নীল বিদ্রোহ

 ঔপনিবেশিক আমলে ভারতে সংঘঠিত কৃষক বিদ্রোহ গুলির মধ্যে একেবারে অন্য ধারার কৃষক বিদ্রোহ ছিলো নীল বিদ্রোহ।নীল বিদ্রোহ ছিলো এমন এক কৃষক বিদ্রোহ, যাকে জমিদার, ইংরেজি শিক্ষিত মধ্যবিত্ত শ্রেনী, ইংরেজ সরকার, খ্রিষ্টান মিশনারি, প্রায় সকলেই সমর্থন করেছিলেন।

 তবে নীল বিদ্রোহের মূল আলোচনায় প্রবেশের আগে নীলগাছের পরিচয়, গাছ থেকে নীল প্রস্তুতি, এবং বাংলাদেশে কিভাবে নীল চাষের সূচনা হয়েছিলো, সেই বিষয়ে আলোকপাত করা প্রয়োজন। 

নীল বিদ্রোহ
নীল বিদ্রোহ 

নীল গাছের পরিচয়

  1. নীলগাছ দেখতে অনেকটা পাট গাছের মতো। গাছটির দৈর্ঘ্য ছিলো ৪ থেকে ৬ ফুটের মতো। এই গাছের পাতা গুলি দেখতে অনেকটা সজনে গাছের পাতার মতো।
  2. প্রাচীনকাল থেকেই ভারতবর্ষে উৎকৃষ্ট মানের নীলের চাষ হতো এবং তা ইওরোপের দেশ গুলিতে রপ্তানি করা হতো। এইজন্য নীলকে গ্রীস বা রোমে "ইন্ডিগো" বলা হতো।
  3. নীল গাছ থেকে যেমন নীল রঙ পাওয়া যেতো, তেমনি নীলগাছের বীজ থেকে একধরনের তেলও তৈরি হতো, যা মানুষ ও পশুর নানা ধরনের চিকিৎসার কাজে ব্যবহার করা হতো। 
  4. নীল রঙ সাধারনত সাদা কাপড়ের উজ্জ্বলতা বৃদ্ধির জন্য ব্যবহার করা হতো। রাসায়নিক পদ্ধতিতে নীল আবিষ্কারের আগে এই রঙ একমাত্র নীল গাছ থেকেই পাওয়া যেতো। 

গাছ থেকে নীলের প্রস্তুতি

ফুল ফুটবার সময় নীলগাছ কেটে আনা হতো এবং তার ডগা সমেত পাতা গুলিকে একটি বড়ো গামলা বা পাত্রে কয়েক ঘন্টা ভিজিয়ে গাঁজানো হতো। গাঁজানো শেষে জলটা হলুদ বর্ন ধারন করলে ঐ জল আরেকটি পাত্রে ঢেলে সিদ্ধ করা হতো। কিছুক্ষণ পরে সিদ্ধ জল সবুজ রঙ ধারন করতো এবং তা টুকরো টুকরো করে দানা বাঁধতে আরম্ভ করতো। আরোও কিছুক্ষণ সিদ্ধ করবার পর নীল প্রস্তুত হতো। 

বাংলায় নীল চাষের সূচনা

প্রাচীন ও মধ্য যুগে ভারতের আগ্রা, গুজরাট প্রভৃতি অঞ্চলে উৎকৃষ্ট মানের নীল চাষের প্রমান পাওয়া গেলেও, এই সময়ে বাংলায় নীল চাষের কোন প্রমান পাওয়া যায় নি।

বাংলায় অষ্টাদশ শতাব্দীর শেষের দিকে বিভিন্ন ইওরোপীয় বনিকদের আগমনের ঘটে। মূলত তাদের হাত ধরেই বাংলায় নীল চাষের সূত্রপাত ঘটে। এই সময়কালের ঐতিহাসিক তথ্য প্রমান গুলি থেকে জানা যায় -
  1. বাংলায় প্রথম ফরাসি বনিক লুই বন্নো চন্দননগরের কাছে তালডাঙ্গা ও গোন্দলপাড়ায় নীল কুঠি স্থাপন করেন এবং নীল চাষের সূত্রপাত করেন।
  2. লুই বন্নোর পরে ক্যারেল ব্লুম নামে এক ইংরেজ বাংলায় নীলচাষ করে প্রচুর মুনাফা অর্জন করেন।
  3. ব্লুম ১৭৭৮ খ্রিঃ কোম্পানি সরকারের কাছে একটি মেমোরেন্ডাম দাখিল করে ভারতে ব্যাপক ভাবে নীল চাষ করতে অনুরোধ করেন।

আর্ন্তজাতিক বাজারে নীলের চাহিদা বৃদ্ধি

ঘটনাসূত্রে ঠিক এই সময়েই আর্ন্তজাতিক ক্ষেত্রে এমন কিছু ঘটনা ঘটে, যার ফলে ইওরোপের বাজারে নীলের চাহিদা বিপুল পরিমাণে বৃদ্ধি পায়।
  • এখানে মাথায় রাখতে হবে, বাংলায় ব্যাপক ভাবে নীল চাষ শুরু করবার আগে ইওরোপের বাজারে নীলের যোগান দিতো দুটো দেশ - আমেরিকা ও ফ্রান্স
  • কিন্তু ১৭৭৬ খ্রিঃ আমেরিকার স্বাধীনতা লাভ এবং ১৭৮৯ খ্রিঃ ফ্রান্সে বিপ্লব (ফরাসি বিপ্লব) হওয়ার পর সেখানকার স্থানীয় প্রশাসন নীলচাষ বন্ধ করে দেয়। এর ফলে ইওরোপের বাজারে নীলের ঘাটতি দেখা গেলো।
  • এদিকে ১৭৬০ খ্রিঃ পর থেকে ধীরে ধীরে ইংল্যান্ডে শিল্প বিপ্লব ঘটলে নীলের চাহিদা বিপুল ভাবে বৃদ্ধি পেতে শুরু করেছিলো। কারন ইংল্যান্ডের কাপড়ের কলগুলোতে সাদা কাপড়ের উজ্জ্বলতা বাড়ানোর জন্য নীলের দরকার পড়ে।

