক্তি দিতে পারে নি। উগ্র জাতীয়তাবাদ, অতৃপ্ত জাতীয়তাবাদ যুদ্ধের বেশে এসে উল্টে মানুষেরই ক্ষতি করতে চেয়েছে

(১১.)  মানুষ তার বুদ্ধিবৃত্তির দ্বারা বিজ্ঞানের নিত্য নতুন আবিষ্কার করেছিলো। উন্নত যানবাহন, শিল্প, ও নির্মান দ্বারা সে মানব সভ্যতাকে চরম উৎকর্ষ ও সমৃদ্ধির জায়গায় পৌঁছে দিতে চেয়েছিলো। কিন্তু বিশ্বযুদ্ধে বিজ্ঞান ও প্রযুক্তির ভয়াবহ আত্মপ্রকাশ দেখে মানুষ আঁতকে উঠেছিলো। মানুষের মনে প্রশ্ন উঠতে আরম্ভ করেছিলো, বিজ্ঞান সাধনা মানুষের কল্যাণের জন্য না ধ্বংসের জন্য? 

(ছ.) উত্তর আধুনিকতাবাদী চিন্তা চেতনার আগমন, বৈশিষ্ট্য, লক্ষন ও উদাহরন:- 

বলা বাহুল্য, দুটি বিশ্বযুদ্ধে মানব সভ্যতা যে বিপর্যয়ের সম্মুখীন হয়, তা ইতিপূর্বে আর কখনোই দেখা যায় নি। আর এখান থেকেই আধুনিকতা, আধুনিক যুগ ও পাশ্চাত্যের সভ্যতা সম্পর্কে অনেকের মনে নানা প্রশ্ন ও সংশয় জাগতে শুরু করে। 

এর ফলে ইওরোপীয় সভ্যতার মোহ থেকে একের পর এক দেশগুলি বেরিয়ে আসতে শুরু করে। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর এশিয়া,আফ্রিকার প্রায় সব দেশ পাশ্চাত্যের অধীনতার নাগপাশ থেকে মুক্তি লাভ করতে শুরু করে। ইওরোপীয় চিন্তাভাবনার বিপরীতে তারা নতুন করে বিকল্প ভাবনা চিন্তা শুরু করে। এর ফলেই দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধোত্তর সোভিয়েত রাশিয়া ও আমেরিকার মধ্যে ঠান্ডা লড়াইয়ের বিপ্রতীপে শুরু হয়েছিলো বিকল্প চিন্তা ভাবনা এবং নির্জোট আন্দোলন। শুধু তাই নয়, ইওরোপীয় রাষ্ট্রসংঘের বিপ্রতীপে গড়ে ওঠ  থাকেএকের পর এক বিকল্প সংঘ বা রাষ্ট্রজোট। 

এককথায়, উত্তর আধুনিকতাবাদ তথাকথিত আধুনিকবাদের বিরুদ্ধে প্রতিক্রিয়া সৃষ্টি করে। এর মূল বক্তব্য হলো - 
(১.) চূড়ান্ত সত্য বলে কিছু হয় না। 
(২.) এটি প্রচলিত বা প্রথাগত ধারনা বা স্ট্রাকচারের বিপরীতে কাজ করার কথা বলে। 
(৩.) তথ্য প্রযুক্তির উন্নতি, বিশ্বায়ন, পাশ্চাত্য প্রাধান্যের বিরোধীতা, মহাকাশ ফেরিয়ান ইত্যাদি উত্তর আধুনিক যুগের প্রধান বৈশিষ্ট্য। 

(ক) তথ্য প্রযুক্তি ও বিশ্বায়ন জাতীয়তাবাদের মতোই আধুনিক যুগের অনেক ফর্ম বা স্ট্রাকচারকে ভেঙ্গে দিতে শুরু করছে। (খ) প্রচলিত স্ট্রাকচার ও উপাদানের বাইরে বেরিয়ে এসে বর্তমান কালে এমন নকশা ও উপাদান দিয়ে বাড়ি তৈরি হচ্ছে, যেটা মানুষ আগে কখনই কল্পনা করতেই পারে নি। এগুলি হলো উত্তর আধুনিকতার উদাহরন। 

(গ) উত্তর আধুনিকতা সাহিত্য রচনার ক্ষেত্রে প্রচলিত স্ট্রাকচারকে ভেঙে ফেলার কথা বলে। গল্প, কবিতা, উপন্যাস, নাটক এগুলো হলো সাহিত্যের এক একটি স্ট্রাকচার। উত্তর আধুনিকতাবাদ এইসব স্ট্রাকচারকে অস্বীকার করে অবিনির্মানের কথা বলে। সব ক্ষেত্রেই এটি দেখা যাচ্ছে। এমনকি সামাজিক সম্পর্কের ক্ষেত্রেও। 

(ঘ) ভারতীয় ঐতিহ্য ও সংস্কার অনুযায়ী জাতি কাঠামোর মধ্যেই বিবাহ কার্য সম্পন্ন হতো। বর্তমানে একজাতির মানুষ অন্য জাতির মানুষকে বিবাহ করে প্রচলিত স্ট্রাকচারকে ভেঙ্গে ফেলতে চাইছেন। এটিও উত্তর আধুনিকতার একটি উদাহরণ। আরোও একটি উদাহরণ দেওয়া যাক। 

(ঙ) ধরা যাক একটি শিশুর বর্ন পরিচয় ও হাতে খড়ি শুরু হয় "অ", "আ" "ই", "ঈ" ইত্যাদি স্বরবর্ন গুলি লেখা বা শেখার মধ্য দিয়ে। উত্তর আধুনিকতাবাদ বলে একটি শিশু সবথেকে ভালো ও দ্রুত শিখতে পারে যদি তাকে ব্যাঞ্জনবর্নের পাঠ প্রথম দেওয়া যায়। "ব" দিয়ে শুরু হবে তার হাতে খড়ি। একটি শিশু "ব" লিখতে পারলে অনায়াসে সে "ব" থেকে ধ, র, ক, ঝ, য, খ, থ, ঘ ইত্যাদি বর্নমালা গুলি সহজে আয়ত্তে করতে ও লিখতে পারবে। এইভাবে উত্তর আধুনিকতা প্রচলিত স্ট্রাকচার ভেঙ্গে ফেলে কোন রকম ছক ছাড়াই মানব বিকাশ ও মানব মুক্তির কথা বলে। 

শেষকথা :- 

উত্তর আধুনিকতাবাদ বলে আধুনিকতার বিভিন্ন স্ট্রাকচার গুলি মানুষকে পরিপূর্ণ মুক্তি দিতে অক্ষম হয়েছে। তাই কোন রকম স্ট্রাকচার ছাড়াই মানুষ নিজের ইচ্ছা মতো করে বাঁচবে, বিকশিত হবে এবং এগিয়ে যাবে। কোন রকম বন্ধন বা সংস্কারের বশবর্তী হবে না মানুষ। যেটা তার করতে মন যাবে সেটাই সে নিজের মতো করে করে যাবে, এটাই উত্তর আধুনিকতাবাদের মূল বক্তব্য। এককথায়, উত্তর আধুনিকতাবাদ আধুনিকতাবাদেরই একটি পাল্টা প্রতিক্রিয়া

Post a Comment (0)
Previous Post Next Post