১৮৫৭ খ্রিঃ মহাবিদ্রোহের প্রতি শিক্ষিত বাঙালি সমাজের ৩ ধরনের মনোভাবের প্রতিফলন লক্ষ্য করা গিয়েছিলো -
- শিক্ষিত বাঙালি সমাজ এই বিদ্রোহকে সমর্থন করে নি।
- অনেকে বিদ্রোহীদের বিরোধীতা করেছিলেন। এবং প্রকাশ্যে তারা বিদ্রোহের নিন্দা পর্যন্ত করেছিলেন।
- বিদ্রোহে তারা ইংরেজদের নানা ভাবে সাহায্য ও সমর্থনও করেছিলেন।
মহাবিদ্রোহের প্রতি শিক্ষিত বাঙালি সমাজের মনোভাব |
মহাবিদ্রোহের প্রতি মধ্যবিত্ত শ্রেনীর দৃষ্টিভঙ্গি
মনে রাখতে হবে, ১৮৫৭ খ্রিঃ মহাবিদ্রোহকে বাঙালি শিক্ষিত শ্রেনী সমর্থন না করলেও, এই বিদ্রোহে তারা একেবারেই নির্লিপ্ত বা নিশ্চুপও ছিলেন না । শিক্ষিত মধ্যবিত্ত বাঙালিরা ১৮৫৭ খ্রিঃ মহাবিদ্রোহকে ভারতে মুসলিম রাজত্ব পুনঃপ্রবর্তনের প্রচেষ্টা এবং সিপাহীদের একটি দাঙ্গা হাঙ্গামা ও বিশৃঙ্খল আচরন হিসাবেই দেখেছিলো।
খুব স্বাভাবিক ভাবেই মহাবিদ্রোহের প্রতি বাঙালি শিক্ষিত শ্রেনীর মনোভাব ও দৃষ্টিভঙ্গি ছিলো - (১.) বিদ্রোহের বিপক্ষে এবং (২.) ভারতে ইংরেজ শাসনের পক্ষে।
মহাবিদ্রোহের বিরোধিতা করা
১৮৫৭ খ্রিঃ মহাবিদ্রোহ শুরু হলে শিক্ষিত বাঙালি শ্রেনী এই বিদ্রোহের বিরুদ্ধে সরব হন এবং নানা ভাবে ইংরেজদের সাহায্য ও সমর্থনে এগিয়ে আসেন।
সংক্ষেপে মহাবিদ্রোহের সময় শিক্ষিত মধ্যবিত্ত বাঙালিদের মনোভাব ও আচরনের প্রধান দিক গুলিকে আমরা নিন্মলিখিত ভাবে তুলে ধরতে পারি -
(১.) সংবাদপত্রে বিদ্রোহীদের নিন্দা
শিক্ষিত বাঙালি সমাজের মনোভাবের প্রতিফলন অনেকটাই সেসময়ের সংবাদপত্র গুলি থেকে জানা যায়। এই সময়ে সংবাদ প্রভাকর বিভিন্ন ছড়া কেটে বিদ্রোহীদের প্রতি তীব্র বিদ্রুপ করে। হরিশচন্দ্রের হিন্দু প্যাট্রিয়ট বিদ্রোহীদের বর্বর আক্রমণের তীব্র নিন্দা করে। সংবাদ পূর্ন চন্দ্রোদয় এবং সংবাদ ভাস্করও বিদ্রোহীদের কঠোর সমালোচনা করে।
(২.) আনুগত্য ও সাহায্যের প্রতিশ্রুতি
শিক্ষিত বাঙালিদের নেতৃস্থানীয় ব্যক্তিদের অনেকেই এই বিদ্রোহে ইংরেজদের পাশে এসে দাঁড়ান এবং তাদের প্রতি কৃতজ্ঞতা ও আনুগত্য জানিয়ে সাহায্যের প্রতিশ্রুতি দেন -
- ব্রাহ্ম সমাজের নেতা দেবেন্দ্রনাথ ঠাকুর কলকাতার প্রার্থনা সভায় ব্রিটিশদের প্রশংসা করে বলেন, "তারা (ব্রিটিশরা) শত্রুতাকে বন্ধুত্ব দিয়ে জয় করতে চায়। সে তুলনায় আমাদের মনোভাব কত জঘন্য।