বাংলায় নীলচাষে কোম্পানির পৃষ্ঠপোষকতা

খুব স্বাভাবিক ভাবেই, আর্ন্তজাতিক ক্ষেত্রে নীলের লাভজনক চাহিদার বিষয়টিকে লক্ষ্য করে ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি ১৭৭৭ থেকে ১৮০৩ খ্রিঃ মধ্যে বাংলা ও বিহারে নীলচাষ করতে সাহায্য করে। কোম্পানির অনেক কর্মচারী এই সময় কোম্পানির চাকরি ছেড়ে দিয়ে নীলকুঠী খুলে বসে। তাদের পুঁজি ও অন্যান্য সাহায্য দিয়ে কোম্পানি পৃষ্ঠপোষকতা করে।

এইভাবেই বাংলায় ধীরে ধীরে নীল চাষের সূত্রপাত ঘটে। পরবর্তীকালে বাংলায় নীলচাষের আরোও প্রসারের জন্য, এবং কোম্পানির কর্মচারীদের নীলচাষে একচেটিয়া প্রভাব খর্ব করবার জন্য ব্রিটিশ সরকার নীলকরদের সহায়ক বেশ কিছু আইন প্রণয়ন করে এবং অন্যান্য ইওরোপীয় পুঁজিপতিদের বাংলায় নীলচাষ করতে আহ্বান জানায়।

 কোম্পানির কর্মচারীদের ব্যক্তিগত দরাদরি ও প্রভাব খর্ব করবার জন্যই ব্রিটিশ সরকার একাধিক আইন প্রণয়ন করে ইওরোপীয় নেটিভদের জন্য ভারতের দরজা উন্মুক্ত করে দেয় এবং নীল চাষে উৎসাহিত করে ।

 এইভাবে দেখা যায়, ব্রিটিশ সরকার প্রত্যক্ষ সহযোগীতা ও লালন পালনের মধ্য দিয়ে বাংলায় "নীলকর" নামক একদল দৈত্যদানবের জন্ম দেয়, যারা আপাত সহজ সরল শান্ত গ্রামসমাজে এক ভয়ঙ্কর ত্রাসের সঞ্চার করে। 

ভারতে নীলচাষের পদ্ধতি ও নিয়ম 

ভারতে ইংরেজরা কি পদ্ধতি ও নিয়মে নীলচাষ করতো তার সংক্ষিপ্ত পরিচয় নীচে তুলে ধরা হলো। 

নীল বিদ্রোহ
নীল চাষের পদ্ধতি 


(১.) কনসার্ন সিস্টেম :-

  1. ভারতে নীলচাষের জন্য ইংরেজরা অনেক যৌথ কোম্পানি তৈরি করেছিলো। একে বলা হতো "কনসার্ন"।
  2. এক একটি কনসার্নের মধ্যে অনেক গুলি নীল কুঠি থাকতো। 
  3. এর মধ্যে একটি প্রধান কুঠি থাকতো। একে বলা হতো "সদরকুঠি"। অর্থাৎ অন্যান্য নীলকুঠি গুলো সদর কুঠিরই শাখা কুঠি ছিলো।

(২.) নীলকুঠির কর্মচারী :- 

প্রত্যেক নীলকুঠিতে একজন ম্যানেজারের অধীনে কয়েকজন দেশীয় কর্মচারী থাকতেন। এর মধ্যে অন্যতম ছিলেন - 
  1. দেওয়ান বা নায়েব। 
  2. দেওয়ানের অধীনে থাকতেন, গোমস্তা। এর কাজ ছিলো কৃষকদের পাওনাগন্ডার হিসাব রাখা। এছাড়াও
  3. কৃষকদের নীলচাষের বরাদ্দ জমি মাপজোকের জন্য ছিলেন আমীন। 
  4. নীল মাপা বা ওজনের জন্য ছিলেন ওজনদার কর্মচারী।
  5. কুলি খাটাবার জন্য থাকতো জমাদার বা সর্দার। 
  6. এছাড়াও নীলকুঠির নিরাপত্তার জন্য থাকতেন বেশ কিছু লাঠিয়াল। 

(৩.) নিজ আবাদি বা এলাকা চাষ :- 

নীলকর সাহেবরা যখন নিজের জমিদারিতে  বা জমিতে কৃষকদের মজুরি দিয়ে নীলচাষ করাতো, তাকে বলা হতো নিজ আবাদি বা এলাকা চাষ। এক্ষেত্রে চাষের সব খরচ নীলকরকেই বহন করতে হতো। 

বাংলায় প্রথম দিকে নিজ আবাদির মাধ্যমে নীলচাষের সূত্রপাত ঘটলেও, পরে নীলকররা এই পদ্ধতি বর্জন করেছিলো এবং বে এলাকা চাষের দিকে ঝুঁকে পড়েছিলো। 

কেননা নিজ আবাদিতে জমিকেনা বা ভাড়া নেওয়া, চাষের সরঞ্জাম জোগাড় করা, কৃষকদের ডেকে এনে মজুরি দিয়ে কাজে লাগানো ইত্যাদিতে প্রচুর ইনভেস্ট করতে হতো। তাছাড়া এতে ঝামেলাও ছিলো অনেক। ফলে লাভ তুলনামূলক ভাবে কম হতো। 

(৪.) রায়তি বা বে এলাকা চাষ :-

চাষিকে দাদন বা আগাম কিছু টাকা দিয়ে চাষির জমিতে নীলচাষ করাবার জন্য নীলকররা যখন চুক্তি করতো, তখন তাকে বলা হতো রায়তি আবাদি/ দাদনি আবাদি বা বে এলাকা চাষ। এই পদ্ধতিতে চাষী তার নিজস্ব কৃষিজ উপকরনের সাহায্যে নিজের জমিতে নীলচাষ করে সেই নীল নীলকুঠিতে পৌঁছে দিতো। 

(৫.) তিনকাঠিয়া প্রথা :- 

বে এলাকা নীল চাষের একটি নিয়ম ছিলো তিনকাঠিয়া প্রথা। বাংলা ও বিহারে কৃষকদের বিঘা প্রতি তিন কাঠায় বাধ্যতামূলক ভাবে নীলচাষ করতে হতো। একেই "তিনকাঠিয়া প্রথা" বলা হতো।

(৬.) দাদন :- 

বে এলাকা বা রায়তি আবাদের ক্ষেত্রে চাষীকে দাদন দেওয়া হতো। দাদন কথার অর্থ হলো অগ্রিম অর্থ প্রদান বা বায়না। বাংলায় কৃষকদের নিজের জমিতে নীলচাষ করানোর সময় নীলকররা কৃষকদের যে অগ্রিম অর্থ প্রদান করতেন, তাই "দাদন" নামে পরিচিত ছিলো। 

