কেন শিক্ষিত মধ্যবিত্ত বাঙালিরা মহাবিদ্রোহকে সমর্থন করে নি?

 ১৮৫৭ খ্রিঃ ভারতে সিপাহী বিদ্রোহ শুরু হলে বাঙালি শিক্ষিত মধ্যবিত্ত শ্রেনী এই বিদ্রোহের বিরোধীতা করে এবং ইংরেজদের সমর্থন করে । শিক্ষিত মধ্যবিত্ত বাঙালির মহাবিদ্রোহকে সমর্থন না করার পিছনে অবশ্য অনেক গুলি কারন ছিলো।

কেন শিক্ষিত মধ্যবিত্ত বাঙালিরা মহাবিদ্রোহকে সমর্থন করে নি?
কেন শিক্ষিত মধ্যবিত্ত বাঙালি মহাবিদ্রোহকে সমর্থন করে নি? 

 

সংক্ষেপে এই কারন গুলিকে আমরা নিন্মলিখিত ভাবে তুলে ধরতে পারি - 

(১.) সামরিক বাহিনীতে বাঙালি সিপাহী না থাকা 

সিপাহী বাহিনীর "বেঙ্গল রেজিমেন্টে" কোন বাঙালি সৈন্য ছিলো না। বেঙ্গল আর্মির সব সেপাইরাই এসেছিলেন অযোধ্যা, বিহার ও উত্তর পশ্চিম সীমান্ত প্রদেশ গুলি থেকে। এদের সঙ্গে বাংলার ভাষাগত, ভূমিগত বা জাতিগত কোন সম্পর্ক ছিলো না। খুব স্বাভাবিক ভাবেই সিপাহীদের বিদ্রোহের প্রতি শিক্ষিত বাঙালি একাত্মতা অনুভব করে নি। 

(২.) মধ্যযুগ পুনঃপ্রবর্তনের আশঙ্কা

শিক্ষিত বাঙালিদের অনেকেই মনে করেন, সিপাহী বিদ্রোহ সফল হলে পুনরায় ভারতে মধ্যযুগ বা মুসলিম রাজত্বের পুনঃপ্রতিষ্ঠা ঘটবে। এর ফলে ভারতে পুনরায় অন্ধকারাচ্ছন্ন যুগ ফিরে আসবে। মধ্যযুগীয় অরাজকতা, কুসংস্কার সারা দেশকে গ্রাস করবে। 

(৩.) সংস্কার আন্দোলন স্তব্ধ হওয়ার আতঙ্ক

শিক্ষিত মধ্যবিত্ত শ্রেনী আশঙ্কা প্রকাশ করে, ভারতে সিপাহী বিদ্রোহ সফল হলে ইংরেজ শাসনের অবসান ঘটবে। ফলে ঔপনিবেশিক প্রশাসনের সহায়তায় ভারতে যে প্রগতিশীল শিক্ষা ও সমাজসংস্কার আন্দোলন চলছে, তার ইতি ঘটবে। যা কখনই কাঙ্খিত ছিলো না শিক্ষিত শ্রেনীর কাছে। 

(৪.) শ্রেনী স্বার্থ বজায় রাখতে 

নিজেদের শ্রেনী স্বার্থ বজায় রাখবার জন্যও মধ্যবিত্ত শ্রেণী সিপাহী বিদ্রোহের বিরোধীতা করেছিলো। কারন ভারতে ইংরেজদের থাকা না থাকার সঙ্গে শিক্ষিত মধ্যবিত্তদের শ্রেনী স্বার্থ বিভিন্ন দিক থেকে জড়িত ছিলো। 

মধ্যবিত্ত শিক্ষিতরা আতঙ্কিত হয় এই ভেবে যে,ভারতে ইংরেজ শাসনের অবসান ঘটলে - 
  • ঔপনিবেশিক শাসনব্যবস্থার ছত্রছায়ায় প্রতিপালিত ও সমৃদ্ধ বাঙালি জমিদাররা তাদের জমিদারি হারাবেন
  • অনেক শিক্ষিত বাঙালি তাদের সরকারি চাকুরি গুলি হারাবেন। 
  • ব্যবসা বাণিজ্যের দিক থেকেও অনেক বাঙালি ব্যবসায়ী ক্ষতিগ্রস্ত হবেন। 

(৫.) বাঙালিদের প্রতি আক্রমণ 

ইংরেজ আমলে শিক্ষিত বাঙালিরা সরকারের বিভিন্ন পদ গুলিতে চাকুরিরত ছিলেন। বিদ্রোহীরা ইংরেজ শাসন উচ্ছেদ করতে গিয়ে তাদের অধীনস্থ কর্মচারীদেরও আক্রমণ করেছিলেন। অনেক শিক্ষিত চাকুরিরত বাঙালিই এইসময় নানা ভাবে বিদ্রোহীদের রোষের মুখে পড়েছিলেন। 

খুব স্বাভাবিক ভাবেই সেইসব বাঙালিরা জীবন ও জীবিকার স্বার্থে ইংরেজদের প্রতিই সমর্থন জানিয়ে ছিলেন এবং বিদ্রোহীদের বিরোধিতা করেন। 

 এইসব কারন গুলির জন্য তাই দেখা গিয়েছিলো - 
  • শিক্ষিত মধ্যবিত্ত বাঙালিরা মহাবিদ্রোহের বিরোধীতা করেই সন্তুষ্ট হতে পারে নি। 
  • তারা চেয়েছিলেন এই বিদ্রোহে ইংরেজরা জয়ী হোক। 
  • এইজন্য তারা ইংরেজদের প্রতি  সর্বতোভাবে সাহায্যআনুগত্য জানান, এবং 
  • বিদ্রোহে জয়ী ইংরেজদের অভিনন্দন জানান এবং অকপটে তাদের প্রশংসা করে নিজেদের রাজভক্তি প্রদর্শন করেন। 
বিদ্রোহ দমনের পর তাই কৃতজ্ঞতা স্বরূপ গভর্নর জেনারেলও এইসব শিক্ষিত বাঙালিদের পাল্টা ধন্যবাদ জানান এবং বিজয় উৎসবের বিরাট ভোজসভায় তাদের আমন্ত্রণ জানান। একমাত্র ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর ছাড়া কলকাতার উচ্চবিত্ত ও মধ্যবিত্ত শিক্ষিত সমাজের নেতৃস্থানীয় সকলেই মহাবিদ্রোহের পরে আয়োজিত সেই ভোজসভায় অংশগ্রহণ করেন।

অর্থাৎ মহাবিদ্রোহে শিক্ষিত বাঙালি শ্রেনী "বীরত্বের" চেয়ে "বিবেচনাকেই" অধিক গুরুত্ব দিয়েছিলেন। 

1 Comments

Post a Comment
Previous Post Next Post