- জমিদারদের তরফ থেকে" ব্রিটিশ ইন্ডিয়ান অ্যাসোসিয়েশন" এবং শিক্ষিত অভিজাত মুসলমানদের তরফ থেকে" মহামেডান অ্যাসোসিয়েশন অব ক্যালকাটা" প্রকাশ্য সভা সমাবেশ করে গর্ভনর জেনারেলকে সাহায্য ও আনুগত্যের নিশ্চয়তা দেন।
- ১৮৫৭ খ্রিঃ ডিসেম্বর মাসের বিভিন্ন সময়ে বর্ধমানের জমিদার মহাতাবচাঁদ বাহাদুর, রাজা রাধাকান্ত দেব, রাজা কালীকৃষ্ণ, মহারাজা সুরেশচন্দ্র রায় সহ বহু জমিদার সরকারকে সমর্থন ও সাহায্যের আশ্বাস দেন।
- নাট্যকার গিরিশ চন্দ্র ঘোষও ইংরেজদের প্রতি সহানুভূতি প্রদর্শন করেন তার ভাইকে লেখা এক পত্র মারফৎ।
- ১৮৫৯ খ্রিঃ "ইন্ডিয়ান ফিল্ড" পত্রিকার তথ্য থেকে জানা যায়, বাংলার জমিদাররা গরুরগাড়ী ও অন্যান্য রসদ দিয়ে ইংরেজদের বিদ্রোহ দমনে সাহায্য করেন।
(৩.) ইংরেজদের বিজয় প্রার্থনা
মহাবিদ্রোহ শুরু হলে ইংরেজদের জয়ের স্বপক্ষে বাঙালিরা কালীঘাট মন্দিরে বিশেষ পূজা ও প্রার্থনার আয়োজন করে। এমনকি দেবেন্দ্রনাথ ঠাকুরের নেতৃত্বে ব্রাহ্মসমাজও পরেমেশ্বরের কাছে ইংরেজদের জয়ের জন্য বিশেষ প্রার্থনা জানায়।
(৪.) রাজভক্তি প্রকাশ
মহাবিদ্রোহ চলাকালীন সময়ে বিভিন্ন সভা সমাবেশ করে শিক্ষিত বাঙালি শ্রেনী ও জমিদাররা ইংরেজদের প্রতি রাজভক্তি প্রকাশ করেন। তারা ইংরেজ শক্তির প্রশংসা করেন। তাদের মঙ্গল প্রার্থনা করেন। বিভিন্ন রকম সাহায্যের প্রতিশ্রুতি দেন এবং বিদ্রোহীদের বর্বরতার প্রতি তীব্র ধিক্কার জানান।
সংবাদপত্র গুলিতেও তারা অকপট ভাবে তাদের রাজভক্তি তুলে ধরেন। ব্রিটিশ সরকারের দিল্লি পুর্নদখলের সংবাদে উচ্ছসিত হয়ে ১৮৫৭ খ্রিঃ ২০ জুন "সংবাদ ভাস্কর" লেখে - "কি মঙ্গল সমাচার, পাঠক সকল জয় জয় বলিয়া নৃত্য করো, হিন্দু প্রজাসকল দেবালয়ে সকলে পূজা দেও, আমাদের রাজেশ্বর শত্রু জয়ী হইলেন"। ঐ একই তারিখে সংবাদ প্রভাকর ব্রিটিশের গুনগান করে লেখে -" চিরকাল হয় যেন ব্রিটিশের জয় /ব্রিটিশের রাজলক্ষী স্থির যেন রয়।
এইভাবে দেখা যায়, ১৮৫৭ খ্রিঃ মহাবিদ্রোহের প্রতি শিক্ষিত বাঙালি সম্প্রদায় ভারতের অন্যান্য অঞ্চলের থেকে -
- বিরোধী ও পৃথক অবস্থান নেয়,
- বিদ্রোহের বিরোধীতা করে এবং
- সর্বতোভাবে ইংরেজদের সমর্থন করে তাদের পাশে এসে দাঁড়ায়।