নীলচাষে বিভিন্ন আইন 


বাংলায় নীলচাষে সাহায্য করেছিলো ব্রিটিশ সরকারের প্রবর্তিত বেশ কিছু আইন। সংক্ষেপে এই আইন গুলির পরিচয় নীচে দেওয়া হলো - 

(১.) ১৮১৯ খ্রিঃ অষ্টম আইন :- 

এই আইনে দেশীয় জমিদারদের জমি পত্তনি বা লিজ দেওয়ার অধিকার দেওয়া হয়।

 ইওরোপীয়রা বা কোম্পানির কর্মচারীরা খুব সহজেই যাতে দেশীয় জমিদারদের কাছে জমি ভাড়া নিয়ে নীলচাষ করতে পারেন, সেই জন্যই এই আইনটি প্রনয়ন করা হয়। এই আইনটি বাংলায় নীল চাষের প্রসারে অনেকখানি সাহায্য করেছিলো।

(২.) ১৮৩০ খ্রিঃ পঞ্চম আইন :- 

এই আইনে বলা হয়েছিলো, দাদন নিয়ে কোন কৃষক নীলচাষ না করলে অর্থাৎ চুক্তি ভঙ্গ করলে, সেই কৃষককে ফৌজদারি অপরাধে অভিযুক্ত করা হবে।

বাংলায় দাদনি আবাদের প্রসারে এবং কৃষকদের ওপর নীলকরদের নিয়ন্ত্রন বৃদ্ধিতে এই আইনটি নানাভাবে সাহায্য করেছিলো। 

(৩.) ১৮৩৩ খ্রিঃ চার্টার আইন :-

১৮৩৩ খ্রিঃ সনদ আইনে ইওরোপীয়দের ভারতে জমি কেনার অনুমতি দেওয়া হয়। এর ফলে ইওরোপের বহু পুঁজিপতি বাংলায় নীলচাষ করতে এগিয়ে আসেন। 

ফলে ১৮৩০ দশকের পর থেকে বাংলায় দ্রুত নীলচাষের প্রসার ঘটতে থাকে।

(৪.) ১৮৫৬ খ্রিঃ আইন :-

মহাবিদ্রোহের আগে ১৮৫৬ খ্রিঃ একটি আইন পাশ করে নীলকরদের অবৈতনিক ম্যাজিস্ট্রেটের অধিকার দেওয়া হয়। 
এই আইনের ফলে কোন কৃষক যখন নীলকরদের বিরুদ্ধে আদালতে মামলা করতো, তখন অবৈতনিক ম্যাজিস্ট্রেটের পদাধিকার বলে নীলকর বিচারকের পাশের আসনে বসে মামলা নিজের স্বপক্ষে নিয়ন্ত্রন করতেন। ফলে নীলচাষী আদালতে কোন সুবিচার পেতো না।

(৫.) একাদশ আইন :-

এই আইনে বলা হয়েছিলো, দাদন নিয়ে কোন কৃষক নীলচাষ না করলে বিঘা প্রতি তাকে ১০ টাকা ক্ষতিপূরণ দিতে হবে এবং তিন মাস কারাদন্ড ভোগ করতে হবে।

নীলকররা অবাধ্য চাষীদের শায়েস্তা করবার জন্য প্রায়ই এই আইনের অপব্যবহার করতেন।

(৬.) ১৮৬৮ খ্রিঃ অষ্টম আইন :-

নীল বিদ্রোহের পর ব্রিটিশ সরকার এই আইন প্রণয়ন করে। এতে নীলকরদের নীলচুক্তি আইন রদ করে বলা হয়, নীলচাষ সম্পূর্ণ চাষীর স্বেচ্ছাধীন বিষয়। জোর করে কোন কৃষককে দিয়ে নীলচাষ করানো যাবে না। 

নীল বিদ্রোহের কয়েকটি উল্লেখযোগ্য দিক


(১.) সময়কাল :- নীল বিদ্রোহ শুরু হয় - ১৮৫৯ - ৬০ খ্রিঃ

(২.) সূচনা ও বিস্তার :- নদীয়া জেলায় প্রথম নীল বিদ্রোহ শুরু হয়। পরে রাজশাহী, খুলনা, পাবনা যশোহর অর্থাৎ বাংলাদেশের বিস্তীর্ণ অঞ্চলে এই বিদ্রোহ ছড়িয়ে পড়ে। 

(৩.) নেতৃত্ব :- নীলবিদ্রোহে নেতৃত্ব দেন নদীয়ার চৌগাছা গ্রামের বিষ্ণুচরন বিশ্বাস ও দিগম্বর বিশ্বাস। এদেরকে বাংলার "ওয়াট টাইটেলার" বলে অভিহিত করা হয়। ( ওয়াট টাইটেলার ছিলেন ইংল্যান্ডের কৃষক বিদ্রোহের নেতা)। 

এছাড়াও এতে নেতৃত্ব দেন - 
  • নড়াইলের জমিদার রামরতন মল্লিক, যাকে "বাংলার নানাসাহেব" বলা হতো। 
  • মালদহের রফিক মন্ডল, 
  • বিশ্বনাথ সর্দার, 
  • বৈদ্যনাথ। 
(৪.) নীল বিদ্রোহ সমর্থনকারী জমিদার :- নীল বিদ্রোহ একমাত্র ব্যতিক্রমী কৃষক বিদ্রোহ ছিলো, যাকে বাংলার অনেক জমিদার সমর্থন করেছিলেন। এদের মধ্যে অন্যতম ছিলো - 
  • নড়াইলের জমিদার রামরতন মল্লিক, 
  • সাধুহাটির জমিদার মথুরানাথ আচার্য, 
  • রানাঘাটের জমিদার শ্রীগোপাল চৌধুরী, 
  • চন্ডীপুরের জমিদার শ্রীহরি রায়।
(৫.) নীল বিদ্রোহ সমর্থনকারী মধ্যবিত্ত বাঙালি :- নীল বিদ্রোহকে অনেক শিক্ষিত মধ্যবিত্ত বাঙালি সমর্থন করেছিলেন। এদের মধ্যে অন্যতম ছিলেন - 
  • হরিশচন্দ্র মুখোপাধ্যায়, 
  • শিশির কুমার ঘোষ, 
  • মনমোহন ঘোষ, 
  • কিশোরীচাঁদ মিত্র, 
  • দীনবন্ধু মিত্র। 
(৬.) নীল বিদ্রোহ সমর্থনকারী পত্রিকা :- নীল বিদ্রোহ সমর্থনকারী সংবাদপত্র গুলির মধ্যে অন্যতম ছিলো - 
  • হিন্দু প্যাট্রিয়ট, 
  • সমাচার চন্দ্রিকা, 
  • সমাচার দর্পন, 
  • তত্ত্ববোধিনী পত্রিকা।
(৭.) নীল বিদ্রোহের সমর্থনে লেখা নাটক :- দীনবন্ধু মিত্রের লেখা "নীলদর্পন"।