ব্যতিক্রমী মনোভাব ও চিন্তাধারা
তবে শ্যামাপ্রসাদ বসুর মতো আধুনিক ঐতিহাসিকদের কেউ কেউ মনে করেন, শিক্ষিত বাঙালিদের সকলেই মহাবিদ্রোহের বিরোধীতা করেন নি। অনেক সাধারন শিক্ষিত বাঙালি ছিলেন যারা বিদ্রোহের প্রতি সহানুভূতিশীল ছিলেন এবং বিদ্রোহকে সমর্থন করেছিলেন। এমনকি কিছু ব্যতিক্রমী বাঙালিও ছিলেন, যারা মহাবিদ্রোহে শিক্ষিত বাঙালিদের একপেশে ভূমিকার তীব্র নিন্দাও করেছিলেন। কালীপ্রসন্ন সিংহ তাদেরই একজন ছিলেন।
মহাবিদ্রোহে অধিকাংশ শিক্ষিত বাঙালিদের ভূমিকাকে তীব্র কটাক্ষ করে তিনি "হুতোম প্যাঁচার নকশা" তে লিখেছিলেন -
"যদিও একশো বছর হয়ে গ্যালো, তবুও তাঁরা আজও সেই হতভাগা ম্যাড়া বাঙালিই আচেন - বহুদিন ব্রিটিশ সহবাসে, ব্রিটিশ শিক্ষায় ও ব্রিটিশ ব্যবহারেও আমেরিকানদের মতো হতে পারেন নি। ....... যাঁরা আপনার ছায়া দেখে ভয় পান - তারা যে লড়াই করবেন একথা নিতান্ত অসম্ভব "।
সুতরাং শিক্ষিত বাঙালি মাত্রই মহাবিদ্রোহের বিরোধীতা করে ছিলেন একথা সবদিক থেকে সঠিক নয়। মনে রাখতে হবে, উনিশ শতকের দ্বিতীয়ার্ধের কিছু আগে থেকেই ইংরেজ শাসনের প্রতি শিক্ষিত বাঙালিদের ক্ষোভ ও রাজনৈতিক সচেতনতার জাগরন হয়েছিলো। মহাবিদ্রোহের অনেক আগে থেকেই বেঙ্গল স্পেকটেটর, সংবাদ ভাস্কর ইত্যাদি পত্র পত্রিকা গুলিতে ব্রিটিশ বিরোধিতার স্পষ্ট সুর লক্ষ্য করা গিয়েছিলো। মহাবিদ্রোহ চলাকালীন সময়ে তাদের সেই বিরোধী কন্ঠস্বর হঠাৎ করেই পরিবর্তিত হয়ে গিয়েছিলো।
দমনমূলক আইন ও তার মনস্তাত্ত্বিক প্রভাব
সংবাদপত্রের এই কন্ঠবদলের একটি বড়ো কারন ছিলো "গ্যাগিং অ্যাক্ট"। লর্ড ক্যানিং মহাবিদ্রোহের সময় এই আইন পাশ করেছিলেন। এই আইনে সংবাদপত্র প্রকাশের জন্য লাইসেন্স নেওয়া বাধ্যতামূলক করা হয়। এর পাশাপাশি এটাও বলা হয়, সংবাদপত্রে অন্তর্ঘাতমূলক কোন সংবাদ পরিবেশন করা যাবে না। এই আইনটি ছাড়াও মহাবিদ্রোহের সময় জনগনের যানবাহন গুলি সংগ্রহ করবার জন্য ব্রিটিশ সরকার "ইমপ্রেসমেন্ট অ্যাক্ট" পাশ করেছিলো। ১৩ জুন, ১৮৫৭ খ্রিঃ পাশ করে দমনমূলক "প্রেস আইন"।
সুতরাং সংবাদপত্রগুলির ইংরেজ স্তুতি এবং বিদ্রোহ দমনে জমিদারদের হাজার হাজার গরুর গাড়ি দিয়ে ইংরেজদের সাহায্য করার বিষয়টিকে যতটা স্বাভাবিক ও স্বতঃস্ফূর্ত বলে মনে করা হয়, বাস্তবে ততটা ছিলো না।
সাধারন শিক্ষিত বাঙালি ও বিদ্রোহের ধারা
মনে রাখতে হবে, বাংলার সাধারন শিক্ষিত শ্রেনী মহাবিদ্রোহের ধারা থেকে পুরোপুরি বিচ্ছিন্ন ছিলো না। এখানে এটাও মাথায় রাখতে হবে মহাবিদ্রোহের প্রথম সূচনাটি কিন্তু বাংলাতেই ঘটেছিলো। কানাইয়ালালের "তারিখ ই বখাবত ই হিন্দ" গ্রন্থ থেকে জানা যায়, ১৮৫৭ খ্রিঃ জানুয়ারি মাসে এক বাঙালি কেরানিকে এনফিল্ড রাইফেলের কার্তুজ কি করে ব্যবহার করতে হবে তা ইংরেজি থেকে বাংলায় অনুবাদ করার সরকারি দায়িত্ব দেওয়া হয়।
কেরানিটি ইংরেজির মূল লেখাটি পড়ে বিস্মিত ও সন্ত্রস্ত হয়ে পড়েন। এবং জানতে পারেন, কার্তুজের চর্বি গরু ও ছাগলের চর্বি থেকে নেওয়া হয়েছে। পরে এই গোপন সংবাদ তিনি সর্বত্র ছড়িয়ে দেন এবং সেটাই গরু ও শুকরের চর্বি নামে সারা দেশে ছড়িয়ে পড়ে এবং উত্তেজনা ছড়ায়।
মহাবিদ্রোহ চলাকালীন সময়েও সাধারন শিক্ষিত শ্রেনী সিপাহী বিদ্রোহ নিয়ে একাধিক গুজব রটিয়েছিলো। কালীপ্রসন্ন সিংহের হুতোম প্যাঁচার নকশা থেকে তার অনেক উদাহরণ পাওয়া যায়। এইসব গুজব ভারতীয়দের ইংরেজ বিদ্বেষকে বহুগুন বাড়িয়ে দিয়েছিলো। সুতরাং শিক্ষিত বাঙালি সম্পর্কে নিশ্চিত হওয়ার কোন কারন ব্রিটিশ সরকারের ছিলো না। এই কারনেই বাঙালিদের বাগে আনবার জন্য ব্রিটিশ সরকার একের পর এক দমন মূলক আইন তৈরি করেছিলো।
কিন্তু এসব করেও সাধারন শিক্ষিত বাঙালিদের বাগে আনা যায় নি। এর অনেক প্রমান পাওয়া যায়। যেমন -
- মহাবিদ্রোহ চলাকালীন সময়ে মেদিনীপুরে বৃন্দাবন তেওয়ারী নামে এক ব্রাহ্মন প্রকাশ্যে জনসাধারণকে বিদ্রোহে প্ররোচিত করার অপরাধে মৃত্যুদন্ডে দন্ডিত হন।
- ঐ জেলাতেই মীর জাঙ্গু ও শেখ জামিরুদ্দিনকে এই একই অপরাধে দীর্ঘ কারাবাস ভোগ করতে হয়।
- মালদহ জেলাতে চমন সিং নামে এক ব্যক্তি বিদ্রোহে প্ররোচনা দিয়ে গ্রেপ্তার হন।
- হুগলি জেলায় কুবের চন্দ্র চৌধুরি নামে এক সরকারি জেলা ডাক্তার এবং যশোর জেলায় পরাগ ধোবী নামে এক ব্যক্তি বিদ্রোহের সংগঠনের কাজে যুক্ত ছিলেন।
- ১৮৫৭ খ্রিঃ ২৬ ফেব্রুয়ারি, মুর্শিদাবাদের সিপাহীরা বিদ্রোহী হয়ে ওঠে। তারা মুর্শিদাবাদের নবাব মনসুর আলী খাঁ কে নেতৃত্ব দিতে অনুরোধ করলে ভীতু নবাব পিছিয়ে আসেন।