নীল বিদ্রোহের কারন 


১৮৫৯ - ৬০ খ্রিঃ "দাদনি আবাদ" সংক্রান্ত একাধিক ক্ষোভের কারনে বাংলার নীল কৃষকরা বিদ্রোহী হয়ে উঠতে বাধ্য হয়েছিলো। মূল কারন গুলিকে আমরা নিন্মলিখিত ভাবে তুলে ধরতে পারি - 

(১.) বলপূর্বক দাদন দেওয়া :-

প্রথম দিকে দাদন গ্রহন কৃষকের স্বেচ্ছাধীন বিষয় হলেও, পরে কৃষকদের জোর করে ধরে এনে দাদন দেওয়া হতো এবং নীল চাষে বাধ্য করা হতো। ফলে দাদন গ্রহনের বিষয়টি নিয়ে কৃষকদের মধ্যে ক্ষোভের সঞ্চার হয়। 


(২.) দাদনের টাকা পরিশোধ না হওয়া :- 

একবার দাদন নিলে সেই টাকা আর কিছুতেই পরিশোধ হতো না। এর ফলে পরের বছর দ্বিগুন জমিতে এবং তার পরের বছর গুলিতে কৃষককে তার সম্পূর্ন জমিতে নীলচাষ করতে হতে। ফলে নীলচাষের কবলে পড়ে চিরাচরিত ধান ও অন্যান্য ফসলের চাষ থেকে কৃষক বঞ্চিত হতো এবং তাকে প্রায় অর্ধাহারে কাটাতে হতো। 

(৩.) জমির মাপে জোর জুলুম :- 

নীলকুঠির আমিনরা ভালো উর্বর জমিতে দাগ দিতো। এক্ষেত্রে চাষীর কোন মতামতকেই তারা গুরুত্ব দিতো না। প্রথমে দেড় বিঘা জমিতে নীলচাষ করার কথা বলা হলেও, পরে তা ছয় বিঘায় দাড়াতো। 

(৪.) জমির মাপে কারচুপি :- 

নীলকররা জমির মাপেও কারচুপি করতো। বাংলায় একবিঘা জমির মাপ ছিলো ১৪০০০ বর্গফুট। কিন্তু নীলকররা এই মাপ মানতো না। তাদের মাপ ছিলো ২১,৫১১ বর্গফুট। ফলে নীল বুনতে গিয়ে চাষীকে অনেকখানি অর্থনৈতিক ক্ষতির সম্মুখীন হতে হতো। 

(৫.) চাষীর অতিরিক্ত খরচ :- 

চুক্তিবদ্ধ কৃষককে নিজের খরচে নীলগাছ কেটে তা গাড়ি করে নীলকুঠিতে পৌঁছে দিতে হতো। এজন্য কৃষকের অতিরিক্ত খরচ হতো। অথচ চুক্তি পত্রে নীল পৌঁছে দেওয়ার কোন কথা লেখা থাকতো না। নীলকররা নীল বহনের জন্য কৃষককে কোন অর্থ প্রদান করতো না।

(৬.) ওজনে কারচুপি :- 

নীলকুঠিতে ওজনদার কর্মচারী নীল ওজনের সময় নানা কারচুপি করতেন। তাদের এই কারচুপির ফলে কৃষকের দাদনের টাকা কোনদিনই আর শোধ হতো না। 

(৭.) নীলের অপরিবর্তিত দাম :- 

কৃষিজ পন্যের দাম ও অন্যান্য জিনিস পত্রের দাম সময়ের সাথে ক্রমাগত বাড়লেও, নীলের দাম প্রায় অপরিবর্তিত থাকতো চাষীর কাছে। প্রথমবার দাদন দেওয়ার পর নীলকররা আর কিছুতেই নীলের দাম বাড়াতেন না। এর ফলে নীল চাষের খরচা মূল্যবৃদ্ধির সাথে সাথে বাড়তেই থাকে এবং নীল চাষ করতে গিয়ে চাষী সর্বস্বান্ত হয়ে যেতে থাকে। 

(৮.) দমনমূলক আইন :- 

নানা দমনমূলক সরকারি আইন নীলকর সাহেবদের কাছে কৃষকদের ক্রীতদাসে পরিনত করে তুলেছিলো।
  • ১৮৩০ খ্রিঃ পঞ্চম আইনে বলা হয়েছিলো, ননীলচুক্তি ভঙ্গ করলে কৃষককে ফৌজদারি অপরাধে অভিযুক্ত করা হবে। 
  • ১৮৫৬ খ্রিঃ আইনে নীলকররা অবৈতনিক ম্যাজিস্ট্রেটের অধিকার পায়। ফলে আদালত কক্ষে পদাধিকার বলে অভিযুক্ত নীলকররা বিচারকের আসনে বসে ন্যায়বিচারকে প্রভাবিত করতেন। 
  • একাদশ আইনে বলা হয়, কোন কৃষক নীলচাষ না করলে বিঘা প্রতি ১০ টাকা ক্ষতিপূরণ দিতে বাধ্য থাকবে এবং চাষীর তিনমাস কারাদন্ড হবে। 
এই সমস্ত আইন গুলির অপব্যবহার করে নীলকররা নীলচাষের অবাধ্য কৃষকদের ওপর তাদের অত্যাচার তীব্র থেকে তীব্রতর করে তুলেছিল। 

(৯.) কৃষকের ওপর অত্যাচার :- 

নীলচাষে অসম্মত কৃষকদের বলপূর্বক নীলকুঠিতে ধরে এনে নীলকররা অমানুষিক অত্যাচার চালাতো। চামড়ার চাবুক "শ্যামচাঁদ" এবং চামড়া মোড়া লাঠি "রামকান্ত" দিয়ে তাদের প্রহার করা হতো। এমনকি কৃষকের ওপর চাপ সৃষ্টি করার জন্য তার স্ত্রী পুত্রদের নীলকুঠিতে ধরে এনেও অত্যাচার করা হতো। 

(১০.) সুবিচার না পাওয়া :- 

নীলকরদের এত অত্যাচার সত্ত্বেও, কৃষকরা নীলকরদের অন্যায় অত্যাচারের বিরুদ্ধে পুলিশ, প্রশাসন বা আদালতে কোন সুবিচার পেতো না। সবাই এক্ষেত্রে নীলকর সাহেবদের পক্ষেই পক্ষপাতিত্ব করতো। 

খুব স্বাভাবিক ভাবেই ন্যায়বিচার ও প্রতিকারের সব পথ বন্ধ হয়ে গেলে কৃষকদের বিদ্রোহী হয়ে ওঠা ছাড়া বিকল্প কোন পথ খোলা ছিলো না। 

মূল্যায়ন 

মাথায় রাখতে হবে, নীলচাষে নিজ আবাদির প্রতি কিন্তু চাষীর কোন ক্ষোভ ছিলো না। তাদের যাবতীয় ক্ষোভ ও অসন্তোষ ছিলো দাদনি আবাদকে ঘিরে। 

অতিরিক্ত লাভের আশায় বাংলায় দাদনি আবাদের ব্যাপক প্রসার ঘটে এবং এই দাদনি আবাদ কৃষকের সমস্ত স্বাধীনতা হরন করে তাদের মধ্যযুগের ভূমিদাসদের মতোই ক্রীতদাসে পরিনত করে তোলে। 

কৃষকদের ক্রীতদাসে পর্যবসিত করার ক্ষেত্রে ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি বা ব্রিটিশ সরকারের ভূমিকার দিকটিকেও কোনভাবে উপেক্ষা করা যায় না। নীলকরদের স্বার্থে তারা একাধিক দমন মূলক আইন তৈরি করে দিয়েছিলো। ঐ সমস্ত আইনের অপব্যবহার করে নীলকররা বাংলার কৃষকদের জীবনকে এতটাই দুর্বিষহ করে তুলেছিলো যে বেঁচে থাকবার জন্য কৃষকদের বিদ্রোহ করা ছাড়া আর কোন বিকল্প রাস্তা খোলা ছিলো না। 

তাই মনে রাখতে হবে, দাদনি আবাদ জনিত একাধিক ক্ষোভ বিক্ষোভ নীল বিদ্রোহের মূল কারন হলেও এই বিদ্রোহের পশ্চাতে মৌলিক কারন ছিলো ৩ টি। যথা - 
  1. বাংলায় দাদনি আবাদ নির্ভর নীলচাষ,
  2. দাদনি আবাদের কবলে পড়ে কৃষকদের স্বাধীনতা হরন এবং বাধ্যতামূলক ভাবে নীলচাষ করে সর্বস্বান্ত হয়ে পড়া, এবং
  3. দাদনি আবাদে নীলকরদের জন্য সাহায্যকারী কোম্পানির একাধিক আইন প্রণয়ন এবং তার অপপ্রয়োগ। 

নীল বিদ্রোহের সূচনা


নীল আন্দোলনের ৩ টি স্তর ছিলো - (১.)  আবেদন নিবেদন, (২.) ধর্মঘট এবং (৩.) সশস্ত্র প্রতিরোধ।

আবেদন নিবেদন

 প্রথম স্তরে বিদ্রোহী নীল চাষীরা দলবদ্ধ ভাবে পুলিশ, ম্যাজিস্ট্রেট ও ছোটলাটের কাছে নীলকরদের অত্যাচারের প্রতিকারের দাবি জানিয়ে দরখাস্ত পাঠাতে থাকে। এই পর্যায়ে কৃষকরা স্বতঃস্ফূর্ত ভাবে সংঘবদ্ধ ও সংগঠিত হতে থাকে। এই সময় গন দরখাস্তের আন্দোলন গ্রামে গ্রামে ছড়িয়ে পড়তে থাকে। 

নীল ধর্মঘট ও বয়কট

কিন্তু আবেদন নিবেদনে কোন ফল না হলে আন্দোলন তার দ্বিতীয় পর্যায়ে প্রবেশ করে। দ্বিতীয় পর্যায় ছিলো ধর্মঘটের স্তর বা নীলচাষে অসম্মতির স্তর। এই সময় চাষীরা সম্মিলিত ভাবে সিদ্ধান্ত নেয়, নীলকররা যতই অত্যাচার করুক, তারা কিছুতেই নীল বুনবে না। 

প্রকৃতপক্ষে "বয়কট" কর্মসূচির মধ্য দিয়েই নীল বিদ্রোহ ব্যাপক আকার ধারন করে। এই পর্বের শুরুতেই কৃষকরা সমবেতভাবে নীলচাষ না করার সিদ্ধান্ত নেয় এবং নীলকর সাহেব ও নীলকুঠির কর্মচারীদের প্রতি সামাজিক বয়কটের ডাক দেয়। 

সশস্ত্র প্রতিরোধ ও অভ্যুত্থান 

নীলচাষের বিরুদ্ধে কৃষকদের অনমনীয় মনোভাবে ক্রুদ্ধ নীলকররা শেষপর্যন্ত বলপূর্বক ভাবে নীলচাষ করাতে উদ্যোগী হয়। এই সময় কৃষকদের ওপর চাপ সৃষ্টির জন্য নীলকররা মামলা দায়ের করতে থাকে। 

এমনকি অবাধ্য চাষীদের গ্রেফতার, বন্দী, মারধর এবং কয়েদ করা হতে থাকে। অসহায় কৃষকদের ওপর নীলকরদের নির্যাতন ভয়ঙ্কর আকার ধারন করলে, নীল আন্দোলন তার তৃতীয় তথা শেষ পর্বে প্রবেশ করে। সশস্ত্র অভ্যুত্থান ছিলো এই পর্বের মূল বৈশিষ্ট্য। 

বিদ্রোহীদের সংগঠন ও কৌশল 

নীল বিদ্রোহে প্রত্যেক গ্রামেই কৃষকরা পৃথক পৃথক ভাবে প্রতিরোধ গড়ে তুলেছিলো। প্রায় প্রত্যেক গ্রামের সীমান্তে একজন ঢাকি থাকতো। নীলকরদের লোকেরা গ্রামে ঢোকার আগেই তারা ঢাক বাজিয়ে সতর্ক করে দিতো। সঙ্গে সঙ্গে হাজার হাজার কৃষক লাঠি, তির ও বল্লম নিয়ে দৌড়ে এসে প্রতিরোধ গড়ে তুলতো। 