এই সমস্ত ঐতিহাসিক ঘটনাক্রম থেকে বোঝা যায়, মহাবিদ্রোহের সর্বভারতীয় ধারা ও প্রবনতা গুলি থেকে বাংলা একেবারেই মুক্ত ও ব্যতিক্রম ছিলো না। বাংলার শিক্ষিত সম্প্রদায় মহাবিদ্রোহের এই প্রচলিত ঐতিহাসিক ধারার অংশিদার ছিলেন।
মূল্যায়ন
সুতরাং মহাবিদ্রোহে শিক্ষিত বাঙালিদের অংশগ্রহণ সংক্রান্ত এই বিশ্লেষন থেকে কয়েকটি বিষয় খুব স্পষ্ট ভাবেই ফুটে ওঠে। এগুলি হল -
- বাংলা ও বাঙালিরা মহাবিদ্রোহ সম্পর্কে পুরোপুরি নিস্পৃহ বা নির্লিপ্ত ছিলো না।
- ভারতের অন্যান্য জায়গার মতো বিদ্রোহ বাংলাতে সেভাবে না ঘটলেও, মহাবিদ্রোহ সংঘঠনে যে গুজব গুলি গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা নিয়েছিলো, সেগুলি রটনায় শিক্ষিত শ্রেনী গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা নিয়েছিলো।
- ইংরেজ আশ্রিত জমিদার বা সরকারি পদে কর্মরত অধিকাংশ শিক্ষিত বাঙালিরা ব্যক্তিস্বার্থে "পরিবেশ ও পরিস্থিতি" গত কারনে বিদ্রোহের বিরোধীতা করেছিলেন এবং ইংরেজদের সমর্থন করেছিলেন।
- কিন্তু সাধারন অনামী, অখ্যাত শিক্ষিত শ্রেনী বিদ্রোহকে সমর্থন করেছিলেন এবং কেউ কেউ বিদ্রোহ সংগঠনের বিচ্ছিন্ন প্রয়াস চালিয়েছিলেন। কিন্তু সেভাবে সফলতা লাভ করতে পারেন নি।
- মহাবিদ্রোহের সময় "ইমপ্রেসমেন্ট অ্যাক্ট", "গ্যাগিং অ্যাক্ট" থেকে বোঝা যায়, সে সময়ের সংবাদপত্র গুলি বা প্রভাবশালী ব্যক্তি বর্গের ইংরেজ ভজনা পুরোপুরি স্বতঃস্ফূর্ত ও স্বাভাবিক ছিলো না।
অতয়েব, সবদিক বিচার বিশ্লেষণ করে আমরা বলতে পারি, মহাবিদ্রোহে বাঙালিরা উদাসীন ছিলো, অথবা তারা এর বিরোধিতা করেছিলো - একথা পুরোপুরি ঠিক নয়। হীরেন্দ্রনাথের ভাষায় "বীরত্বের চেয়ে বিবেচনাকে অধিক ঠাঁই দিয়েছিলো" - একথাও পুরোপুরি সত্য নয়।
আসলে মহাবিদ্রোহে সারা দেশের ব্রিটিশ বিরোধিতার মূল সুরটির সাথে বাংলার সুরের ধারাটিও যে অভিন্ন ছিলো, তাতে কোন সন্দেহ নেই। ভারতের অন্যান্য স্থানে "বড়ো মানুষ" ও "বড়ো নেতৃত্বের" গুনে সেই সুরটি যেভাবে সুতীব্র ভাবে ধ্বনিত হয়েছিলো, বাংলায় তার অভাবেই সেই সুরটি ম্রিয়মান হয়ে পড়েছিলো। কিন্তু তার মানে এই নয় যে বাংলা নিরব, নিস্প্রভ বা নির্লিপ্ত ছিলো।
বাংলায় কেন বিদ্রোহ দানা বাঁধে নি?