১৮৬০ খ্রিঃ মাসিক "ইন্ডিয়ান ফিল্ড" পত্রিকায় নদীয়া জেলার কৃষ্ণনগরের একজন জনৈক জার্মান পাদ্রির বিবরন থেকে এই বিদ্রোহের সংগঠন ও তার কৌশল সম্পর্কে জানতে পারা যায়। 

এই বিবরন অনুযায়ী, আক্রমন ও প্রতিরোধ গড়ে তোলার জন্য কৃষকরা নিজেদের মধ্যে বিভিন্ন কোম্পানি বা বাহিনী গঠন করে। যেমন তীরন্দাজ বাহিনী, ইটওয়ালাদের দল, কাঁচা বেলওয়ালাদের দল, থালাওয়ালাদের দল, বল্লমধারীদের দল, লাঠিয়াল বাহিনী ইত্যাদি। নীলকরদের লোকজন এলে বিভিন্ন দিক থেকে তারা আক্রমণ চালিয়ে প্রতিরোধ গড়ে তুলতো। 

বিদ্রোহের নেতৃত্ব

নীল বিদ্রোহে কৃষকদের সংগঠিত করতে ও নেতৃত্ব দিতে এগিয়ে এসেছিলো বেশ কয়েকজন ব্যক্তি। এদের মধ্যে ছিলেন নদীয়া জেলার কৃষ্ণনগরের চৌগাছা গ্রামের বিষ্ণুচরন বিশ্বাস ও দিগম্বর বিশ্বাস। এছাড়াও ছিলেন ঝিনাইদহের মহেশ চট্টোপাধ্যায়, বৈদ্যনাথ ও বিশ্বনাথ, যিনি বিশে ডাকাত নামে পরিচিত ছিলেন। 

এখানে বলা প্রয়োজন, বিষ্ণুচরন বিশ্বাস, দিগম্বর বিশ্বাস ও মহেশ চট্টোপাধ্যায়, এরা সকলেই একসময় নীলকুঠির দেওয়ান ছিলেন। নীলকুঠিতে প্রচন্ড অপমান, অবিচার আর অত্যাচারের শিকার হয়ে তারা বিদ্রোহী হয়ে ওঠেন এবং নেতৃত্ব দিতে এগিয়ে আসেন। 

বহু জমিদারও এই বিদ্রোহে নেতৃত্ব দিয়েছিলেন। এদের মধ্যে অন্যতম ছিলেন - 
  1. নড়াইলের জমিদার রামরতন মল্লিক, 
  2. সাধুহাটির জমিদার মথুরানাথ আচার্য, 
  3. রানাঘাটের জমিদার শ্রীগোপাল চৌধুরী, 
  4. চন্ডীপুরের জমিদার শ্রীহরি রায়।

নীলবিদ্রোহের বিস্তার ও বিদ্রোহের রূপ 

চৌগাছা গ্রামের বিদ্রোহ

নীল বিদ্রোহের প্রথম শক্তিশালী প্রতিরোধ গড়ে ওঠে নদীয়া জেলার চৌগাছা গ্রামে। এখানে নেতৃত্ব দেন বিষ্ণুচরন বিশ্বাস ও দিগম্বর বিশ্বাস। বিষ্ণুচরন একজন ছোট জোতদার ছিলেন, অন্যদিকে দিগম্বর একজন ছোট মহাজন ছিলেন। তারা দুজনেই বিভিন্ন সময়ে নানা নীল কুঠিতে দেওয়ানের কাজ করেছিলেন। কিন্তু আত্মসম্মান বজায় রেখে কোথাও বেশিদিন কাজ করতে পারেন নি। নীলকুঠিতে তারাও নানা বঞ্চনা ও অত্যাচারের শিকার হয়েছিলেন। 

শেষপর্যন্ত, বিবেকের ডাকে সাড়া দিয়ে তারা কৃষকদের পাশে এসে দাঁড়ান এবং প্রতিরোধের মাধ্যমে বিদ্রোহ ঘোষনা কেই শ্রেয় বলে মনে করেন। 

১৮৫৯ খ্রিঃ চৌগাছা এবং তার পাশের গ্রামটি বিদ্রোহ ঘোষনা করে। এমতাবস্থায়, নীলকররা ১০০০ লাঠিয়াল নিয়ে গ্রাম দুটি ধ্বংস করার জন্য উদ্যোত হয় এবং সারা গ্রামে আগুন লাগিয়ে দেয়। বহু কৃষককে গ্রেপ্তার করা হয় এবং তাদের নামে চুক্তি ভঙ্গের মামলা দায়ের করা হয়। এর ফলে অনেক কৃষকের জেল হয়।

 আর্থিক দিকে স্বচ্ছল বিশ্বাস ভ্রাতৃদ্বয় এইসময় আড়াল থেকে কৃষকদের হয়ে মামলার সমস্ত খরচ জোগান। বলা বাহুল্য, এইসময় পুলিশ বিশ্বাসদের ধরার অনেক চেষ্টা করেও ব্যর্থ হয়। তারা পুলিশের হাত থেকে বাঁচতে রাতের অন্ধকারে গা ঢাকা দিয়ে গ্রামে গ্রামে বিদ্রোহ সংগঠনের চেষ্টা চালিয়ে যান। 

বিশ্বাসরা দেখলেন, নীল বিদ্রোহকে এগিয়ে নিয়ে যাওয়ার জন্য অন্তত একটা লড়াইয়ে নীলকরদের পরাজিত করতে হবে। তা না হলে, কৃষকদের মনবল ফেরানো যাবে না। সুতরাং সেই মত তারা রাতের অন্ধকারে বিদ্রোহ সংগঠনের চেষ্টা চালিয়ে নিয়ে যেতে লাগলেন। 

এইসময় বিশ্বাস ভ্রাতৃদ্বয়ের নির্দেশে চৌগাছা গ্রাম ও তার আশেপাশের গ্রাম গুলি থেকে মেয়ে ও শিশুদের দূর নিরাপদ গ্রাম গুলিতে সরিয়ে দেওয়া হয়। অতঃপর বিশ্বাস ভ্রাতৃদ্বয় বরিশাল থেকে কয়েকজন নামকরা লাঠিয়াল নিয়ে এলেন। এইসব লাঠিয়ালদের কাছে কৃষকরা দলে দলে প্রশিক্ষণ নিতে থাকলেন। এর ফলে কিছুদিনের মধ্যেই চৌগাছা গ্রামের কাঠগড়া কুঠি বিদ্রোহীদের আক্রমণে ধ্বংস হয়ে যায়। 