বাংলায় মহাবিদ্রোহ দানা বাঁধতে না পারার একটি বড়ো কারন ছিলো বেঙ্গল রেজিমেন্টে বাঙালি সৈন্যের অভাব। ভারতে ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির বাংলা, বোম্বাই ও মাদ্রাজ প্রেসিডেন্সিতে ৩ টি সিপাহী বাহিনী ছিলো। এর মধ্যে বেঙ্গল আর্মির সংখ্যাই ছিলো সবচেয়ে বেশি। এদের সংখ্যা ছিলো প্রায় এক লক্ষ সত্তর হাজার।
আশ্চর্যজনক ভাবে বেঙ্গল আর্মির সব সেপাইরাই এসেছিলো অযোধ্যা, বিহার ও উত্তর পশ্চিম সীমান্ত প্রদেশ গুলি থেকে। সেপাইদের বেশিরভাগই ছিলেন ব্রাহ্মন, রাজপুত, জাঠ ও মুসলমান সম্প্রদায় ভুক্ত। এরা সবাই হিন্দুস্থানিতে কথা বলতো এবং সবাই গ্রাম সমাজের উচ্চবর্নভুক্ত ছিলো অথবা ক্ষুদে সামন্ত বা ছোট জমিদারের পুত্র ছিলো। গ্রাম সমাজের সঙ্গে এরা ঘনিষ্ঠ যোগাযোগও রাখতো।
খুব স্বাভাবিক ভাবেই বেঙ্গল আর্মির এই সিপাহীদের সঙ্গে বাংলার কোন নাড়ির যোগ ছিলো না। ভাষাগত, ভূমিগত পার্থক্যের কারনে বাংলার সাধারণ মানুষের সঙ্গে তাদের কোন আত্মিক বা সামাজিক সম্পর্ক গড়ে ওঠে নি।
অন্যদিকে বাংলার জমি উর্বর হওয়ায় বাংলার মানুষ কৃষিকাজকেই প্রধান জীবিকা হিসাবে গ্রহন করেছিলো। সিপাহী হওয়ার গৌরব বা লোভ কোনটাই তাদের ছিলো না। তাছাড়া বাংলায় ক্রমাগত বিদ্রোহ ও ষড়যন্ত্রের কারনে ইংরেজরা নিজে থেকেই বাঙালিদের সিপাহী বাহিনীতে নিযুক্ত করতে চাইতো না। এই কারনে ইংরেজ আমলে বেঙ্গল আর্মি বাঙালি বর্জিত ছিলো।
অন্যদিকে দেখা যায়, উত্তর ভারতের এলাকা গুলির পুরুষরা বাঙালিদের থেকে অনেক বেশি পরিশ্রমী ছিলেন। এছাড়া, উঃ পঃ সীমান্ত প্রদেশ ও উত্তর ভারতের অন্যান্য অঞ্চল গুলির জমি অনুর্বর ও কৃষিকাজের অনুপযুক্ত হওয়ায়, সেখানকার মানুষরা বিকল্প কর্মসংস্থানের জন্য সেপাইয়ের চাকুরিকে বেছে নিতে বাধ্য হয়েছিলো। এইসব কারনে বেঙ্গল আর্মি পুরোপুরি ভাবে বাঙালি বিচ্ছিন্ন ছিলো।
যেহেতু বেঙ্গল আর্মিতে কোন বাঙালি সৈন্য ছিলো না, তাই তাদের বিদ্রোহের সঙ্গে বাঙালিরা কোন একাত্মতা অনুভব করতে পারে নি। যদি বেঙ্গল আর্মিতে বাংলার কৃষকরা নিযুক্ত হতেন, তাহলে অবশ্যই সাধারন মানুষ আর সিপাহীদের মিলনে বাংলায় মহাবিদ্রোহ তীব্র আকার ধারন করতো। কিন্তু সেটি ঘটে নি। বেঙ্গল আর্মির সেপাইরা ছিলো অবাঙালি। ফলে ভাষাগত প্রভেদ বা প্রতিবন্ধকতা সেখানে একটা ছিলো। এই কারনে সাধারন মানুষ আর সিপাহীদের মধ্যে একটা দেওয়াল থেকেই গিয়েছিলো।
এই কারনে ব্রিটিশ বিরোধী ক্ষোভ আর অভিযোগের সুর একই থাকা সত্ত্বেও বাংলায় মহাবিদ্রোহ সেভাবে ছড়িয়ে পড়তে পারে নি। কিন্তু তার তাপ উত্তাপ থেকে বাঙালি মনীষা একেবারেই পৃথক বা বিচ্ছিন্নও ছিলো না।