অন্যান্য স্থানে বিদ্রোহের বিস্তার 

এরপর চৌগাছা গ্রামের অনুকরনে একের পর এক গ্রামে লাঠিয়াল বাহিনী গড়ে ওঠে এবং কৃষকরা একের পর এক নীলকুঠি আক্রমণ করে তা ধ্বংস করে দিতে থাকে। ১৮৫৯ - ৬০ খ্রিঃ নীল বিদ্রোহ ক্রমে খড়ের আগুনের মতো ক্রমে ক্রমে নদীয়া, যশোহর, খুলনা, ফরিদপুর, রাজশাহী, চব্বিশ পরগনা, পাবনা জেলায় ছড়িয়ে পড়তে থাকে। 

সরকারের ওপর চাপ সৃষ্টি 

একের পর এক নীলকুঠিতে অগ্নিসংযোগ করে ধ্বংস করে দেওয়া হয়। বিদ্রোহের এই বিধ্বংসী রূপ দেখে আতঙ্কিত নীলকররা সরকারের কাছে সাহায্যের জন্য করুন আর্তি জানায়। অন্যদিকে নীলবিদ্রোহের ব্যপকতা সরকারকেও চিন্তিত করে তোলে। 

১৮৫৭ খ্রিঃ সিপাহী বিদ্রোহের পর ১৮৫৯ খ্রিঃ সারা বাংলাদেশব্যাপী বিস্তৃত নীল বিদ্রোহ নিয়ে সরকার কোন রকম ঝুঁকি নিতে চাইছিলো না। বিশেষত, নীল বিদ্রোহকে জমিদার ও মধ্যবিত্ত শ্রেণীর একাংশের সমর্থন সরকারের চিন্তা বাড়ায় এবং ব্রিটিশ সরকারের ওপর চাপ সৃষ্টি করে। 

ইন্ডিগো কমিশন গঠন


এই অবস্থায় সরকার ১৮৬০ খ্রিঃ ৩১ মার্চ নীলচাষীদের ক্ষোভ বিক্ষোভ ও অসন্তোষের কারন গুলি অনুসন্ধানের জন্য "নীল কমিশন" বা "ইন্ডিগো কমিশন" গঠন করে। 

নীল কমিশন প্রায় তিনমাস ধরে ১৩৬ জনের সাক্ষ্য গ্রহণ করে সরকারের কাছে রিপোর্ট পেশ করে। কমিশন সাক্ষ্য থেকে কৃষকদের সমস্ত অভিযোগ গুলির সত্যতাই মেনে নেয়। 

অতঃপর কমিশন নীল বিদ্রোহে সরকারের ভূমিকা সম্পর্কে ৩ টি স্পষ্ট বক্তব্য তুলে ধরে। যথা - 
  1. সরকার নীল চাষের পক্ষে বা বিপক্ষে নয়। 
  2. অন্য শস্যের মতো নীলের চাষ করাও কৃষকদের স্বেচ্ছাধীন বিষয়। 
  3. আইন অমান্য করে অত্যাচার বা অশান্তির ঘটনা ঘটলে নীলকর বা বিদ্রোহী প্রজা কেউই কঠোর শাস্তি থেকে ছাড় পাবে না। 
বস্তুতপক্ষে নীল কমিশন দ্বারা সরকার চাষীদের মূল সমস্যার প্রতিকার অপেক্ষা এটাই বোঝাতে চেয়েছিলো নীলচাষ নীলকর ও কৃষকদের অভ্যন্তরীণ বিষয়। সরকার এর কোন পক্ষেই নেই। আসলে কৃষক ও নীলকর বিরোধে ব্রিটিশ সরকার যে নিরপেক্ষ ও নির্দোষ, সেটাই বুঝিয়ে দিতে চেয়েছিলো। 

প্রকৃতপক্ষে এর দ্বারা সদ্য ভারত শাসনের অধিকার পাওয়া ব্রিটিশ সরকার নিজের মহানুভবতার দিকটি জাহির করতে চেয়েছিলো। পাশাপাশি ১৮৫৭ খ্রিঃ সিপাহী বিদ্রোহের পর যাবতীয় অশান্তি ও বিশৃঙ্খলা থেকেও নিজেকে দূরে সরিয়ে রাখার নীতি নিয়েছিলো। নীল কমিশনের রিপোর্টে সরকারের এই মনোভাবেরই প্রতিফলন ঘটেছিলো। 

ছোটলাটের কাছে সুপারিশ 

যাইহোক, এর পরেও নীলচাষ বাংলায় একেবারে বন্ধ হয়ে যায় নি। ১৮৬০ খ্রিঃ আগস্ট মাসে একটি স্মরণীয় ঘটনা ঘটে। এই সময় বাংলার লেফটেন্যান্ট গর্ভনর গ্রান্ট সাহেব যশোহর ও নদীয়া জেলার কুমার ও কালীগঙ্গা নদীপথে প্রায় ৬০ - ৭০ মাইল ভ্রমনকালে নীলচাষীদের করুন অবস্থা স্বচক্ষে প্রত্যক্ষ করেন। অনেক চাষী এই সময় জীবনের ঝুঁকি নিয়ে মাঝনদীতে নেমে পড়ে তাদের অভিযোগের প্রতিকার করতে সকরুন অনুরোধ করেন। গ্রান্ট সাহেব কৃষকদের আশ্বস্ত করে নীলচাষ বন্ধের প্রতিশ্রুতি দেন। 

ইন্ডিগো অ্যাক্ট (১৮৬২) ও অষ্টম আইন (১৮৬৮)

ইতিমধ্যে নীলকমিশনের রিপোর্টের ভিত্তিতে সরকার - 
  1. ১৮৬২ খ্রিঃ "ইন্ডিগো অ্যাক্ট" পাশ করে ঘোষনা করে, জোর করে চাষীকে দিয়ে নীলচাষ করানো যাবে না। এটি তার সম্পূর্ণ স্বেচ্ছাধীন বিষয়। 
  2. এর কয়েক বছর বাদে ১৮৬৮ খ্রিঃ অষ্টম আইন পাশ করে নীলচুক্তি আইনও বাতিল করে দেওয়া হয়। বলা হয়, নীলকররা আর চুক্তি করে কৃষকদের নীলচাষ করাতে পারবে না। 

বাংলা থেকে নীলচাষের অবসান

এই আইন গুলি প্রনয়নের পর যশোহর, নদীয়া ও বাংলার অন্যান্য জায়গা গুলিতে নীলচাষ ধীরে ধীরে একেবারেই বন্ধ হয়ে যায়। বহু কুঠি তার কারবার বন্ধ করে অন্য ব্যবসায় মন দেয়। তবুও কিছু কুঠি চাষীদের সঙ্গে সদ্ভাব বজায় রেখে নীল উৎপাদনের চেষ্টা চালায়। অবশেষে ব্যর্থ হয়ে তারা কুঠিগুলিকে বিহারে স্থানান্তরিত করে। 

পরবর্তীকালে সেখানে অন্তিম বারের মতো জুলুম চালিয়ে নীলকররা নীলচাষের চেষ্টা করলে ১৯১৭ খ্রিঃ তিনকাঠিয়া ব্যবস্থার বিরুদ্ধে মহাত্মা গান্ধী চম্পারন সত্যাগ্রহের ডাক দেন। ইতিমধ্যে বাজারে রাসায়নিক পদ্ধতিতে তৈরি কৃত্রিম নীল চলে এলে নীলচাষ পুরোপুরি বন্ধ হয়ে যায়। 

রাসায়নিক নীল সম্পর্কে তথ্য 

১৮৮০ খ্রিঃ জার্মান রসায়নবিদ আডল্ক ফন বেইয়ার আলকাতরা থেকে রাসায়নিক উপায়ে কৃত্রিম নীল রঙ প্রস্তুত করতে সক্ষম হন এবং এইজন্য ১৯০৫ সালে যক্ষা রোগের জীবাণুর আবিষ্কারক জার্মান চিকিৎসক বিজ্ঞানী রবার্ট কথের সঙ্গে যৌথভাবে নোবেল পুরস্কার লাভ করেন। 

১৮৯২ খ্রিঃ এই কৃত্রিম নীল বাজারে সস্তা দরে ছড়িয়ে পড়লে ধীরে ধীরে ভারতে নীলচাষ একেবারেই বন্ধ হয়ে যায়। 

নীল বিদ্রোহের ঐতিহাসিক গুরুত্ব ও অবদান

ভারতের কৃষক বিদ্রোহের ইতিহাসে নীল বিদ্রোহের  গুরুত্ব ছিলো অপরিসীম - 
  1. ভারতের কৃষক আন্দোলনের ইতিহাসে নীল বিদ্রোহ ছিলো পরিপূর্ণ অর্থে একটি সফল কৃষক সংগ্রাম। 
  2. এই বিদ্রোহের ব্যপকতা লক্ষ্য করে সরকার ১৮৬০ খ্রিঃ নীল কমিশন বসায় এবং ১৮৬২ খ্রিঃ ইন্ডিগো অ্যাক্ট দ্বারা বাধ্যতামূলক ও বলপূর্বক নীলচাষ বন্ধ করে দেয়। 
  3. এর কয়েক বছর পর ১৮৬৮ খ্রিঃ অষ্টম আইন দ্বারা নীলচুক্তি আইনও বাতিল করে দেওয়া হয়। এর ফলে কৃষকদের ওপর নীলকর সাহেবদের অত্যাচারের অবসান ঘটে। 
  4. নীল বিদ্রোহের এই সাফল্য অশিক্ষিত গ্রামীন কৃষকদের মনে নতুন চেতনা ও আত্মবিশ্বাসের জন্ম দেয়। 
  5. এই বিদ্রোহ পরোক্ষভাবে জাতীয় চেতনার উন্মেষেও সাহায্য করেছিলো এবং দেশবাসীকে সংঘবদ্ধ আন্দোলনের প্রয়োজনীয়তা ও সাফল্যকে তুলে ধরেছিলো। 
  6. এই বিদ্রোহের মধ্য দিয়েই সর্বপ্রথম কৃষক, জমিদার, শিক্ষিত মধ্যবিত্ত শ্রেনী ও হিন্দু - মুসলমান সম্প্রদায়ের মধ্যে ঐক্য প্রতিষ্ঠিত হয়েছিলো। 
  7. ধর্মীয় উন্মাদনা ও আদর্শ ব্যতিরেকেও যে কোন কৃষক আন্দোলনকে সফল করে তোলা যায়, নীল বিদ্রোহ ছিলো তার প্রথম উজ্জ্বল নির্দশন। 
  8. নীল বিদ্রোহের ধর্মনিরপেক্ষ আন্দোলনের চেতনা পরবর্তীকালে শিক্ষিত মধ্যবিত্ত শ্রেনীকে প্রভাবিত করে এবং ধর্মনিরপেক্ষ আদর্শের মডেলেই পরবর্তী ক্ষেত্রে ভারতের জাতীয়তাবাদী আন্দোলন গুলি পরিচালিত হয়। 
নীল বিদ্রোহের ঐতিহাসিক তাৎপর্য তাই কৃষক আন্দোলনের মধ্যেই আবদ্ধ ছিলো না। 

নীল বিদ্রোহের বৈশিষ্ট্য 

নীল বিদ্রোহের সামগ্রিক পর্যালোচনা থেকে আমরা এর ৫ টি গুরুত্বপূর্ণ বৈশিষ্ট্যের দিককে তুলে ধরতে পারি। যথা - 
  1. নীল বিদ্রোহ ছিলো একটি সফল কৃষক আন্দোলন, 
  2. এই আন্দোলনের ৩ টি স্তর ছিলো - আবেদন নিবেদনের স্তর, ধর্মঘট ও সশস্ত্র প্রতিরোধ, 
  3. নীল বিদ্রোহ ছিলো একমাত্র ব্যতিক্রমী কৃষক বিদ্রোহ, যাকে জমিদার, শিক্ষিত মধ্যবিত্ত শ্রেনী, সরকার, খ্রিষ্টান মিশনারি প্রায় সকলেই সমর্থন করেছিলেন, 
  4. হিন্দু মুসলিম ঐক্য ছিলো এই আন্দোলনের অপর উল্লেখযোগ্য দিক, 
  5. কোন ধর্মীয় উন্মাদনা এই কৃষক বিদ্রোহে দেখা যায় নি। এটি ছিলো একটি ধর্মনিরপেক্ষ কৃষক আন্দোলন।

2 Comments

Post a Comment
Previous Post Next Post